শিক্ষা-প্রশাসন-বেসরকারি কলেজের নিরীক্ষা! by বদরে মুনীর

সরকারি এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় মিনিস্ট্রি অডিট বলে একটা কাজ হয়। এই প্রক্রিয়ায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে সাধারণত একজন পরিদর্শক ও একজন নিরীক্ষক নির্ধারিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো, জনবল-কাঠামো, বছরভিত্তিক আয়-ব্যয়ের হিসাব, নিয়োগ-প্রক্রিয়া ইত্যাদি পরিদর্শন ও নিরীক্ষণ শেষে মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট প্রদান করেন।


এ রকম অডিটের কবলে পড়ে হয়তো ১০-১৫, এমনকি ২০ বছর ধরে শিক্ষকতা করা এবং বেতন-ভাতার সরকারি অংশ ভোগ করে যাওয়া একজন শিক্ষক জানতে পারেন, তাঁর নিয়োগ অবৈধ। অর্থাৎ এই ১০-১৫-২০ বছরে হাজার হাজার ছাত্রের সামনে শিক্ষক হিসেবে দাঁড়িয়ে তাদের পড়ালেখায় সাহায্য করা এবং বিনিময়ে মজুরি পাওয়ার পুরো ব্যাপারটাই একজন শিক্ষকের জীবনে অবৈধ! কারণ কী? কারণ, ওই নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় একটি বিষয়ের জন্য ন্যূনতম নিয়োগপ্রার্থী থাকার নিয়ম তিনজন, ছিলেন দুজন; শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের প্রতিনিধি হিসেবে সাক্ষাৎকার বোর্ডে সরকারি কলেজের একজন অধ্যক্ষের উপস্থিত থাকার বিধি, কিন্তু ছিলেন একজন সহকারী অধ্যাপক; বিষয় বিশেষজ্ঞ হিসেবে একজন সহকারী অধ্যাপক থাকার বিধান, ছিলেন একজন প্রভাষক।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় যেকোনো পেশায় নিয়োগপ্রার্থী একজন ব্যক্তির পক্ষে কি উপরিউক্ত শর্তগুলো জানা সম্ভব, না সেগুলো জানা তাঁর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? একজন নিয়োগপ্রার্থী কি নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে জানতে চাইবেন, নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় কতজন প্রতিযোগী অংশ নিচ্ছেন, নাকি সাক্ষাৎকার বোর্ডে জানতে চাইবেন, মাউশির প্রতিনিধি সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ কি না অথবা বিষয় বিশেষজ্ঞ সহকারী অধ্যাপক কি না? তাহলে নিয়োগ-প্রক্রিয়ার এই অবৈধতার দায় কার? দায় যারই হোক, তা বহন করতে হয় সেই শিক্ষককে, আকৈশোর যার ধারণা ছিল শিক্ষকতা একটা নির্ঝঞ্ঝাট এবং মোটামুটি সম্মানজনক জীবিকা।
এভাবে সকাল নয়টা থেকে রাত নয়টা—তিন দিন অডিট চলার পর নির্ধারিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষক-কর্মচারীর নিয়োগ অবৈধ হয়ে গেলে পরিদর্শক বা নিরীক্ষক সাহেব রসিকতা করে বলেন, মিনিস্ট্রি অডিট হলো কারেন্টের জাল, অনিয়মের কেঁচকি মাছটাও ছাড়া পাবে না। দিন তিনেক পর প্রতিষ্ঠানপ্রধান শিক্ষক-কর্মচারীদের জানান, ঢাকা থেকে ফোন করা হচ্ছে যোগাযোগ করতে। অডিটের কারেন্টের জাল ছিঁড়ে সব অবৈধতাকে বৈধতা দিতে পারে যে বোয়াল মাছ, তার দাম প্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষক-কর্মচারীর দুই মাসের বেতন। সত্য-মিথ্যা বলা মুশকিল। কেননা, মফস্বলের এসব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের বেশির ভাগই (অবশ্যই সবাই নন) তস্কর শ্রেণীর। ইন্সপেক্টর-অডিটর সত্যিই উৎকোচ চাইছেন, না প্রতিষ্ঠানের প্রধানেরা তাঁদের নাম ভাঙিয়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন অথবা যে পরিমাণ ঘুষ দাবি করা হচ্ছে, তার পরিমাণ বাড়িয়ে বলা হচ্ছে কি না, তা যাচাই করার কোনো উপায় এই শিক্ষক-কর্মচারীদের থাকে না। লেনদেন বিষয়ে কথা হয় প্রতিষ্ঠানের প্রধানের সঙ্গে।
এ ব্যাপারে দৃষ্টান্ত টানতে গত অক্টোবরের একটি প্রসঙ্গ তোলা যায়। বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ আট বছর পূর্ণ হওয়ায় বেতন স্কেলের যে উন্নতি ঘটে, তা কয়েক বছর বন্ধ ছিল। সেই টাইম স্কেল পুনরায় চালুর প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় শিক্ষা ভবনে উৎকোচ গ্রহণের প্রস্তুতি বিষয়ে খবর প্রকাশিত হয় পত্রপত্রিকায়।
মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর ত্বরিত হস্তক্ষেপে অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে এবারের টাইম স্কেল পরিবর্তনে শিক্ষা ভবনে টাকা লাগেনি। কেননা এ বিষয়ে গঠিত কমিটির আহ্বায়ক দীপক কুমার নাগ, মহাপরিচালক (প্রশাসন), মাউশি জানাচ্ছেন, ‘কোনো টাকা লাগবে না। কে টাকা নিচ্ছে, আমাকে বলেন। আমরা দিনরাত দরজা বন্ধ করে কাজ করছি। ১৮ (অক্টোবর) তারিখের মধ্যে টাইম স্কেল পৌঁছে যাবে।’ এরপর তো বলা যায় না, শিক্ষা ভবন ঘুষ নিয়েছে। অথচ বেসরকারি কলেজের অনেক অধ্যক্ষই টাকা না নিয়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ঢাকায় পাঠাননি, অথবা কাগজপত্র ঢাকায় নিয়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের ফোন করেছেন, ‘ঘুষ লাগছে, এসএ পরিবহনে টাকা পাঠান।’
এ পর্যন্ত যা লেখা হলো তার প্রতি বর্ণ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় পাওয়া নির্জলা সত্য হলেও এর কোনো দালিলিক প্রমাণ হাজির করা সম্ভব না। কেননা গত শতকের নব্বইয়ের দশকে এবং তার পরে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের মফস্বলের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর, বিশেষ করে বেসরকারি কলেজগুলো প্রতিষ্ঠায় ও পরিচালনায় ব্যাপক-বিস্তৃত অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, আত্মীয়প্রীতি এবং অদক্ষতা ও অযোগ্যতা বিরাজমান। এমন দৃষ্টান্তও হাজির করা যাবে যে মফস্বলের আনাচ-কানাচে যেকোনো চার বর্গকিলোমিটার, অথবা তারও কম এলাকা নিয়ে পাঁচ-ছয়জন যেনতেন এমএ পাস, তাদের মধ্য থেকে শারীরিকভাবে সবচেয়ে বলশালী একজনকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বানিয়ে একটা কলেজ খুলে বসা হয়েছে। এরপর বিষয়ভিত্তিক এমএ, এমএসসি, এমকম পাস স্থানীয়দের কাছ থেকে ‘যার কাছে যেমন পাই’ ভিত্তিতে লাখ লাখ টাকা নিয়ে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ আর নানা রকম প্রলোভন দেখিয়ে ছাত্র ভর্তি শুরু করা হয়। এভাবে চলতে চলতে পাঁচ-সাত বছর চলার পর একেকটা কলেজ মোটামুটি দুই-তিন-চার শ ছাত্রছাত্রী এবং ৪০-৫০-৬০ জন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। সুতরাং জন্মলগ্ন থেকেই অনিয়ম-দুর্নীতি এসব কলেজগুলোর দোসর। মিনিস্ট্রি অডিটের কালে এসব অনিয়ম-দুর্নীতি, অসৎ অধ্যক্ষ ও অসৎ ইন্সপেক্টর অডিটরদের কাছে এক মহা মওকা হয়ে ওঠে। আর এটা তো সবারই জানা যে এ রকম লেনদেনের কোনো প্রমাণ থাকে না।
এমন পরিবেশ-পরিস্থিতিতে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছে মিনিস্ট্রি অডিট আরেকটা বিষফোঁড়া।
শিক্ষামন্ত্রীর অনেক সাহসী, দৃঢ়সংকল্প ও পদক্ষেপের ফলে আমাদের পুরো শিক্ষাব্যবস্থারই মনে হচ্ছে একটা বদল হচ্ছে। আধুনিক ও সম্ভাবনাময় জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন সেই পদক্ষেপগুলোর একটি। এ বিষয়ে কি কিছু ভাবা যায় না, এই মিনিস্ট্রি অডিট নিয়ে?
দেশের জন্য সুখবর যে আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব একজন কবি। ক্ষমতার অন্যায্য দাপটের সামনে টিকতে না পেরে ঘুষ দিলে কেবল তো আর্থিক ক্ষতিই হচ্ছে না, মানুষ হিসেবে ব্যক্তির মর্যাদাও মাটিতে লুটাচ্ছে। এদিকটায় একটু তাকানো মনে হয় দরকার।
বদরে মুনীর: কবি ও শিক্ষক।

No comments

Powered by Blogger.