শ্রদ্ধাঞ্জলি-একজন সৎ মানুষের নিষ্ক্রমণ by নূরন্নবী খান

সাইফুল ইসলাম। আমাদের প্রিয় সাইফুল ভাই। কয়েক দিন আগে পরপারে চলে গেলেন। বলা যায়, প্রায় নীরবে, নিঃশব্দে। আয়ুষ্কাল পেয়েছিলেন প্রায় ৮২ বছর। পরিণত বয়সেই তাঁর নিষ্ক্রমণ। কিন্তু ভক্তজনের কাছে মনে হবে, আরও কিছুদিন থাকলে পৃথিবীরই ভালো হতো, মানবসমাজেরই কল্যাণ হতো।


সাইফুল ভাই রাজনীতি করতেন, বামঘেঁষা রাজনীতি। একেবারে কিশোর বয়স থেকে তাঁর এই পথচলা। ভারত বিভাগের আগে থেকে তিনি মুকুল-আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। সিরাজগঞ্জ তখন মহকুমা শহর। সেখানে ‘মুকুল-মেলা’র বেশ কয়েকটি ইউনিট ছিল। শহরসংলগ্ন গ্রাম রহমতগঞ্জের মুকুল-মেলা ইউনিটের তিনি প্রধান সংগঠক ছিলেন।
সিরাজগঞ্জ কলেজে পড়ার সময় তুখোড় ছাত্রনেতা হিসেবে তাঁকে দেখা যায়। স্থানীয়ভাবে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, কারাবরণ করেছেন। পঞ্চাশের দশকে সিরাজগঞ্জের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সংগঠনের পুরোভাগে ছিলেন তিনি। সক্রিয় রাজনীতিতে তখন থেকেই ঝুঁকে পড়েন। পাকিস্তান যুগে গ্রেপ্তারের পরোয়ানা, হুলিয়া কাঁধে নিয়ে পথপরিক্রম করেছেন। যাঁরা রাজনীতির চর্চা করেন, তাঁদের স্বভাবতই নির্দিষ্ট একটা লক্ষ্য থাকে। সাইফুল ভাই ক্ষমতায় আরোহণের লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতি করেননি। গণমানুষের কল্যাণের কথাই তিনি ভাবতেন। নিষ্ঠার সঙ্গে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করতেন। অমানুষিক পরিশ্রম করতে পারতেন।
জীবন নির্বাহ করেছেন অত্যন্ত সাদামাটাভাবে। সহজ, অনাড়ম্বর, ভণ্ডামি কিংবা কপটতার কলুষ-মালিন্য তাঁকে কখনো স্পর্শ করতে পারেনি। লক্ষণীয়, বহুবিধ বৈরিতার মধ্যেও সুশৃঙ্খল ও সৎ জীবনযাপন করে গেছেন। সাধারণ হয়েও তিনি ছিলেন অসাধারণ।
শৈশবকালে মা-বাবাকে হারান। দূরসম্পর্কের এক ভগ্নিপতি তাঁকে আশ্রয় দেন। পরে নিজের চলার ব্যবস্থা নিজেই করে নেন।
ব্যবসায়ী তালুকদার পরিবারের সন্তান। ভাবতে অবাক লাগে, তাঁর পরিবারের কাছ থেকে বৈষয়িক কিছুই গ্রহণ করেননি তিনি। অন্য অনেকের মতো বৈষয়িক সম্পদ আহরণ কিংবা সঞ্চয় তাঁর কাছে মুখ্য বিবেচনার বিষয় ছিল না। তিনি ছিলেন নিতান্তই নির্লোভ। নির্মোহ দৃষ্টিতে সবকিছু দেখতে পারার দুর্লভ শক্তি ছিল তাঁর।
যেকোনো অবস্থায় সর্বদাই প্রফুল্ল ও প্রাণবন্ত একজন মানুষ। নিরহংকার এই মানুষটি আবালবৃদ্ধবনিতার অকুণ্ঠ ভালোবাসা অর্জন করেছিলেন। বাক্যে ও আচরণে বিনম্র শিষ্টতার পরিচয় দিয়ে গেছেন জীবনভর। রাজনৈতিক দর্শন বা বিশ্বাসে একের সঙ্গে অন্যের ভিন্নতা থাকে এবং এটাই স্বাভাবিক। তিনি বিশ্বাস করতেন, জীবনের বড় সার্থকতা ভোগে নয়, ত্যাগে। জীবনের বেশির ভাগ সময় তাঁকে সংগ্রাম করে এগিয়ে যেতে হয়েছে।
তাঁর বন্ধুভাগ্য ভালো ছিল। প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী বন্ধু তাঁকে পরামর্শ দিয়ে, সক্রিয় সহযোগিতা দিয়ে ব্যবসায়ে মোটামুটি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। এভাবে চলার একটা ব্যবস্থা হয়। সেখানেও তিনি শতভাগ সততার পরিচয় রাখেন। বিত্তসাধনা তিনি করেননি। নির্লোভ, নির্মোহ থেকে কর্তব্য করে গেছেন।
ভাগ্যগুণে সহধর্মিণী পেয়েছিলেন তাঁর মনের মতো—তাঁর আদর্শের অংশীদার, যিনি আত্যন্তিক সহিষ্ণুতা ও ঔদার্য দিয়ে তাঁর সংগ্রামী জীবনকে অর্থবহ ও পরিপূর্ণ করে তুলেছিলেন সব প্রতিকূলতা দূরে ঠেলে দিয়ে।
তাঁর নানা গুণের মধ্যে উল্লেখ করতে হয় সাহিত্যকৃতির কথা। পঞ্চাশের দশকে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল-এর মতো অভিজাত সাহিত্য পত্রিকায় তাঁর তরুণ বয়সে লেখা ছোটগল্প নিয়মিত প্রকাশিত হতো। মানবিকতার মূল্যবোধে আকীর্ণ সেসব রচনা।
বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত তাঁর লেখা পুস্তকগুলোতে পাঠক ভাবনার উপাদান খুঁজে পাবে। তাঁর বিবেচনায় রাজনীতির চর্চা করতে হলে জ্ঞান আহরণ করতে হয়। তার জন্য সাধনা দরকার। প্রচুর পড়াশোনা করতেন। তিনি যে ব্যক্তিগত পাঠাগারটি গড়ে তোলেন, তা বেশ সমৃদ্ধ—দুষ্প্রাপ্য ও মূল্যবান দুর্লভ পুস্তকে ভরপুর।
আমাদের অগ্রজসম সাইফুল ইসলাম ইতিহাসের ছাত্র। ইতিহাস পাঠ করেছেন গভীর অভিনিবেশ আর অনুরাগের সঙ্গে। একসময় অধ্যাপনা করেছেন। শিক্ষক, ভাষাসৈনিক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক—বহুবিধ তাঁর পরিচয়। তিনি ভিন্ন দল করলেও জননেতা মওলানা ভাসানীর সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে। মওলানা সাহেব তাঁকে বিশেষ স্নেহ করতেন। তাঁর বিহনে এ কথাই মনে হবে, আমাদের মধ্য থেকে একজন সৎ ও কৃতী মানুষ চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেলেন।
তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে জানাই গভীর শ্রদ্ধা।
নূরন্নবী খান
সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ বেতার

No comments

Powered by Blogger.