নগরদর্পণ: চট্টগ্রাম-এরই নাম প্রেম? by বিশ্বজিৎ চৌধুরী
পুরোনো দিনের বাংলা ছবি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা একটি দৃশ্যের সঙ্গে খুবই পরিচিত। নায়ক ‘মা’ ‘মা’ বলে ছুটে আসছেন বাড়িতে। দরিদ্র পরিবারের কর্মব্যস্ত মা ছেলের ডাক শুনে রান্নাঘর থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে আসেন। নায়ক বলেন, ‘মা, আমি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছি।’
আনন্দ-বেদনায় আপ্লুত মা ওপর দিকে দুই হাত তুলে শুকরিয়া আদায় করেন সৃষ্টিকর্তার প্রতি। এর পরই ঘরে টাঙানো একটি ফ্রেমে বাঁধানো ছবির কাছে গিয়ে মায়ের অশ্রুপাত, ‘আজ যদি তোর বাবা বেঁচে থাকত,...ওগো দেখে যাও...’ ইত্যাদি। বড় ক্লিশে মনে হতো দৃশ্যটি। নায়ক মানেই ফার্স্ব ক্লাস ফার্স্ট। তাঁর সঙ্গে প্রায়ই প্রেমে জড়িয়ে পড়তেন বড়লোকের গুণমুগ্ধ মেয়েটি।
কিন্তু সেই দৃশ্য এখন পাল্টে গেছে। সম্ভবত আশির দশক থেকেই এই চোখে পড়ার মতো পরিবর্তনটির সূচনা। এর আগে অবশ্য রংবাজ ছবির মাতাল নায়কের সূত্রে পরিবর্তনের ইশারা-ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু নায়কের পুরোপুরি পরিবর্তিত রূপটি পাওয়া গেছে আশি-নব্বইয়ের দশকে। এখন দেখতে পাই নায়িকা আক্রান্ত হয়েছেন ভিলেন বা তার দলবলের হাতে, চিৎকার করছেন, ‘বাঁচাও, বাঁচাও...ছেড়ে দে শয়তান...’ বলে। সেখানে প্রায় মাটি ফুঁড়ে ত্রাতা হিসেবে নায়কের আবির্ভাব। প্রায় একাই ভিলেন বাহিনীকে পরাজিত করে যখন বীরদর্পে ফিরে যেতে উদ্যত, তখনই নায়িকার মধুর আহ্বান, ‘শুনুন’। সেখানে প্রেমকাহিনির শুরু। অর্থাৎ বাহুবলের প্রতি সমীহ বা মুগ্ধতাই অনুবাদ হলো প্রেমে, পরোক্ষভাবে প্রতিনায়কের (অ্যান্টিহিরো) প্রতিই আকর্ষণ বোধ করল নায়িকা।
আমরা যেগুলোকে ফর্মুলা ছবি বলি, তাতে একসময় ফার্স্ব ক্লাস ফার্স্ট, কবি বা শিল্পী এঁরাই হতেন নায়ক। এখন তাঁরা বড়জোর কৌতুকাভিনেতার (কমেডিয়ান) চরিত্র পেতে পারেন, ভাঁড়ামি করে মনোরঞ্জনের বেশি দায়িত্ব তাঁদের দেওয়া হয় না। আমাদের দর্শকেরা তো বাংলা ও হিন্দি ছবিই (স্যাটেলাইট চ্যানেলের সূত্রে) দেখেন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, এ দুই ধরনের ছবিতেই (ব্যতিক্রম কখনো নিয়ম নয়) এখন প্রতিনায়কের জয়জয়কার।
সমাজের পরিবর্তনের লক্ষণগুলোই কি এ ধরনের ছবি নির্মাণের প্রেরণা, নাকি এ ধরনের ছবিই পাল্টে দিচ্ছে তরুণদের মনমানসিকতা—এ নিয়ে গবেষণা চলতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা এই, সমাজ ও বিনোদনমাধ্যম উভয় ক্ষেত্রেই ঘটে গেছে বিশাল এই পরিবর্তন।
ইভ টিজিং, বখাটের দৌরাত্ম্য—এ নিয়ে এখন সমাজ উদ্বিগ্ন। এ নিয়ে আইনের আওতা ও ক্ষমতা বাড়ানোর দাবি উঠছে সচেতন মহলের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে। কিন্তু হাতেগোনা কয়েকটি বাংলা ছবিতে দেখা যাবে, যেখানে তথাকথিত নায়ক উত্ত্যক্ত করছে না নায়িকাকে। উত্ত্যক্ত হতে হতে একসময় নায়িকা অনুরক্ত হচ্ছে নায়কের প্রতি—এ রকম উদাহরণ তো প্রচুর। তাহলে স্কুল-কলেজগামী ছাত্রীদের পেছনে লাগে যে বখাটেরা, তারা উৎসাহিত হবে না কেন?
এ লেখা যখন লিখছি, তখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে কাতরাচ্ছে ১৫ বছর বয়সী এক কিশোরী। তার অপরাধের নাম প্রেম! কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলা থেকে পোশাকশ্রমিকের চাকরি নিয়ে চট্টগ্রাম এসেছিল মেয়েটি। দেওয়ানহাটের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করত, থাকত লালখান বাজারে বড় বোনের বাসায়। একই এলাকার স্বপন নামের এক ছেলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তার। ৩ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ওই কিশোরী দেওয়ানহাটে বান্ধবীর বাসায় যাবে বলে বেরিয়ে দেখা করে স্বপনের সঙ্গে। স্বপনের প্রস্তাবে রাজি হয়ে বেড়াতে যায় মতিঝরনা পাহাড়ে। প্রেমিকের প্রস্তাবে রাজি হয়ে ভরসন্ধ্যায় নির্জন পাহাড়ে যাওয়ার সময় কল্পনায়ও আসেনি কী ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছিল তার জন্য। পাহাড়ে নির্জনতার সুযোগে স্বপন ও তার বন্ধুরা মিলে ধর্ষণ করে মেয়েটিকে। সুমন, কামাল, বাবু ও রুবেল নামে স্বপনের এই বন্ধুদের আগে থেকেই চিনত মেয়েটি। তারা যে হঠাৎ পূর্বপরিচয়ের সামান্য মনুষ্যত্বও ঝেড়ে ফেলবে, কী করে বুঝবে অল্প বয়সী মেয়েটি? ধর্ষণের পর সংজ্ঞাহীন মেয়েটিকে পাহাড় থেকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল স্বপন ও তার বন্ধুরা। মৃত্যু ছিল অবধারিত। কিন্তু সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছে মেয়েটি। পাহাড় থেকে গড়িয়ে ঢালের একটি বাসার টিনের চালের ওপর পড়েছিল। স্থানীয় বাসিন্দারা দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে জীবন রক্ষা করে তার।
ঘটনার অন্য একটি ভাষ্যও পাওয়া গেছে। বলা হচ্ছে, মেয়েটির বিয়ে ঠিক হয়েছিল গ্রামের বাড়িতে। সে খবর শুনে মতিঝরনার কাছে তার গতিরোধ করে স্বপন। তারপর পাহাড়ে নিয়ে গিয়ে প্রতিশোধ চরিতার্থ করেছে সে।
আমরা যুগে যুগে দেখেছি, প্রেমিকার সম্ভ্রম বাঁচাতে জীবন তুচ্ছ করেছে পুরুষ। অথচ এখানে আরও তিন-চারজন দুর্বৃত্তকে ডেকে এনে নিজের চোখের সামনে প্রেমিকার সম্ভ্রমহানি উপভোগ করছে যে তরুণটি, তার মনস্তত্ত্বের কী বিশ্লেষণ দেবেন মনোবিজ্ঞানীরা জানি না, কিন্তু সভ্য সমাজে যে তার স্থান হওয়ার কথা নয়, এ তো নিশ্চিত।
পোশাকশ্রমিক মেয়েটি ছিল দরিদ্র পরিবারের সন্তান। মনে হতে পারে, বোনের বাড়িতে আশ্রিত মেয়েটির পক্ষে আইনকানুনের আশ্রয় নেওয়ার সামর্থ্য কম ভেবেই এ রকম একটি ঘটনা ঘটানোর দুঃসাহস করেছে স্বপন ও তার সহযোগীরা। কিন্তু গত অক্টোবরে মিধাত সারিমা রহমান নামের যে তরুণী খুন হলেন তাঁরই এক বন্ধুর হাতে, তাঁর ক্ষেত্রে কী সিদ্ধান্ত নেব আমরা? মিধাত অবস্থাপন্ন পরিবারের মেয়ে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতেন। তাঁর খুনি তোহাও সচ্ছল পরিবারের বখে যাওয়া সন্তান। প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর আত্মহত্যা করবে বলে হুমকি দিয়ে মিধাতকে এক বন্ধুর বাসায় ডেকে এনেছিল তোহা। সেখানেও বোঝানোর চেষ্টা করেছিল তার প্রস্তাবে রাজি হওয়ার জন্য। কিন্তু কিছুতেই তাঁকে রাজি করাতে না পেরে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেছিল মিধাতকে। ভাবুন, প্রেমের প্রস্তাব দেওয়ার জন্য বন্ধুকে ডেকে আনার আগেই পশু জবাইয়ের ছুরি সংগ্রহে রেখেছিল বন্ধু! হয় রাজি হও, নয় মৃত্যুবরণ করো। এ কেমন প্রেম! আগেই বলেছি, কবি-শিল্পী বা ক্লাসের ভালো ছাত্রটি এখন সিনেমার ভাঁড় চরিত্রে প্রতিষ্ঠিত। অথচ প্রেমে ব্যর্থ জন কিটসের কবিতা বা ভ্যান গঘের ছবি মর্যাদা পেয়েছে শিল্প-সাহিত্যের চিরকালীন সম্পদ হিসেবে। প্রেমে ব্যর্থ কিন্তু জীবনে সফল মানুষের সংখ্যা আমাদের দেশেও তো কম নয়। আমাদের মেধাবী তরুণেরা সেই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেবেন না? নাকি খুন, এসিড-সন্ত্রাসের মতো প্রতিহিংসার পথটিকেই একমাত্র গন্তব্য বলে বিবেচনা করবেন? অথবা মাদকাসক্তির মতো আত্মবিধ্বংসী পথ?
প্রযুক্তির যুগে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার নতুন নতুন পথ উদ্ভাবন হচ্ছে। মেধার অপব্যবহার দেখছি এসব উদ্ভাবনের ক্ষেত্রেও। প্রেমে ব্যর্থ বা প্রতারিত হয়ে প্রেমিকার সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে মুঠোফোনে তোলা ছবি ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ইন্টারনেটে। নিজের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটির শতবার সম্ভ্রমহানি ঘটছে শত কুৎসিত দৃষ্টির সামনে। এ কেমন প্রেম!
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, পুরুষ তার দৈহিক ও সামাজিক শক্তির জোরেই নারীর ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার কথা ভাবতে পারে। পুরুষের কাছে প্রেমে প্রতারিত নারী সহিংস প্রতিশোধ নিয়েছে, এমন ঘটনা দুর্লভ। এখানেই আইনের আওতা ও প্রয়োগের কথাটি বারবার আসছে। এ দেশে আইনে নারী ও পুরুষের অধিকার কি সমান? এক শব্দে এর উত্তর দেওয়া যায়—না। একটি পরিণত ও সভ্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হলে আইনে নারীর অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সচেতনতা সৃষ্টির কাজটিও এগিয়ে না গেলে আমাদের তরুণেরা হয়তো প্রেম ও প্রতিযোগিতার তফাৎটি শনাক্ত করতে পারবে না। তাদের জানাতে হবে, প্রকৃত প্রেম, তা সফল হোক বা ব্যর্থই হোক, অপরাজেয়।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com
কিন্তু সেই দৃশ্য এখন পাল্টে গেছে। সম্ভবত আশির দশক থেকেই এই চোখে পড়ার মতো পরিবর্তনটির সূচনা। এর আগে অবশ্য রংবাজ ছবির মাতাল নায়কের সূত্রে পরিবর্তনের ইশারা-ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু নায়কের পুরোপুরি পরিবর্তিত রূপটি পাওয়া গেছে আশি-নব্বইয়ের দশকে। এখন দেখতে পাই নায়িকা আক্রান্ত হয়েছেন ভিলেন বা তার দলবলের হাতে, চিৎকার করছেন, ‘বাঁচাও, বাঁচাও...ছেড়ে দে শয়তান...’ বলে। সেখানে প্রায় মাটি ফুঁড়ে ত্রাতা হিসেবে নায়কের আবির্ভাব। প্রায় একাই ভিলেন বাহিনীকে পরাজিত করে যখন বীরদর্পে ফিরে যেতে উদ্যত, তখনই নায়িকার মধুর আহ্বান, ‘শুনুন’। সেখানে প্রেমকাহিনির শুরু। অর্থাৎ বাহুবলের প্রতি সমীহ বা মুগ্ধতাই অনুবাদ হলো প্রেমে, পরোক্ষভাবে প্রতিনায়কের (অ্যান্টিহিরো) প্রতিই আকর্ষণ বোধ করল নায়িকা।
আমরা যেগুলোকে ফর্মুলা ছবি বলি, তাতে একসময় ফার্স্ব ক্লাস ফার্স্ট, কবি বা শিল্পী এঁরাই হতেন নায়ক। এখন তাঁরা বড়জোর কৌতুকাভিনেতার (কমেডিয়ান) চরিত্র পেতে পারেন, ভাঁড়ামি করে মনোরঞ্জনের বেশি দায়িত্ব তাঁদের দেওয়া হয় না। আমাদের দর্শকেরা তো বাংলা ও হিন্দি ছবিই (স্যাটেলাইট চ্যানেলের সূত্রে) দেখেন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, এ দুই ধরনের ছবিতেই (ব্যতিক্রম কখনো নিয়ম নয়) এখন প্রতিনায়কের জয়জয়কার।
সমাজের পরিবর্তনের লক্ষণগুলোই কি এ ধরনের ছবি নির্মাণের প্রেরণা, নাকি এ ধরনের ছবিই পাল্টে দিচ্ছে তরুণদের মনমানসিকতা—এ নিয়ে গবেষণা চলতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা এই, সমাজ ও বিনোদনমাধ্যম উভয় ক্ষেত্রেই ঘটে গেছে বিশাল এই পরিবর্তন।
ইভ টিজিং, বখাটের দৌরাত্ম্য—এ নিয়ে এখন সমাজ উদ্বিগ্ন। এ নিয়ে আইনের আওতা ও ক্ষমতা বাড়ানোর দাবি উঠছে সচেতন মহলের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে। কিন্তু হাতেগোনা কয়েকটি বাংলা ছবিতে দেখা যাবে, যেখানে তথাকথিত নায়ক উত্ত্যক্ত করছে না নায়িকাকে। উত্ত্যক্ত হতে হতে একসময় নায়িকা অনুরক্ত হচ্ছে নায়কের প্রতি—এ রকম উদাহরণ তো প্রচুর। তাহলে স্কুল-কলেজগামী ছাত্রীদের পেছনে লাগে যে বখাটেরা, তারা উৎসাহিত হবে না কেন?
এ লেখা যখন লিখছি, তখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে কাতরাচ্ছে ১৫ বছর বয়সী এক কিশোরী। তার অপরাধের নাম প্রেম! কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলা থেকে পোশাকশ্রমিকের চাকরি নিয়ে চট্টগ্রাম এসেছিল মেয়েটি। দেওয়ানহাটের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করত, থাকত লালখান বাজারে বড় বোনের বাসায়। একই এলাকার স্বপন নামের এক ছেলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তার। ৩ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ওই কিশোরী দেওয়ানহাটে বান্ধবীর বাসায় যাবে বলে বেরিয়ে দেখা করে স্বপনের সঙ্গে। স্বপনের প্রস্তাবে রাজি হয়ে বেড়াতে যায় মতিঝরনা পাহাড়ে। প্রেমিকের প্রস্তাবে রাজি হয়ে ভরসন্ধ্যায় নির্জন পাহাড়ে যাওয়ার সময় কল্পনায়ও আসেনি কী ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছিল তার জন্য। পাহাড়ে নির্জনতার সুযোগে স্বপন ও তার বন্ধুরা মিলে ধর্ষণ করে মেয়েটিকে। সুমন, কামাল, বাবু ও রুবেল নামে স্বপনের এই বন্ধুদের আগে থেকেই চিনত মেয়েটি। তারা যে হঠাৎ পূর্বপরিচয়ের সামান্য মনুষ্যত্বও ঝেড়ে ফেলবে, কী করে বুঝবে অল্প বয়সী মেয়েটি? ধর্ষণের পর সংজ্ঞাহীন মেয়েটিকে পাহাড় থেকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল স্বপন ও তার বন্ধুরা। মৃত্যু ছিল অবধারিত। কিন্তু সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছে মেয়েটি। পাহাড় থেকে গড়িয়ে ঢালের একটি বাসার টিনের চালের ওপর পড়েছিল। স্থানীয় বাসিন্দারা দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে জীবন রক্ষা করে তার।
ঘটনার অন্য একটি ভাষ্যও পাওয়া গেছে। বলা হচ্ছে, মেয়েটির বিয়ে ঠিক হয়েছিল গ্রামের বাড়িতে। সে খবর শুনে মতিঝরনার কাছে তার গতিরোধ করে স্বপন। তারপর পাহাড়ে নিয়ে গিয়ে প্রতিশোধ চরিতার্থ করেছে সে।
আমরা যুগে যুগে দেখেছি, প্রেমিকার সম্ভ্রম বাঁচাতে জীবন তুচ্ছ করেছে পুরুষ। অথচ এখানে আরও তিন-চারজন দুর্বৃত্তকে ডেকে এনে নিজের চোখের সামনে প্রেমিকার সম্ভ্রমহানি উপভোগ করছে যে তরুণটি, তার মনস্তত্ত্বের কী বিশ্লেষণ দেবেন মনোবিজ্ঞানীরা জানি না, কিন্তু সভ্য সমাজে যে তার স্থান হওয়ার কথা নয়, এ তো নিশ্চিত।
পোশাকশ্রমিক মেয়েটি ছিল দরিদ্র পরিবারের সন্তান। মনে হতে পারে, বোনের বাড়িতে আশ্রিত মেয়েটির পক্ষে আইনকানুনের আশ্রয় নেওয়ার সামর্থ্য কম ভেবেই এ রকম একটি ঘটনা ঘটানোর দুঃসাহস করেছে স্বপন ও তার সহযোগীরা। কিন্তু গত অক্টোবরে মিধাত সারিমা রহমান নামের যে তরুণী খুন হলেন তাঁরই এক বন্ধুর হাতে, তাঁর ক্ষেত্রে কী সিদ্ধান্ত নেব আমরা? মিধাত অবস্থাপন্ন পরিবারের মেয়ে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতেন। তাঁর খুনি তোহাও সচ্ছল পরিবারের বখে যাওয়া সন্তান। প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর আত্মহত্যা করবে বলে হুমকি দিয়ে মিধাতকে এক বন্ধুর বাসায় ডেকে এনেছিল তোহা। সেখানেও বোঝানোর চেষ্টা করেছিল তার প্রস্তাবে রাজি হওয়ার জন্য। কিন্তু কিছুতেই তাঁকে রাজি করাতে না পেরে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেছিল মিধাতকে। ভাবুন, প্রেমের প্রস্তাব দেওয়ার জন্য বন্ধুকে ডেকে আনার আগেই পশু জবাইয়ের ছুরি সংগ্রহে রেখেছিল বন্ধু! হয় রাজি হও, নয় মৃত্যুবরণ করো। এ কেমন প্রেম! আগেই বলেছি, কবি-শিল্পী বা ক্লাসের ভালো ছাত্রটি এখন সিনেমার ভাঁড় চরিত্রে প্রতিষ্ঠিত। অথচ প্রেমে ব্যর্থ জন কিটসের কবিতা বা ভ্যান গঘের ছবি মর্যাদা পেয়েছে শিল্প-সাহিত্যের চিরকালীন সম্পদ হিসেবে। প্রেমে ব্যর্থ কিন্তু জীবনে সফল মানুষের সংখ্যা আমাদের দেশেও তো কম নয়। আমাদের মেধাবী তরুণেরা সেই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেবেন না? নাকি খুন, এসিড-সন্ত্রাসের মতো প্রতিহিংসার পথটিকেই একমাত্র গন্তব্য বলে বিবেচনা করবেন? অথবা মাদকাসক্তির মতো আত্মবিধ্বংসী পথ?
প্রযুক্তির যুগে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার নতুন নতুন পথ উদ্ভাবন হচ্ছে। মেধার অপব্যবহার দেখছি এসব উদ্ভাবনের ক্ষেত্রেও। প্রেমে ব্যর্থ বা প্রতারিত হয়ে প্রেমিকার সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে মুঠোফোনে তোলা ছবি ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ইন্টারনেটে। নিজের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটির শতবার সম্ভ্রমহানি ঘটছে শত কুৎসিত দৃষ্টির সামনে। এ কেমন প্রেম!
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, পুরুষ তার দৈহিক ও সামাজিক শক্তির জোরেই নারীর ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার কথা ভাবতে পারে। পুরুষের কাছে প্রেমে প্রতারিত নারী সহিংস প্রতিশোধ নিয়েছে, এমন ঘটনা দুর্লভ। এখানেই আইনের আওতা ও প্রয়োগের কথাটি বারবার আসছে। এ দেশে আইনে নারী ও পুরুষের অধিকার কি সমান? এক শব্দে এর উত্তর দেওয়া যায়—না। একটি পরিণত ও সভ্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হলে আইনে নারীর অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সচেতনতা সৃষ্টির কাজটিও এগিয়ে না গেলে আমাদের তরুণেরা হয়তো প্রেম ও প্রতিযোগিতার তফাৎটি শনাক্ত করতে পারবে না। তাদের জানাতে হবে, প্রকৃত প্রেম, তা সফল হোক বা ব্যর্থই হোক, অপরাজেয়।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com
No comments