ভালোবাসা সীমিতকরণ অপরাধের শাস্তি by ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার
১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী পালিত হয় ভালোবাসা দিবস। জনশ্রুতি অনুযায়ী যাজক ভ্যালেনটাইন ২৭০ খ্রিস্টাব্দে ভালোবাসার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে রোম সম্রাট কর্তৃক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ার পর থেকে পাশ্চাত্যে এ দিবসটিকে ভালোবাসা দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে।
প্রায় একযুগ হলো এ দিবসটি পালন করা শুরু হয়েছে এ উপমহাদেশে। বাংলাদেশে যে ভঙ্গিমায় এ দিবস পালিত হচ্ছে তাতে অনেকের মনে হতে পারে, এ দেশে এ দিবস পালনকারীরা ভালোবাসার মতো একটি মূল্যবান, মহান, বহুধাবিস্তৃত ও দিগন্ত প্রসারিত সম্পদকে একটি বিশেষ এলাকায় সীমিত করে এক ধরনের অপরাধ করছেন। এ প্রবন্ধে আমরা বিশ্লেষণ করে দেখাতে চেষ্টা করব বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবস পালনের নামে যারা এ অপরাধ করছেন তাদের সে অপরাধের কী ধরনের শাস্তি হওয়া উচিত।
স্মর্তব্য, প্রথম প্রথম এ উপমহাদেশে ভালোবাসা দিবস পালন শুরু হলে সংস্কৃতিকর্মীদের অনেকেই এর বিরোধিতা করেন। পরবর্তী সময়ে ২০০৩ সালে ভারতের মুম্বাই ও দিল্লিতে শিবসেনার হুমকিতে দোকানিরা ভ্যালেনটাইন কার্ড বিক্রি করতে পারেননি। ওই বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেনটাইন কার্ড বিক্রি করার কারণে শিবসেনার জঙ্গিরা নয়া দিল্লির দুটি দোকান ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। এরা এ দিবস পালনকে খ্রিস্টান সংস্কৃতির অংশ বলে প্রচার করে দেশবাসীকে এ দিবস পালন না করার জন্য আহ্বান জানায়। ২০০২ সালে ঢাকায় সংস্কৃতি ফোরাম ‘অকৃত্রিম ভালোবাসার জন্য আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন নেই’ থিম সংবলিত পোস্টার প্রকাশ করে। ওই বছর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব সাহেব ‘মুসলমানদের অনুষ্ঠান নয়’ হিসেবে ব্যাখ্যা দিয়ে সমালোচনা করে এ দিবস পালন থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করার জন্য আল্লাহর কাছে মোনাজাত করেন। বাংলাদেশে প্রথমে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা এ দিবসটি পালন শুরু করলেও ক্রমান্বয়ে অন্যান্য পত্রিকা এবং ইলেট্রনিক মিডিয়ায়ও এ দিবস উত্যাপন শুরু হয় এবং এখন রাজধানীসহ দেশের বিভাগীয় ও অনেক জেলা শহরগুলোতেও যুবসমাজ কর্তৃক এ দিবস পালিত হতে দেখা যায়।
ভালোবাসা এক মহামূল্যবান সম্পদ। ভালোবাসার শক্তি সৃষ্টিকুলকে সজীব ও প্রাণবন্ত করে রাখে। ভালোবাসা না থাকলে এ বিশ্ব হতো মরুভূমির মতো, মানুষগুলো হতো রবোটের মতো। ভালোবাসা আছে বলেই বিশ্বব্যাপী পরিবার, সংসার ও সমাজ টিকে আছে। ভালোবাসার বন্ধন ও উষ্ণতাই সমাজের বন্ধন, সহমর্মিতা ও মমত্ব জিইয়ে রেখেছে। ভালোবাসা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের যাবতীয় ক্লান্তি ও শ্রান্তি দূর করতে সঞ্জীবনী টনিকের মতো কাজ করে। ভালোবাসার উপস্থিতি ও প্রবাহ বিশ্ব মানচিত্রের প্রতিটি প্রান্তে একই ধারায় বহমান। সে কারণে অর্থনেতিক উন্নয়নের মানদণ্ডে আমরা যেমন কোনো দেশকে উন্নত, উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত হিসিবে ভাগ করে দেখাই, ভালোবাসার উপস্থিতি বা সক্রিয়তার মানদণ্ডের বিচারে আমরা বিশ্বের দেশগুলোকে কিন্তু তেমনভাবে ভালোবাসাসমৃদ্ধ বা ভালোবাসা-দরিদ্র হিসেবে ভাগ করে দেখাতে পারি না। ভালোবাসা এমনই এক নিয়ামত যা পৃথিবীর সব অঞ্চলের সব মানুষের মধ্যে একই ধারায় প্রবাহিত। সাদা-কালো, ধনী-দরিদ্র, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এ সম্পদে বিশ্বের সব দেশের সব সমাজের সব মানুষই সমৃদ্ধ।
ভালোবাসা এক সহজাত সম্পদ যা সৃষ্টিকুলের মধ্যে আপনা আপনি জন্ম নেয়। এ সহজাত সম্পদ অর্জনের জন্য কোনো পরিশ্রম করা লাগে না। এ সম্পদ অর্জনের জন্য কোনো আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া বা ব্যবসা-বাণিজ্য করা লাগে না। নাচ-গান বা লেখাপড়া শেখার মতো ভালোবাসা শেখার জন্য কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। ভালোবাসার কিংবদন্তি আইকন ইউসুফ-জুলেখা, লাইলী-মজনু, রোমিও-জুলিয়েট বা শিরি-ফরহাদ ভালোবাসা শেখার জন্য যেমন কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাননি, তেমনি ভালোবাসায় উষ্ণ হতে অংশগ্রহণ করেননি কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে। কাজেই আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে ভালোবাসায় তীব্রতা সৃষ্টি করা যায় এমনটি বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। এ দেশে যখন ভালোবাসা দিবস উদযাপিত হতো না, তখন কী মানুষের মধ্যে ভালোবাসা কম ছিল? অথবা, এ দেশে এখন যারা ভালোবাসা দিবস উদযাপন করেন না, তারা কী ভালোবাসতে জানেন না? যারা হাজার বছর ধরে ভালোবাসা দিবস উদযাপন করে আসছেন তাদের চেয়ে কী আমাদের ভালোবাসার ঐতিহ্য কম? না, তেমনটি মনে হয় না। মনে রাখা প্রয়োজন, মাতৃভাষার ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এ দেশের ছাত্র-যুবকরা প্রাণ দিতে কার্পণ্য করেননি; দেশমাতাকে ভালোবেসে দেশের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য এ দেশে লাখো মানুষ প্রাণ দিয়েছেন। একজন রিকশাওয়ালা তার ঘামঝরা উপার্জন থেকে নিজে না খেয়ে এক টাকা দুই টাকা করে জমিয়ে একটি শাড়ি কিনে যখন ট্রেনের ছাদে চড়ে ঈদের আগে গ্রামে মায়ের কাছে ছুটে যান তখন তার ওই ভালোবাসা কোনো ভালোবাসার চেয়েই কম উষ্ণ নয়। মা অসুস্থ, মায়ের ভালোবাসার আহ্বানে বর্ষার নদী সাঁতরে মাকে দেখতে ছুটে গিয়েছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। যারা হাজার বছর ধরে অনুষ্ঠান করে ভালোবাসা দিবস উদযাপন করছেন তাদের ভালোবাসা চর্চায় এমন গর্ব করার মতো ভালোবাসার উদাহরণ খুব বেশি আছে কী? কোনো ব্রিটিশ বা আমেরিকান যুবক অসুস্থ মাকে দেখার জন্য টেমস বা মিসিসিপি নদীতে ঝাঁপ দিয়েছেন বলে আমাদের জানা নেই। এসব উদাহরণের মধ্য দিয়ে একথা বলা যাবে না যে, যারা হাজার বছর ধরে ভালোবাসা দিবস উদযাপন করছেন তাদের মধ্যে ভালোবাসা নেই, বা ভালোবাসার কমতি আছে। অবশ্যই তাদের মধ্যেও আমাদের মতোই ভালেবাাসার সক্রিয়তা রয়েছে। তবে এ বিশ্বাস করা যায়, অনুষ্ঠান করে তারা আমাদের চেয়ে অধিকতর ভালোবাসা-সমৃদ্ধ হতে পারেনি।
ভালোবাসা সম্পর্কিত আলোচনায় ভালোবাসার বহুমাত্রিকতাকে ভুলে যাওয়া উচিত নয়। মনে রাখতে হবে, প্রতিটি পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কই ভালোবাসানির্ভর। স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর, বাবার সঙ্গে ছেলের, মার সঙ্গে সন্তানের, নেতার সঙ্গে কর্মীর, মালিকের সঙ্গে শ্রমিকের, প্রেমিকের সঙ্গে প্রেমিকার, শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীর, পীরের সঙ্গে মুরিদের, আদর্শের সঙ্গে বিপ্লবীর, ধর্মের সঙ্গে ধার্মিকের, ফুল বাগানের সঙ্গে মালির, শিল্পের সঙ্গে শিল্পীর, এসব সম্পর্কই ভালোবাসানির্ভর। ভালোবাসার শক্তিই এসব সম্পর্ককে সজীব, প্রাণবন্ত, সৃষ্টিশীল ও উন্নয়নমুখী করে রাখে। ভালোবাসার অনুপস্থিতি এসব সম্পর্কে ফাটল ধরিয়ে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য তৈরি করে। সেজন্য যারা ভালোবাসার উত্কর্ষতা ও শক্তিবৃদ্ধি ঘটাতে চান তাদের উচিত ভালোবাসার সক্রিয়তা আছে এমন প্রতিটি অঙ্গনে ভালোবাসার চর্চায় উষ্ণতা ও গতিশীলতা সৃষ্টি করা।
পরিতাপের বিষয়, বাংলাদেশে যারা ভালোবাসা দিবস পালন করছেন তাদের কর্মকাণ্ডের মধ্যে সব এলাকায় ভালোবাসার শক্তিবৃদ্ধির কোনো পরিকল্পনা পরিলক্ষিত হয় না। কারণ, এরা এদের ভালোবাসা দিবসের আনুষ্ঠানিকতা যুবক-যুবতীদের মধ্যে পুষ্প বিনিময় এবং ভালোবাসার স্মৃতি জাগানিয়া গালগল্পের মধ্যেই সীমিত রাখছেন। আমাদের দেশের যুবক-যুবতীর মধ্যে ভালোবাসার কোনো ঘাটতি না থাকা সত্ত্বেও পূর্বে উল্লিখিত অন্যসব এলাকায় ভালোবাসার চর্চা ও শক্তি বৃদ্ধির পরিকল্পনা গ্রহণ না করে শুধু তরুণ-তরুণী ও যুবক-যুবতীদের মধ্যে জাগ্রত ভালোবাসায় তীব্রতা সৃষ্টির চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এর ফলে ভালোবাসা দিবস পালনের আয়োজকরা জেনে বা না বুঝেই এক ধরনের অপরাধ করে ফেলছেন। এ অপরাধ হচ্ছে ভালোবাসার মতো একটি সম্ভাবনাময় শক্তিকে সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগের পরিবর্তে সমাজের যে অংশে ভালোবাসা সবচেয়ে বেশি সক্রিয় সে অংশেই এর চর্চাকে অধিক উত্সাহিত করে মহান ও সর্বত্র-সক্রিয় ভালোবাসাকে সীমিত করে ফেলার অপরাধ। এর ফলে যেসব এলাকায় ভালোবাসার চর্চা তুলনামূলক কম, সেসব এলাকার নাগরিকরা ভালোবাসার শক্তিজাত মুনাফা লাভে বঞ্চিত হচ্ছেন। সম্মানিত পাঠক, আসুন দু’একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি আরও একটু খোলামেলাভাবে আলোচনা করি।
আমাদের দেশকে অর্থনৈতিকভাবে টিকিয়ে রেখেছে শ্রমিকের শ্রম। আর এ শ্রমিকের সঙ্গে মালিকের যে সম্পর্ক সেখানে যদি আলোচ্য দিবস পালনের মাধ্যমে ভালোবাসার উষ্ণতা বৃদ্ধি করা যেত তাহলে কতই না ভালো হতো। গার্মেন্ট সেক্টরে লাখো তরুণী সারাদিন ফার্মের মুরগির মতো আটকাবস্থায় থেকে ঘামঝরা শ্রম দিয়ে সন্ধ্যায় যখন বাসার উদ্দেশে রাস্তায় হাঁটেন তখন তাদের মলিন মুখের দিকে তাকালে যে কোনো উন্নয়নপ্রত্যাশী ও দেশপ্রেমিক নাগরিকের হৃদয়ে এসব কম মজুরি পাওয়া আধপেটে খাওয়া শ্রমিকের প্রতি ভালোবাসা না জেগে পারে না। অথচ, গার্মেন্ট মালিকেরা যেভাবে মুনাফা করছেন সেভাবে কী এসব শ্রমিকের পারিশ্রমিক দেয়া হচ্ছে? আমাদের ভালোবাসা দিবস অনুষ্ঠানের সম্মানিত আয়োজকরা কয়েকজন গার্মেন্ট মালিক ও শ্রমিককে তাদের অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিয়ে অংশগ্রহণ করান না কেন? যদি তারা এরকম কোনো কাজ করাতে পারতেন, যদি গার্মেন্ট মালিকদের দিয়ে তাদের শ্রমিকদের প্রতি তাদের ভালোবাসার হাত একটুখানি প্রসারিত করিয়ে ভালোবাসা দিবসের অনুষ্ঠানে সামান্য হলেও মজুরি বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়াতে পারতেন তাহলে ভালোবাসা দিবসের শক্তি অনেক বৃদ্ধি পেত, ভালোবাসা দিবসের অনু্ঠানগুলো হয়ে উঠত আরও অনেক প্রশংসিত, গ্রহণযোগ্য, জীবনঘনিষ্ঠ, আকর্ষণীয় ও বর্ণময়।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভালোবাসাকে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা কই? পরস্পরকে ভালোবাসা তো দূরের কথা এক নেতার সঙ্গে আর এক নেতার যেখানে মুখ দেখাদেখি বন্ধ সেখানে ভালোবাসা দিবসের অনুষ্ঠান আয়োজকরা কেন এ রকম জাতীয় নেতাদের আলোচ্য দিবসের অনুষ্ঠানে এনে পরস্পরকে পুষ্প বিনিময়ের মাধ্যমে আলিঙ্গনে উদ্বুদ্ধ করান না? টিএসসির ভালোবাসা দিবসের অনুষ্ঠানের আয়োজকরা পরস্পরবিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদের পরস্পরকে দিয়ে মাল্যভূষিত করানোর উদ্যোগ নিয়ে এরকম কাজগুলো গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার করাতে পারলে সারা দেশে স্থানীয় পর্যায়ে পরস্পরবিরোধী প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের মধ্যে পারস্পরিক সহমর্মিতা তৈরি হতো, হ্রাস পেত। হিংসা, ঘৃণা ও পরস্পরকে সুযোগ পেলে দেখে নেয়ার মনোভাব। যারা ভালোবাসা দিবস অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে ভালোবাসাকে ছড়িয়ে দিতে চান, তারা যদি পাশ্চাত্যের ধনী দেশগুলোর ভালোবাসা দিবস অনুষ্ঠানের আদলে এ দিবস পালন না করে জাতীয় ও আঞ্চলিক প্রয়োজন ও সমস্যার প্রসঙ্গটি মাথায় রেখে আলোচ্য দিবসের কর্মসূচি নির্মাণ করতেন এবং তার মধ্য দিয়ে ওইসব সমস্যা সমাধানের জন্য ভালোবাসার শক্তিকে কাজে লাগানোর উদ্যোগ গ্রহণ করতেন তাহলে তা দেশের জন্য ভালো হতো। কিন্তু আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, এ ধরনের কাজ না করে ভালোবাসা দিবস অনুুষ্ঠানের আয়োজকরা সর্বক্ষেত্রে সক্রিয় ভালোবাসাকে শুধ যুবক-যুবতী আর তরুণ-তরুণীদের প্রেম-ভালবাসা আর পুষ্প বিনিময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে অপরাধ করছেন। ভালোবাসা সীমিতকরণের এ অপরাধের জন্য এদের শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। এ অপরাধের শাস্তি শুধু একটি উপায়েই হতে পারে, আর তা হলো এদের দিয়ে সর্বক্ষেত্রে ভালোবাসার শক্তিকে সুপরিকল্পিত উপায়ে ছড়িয়ে দেয়ার কাজ করিয়ে এ সমাজ দেশ ও বিশ্বকে হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত করা এবং তার মধ্য দিয়ে আজকের অশান্ত পৃথিবীকে অধিকতর শান্তি, প্রেম, পারস্পরিক সহমর্মিতা ও ভালোবাসাময় করে তোলা।
লেখক : অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ই-মেইল : akhtermy@yahoo.com
স্মর্তব্য, প্রথম প্রথম এ উপমহাদেশে ভালোবাসা দিবস পালন শুরু হলে সংস্কৃতিকর্মীদের অনেকেই এর বিরোধিতা করেন। পরবর্তী সময়ে ২০০৩ সালে ভারতের মুম্বাই ও দিল্লিতে শিবসেনার হুমকিতে দোকানিরা ভ্যালেনটাইন কার্ড বিক্রি করতে পারেননি। ওই বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেনটাইন কার্ড বিক্রি করার কারণে শিবসেনার জঙ্গিরা নয়া দিল্লির দুটি দোকান ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। এরা এ দিবস পালনকে খ্রিস্টান সংস্কৃতির অংশ বলে প্রচার করে দেশবাসীকে এ দিবস পালন না করার জন্য আহ্বান জানায়। ২০০২ সালে ঢাকায় সংস্কৃতি ফোরাম ‘অকৃত্রিম ভালোবাসার জন্য আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন নেই’ থিম সংবলিত পোস্টার প্রকাশ করে। ওই বছর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব সাহেব ‘মুসলমানদের অনুষ্ঠান নয়’ হিসেবে ব্যাখ্যা দিয়ে সমালোচনা করে এ দিবস পালন থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করার জন্য আল্লাহর কাছে মোনাজাত করেন। বাংলাদেশে প্রথমে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা এ দিবসটি পালন শুরু করলেও ক্রমান্বয়ে অন্যান্য পত্রিকা এবং ইলেট্রনিক মিডিয়ায়ও এ দিবস উত্যাপন শুরু হয় এবং এখন রাজধানীসহ দেশের বিভাগীয় ও অনেক জেলা শহরগুলোতেও যুবসমাজ কর্তৃক এ দিবস পালিত হতে দেখা যায়।
ভালোবাসা এক মহামূল্যবান সম্পদ। ভালোবাসার শক্তি সৃষ্টিকুলকে সজীব ও প্রাণবন্ত করে রাখে। ভালোবাসা না থাকলে এ বিশ্ব হতো মরুভূমির মতো, মানুষগুলো হতো রবোটের মতো। ভালোবাসা আছে বলেই বিশ্বব্যাপী পরিবার, সংসার ও সমাজ টিকে আছে। ভালোবাসার বন্ধন ও উষ্ণতাই সমাজের বন্ধন, সহমর্মিতা ও মমত্ব জিইয়ে রেখেছে। ভালোবাসা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের যাবতীয় ক্লান্তি ও শ্রান্তি দূর করতে সঞ্জীবনী টনিকের মতো কাজ করে। ভালোবাসার উপস্থিতি ও প্রবাহ বিশ্ব মানচিত্রের প্রতিটি প্রান্তে একই ধারায় বহমান। সে কারণে অর্থনেতিক উন্নয়নের মানদণ্ডে আমরা যেমন কোনো দেশকে উন্নত, উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত হিসিবে ভাগ করে দেখাই, ভালোবাসার উপস্থিতি বা সক্রিয়তার মানদণ্ডের বিচারে আমরা বিশ্বের দেশগুলোকে কিন্তু তেমনভাবে ভালোবাসাসমৃদ্ধ বা ভালোবাসা-দরিদ্র হিসেবে ভাগ করে দেখাতে পারি না। ভালোবাসা এমনই এক নিয়ামত যা পৃথিবীর সব অঞ্চলের সব মানুষের মধ্যে একই ধারায় প্রবাহিত। সাদা-কালো, ধনী-দরিদ্র, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এ সম্পদে বিশ্বের সব দেশের সব সমাজের সব মানুষই সমৃদ্ধ।
ভালোবাসা এক সহজাত সম্পদ যা সৃষ্টিকুলের মধ্যে আপনা আপনি জন্ম নেয়। এ সহজাত সম্পদ অর্জনের জন্য কোনো পরিশ্রম করা লাগে না। এ সম্পদ অর্জনের জন্য কোনো আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া বা ব্যবসা-বাণিজ্য করা লাগে না। নাচ-গান বা লেখাপড়া শেখার মতো ভালোবাসা শেখার জন্য কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। ভালোবাসার কিংবদন্তি আইকন ইউসুফ-জুলেখা, লাইলী-মজনু, রোমিও-জুলিয়েট বা শিরি-ফরহাদ ভালোবাসা শেখার জন্য যেমন কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাননি, তেমনি ভালোবাসায় উষ্ণ হতে অংশগ্রহণ করেননি কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে। কাজেই আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে ভালোবাসায় তীব্রতা সৃষ্টি করা যায় এমনটি বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। এ দেশে যখন ভালোবাসা দিবস উদযাপিত হতো না, তখন কী মানুষের মধ্যে ভালোবাসা কম ছিল? অথবা, এ দেশে এখন যারা ভালোবাসা দিবস উদযাপন করেন না, তারা কী ভালোবাসতে জানেন না? যারা হাজার বছর ধরে ভালোবাসা দিবস উদযাপন করে আসছেন তাদের চেয়ে কী আমাদের ভালোবাসার ঐতিহ্য কম? না, তেমনটি মনে হয় না। মনে রাখা প্রয়োজন, মাতৃভাষার ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এ দেশের ছাত্র-যুবকরা প্রাণ দিতে কার্পণ্য করেননি; দেশমাতাকে ভালোবেসে দেশের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য এ দেশে লাখো মানুষ প্রাণ দিয়েছেন। একজন রিকশাওয়ালা তার ঘামঝরা উপার্জন থেকে নিজে না খেয়ে এক টাকা দুই টাকা করে জমিয়ে একটি শাড়ি কিনে যখন ট্রেনের ছাদে চড়ে ঈদের আগে গ্রামে মায়ের কাছে ছুটে যান তখন তার ওই ভালোবাসা কোনো ভালোবাসার চেয়েই কম উষ্ণ নয়। মা অসুস্থ, মায়ের ভালোবাসার আহ্বানে বর্ষার নদী সাঁতরে মাকে দেখতে ছুটে গিয়েছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। যারা হাজার বছর ধরে অনুষ্ঠান করে ভালোবাসা দিবস উদযাপন করছেন তাদের ভালোবাসা চর্চায় এমন গর্ব করার মতো ভালোবাসার উদাহরণ খুব বেশি আছে কী? কোনো ব্রিটিশ বা আমেরিকান যুবক অসুস্থ মাকে দেখার জন্য টেমস বা মিসিসিপি নদীতে ঝাঁপ দিয়েছেন বলে আমাদের জানা নেই। এসব উদাহরণের মধ্য দিয়ে একথা বলা যাবে না যে, যারা হাজার বছর ধরে ভালোবাসা দিবস উদযাপন করছেন তাদের মধ্যে ভালোবাসা নেই, বা ভালোবাসার কমতি আছে। অবশ্যই তাদের মধ্যেও আমাদের মতোই ভালেবাাসার সক্রিয়তা রয়েছে। তবে এ বিশ্বাস করা যায়, অনুষ্ঠান করে তারা আমাদের চেয়ে অধিকতর ভালোবাসা-সমৃদ্ধ হতে পারেনি।
ভালোবাসা সম্পর্কিত আলোচনায় ভালোবাসার বহুমাত্রিকতাকে ভুলে যাওয়া উচিত নয়। মনে রাখতে হবে, প্রতিটি পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কই ভালোবাসানির্ভর। স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর, বাবার সঙ্গে ছেলের, মার সঙ্গে সন্তানের, নেতার সঙ্গে কর্মীর, মালিকের সঙ্গে শ্রমিকের, প্রেমিকের সঙ্গে প্রেমিকার, শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীর, পীরের সঙ্গে মুরিদের, আদর্শের সঙ্গে বিপ্লবীর, ধর্মের সঙ্গে ধার্মিকের, ফুল বাগানের সঙ্গে মালির, শিল্পের সঙ্গে শিল্পীর, এসব সম্পর্কই ভালোবাসানির্ভর। ভালোবাসার শক্তিই এসব সম্পর্ককে সজীব, প্রাণবন্ত, সৃষ্টিশীল ও উন্নয়নমুখী করে রাখে। ভালোবাসার অনুপস্থিতি এসব সম্পর্কে ফাটল ধরিয়ে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য তৈরি করে। সেজন্য যারা ভালোবাসার উত্কর্ষতা ও শক্তিবৃদ্ধি ঘটাতে চান তাদের উচিত ভালোবাসার সক্রিয়তা আছে এমন প্রতিটি অঙ্গনে ভালোবাসার চর্চায় উষ্ণতা ও গতিশীলতা সৃষ্টি করা।
পরিতাপের বিষয়, বাংলাদেশে যারা ভালোবাসা দিবস পালন করছেন তাদের কর্মকাণ্ডের মধ্যে সব এলাকায় ভালোবাসার শক্তিবৃদ্ধির কোনো পরিকল্পনা পরিলক্ষিত হয় না। কারণ, এরা এদের ভালোবাসা দিবসের আনুষ্ঠানিকতা যুবক-যুবতীদের মধ্যে পুষ্প বিনিময় এবং ভালোবাসার স্মৃতি জাগানিয়া গালগল্পের মধ্যেই সীমিত রাখছেন। আমাদের দেশের যুবক-যুবতীর মধ্যে ভালোবাসার কোনো ঘাটতি না থাকা সত্ত্বেও পূর্বে উল্লিখিত অন্যসব এলাকায় ভালোবাসার চর্চা ও শক্তি বৃদ্ধির পরিকল্পনা গ্রহণ না করে শুধু তরুণ-তরুণী ও যুবক-যুবতীদের মধ্যে জাগ্রত ভালোবাসায় তীব্রতা সৃষ্টির চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এর ফলে ভালোবাসা দিবস পালনের আয়োজকরা জেনে বা না বুঝেই এক ধরনের অপরাধ করে ফেলছেন। এ অপরাধ হচ্ছে ভালোবাসার মতো একটি সম্ভাবনাময় শক্তিকে সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগের পরিবর্তে সমাজের যে অংশে ভালোবাসা সবচেয়ে বেশি সক্রিয় সে অংশেই এর চর্চাকে অধিক উত্সাহিত করে মহান ও সর্বত্র-সক্রিয় ভালোবাসাকে সীমিত করে ফেলার অপরাধ। এর ফলে যেসব এলাকায় ভালোবাসার চর্চা তুলনামূলক কম, সেসব এলাকার নাগরিকরা ভালোবাসার শক্তিজাত মুনাফা লাভে বঞ্চিত হচ্ছেন। সম্মানিত পাঠক, আসুন দু’একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি আরও একটু খোলামেলাভাবে আলোচনা করি।
আমাদের দেশকে অর্থনৈতিকভাবে টিকিয়ে রেখেছে শ্রমিকের শ্রম। আর এ শ্রমিকের সঙ্গে মালিকের যে সম্পর্ক সেখানে যদি আলোচ্য দিবস পালনের মাধ্যমে ভালোবাসার উষ্ণতা বৃদ্ধি করা যেত তাহলে কতই না ভালো হতো। গার্মেন্ট সেক্টরে লাখো তরুণী সারাদিন ফার্মের মুরগির মতো আটকাবস্থায় থেকে ঘামঝরা শ্রম দিয়ে সন্ধ্যায় যখন বাসার উদ্দেশে রাস্তায় হাঁটেন তখন তাদের মলিন মুখের দিকে তাকালে যে কোনো উন্নয়নপ্রত্যাশী ও দেশপ্রেমিক নাগরিকের হৃদয়ে এসব কম মজুরি পাওয়া আধপেটে খাওয়া শ্রমিকের প্রতি ভালোবাসা না জেগে পারে না। অথচ, গার্মেন্ট মালিকেরা যেভাবে মুনাফা করছেন সেভাবে কী এসব শ্রমিকের পারিশ্রমিক দেয়া হচ্ছে? আমাদের ভালোবাসা দিবস অনুষ্ঠানের সম্মানিত আয়োজকরা কয়েকজন গার্মেন্ট মালিক ও শ্রমিককে তাদের অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিয়ে অংশগ্রহণ করান না কেন? যদি তারা এরকম কোনো কাজ করাতে পারতেন, যদি গার্মেন্ট মালিকদের দিয়ে তাদের শ্রমিকদের প্রতি তাদের ভালোবাসার হাত একটুখানি প্রসারিত করিয়ে ভালোবাসা দিবসের অনুষ্ঠানে সামান্য হলেও মজুরি বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়াতে পারতেন তাহলে ভালোবাসা দিবসের শক্তি অনেক বৃদ্ধি পেত, ভালোবাসা দিবসের অনু্ঠানগুলো হয়ে উঠত আরও অনেক প্রশংসিত, গ্রহণযোগ্য, জীবনঘনিষ্ঠ, আকর্ষণীয় ও বর্ণময়।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভালোবাসাকে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা কই? পরস্পরকে ভালোবাসা তো দূরের কথা এক নেতার সঙ্গে আর এক নেতার যেখানে মুখ দেখাদেখি বন্ধ সেখানে ভালোবাসা দিবসের অনুষ্ঠান আয়োজকরা কেন এ রকম জাতীয় নেতাদের আলোচ্য দিবসের অনুষ্ঠানে এনে পরস্পরকে পুষ্প বিনিময়ের মাধ্যমে আলিঙ্গনে উদ্বুদ্ধ করান না? টিএসসির ভালোবাসা দিবসের অনুষ্ঠানের আয়োজকরা পরস্পরবিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদের পরস্পরকে দিয়ে মাল্যভূষিত করানোর উদ্যোগ নিয়ে এরকম কাজগুলো গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার করাতে পারলে সারা দেশে স্থানীয় পর্যায়ে পরস্পরবিরোধী প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের মধ্যে পারস্পরিক সহমর্মিতা তৈরি হতো, হ্রাস পেত। হিংসা, ঘৃণা ও পরস্পরকে সুযোগ পেলে দেখে নেয়ার মনোভাব। যারা ভালোবাসা দিবস অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে ভালোবাসাকে ছড়িয়ে দিতে চান, তারা যদি পাশ্চাত্যের ধনী দেশগুলোর ভালোবাসা দিবস অনুষ্ঠানের আদলে এ দিবস পালন না করে জাতীয় ও আঞ্চলিক প্রয়োজন ও সমস্যার প্রসঙ্গটি মাথায় রেখে আলোচ্য দিবসের কর্মসূচি নির্মাণ করতেন এবং তার মধ্য দিয়ে ওইসব সমস্যা সমাধানের জন্য ভালোবাসার শক্তিকে কাজে লাগানোর উদ্যোগ গ্রহণ করতেন তাহলে তা দেশের জন্য ভালো হতো। কিন্তু আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, এ ধরনের কাজ না করে ভালোবাসা দিবস অনুুষ্ঠানের আয়োজকরা সর্বক্ষেত্রে সক্রিয় ভালোবাসাকে শুধ যুবক-যুবতী আর তরুণ-তরুণীদের প্রেম-ভালবাসা আর পুষ্প বিনিময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে অপরাধ করছেন। ভালোবাসা সীমিতকরণের এ অপরাধের জন্য এদের শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। এ অপরাধের শাস্তি শুধু একটি উপায়েই হতে পারে, আর তা হলো এদের দিয়ে সর্বক্ষেত্রে ভালোবাসার শক্তিকে সুপরিকল্পিত উপায়ে ছড়িয়ে দেয়ার কাজ করিয়ে এ সমাজ দেশ ও বিশ্বকে হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত করা এবং তার মধ্য দিয়ে আজকের অশান্ত পৃথিবীকে অধিকতর শান্তি, প্রেম, পারস্পরিক সহমর্মিতা ও ভালোবাসাময় করে তোলা।
লেখক : অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ই-মেইল : akhtermy@yahoo.com
No comments