কোথায় নীতি, কোথায় আইন, পলাতক শৃঙ্খলা by আতাউস সামাদ
আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব যদি হয়ে থাকে আইনের দেখভাল করা, অর্থাত্ আইনের সঠিক প্রয়োগ হলো কিনা এবং ভালো আইন তৈরি হলো কীনা তা দেখা আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্তব্য যদি হয়ে থাকে আইন মোতাবেক শৃঙ্খলা রক্ষা করা তাহলে বোধহয় এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতেই হয় যে, বর্তমানে আইন ও শৃঙ্খলা দুটোই দেশের মানুষকে বিদায় জানাতে চলেছে।
আর নিরাপদে বেঁচে থাকার জন্য খুবই জরুরি এই দুটো উপাদানকে আমাদের কাছ থেকে দূরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন আইন মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্ণধাররা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা দেখা গেছে বর্তমান সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত—এই পুরো সময়টাতেই। এখানে সাফল্য-ব্যর্থতার মাপকাঠি ধরছি মূলত মানুষের প্রাণের নিরাপত্তা, তারপর নাগরিকদের সম্পদের। তৃতীয়টি ধরেছি জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের এবং চতুর্থত, সমাজের কাছে আইনকে একটা শ্রদ্ধার ভিত্তির উপর বসানোর কর্তব্য পালনকে। এই চার নিরিখেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও এর অধীনস্থ বিভাগ এবং বাহিনীগুলো লাগাতার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে এসেছে।
হত্যাকাণ্ডের দিক থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে সব হিসাব অতিক্রম করে গেছে গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে রাজধানীর পিলখানায় বিদ্রোহী বিডিআর সৈনিকদের হাতে ৫৬ সেনা কর্মকর্তাসহ ৬২ জন একদিনে খুন হওয়া। বিডিআর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন একটা বাহিনী। তাই পিলখানা হত্যাযজ্ঞ প্রতিরোধ করতে না পারার প্রাথমিক দায় এই মন্ত্রণালয়কেই নিতে হবে । ওই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ যখন জনগণকে দুঃখ ভারাক্রান্ত করে রেখেছে সেই সময়ে খোদ রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিদিন মানুষ খুন হয়েছে সন্ত্রাসীদের হাতে। খুব তাড়াতাড়িই দেশের মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অথবা পেছনে থাকছে সরকার সমর্থক ছাত্র-যুব সংগঠনগুলো। সুযোগমত তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীরাও এসেছে এই অন্ধকার পথে। ঢাকায় এই ধরনের হত্যাকাণ্ড, যেগুলো সবাইকে চমকে দেয়, শুরু হয় বকশিবাজারে ঢাকা মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে। সেখানে একজন ইন্টার্নি ডাক্তারকে, যে নিজেও সন্দেহভাজন ছিল, তাকে এক চিহ্নিত সন্ত্রাসীর অনুসারীরা মারধর করার পর তিন তলার বারান্দা থেকে নিচে ফেলে দিয়ে হত্যা করে। এ খুনের কিনারা হয়নি এ পর্যন্ত। খুনি এবং নিহত দুই পক্ষই ছাত্রলীগের প্রভাবশালী সদস্য। ঢাকা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে ছাত্র সংঘর্ষে এক ছাত্রের মৃত্যু ও র্যাবের হাতে গ্রেফতারের পর আরও দুই ছাত্রের প্রাণনাশ, বাড্ডায় এক শিল্পপতির শ্বশুর তার নাতীদের সামনেই সন্ত্রাসীদের ব্রাশ ফায়ারে খুন, কারওয়ানবাজারে এক সন্ত্রাসী হামলায় তিন ব্যবসায়ী খুন (এতে বিএনপি সমর্থক কয়েক ব্যক্তি গ্রেফতার হয়েছে), বিজয়নগরে নজরুল ইসলাম নামে জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের এক নেতা খুন, মোহাম্মদপুর ও মিরপুরে লাগাতার কয়েকটি হত্যাকাণ্ড, সম্প্রতি পুরনো ঢাকায় ব্যবসায়ী এবং ওয়ার্ড কমিশনার হত্যাকাণ্ড, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এএফ রহমান হলে মেধাবী ছাত্র আবু বকর সিদ্দিককে হত্যা, কুষ্টিয়া ও খুলনায় অনেক হত্যাকাণ্ড, বিয়ানীবাজারে পুলিশের অফিসার-ইন-চার্জ খুন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরপর দুই ছাত্র খুন (একজন ইসলামী ছাত্র শিবিরের নেতা, আরেকজন ছাত্রলীগের সমর্থক) এবং সর্বশেষ রাজশাহীর চৈতন্যপুর গ্রামে পুলিশ তল্লাশি চলার সময় তারা একটা বাড়ি ঘেরাও করে রাখা অবস্থায় রাজশাহী থেকে পালিয়ে এসে সেই বাড়িতে আশ্রয় নেয়া ইসলামী ছাত্র শিবিরের এক নেতা খুন—এরকম সব হত্যাকাণ্ড, যার মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আছে বেশ কিছু। গত সাড়ে তের মাস জনগণকে শঙ্কা ও আতঙ্কে রেখেছে। প্রায় সারাক্ষণই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে মানুষ। মানুষ খুনের সাথে যোগ হয়েছে অপহরণ ও চাঁদার জন্য টেলিফোনে হুমকি।
এর মধ্যে আবার দেখা গেছে যে, সরকার অপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবার বিষয়ে খুবই পক্ষপাতিত্ব করছে। সন্দেহভাজন ব্যক্তিটি যখনই বিরোধীদলের সঙ্গে সম্পৃক্ত দেখা গেছে তখনই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী হুঙ্কার দিয়ে উঠেছেন আবার অপরাধী ছাত্রলীগ, যুবলীগ বা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য বা মদতপুষ্ট হলে তাদের রেহাই দেয়ার বন্দোবস্তই করা হয়েছে। এ ধরনের পক্ষপাতিত্বের সর্বশেষ নিদর্শন হলো যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবী ছাত্র ফারুক হোসেনের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর দোষীদের ধরতে ইসলামী ছাত্র শিবির ও জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে দেশজুড়ে ‘চিরুনি অভিযান’ চলছে। এ নির্দেশ দেয়ার সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের হামলা ছিল দেশকে অস্থিতিশীল করার পরিকল্পনার অংশ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন এ বিষয়ে জাতীয় সংসদে বিবৃতি দিতে গিয়ে ‘খুনি মোশতাক-জিয়া’ চক্র উল্লেখ করে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য বিএনপিকে দায়ী করলে এর প্রতিবাদে বিরোধী দল ওয়াকআউট করে। অথচ দীর্ঘ নয় মাস সংসদ বর্জন করার পর বিরোধী দল সেদিনই সংসদে ফিরে গিয়েছিল এবং আশা করা হচ্ছিল যে, সরকারি দলের পক্ষ থেকে তাদের প্রতি অহেতুক কটুক্তি করা হবে না। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সামছুল হক টুকু তার দফতরে বলেন, জামায়াত-শিবিরকে উত্খাত করে ফেলতে হবে। পুলিশ তাদের এসব মন্তব্যের পর মারমুখী হয়ে রয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে দরকার ছিল ব্যাপক তদন্তের, যাতে শিক্ষাঙ্গনে, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে, ছাত্ররা কীভাবে নষ্ট হচ্ছে, কে তাদের নষ্ট করছে এবং তারা আশপাশের সমাজে অশান্তি ঘটাচ্ছে, যার জের ধরে হচ্ছে ন্যক্কারজনক হত্যাকাণ্ড, তা খুঁজে বের করে সেই কারণগুলো ‘উত্পাটন’ করা। জনগণ খুবই গভীরভাবে চেয়েছিল, দেশ জুড়ে শিক্ষাঙ্গনে এই লজ্জাজনক অশান্তির শেষ হোক। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী খুবই দলীয় পক্ষপাতপূর্ণ নীতি নেয়ায় এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু ছাত্রনামধারীর অবৈধ কীর্তিকাণ্ডের ফলাফল পুরো রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছে। শিক্ষাঙ্গনের অঘটন বন্ধ করতে কর্তৃপক্ষের ও সরকারের যে দলীয় রাজনীতির বাইরে থাকতে হয়, সেই কথাটা তারা ভুলে গেছে। এর ফলে একদিকে তাদের সমর্থক যুবকদের হত্যা তদন্তের বেলায় হচ্ছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা বিচার ছাড়াই প্রাণদণ্ড দান ও কার্যকর করার মতো অপরাধ আর অন্য হত্যাকাণ্ডে তদন্ত কার্যত বন্ধ রাখার মতো অনিয়ম ও কর্তব্যে ইচ্ছাকৃত অবহেলা। ফলে পুলিশ বাহিনী আফ্রিকার গোত্রীয় সৈন্যদের মতো দলীয় বাহিনী হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে জনগণের চোখে। এভাবেই কর্তব্য পালনে শৃঙ্খলা ধ্বংস করা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অন্যান্য কাজেও ব্যর্থ। যেমন সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাচ্ছে রোজ। এ রকম নিহতের সংখ্যা বাড়ছেই। এখন দেশের মহাসড়কগুলো দিয়ে যাতায়াত করতে হয় প্রাণ হাতে নিয়ে। পরিবারের পর পরিবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এসব সড়ক দুর্ঘটনার ফলে। কিন্তু সড়ক নিরাপত্তা গড়ে তোলার যেন লক্ষণীয় প্রয়াস নেই। একইভাবে অগ্নিকাণ্ডের বড় বড় ঘটনা ঘটছে রাজধানী ঢাকা ও অন্যত্র। আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সব দেশেই নীতি হচ্ছে, প্রথমে দেখা আগুন যেন না লাগে। আর যদি লেগেই যায় তখন যেন মানুষ সঙ্গে সঙ্গে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে পারে তেমন কৌশল শিখে রাখা। সবার ওপর সবাই যেন সতর্কতা অভ্যাস করে। দেশে বসতি বেড়েছে, কল-কারখানা বেড়েছে, মানুষ বেড়েছে। ফলে আগুন লাগার মতো জায়গা ও কাজও বেড়েছে। তাই দেশজুড়ে আগুনের বিরুদ্ধে সতর্কতা, সচেতনতা ও আত্মরক্ষার কৌশল প্রচার করা দরকার। সেই কাজটি যে হচ্ছে এমন চিহ্ন চোখে পড়ে কদাচিত্। সড়ক নিরাপত্তা ও আগুন প্রতিরোধ আমাদের দেশে দুটো কাজের দায়িত্বই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু এসব দায়িত্বের দিকে মন্ত্রণালয়ের তথা সরকারের নজর দেয়ার সময় কই।
মহাজোট, তথা আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর থেকে আইন মন্ত্রণালয় নিয়মিত নজর কেড়েছে টেলিভিশন দর্শক ও সংবাদপত্র পাঠকদের। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচার ও রায় কার্যকর করা, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ, সংবিধানকে বাহাত্তরের রূপে ফিরিয়ে নেয়া এবং আইনের শাসন কায়েম করার ঘোষণা দিয়ে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী রোজ এসেছেন জনসমক্ষে। তবে দেখা গেল এ পর্যন্ত তারা ‘বিশাল’ যে কাজটি করেছেন তা হলো ‘রাজনৈতিক বিবেচনায় করা মামলা’ পুনর্বিবেচনা করে উপযুক্ত ক্ষেত্রে মামলা প্রত্যাহার প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন। বুঝতে অসুবিধা নেই যে, বিশেষ সহানুভূতির সঙ্গে যাদের মামলা বিবেচনা করা হবে তারা হবেন ক্ষমতাসীন দলের লোক। বাস্তবেও তাই হয়েছে। এদিকে চ্যানেল ওয়ান টেলিভিশন তাদের এক বিশেষ প্রতিবেদনে দেখিয়েছে যে, প্রতিমন্ত্রী জনাব কামরুল ইসলামকে সভাপতি করে আইন মন্ত্রণালয়ের যে কমিটি ওই রকম মামলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিচ্ছিল সেটি প্রায় ৭০০০ আবেদনের মধ্যে ২৮৯৩টি মামলা প্রত্যাহার করতে সম্মতি দিয়েছে। চ্যানেল ওয়ানের প্রতিবেদক সাইফুল হাসান দেখিয়েছেন, কমিটি মোট ১৩টি বৈঠকে মিলিত হয়ে ৫০ ঘণ্টা কাজ করে ৭০০০ মামলার কাগজ পর্যালোচনা করেছে। অর্থাত্ কমিটি প্রতিটি মামলা দেখতে গড়পড়তা সময় নিয়েছে মাত্র ৪২.৮ সেকেন্ড। প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম প্রতিবেদককে বলেছেন, মামলাগুলো যেহেতু জেলা ও মন্ত্রণালয় পর্যায়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাদের কাছে পাঠানো হয়েছে কাজেই তারা দ্রুত সিদ্ধান্ত দিতে পেরেছেন। এখানে আমাদের প্রশ্ন হলো, ফৌজদারি মামলায় আইনের প্রয়োগ সঠিকমত হয়েছে কীনা তা কী এত সহজে বোঝা যায়? তা যদি যেত তাহলে দেশের আদালতগুলোতে লাখ লাখ মামলা পড়ে আছে কেন? তাই আমরা ঘোর সন্দেহ পোষণ করছি যে, পর্যালোচনা কমিটিতে আইনের বিবেচনা হয়েছে কমই।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা দেখা গেছে বর্তমান সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত—এই পুরো সময়টাতেই। এখানে সাফল্য-ব্যর্থতার মাপকাঠি ধরছি মূলত মানুষের প্রাণের নিরাপত্তা, তারপর নাগরিকদের সম্পদের। তৃতীয়টি ধরেছি জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের এবং চতুর্থত, সমাজের কাছে আইনকে একটা শ্রদ্ধার ভিত্তির উপর বসানোর কর্তব্য পালনকে। এই চার নিরিখেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও এর অধীনস্থ বিভাগ এবং বাহিনীগুলো লাগাতার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে এসেছে।
হত্যাকাণ্ডের দিক থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে সব হিসাব অতিক্রম করে গেছে গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে রাজধানীর পিলখানায় বিদ্রোহী বিডিআর সৈনিকদের হাতে ৫৬ সেনা কর্মকর্তাসহ ৬২ জন একদিনে খুন হওয়া। বিডিআর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন একটা বাহিনী। তাই পিলখানা হত্যাযজ্ঞ প্রতিরোধ করতে না পারার প্রাথমিক দায় এই মন্ত্রণালয়কেই নিতে হবে । ওই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ যখন জনগণকে দুঃখ ভারাক্রান্ত করে রেখেছে সেই সময়ে খোদ রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিদিন মানুষ খুন হয়েছে সন্ত্রাসীদের হাতে। খুব তাড়াতাড়িই দেশের মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অথবা পেছনে থাকছে সরকার সমর্থক ছাত্র-যুব সংগঠনগুলো। সুযোগমত তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীরাও এসেছে এই অন্ধকার পথে। ঢাকায় এই ধরনের হত্যাকাণ্ড, যেগুলো সবাইকে চমকে দেয়, শুরু হয় বকশিবাজারে ঢাকা মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে। সেখানে একজন ইন্টার্নি ডাক্তারকে, যে নিজেও সন্দেহভাজন ছিল, তাকে এক চিহ্নিত সন্ত্রাসীর অনুসারীরা মারধর করার পর তিন তলার বারান্দা থেকে নিচে ফেলে দিয়ে হত্যা করে। এ খুনের কিনারা হয়নি এ পর্যন্ত। খুনি এবং নিহত দুই পক্ষই ছাত্রলীগের প্রভাবশালী সদস্য। ঢাকা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে ছাত্র সংঘর্ষে এক ছাত্রের মৃত্যু ও র্যাবের হাতে গ্রেফতারের পর আরও দুই ছাত্রের প্রাণনাশ, বাড্ডায় এক শিল্পপতির শ্বশুর তার নাতীদের সামনেই সন্ত্রাসীদের ব্রাশ ফায়ারে খুন, কারওয়ানবাজারে এক সন্ত্রাসী হামলায় তিন ব্যবসায়ী খুন (এতে বিএনপি সমর্থক কয়েক ব্যক্তি গ্রেফতার হয়েছে), বিজয়নগরে নজরুল ইসলাম নামে জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের এক নেতা খুন, মোহাম্মদপুর ও মিরপুরে লাগাতার কয়েকটি হত্যাকাণ্ড, সম্প্রতি পুরনো ঢাকায় ব্যবসায়ী এবং ওয়ার্ড কমিশনার হত্যাকাণ্ড, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এএফ রহমান হলে মেধাবী ছাত্র আবু বকর সিদ্দিককে হত্যা, কুষ্টিয়া ও খুলনায় অনেক হত্যাকাণ্ড, বিয়ানীবাজারে পুলিশের অফিসার-ইন-চার্জ খুন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরপর দুই ছাত্র খুন (একজন ইসলামী ছাত্র শিবিরের নেতা, আরেকজন ছাত্রলীগের সমর্থক) এবং সর্বশেষ রাজশাহীর চৈতন্যপুর গ্রামে পুলিশ তল্লাশি চলার সময় তারা একটা বাড়ি ঘেরাও করে রাখা অবস্থায় রাজশাহী থেকে পালিয়ে এসে সেই বাড়িতে আশ্রয় নেয়া ইসলামী ছাত্র শিবিরের এক নেতা খুন—এরকম সব হত্যাকাণ্ড, যার মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আছে বেশ কিছু। গত সাড়ে তের মাস জনগণকে শঙ্কা ও আতঙ্কে রেখেছে। প্রায় সারাক্ষণই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে মানুষ। মানুষ খুনের সাথে যোগ হয়েছে অপহরণ ও চাঁদার জন্য টেলিফোনে হুমকি।
এর মধ্যে আবার দেখা গেছে যে, সরকার অপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবার বিষয়ে খুবই পক্ষপাতিত্ব করছে। সন্দেহভাজন ব্যক্তিটি যখনই বিরোধীদলের সঙ্গে সম্পৃক্ত দেখা গেছে তখনই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী হুঙ্কার দিয়ে উঠেছেন আবার অপরাধী ছাত্রলীগ, যুবলীগ বা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য বা মদতপুষ্ট হলে তাদের রেহাই দেয়ার বন্দোবস্তই করা হয়েছে। এ ধরনের পক্ষপাতিত্বের সর্বশেষ নিদর্শন হলো যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবী ছাত্র ফারুক হোসেনের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর দোষীদের ধরতে ইসলামী ছাত্র শিবির ও জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে দেশজুড়ে ‘চিরুনি অভিযান’ চলছে। এ নির্দেশ দেয়ার সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের হামলা ছিল দেশকে অস্থিতিশীল করার পরিকল্পনার অংশ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন এ বিষয়ে জাতীয় সংসদে বিবৃতি দিতে গিয়ে ‘খুনি মোশতাক-জিয়া’ চক্র উল্লেখ করে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য বিএনপিকে দায়ী করলে এর প্রতিবাদে বিরোধী দল ওয়াকআউট করে। অথচ দীর্ঘ নয় মাস সংসদ বর্জন করার পর বিরোধী দল সেদিনই সংসদে ফিরে গিয়েছিল এবং আশা করা হচ্ছিল যে, সরকারি দলের পক্ষ থেকে তাদের প্রতি অহেতুক কটুক্তি করা হবে না। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সামছুল হক টুকু তার দফতরে বলেন, জামায়াত-শিবিরকে উত্খাত করে ফেলতে হবে। পুলিশ তাদের এসব মন্তব্যের পর মারমুখী হয়ে রয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে দরকার ছিল ব্যাপক তদন্তের, যাতে শিক্ষাঙ্গনে, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে, ছাত্ররা কীভাবে নষ্ট হচ্ছে, কে তাদের নষ্ট করছে এবং তারা আশপাশের সমাজে অশান্তি ঘটাচ্ছে, যার জের ধরে হচ্ছে ন্যক্কারজনক হত্যাকাণ্ড, তা খুঁজে বের করে সেই কারণগুলো ‘উত্পাটন’ করা। জনগণ খুবই গভীরভাবে চেয়েছিল, দেশ জুড়ে শিক্ষাঙ্গনে এই লজ্জাজনক অশান্তির শেষ হোক। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী খুবই দলীয় পক্ষপাতপূর্ণ নীতি নেয়ায় এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু ছাত্রনামধারীর অবৈধ কীর্তিকাণ্ডের ফলাফল পুরো রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছে। শিক্ষাঙ্গনের অঘটন বন্ধ করতে কর্তৃপক্ষের ও সরকারের যে দলীয় রাজনীতির বাইরে থাকতে হয়, সেই কথাটা তারা ভুলে গেছে। এর ফলে একদিকে তাদের সমর্থক যুবকদের হত্যা তদন্তের বেলায় হচ্ছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা বিচার ছাড়াই প্রাণদণ্ড দান ও কার্যকর করার মতো অপরাধ আর অন্য হত্যাকাণ্ডে তদন্ত কার্যত বন্ধ রাখার মতো অনিয়ম ও কর্তব্যে ইচ্ছাকৃত অবহেলা। ফলে পুলিশ বাহিনী আফ্রিকার গোত্রীয় সৈন্যদের মতো দলীয় বাহিনী হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে জনগণের চোখে। এভাবেই কর্তব্য পালনে শৃঙ্খলা ধ্বংস করা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অন্যান্য কাজেও ব্যর্থ। যেমন সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাচ্ছে রোজ। এ রকম নিহতের সংখ্যা বাড়ছেই। এখন দেশের মহাসড়কগুলো দিয়ে যাতায়াত করতে হয় প্রাণ হাতে নিয়ে। পরিবারের পর পরিবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এসব সড়ক দুর্ঘটনার ফলে। কিন্তু সড়ক নিরাপত্তা গড়ে তোলার যেন লক্ষণীয় প্রয়াস নেই। একইভাবে অগ্নিকাণ্ডের বড় বড় ঘটনা ঘটছে রাজধানী ঢাকা ও অন্যত্র। আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সব দেশেই নীতি হচ্ছে, প্রথমে দেখা আগুন যেন না লাগে। আর যদি লেগেই যায় তখন যেন মানুষ সঙ্গে সঙ্গে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে পারে তেমন কৌশল শিখে রাখা। সবার ওপর সবাই যেন সতর্কতা অভ্যাস করে। দেশে বসতি বেড়েছে, কল-কারখানা বেড়েছে, মানুষ বেড়েছে। ফলে আগুন লাগার মতো জায়গা ও কাজও বেড়েছে। তাই দেশজুড়ে আগুনের বিরুদ্ধে সতর্কতা, সচেতনতা ও আত্মরক্ষার কৌশল প্রচার করা দরকার। সেই কাজটি যে হচ্ছে এমন চিহ্ন চোখে পড়ে কদাচিত্। সড়ক নিরাপত্তা ও আগুন প্রতিরোধ আমাদের দেশে দুটো কাজের দায়িত্বই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু এসব দায়িত্বের দিকে মন্ত্রণালয়ের তথা সরকারের নজর দেয়ার সময় কই।
মহাজোট, তথা আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর থেকে আইন মন্ত্রণালয় নিয়মিত নজর কেড়েছে টেলিভিশন দর্শক ও সংবাদপত্র পাঠকদের। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচার ও রায় কার্যকর করা, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ, সংবিধানকে বাহাত্তরের রূপে ফিরিয়ে নেয়া এবং আইনের শাসন কায়েম করার ঘোষণা দিয়ে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী রোজ এসেছেন জনসমক্ষে। তবে দেখা গেল এ পর্যন্ত তারা ‘বিশাল’ যে কাজটি করেছেন তা হলো ‘রাজনৈতিক বিবেচনায় করা মামলা’ পুনর্বিবেচনা করে উপযুক্ত ক্ষেত্রে মামলা প্রত্যাহার প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন। বুঝতে অসুবিধা নেই যে, বিশেষ সহানুভূতির সঙ্গে যাদের মামলা বিবেচনা করা হবে তারা হবেন ক্ষমতাসীন দলের লোক। বাস্তবেও তাই হয়েছে। এদিকে চ্যানেল ওয়ান টেলিভিশন তাদের এক বিশেষ প্রতিবেদনে দেখিয়েছে যে, প্রতিমন্ত্রী জনাব কামরুল ইসলামকে সভাপতি করে আইন মন্ত্রণালয়ের যে কমিটি ওই রকম মামলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিচ্ছিল সেটি প্রায় ৭০০০ আবেদনের মধ্যে ২৮৯৩টি মামলা প্রত্যাহার করতে সম্মতি দিয়েছে। চ্যানেল ওয়ানের প্রতিবেদক সাইফুল হাসান দেখিয়েছেন, কমিটি মোট ১৩টি বৈঠকে মিলিত হয়ে ৫০ ঘণ্টা কাজ করে ৭০০০ মামলার কাগজ পর্যালোচনা করেছে। অর্থাত্ কমিটি প্রতিটি মামলা দেখতে গড়পড়তা সময় নিয়েছে মাত্র ৪২.৮ সেকেন্ড। প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম প্রতিবেদককে বলেছেন, মামলাগুলো যেহেতু জেলা ও মন্ত্রণালয় পর্যায়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাদের কাছে পাঠানো হয়েছে কাজেই তারা দ্রুত সিদ্ধান্ত দিতে পেরেছেন। এখানে আমাদের প্রশ্ন হলো, ফৌজদারি মামলায় আইনের প্রয়োগ সঠিকমত হয়েছে কীনা তা কী এত সহজে বোঝা যায়? তা যদি যেত তাহলে দেশের আদালতগুলোতে লাখ লাখ মামলা পড়ে আছে কেন? তাই আমরা ঘোর সন্দেহ পোষণ করছি যে, পর্যালোচনা কমিটিতে আইনের বিবেচনা হয়েছে কমই।
No comments