খোলা হাওয়া-সরকার অনেকটা সফল কিন্তু... by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
পাঁচ বছরের মেয়াদে নির্বাচিত একটি সরকারের জন্য প্রথম ছয় মাস যদি হয় মধুচন্দ্রিমার, বাকি সাড়ে চার বছর হয় মধুহীন, চন্দ্রিমাহীন সংগ্রামের ও সংকটের। এ সরকারের দুই বছর মাত্র হয়েছে, এরই মধ্যে বিরোধী দল দাবি তুলেছে সংসদ ভেঙে নতুন নির্বাচন দেওয়ার।
‘এ সরকারের ওপর জনগণের আর আস্থা নেই’, বলেছেন বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। ‘সকল ক্ষেত্রে এ সরকার চরমভাবে ব্যর্থ।’ অন্য কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধী দল এ রকম অনাস্থা দেখালে সরকার অস্তিত্বসংকটে পড়ত, মিডিয়া সরগরম থাকত সরকারের পতন-সম্ভাবনার আলোচনায়। আমাদের দেশে সে রকম হচ্ছে না। কারণ, সরকার পতনের ডাক দিচ্ছে যে বিরোধী দল, সে নিজেই আছে অস্তিত্বসংকটে।
আমাদের দুই দশকের গণতন্ত্রী অধ্যায়ে একটি বিষয় এখন স্বীকৃত এবং তা হচ্ছে জাতীয় নির্বাচনে সরকারি দলের পরাজয়ের মূলে যতটা না বিরোধী দলের ভূমিকা থাকে, তার চেয়ে বেশি থাকে সরকারি দলের নিজের। অর্থাৎ, বিরোধী দল শক্তিশালী, সুসংগঠিত এবং পরিবর্তন-সক্ষম একটি শক্তি হিসেবে পাঁচ বছর ধরে কার্যকর থাকে না। অন্যদিকে সরকারি দলের ভেতর কোন্দল, ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতি তাকে অজনপ্রিয় করে তোলে। এটি নিশ্চিতভাবেই খারাপ একটি প্রবণতা। হতাশাজনকও। এ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের দুই বছরের মধ্যে এই প্রবণতার প্রতিফলন চোখে পড়ছে। সরকারি দলের সহযোগী সংগঠনগুলো টেন্ডার ও নানাবিধ দখলপ্রক্রিয়ায় যুক্ত হচ্ছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
প্রথম আলোর জরিপমতে, দুই বছরে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা যে প্রায় ১১ শতাংশ কমেছে, তার প্রধান কারণ সরকারি দলের সহযোগী সংগঠনগুলোর বেপরোয়া আচরণ। তবে বিরোধী দলের সমর্থন যে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়েনি, এখনই নির্বাচন হলে দলটি যে তার সহযোগীদের নিয়ে ক্ষমতায় যেতে পারবে না, তার কারণ এর সাংগঠনিক দুর্বলতা, এর ভেতরে নেতৃত্বের কোন্দল ও অনৈক্য এবং এর পশ্চাৎপদ নীতি ও পন্থাসমূহ। দুটি দলের জন্যই এই জরিপ জেগে ওঠার, নতুনভাবে নিজেদের মূল্যায়নের এবং বাকি তিন বছর সুচারুভাবে ঘর গোছানোর আহ্বান। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, এ রকম আহ্বান উপেক্ষিতই থেকে যায়, ১০টায় অফিসে পৌঁছানোর জন্য সাতটায় ঘড়িতে অ্যালার্ম বাজার পর কেরানি সাহেব যদি ঘড়িটার টুঁটি চেপে আবার ঘুমাতে যান, তাঁর যে সমস্যা হবে, দলগুলোরও তা-ই হবে। কিন্তু এর পরিণাম, আবারও আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, হচ্ছে নতুন সংকট, অরাজকতা।
গত দুই বছর সরকারকে শক্তিশালী কোনো বিরোধী দলকে মোকাবিলা করতে হয়নি—না সংসদে, না রাস্তায়। বিরোধী দল (অর্থাৎ বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী) ১/১১-এর পর থেকে ক্রমাগত দুর্বল হয়েছে, এর নৈতিক অবস্থান নড়বড়ে হয়েছে। বিএনপির সমস্যা হাওয়া ভবনের দুর্নীতি, পরিণামে তারেক জিয়ার অনুপস্থিতি, জামায়াতের সমস্যা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। আগামী তিন বছরে বিরোধী দলের সংকট বাড়বে বলেই মনে হয়। আওয়ামী লীগ (এবং এর সহযোগী দলগুলো) সেই তুলনায় ভালো অবস্থানে। একটু বিচক্ষণতা এবং প্রচুর সততা ও দক্ষতা দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করলে দলটির পক্ষে আগামী নির্বাচনে জয়লাভ করা সম্ভব। কিন্তু আমরা জানি, শক্তিশালী সরকারের স্বার্থে শক্তিশালী একটি বিরোধী দল প্রয়োজন। অথচ সরকারের ভেতরের কিছু মানুষ এ সত্যটি অস্বীকার অথবা অবহেলা করেন। তাঁরা ভাবেন, বিরোধী দলের হাত ক্রমাগত মুচড়ে দিলে তারা লাইনে থাকবে! তাদের ওপর ডেমোক্লিসের তলোয়ার ঝুলিয়ে রাখলে তারা হইচই করবে না। এ চিন্তা, বলাবাহুল্য, উপকারী নয়। দুর্বল বিরোধী দলের পক্ষে অপ্রত্যাশিতভাবে জনমত চলে যেতে পারে, তৃতীয় কোনো শক্তি দাঁড়িয়ে যেতে পারে। তা ছাড়া সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি তখন আসে সরকারি দলের ভেতর থেকেই। বিরোধী দল দুর্বল বলে নিজেরা বেপরোয়া হয়ে পড়ে। মানুষ তা অত্যন্ত অপছন্দ করে। নির্বাচনের দিন তারা তাদের অপছন্দের বিষয়টি চুপচাপ জানিয়ে দিয়ে আসে।
গত দুই বছর বিরোধী দল শুধু প্রতিবাদ করেছে, সরকারের বিপক্ষে একের পর এক অভিযোগ এনেছে, কিন্তু সংসদে যায়নি। আগামী তিন বছর যাতে তারা সংসদে থাকে, সে উদ্যোগ তাই সরকারকে নিতে হবে। বস্তুত, সরকারের অনেক সাফল্যের সঙ্গে বিরোধী দলের সঙ্গে সদাচরণও যুক্ত হতে পারত। হয়নি। কারণ, একেবারে গোড়াতে যখন বিরোধী দল সংসদের প্রথম সারিতে দুটি বেশি আসন চেয়েছিল, সরকার তা দেয়নি। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের আগে ঘোষণা দিয়েছিলেন, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হবেন। সরকার গঠনের পর সে প্রতিশ্রুতি থেকে তিনি সরে এসেছেন। শুরুতেই যে সংকট তৈরি হয়েছিল, তা নিরসনে স্পিকারও যথেষ্ট আন্তরিক ভূমিকা পালন করেননি—তিনি ব্যক্তিগতভাবে আন্তরিক হলেও তাঁর দলের হয়তো চাপ ছিল আসন না দিতে। ফলে, যে ফাটলটি একটুখানি সিমেন্ট দিয়ে বুজিয়ে ফেলা যেত, তা এখন মেরামতের অযোগ্য। আমি মনে করি, গত দুই বছরে সংসদ যে কার্যকর হয়নি, ‘গণতন্ত্রের প্রাণকেন্দ্র’ হিসেবে ভূমিকা পালন করেনি, তা ছিল আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্যই একটা বড় ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতার দায় সরকারের ওপর বর্তায়, বর্তায় বিরোধী দলের ওপরও। এ রকম ব্যর্থতা যখন দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে বাড়ে, যখন তাকে সামাল দেওয়া যায় না, তৃতীয় শক্তি তখনই মাঠে নেমে পড়ে। সেই অভিজ্ঞতার বেল আমাদের মতো ন্যাড়াদের মাথায় তো পড়েছে। তার পরও ব্যর্থতার বেলতলায় আমরা কেন যাব?
২.
সরকার কৃতিত্ব নিতে পারে কয়েকটি ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য। দেশের অর্থনীতির ভিতটি মজবুত হচ্ছে। সরকারের নীতি ও নানান পদক্ষেপ বিনিয়োগবান্ধব এবং শিল্পোৎসাহী প্রমাণিত হয়েছে। সারা দেশে এখন উদ্যোগমুখী নানা কর্মকাণ্ড চলছে, অনেক থ্রাস্ট আর গ্রোথ সেক্টরের আবির্ভাব হচ্ছে, ওষুধ থেকে নিয়ে জাহাজ-নির্মাণশিল্প—যেগুলো সরকারের কারণে তৈরি না হলেও সরকারের সহযোগিতায় বিকশিত হচ্ছে। বিদেশে বাংলাদেশি শ্রমিকেরা কাজে যাচ্ছেন। বিদেশ থেকে কাজ হারিয়ে দেশেও ফিরছেন। যাঁরা আসছেন, তাঁদের থেকে বেশিসংখ্যায় যাচ্ছেন—এটাই রক্ষা। বৈদেশিক কর্মসংস্থান একটি বিপজ্জনক ক্ষেত্র। এর ওঠানামা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তার পরও সরকার এ ক্ষেত্রে সক্রিয়তা দেখিয়েছে। খাদ্য ও কৃষিতে গত দুই বছর অনর্জন থেকে অর্জন বেশি। কৃষিপণ্য উৎপাদনে আমাদের সক্ষমতা দাতাদের বড় বড় কর্তা-বিশেষজ্ঞদের কপালে বিস্ময়ের দাগ ফেলেছে। বাংলাদেশের কৃষক এ দুই বছর আবারও প্রমাণ করেছেন, তাঁদের যৎসামান্য সার, সেচ, বীজ ও অন্যান্য উপকরণ দিলে তারা দুই হাত ভরে ফেরত দিতে পারেন। আমাদের ভাগ্য ভালো, সিডরের পর বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসেনি, বন্যাও হয়নি। আবার আমাদের মেধাবী বিজ্ঞানীরা উত্তরের মঙ্গা মোকাবিলার চেষ্টায় সফল হয়েছেন। কৃষিশিল্পের বিকাশ ঘটেছে। বিদেশে প্রচুর কৃষিশিল্প-পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। এ দুই বছর প্রচুর সাফল্য দেখিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। নতুন একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন, সংসদে পেশ ও পাস করা ছাড়াও বিনা মূল্যে বই তুলে দেওয়া হয়েছে সারা দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের হাতে; সমাপনী পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে মানসম্মত করার লক্ষ্যে একটি আইনও পাস হয়েছে। নারীশিক্ষায় অগ্রগতি হয়েছে, তবে নারীদের ওপর নতুন করে যেন সমাজের একটি অংশ হামলে পড়েছে। এই অংশটিকে আমরা বেশ আদর করে ‘বখাটে’ বলে ডাকা শুরু করেছি। এবং নারীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসকে ‘ইভ টিজিং’ নামের বেশ টিজিং বর্ণনায় বয়ান করতে শুরু করেছি। একসময় যা ছিল সন্ত্রাস—যেমন এসিড সন্ত্রাস—তা এখন টিজিংয়ের আওতায় চলে গেলে নারীরা আরও নিরাপত্তাহীনতার মুখে পড়বে। তবে সরকার এ ক্ষেত্রে শক্ত অবস্থানে ছিল। নতুন আইন হয়েছে। সরকার আরও শক্ত হলে এর প্রকোপ নিশ্চয় কমবে।
সরকারের সাফল্য ছিল বিদেশনীতিতে, প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে। ভারত ও চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক শীতল থাকলে ক্ষতি আমাদেরই। বিশ্বায়নের ফলে অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি এখন এমনি যে ঘরের দরজা-জানালা আটকে বসে থাকলে লাভ নেই। গত দুই বছরে প্রমাণিত হয়েছে, বাংলাদেশ এখন উড়াল দেওয়ার অবস্থানে চলে এসেছে। এখন ক্রিকেটে যেমন, অর্থনীতিতেও তেমনি—এ দেশ যেকোনো দেশের সঙ্গে লড়তে পারে। ফলে বড় এ দুই দেশের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতা আমাদের জন্যই মঙ্গলজনক। চীন গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনে আগ্রহী। নেপালের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করতে পারবে। ভারত এ প্রকল্পসহ এখন অনেক ক্ষেত্রেই সহযোগিতার মনোভাব দেখাচ্ছে এবং তা তার নিজের প্রয়োজনেই। গত দুই বছর সরকার বেশ সফলভাবেই বিশ্বায়নের এই প্রভাব দেশের অনুকূলে এনেছে। অথচ বিরোধী দল এখনো ‘প্রতিবেশী দেশ ফেনী পর্যন্ত নিয়ে নেবে’ গানটি গেয়েই যাচ্ছে। গত ২০ বছর বিএনপির এই গানটি একটি ভাঙা গ্রামোফোন রেকর্ড থেকে এক জায়গাতেই বেজে চলছে।
৩.
সরকারের আরও সাফল্য আছে, তবে এ লেখার উদ্দেশ্য সাফল্যের তালিকা তৈরি করা নয়। বরং সফলতার প্রবণতা ও পেছনের কারণগুলো চিহ্নিত করা। সফলতার একটি প্রবণতা হচ্ছে কথা থেকে বেশি কাজ। খুব ঘনিষ্ঠভাবে দেখার দরকার নেই—সাদা চোখেই দেখা যায়, যেসব ক্ষেত্রে সরকার সফল, সেসব ক্ষেত্রে সাফল্যের দাবিদার ব্যক্তিরা কথার চেয়ে কাজ বেশি করেছেন। শিক্ষা বা খাদ্যমন্ত্রীকে নিজেদের বিষয়ের বাইরে বক্তব্য রাখতে আমি কখনো দেখিনি, বিরোধী দলের মুণ্ডুপাত করতেও দেখিনি। তাঁরা চুপচাপ নিজের কাজ করেছেন। বিপরীতে যোগাযোগমন্ত্রী যত কথা বলেছেন, কাজ করেছেন তত কম। দুই দিন আগে রাতের ট্রেনে সিলেটে গেলাম। যেতে লাগল সাড়ে নয় ঘণ্টা। অথচ ২০ বছর আগে লাগত সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা। যে ট্রেনে গেলাম, নিঃসন্দেহে তা পৃথিবীর দরিদ্রতম, ট্রেন হতে পারে আমাদের জন্য সবচেয়ে আধুনিক, নিরাপদ, পর্যাপ্ত, ঈপ্সিত যোগাযোগব্যবস্থা। অথচ এটি এখন মৃত্যুমুখে পড়ে ধুঁকছে। গত দুই বছরে ট্রেনের আয়ু আরও কমেছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে কথা বেশি শুনছি। কাজ যা হওয়ার তা হচ্ছে প্রাইভেট সেক্টরে। কেন? এ জন্য শুধু গত জোট সরকারকে দুষলে কি হবে? যানজটের জন্য, দ্রব্যমূল্যের জন্য শুধু জোট সরকারের ভুলত্রুটি তুলে ধরলে কি মানুষ কষ্ট ভুলে যাবে?
সরকারের যেসব সাফল্য, তা এসেছে সেই পুরোনো, পরীক্ষিত একটি পথে, যে পথে কাজ বেশি, কথা কম। কাজটাও হতে হবে নিঃস্বার্থ। এখানে দেশের স্বার্থটাকেই দেখতে হবে একমাত্র। যেসব মন্ত্রীর নামে নানান অভিযোগ, তাঁদের মন্ত্রণালয়ের রেকর্ডের দিকে দেখুন, প্রমাণিত হবে, স্বার্থপরতার (নিজ বা দলীয়) সঙ্গে বিপরীত অনুপাতে জড়িত উন্নয়ন ও সাফল্য। যত স্বার্থ তত অসফলতা, যত নিঃস্বার্থতা তত সাফল্য।
সরকার আগামী তিন বছরের জন্য দুটি স্লোগান নিয়ে কাজে নামতে পারে—১. কথা কম, কাজ বেশি; এবং ২. যত নিঃস্বার্থতা তত সাফল্য।
সেদিন কাগজে দেখলাম, এক সাংসদ তাঁর ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে এক নির্বাহী প্রকৌশলীর ওপর হামলে পড়েছেন। প্রকৌশলী তাঁকে বা তাঁর ছেলেকে কাজ দেননি সেই রাগে। একসময় বাবারা ছেলেদের সঙ্গে নিয়ে ভালো কাজে যেতেন। এখন যান খারাপ কাজে। সরকার তাই আরেকটি স্লোগান দিতে পারে, ভালো কাজ করব সবাই মিলে।
৪.
বিরোধী দল নিজেদের যতই আলাদা ভাবুক সরকার থেকে, আমি সব সময় একে সরকারের অংশ হিসেবেই দেখি। আদর্শ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তা-ই হয়ে থাকে। বিরোধী দলের একটি ছায়া-সরকার থাকার কথা। নেই। বেগম জিয়াকে যে রকম দৃষ্টিকটুভাবে তাঁর ক্যান্টনমেন্টের বাসা থেকে বের করা হলো, তা থেকে দেশবাসীর সহানুভূতি দলটি ভালোভাবে আদায় করে নিতে পারত। পারেনি ঈদের ঠিক আগে অপরিণামদর্শী এক হরতাল ডাকার কারণে। এটি দায়িত্বশীলতার পরিচায়ক হয়নি। বিরোধী দলকে ভাবতে হবে, তারা বিকল্প সরকার, এবং তা ভেবে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে মানুষের অধিকার সংরক্ষণে ভূমিকা রাখতে হবে।
৫.
সরকার দুই বছর মোটামুটি ভালোই করেছে বলে আমার মনে হয়েছে। তবে ভবিষ্যতে আরও ভালো আশা করি। সরকারের প্রধান যে শক্তি তা হচ্ছে বর্তমান সময়; এবং এর প্রতি তারুণ্যের সমর্থন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে প্রবল জনসমর্থন রয়েছে, হরতালের বিপক্ষে জনমত রয়েছে। তেমনি সরকার ক্ষমতায় আছে এমন একটি সময়ে যখন দেশটি উড়ালের অপেক্ষায়। এই সময়ের ডাইনামিকস সরকারের সঙ্গে গেছে। এখন কাজে নামতে হবে। দুর্নীতি তাড়াতে হবে নিজের গা থেকে। সহযোগী সংগঠনগুলোকে কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সরকারকে আরও সহিষ্ণু হতে হবে। সর্বোপরি, ওপরের তিনটি স্লোগান কণ্ঠে নিয়ে চললে আগামী বছর এর সফলতার তালিকাটি আরও বড় হবে নিঃসন্দেহে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আমাদের দুই দশকের গণতন্ত্রী অধ্যায়ে একটি বিষয় এখন স্বীকৃত এবং তা হচ্ছে জাতীয় নির্বাচনে সরকারি দলের পরাজয়ের মূলে যতটা না বিরোধী দলের ভূমিকা থাকে, তার চেয়ে বেশি থাকে সরকারি দলের নিজের। অর্থাৎ, বিরোধী দল শক্তিশালী, সুসংগঠিত এবং পরিবর্তন-সক্ষম একটি শক্তি হিসেবে পাঁচ বছর ধরে কার্যকর থাকে না। অন্যদিকে সরকারি দলের ভেতর কোন্দল, ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতি তাকে অজনপ্রিয় করে তোলে। এটি নিশ্চিতভাবেই খারাপ একটি প্রবণতা। হতাশাজনকও। এ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের দুই বছরের মধ্যে এই প্রবণতার প্রতিফলন চোখে পড়ছে। সরকারি দলের সহযোগী সংগঠনগুলো টেন্ডার ও নানাবিধ দখলপ্রক্রিয়ায় যুক্ত হচ্ছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
প্রথম আলোর জরিপমতে, দুই বছরে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা যে প্রায় ১১ শতাংশ কমেছে, তার প্রধান কারণ সরকারি দলের সহযোগী সংগঠনগুলোর বেপরোয়া আচরণ। তবে বিরোধী দলের সমর্থন যে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়েনি, এখনই নির্বাচন হলে দলটি যে তার সহযোগীদের নিয়ে ক্ষমতায় যেতে পারবে না, তার কারণ এর সাংগঠনিক দুর্বলতা, এর ভেতরে নেতৃত্বের কোন্দল ও অনৈক্য এবং এর পশ্চাৎপদ নীতি ও পন্থাসমূহ। দুটি দলের জন্যই এই জরিপ জেগে ওঠার, নতুনভাবে নিজেদের মূল্যায়নের এবং বাকি তিন বছর সুচারুভাবে ঘর গোছানোর আহ্বান। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, এ রকম আহ্বান উপেক্ষিতই থেকে যায়, ১০টায় অফিসে পৌঁছানোর জন্য সাতটায় ঘড়িতে অ্যালার্ম বাজার পর কেরানি সাহেব যদি ঘড়িটার টুঁটি চেপে আবার ঘুমাতে যান, তাঁর যে সমস্যা হবে, দলগুলোরও তা-ই হবে। কিন্তু এর পরিণাম, আবারও আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, হচ্ছে নতুন সংকট, অরাজকতা।
গত দুই বছর সরকারকে শক্তিশালী কোনো বিরোধী দলকে মোকাবিলা করতে হয়নি—না সংসদে, না রাস্তায়। বিরোধী দল (অর্থাৎ বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী) ১/১১-এর পর থেকে ক্রমাগত দুর্বল হয়েছে, এর নৈতিক অবস্থান নড়বড়ে হয়েছে। বিএনপির সমস্যা হাওয়া ভবনের দুর্নীতি, পরিণামে তারেক জিয়ার অনুপস্থিতি, জামায়াতের সমস্যা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। আগামী তিন বছরে বিরোধী দলের সংকট বাড়বে বলেই মনে হয়। আওয়ামী লীগ (এবং এর সহযোগী দলগুলো) সেই তুলনায় ভালো অবস্থানে। একটু বিচক্ষণতা এবং প্রচুর সততা ও দক্ষতা দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করলে দলটির পক্ষে আগামী নির্বাচনে জয়লাভ করা সম্ভব। কিন্তু আমরা জানি, শক্তিশালী সরকারের স্বার্থে শক্তিশালী একটি বিরোধী দল প্রয়োজন। অথচ সরকারের ভেতরের কিছু মানুষ এ সত্যটি অস্বীকার অথবা অবহেলা করেন। তাঁরা ভাবেন, বিরোধী দলের হাত ক্রমাগত মুচড়ে দিলে তারা লাইনে থাকবে! তাদের ওপর ডেমোক্লিসের তলোয়ার ঝুলিয়ে রাখলে তারা হইচই করবে না। এ চিন্তা, বলাবাহুল্য, উপকারী নয়। দুর্বল বিরোধী দলের পক্ষে অপ্রত্যাশিতভাবে জনমত চলে যেতে পারে, তৃতীয় কোনো শক্তি দাঁড়িয়ে যেতে পারে। তা ছাড়া সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি তখন আসে সরকারি দলের ভেতর থেকেই। বিরোধী দল দুর্বল বলে নিজেরা বেপরোয়া হয়ে পড়ে। মানুষ তা অত্যন্ত অপছন্দ করে। নির্বাচনের দিন তারা তাদের অপছন্দের বিষয়টি চুপচাপ জানিয়ে দিয়ে আসে।
গত দুই বছর বিরোধী দল শুধু প্রতিবাদ করেছে, সরকারের বিপক্ষে একের পর এক অভিযোগ এনেছে, কিন্তু সংসদে যায়নি। আগামী তিন বছর যাতে তারা সংসদে থাকে, সে উদ্যোগ তাই সরকারকে নিতে হবে। বস্তুত, সরকারের অনেক সাফল্যের সঙ্গে বিরোধী দলের সঙ্গে সদাচরণও যুক্ত হতে পারত। হয়নি। কারণ, একেবারে গোড়াতে যখন বিরোধী দল সংসদের প্রথম সারিতে দুটি বেশি আসন চেয়েছিল, সরকার তা দেয়নি। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের আগে ঘোষণা দিয়েছিলেন, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হবেন। সরকার গঠনের পর সে প্রতিশ্রুতি থেকে তিনি সরে এসেছেন। শুরুতেই যে সংকট তৈরি হয়েছিল, তা নিরসনে স্পিকারও যথেষ্ট আন্তরিক ভূমিকা পালন করেননি—তিনি ব্যক্তিগতভাবে আন্তরিক হলেও তাঁর দলের হয়তো চাপ ছিল আসন না দিতে। ফলে, যে ফাটলটি একটুখানি সিমেন্ট দিয়ে বুজিয়ে ফেলা যেত, তা এখন মেরামতের অযোগ্য। আমি মনে করি, গত দুই বছরে সংসদ যে কার্যকর হয়নি, ‘গণতন্ত্রের প্রাণকেন্দ্র’ হিসেবে ভূমিকা পালন করেনি, তা ছিল আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্যই একটা বড় ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতার দায় সরকারের ওপর বর্তায়, বর্তায় বিরোধী দলের ওপরও। এ রকম ব্যর্থতা যখন দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে বাড়ে, যখন তাকে সামাল দেওয়া যায় না, তৃতীয় শক্তি তখনই মাঠে নেমে পড়ে। সেই অভিজ্ঞতার বেল আমাদের মতো ন্যাড়াদের মাথায় তো পড়েছে। তার পরও ব্যর্থতার বেলতলায় আমরা কেন যাব?
২.
সরকার কৃতিত্ব নিতে পারে কয়েকটি ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য। দেশের অর্থনীতির ভিতটি মজবুত হচ্ছে। সরকারের নীতি ও নানান পদক্ষেপ বিনিয়োগবান্ধব এবং শিল্পোৎসাহী প্রমাণিত হয়েছে। সারা দেশে এখন উদ্যোগমুখী নানা কর্মকাণ্ড চলছে, অনেক থ্রাস্ট আর গ্রোথ সেক্টরের আবির্ভাব হচ্ছে, ওষুধ থেকে নিয়ে জাহাজ-নির্মাণশিল্প—যেগুলো সরকারের কারণে তৈরি না হলেও সরকারের সহযোগিতায় বিকশিত হচ্ছে। বিদেশে বাংলাদেশি শ্রমিকেরা কাজে যাচ্ছেন। বিদেশ থেকে কাজ হারিয়ে দেশেও ফিরছেন। যাঁরা আসছেন, তাঁদের থেকে বেশিসংখ্যায় যাচ্ছেন—এটাই রক্ষা। বৈদেশিক কর্মসংস্থান একটি বিপজ্জনক ক্ষেত্র। এর ওঠানামা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তার পরও সরকার এ ক্ষেত্রে সক্রিয়তা দেখিয়েছে। খাদ্য ও কৃষিতে গত দুই বছর অনর্জন থেকে অর্জন বেশি। কৃষিপণ্য উৎপাদনে আমাদের সক্ষমতা দাতাদের বড় বড় কর্তা-বিশেষজ্ঞদের কপালে বিস্ময়ের দাগ ফেলেছে। বাংলাদেশের কৃষক এ দুই বছর আবারও প্রমাণ করেছেন, তাঁদের যৎসামান্য সার, সেচ, বীজ ও অন্যান্য উপকরণ দিলে তারা দুই হাত ভরে ফেরত দিতে পারেন। আমাদের ভাগ্য ভালো, সিডরের পর বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসেনি, বন্যাও হয়নি। আবার আমাদের মেধাবী বিজ্ঞানীরা উত্তরের মঙ্গা মোকাবিলার চেষ্টায় সফল হয়েছেন। কৃষিশিল্পের বিকাশ ঘটেছে। বিদেশে প্রচুর কৃষিশিল্প-পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। এ দুই বছর প্রচুর সাফল্য দেখিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। নতুন একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন, সংসদে পেশ ও পাস করা ছাড়াও বিনা মূল্যে বই তুলে দেওয়া হয়েছে সারা দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের হাতে; সমাপনী পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে মানসম্মত করার লক্ষ্যে একটি আইনও পাস হয়েছে। নারীশিক্ষায় অগ্রগতি হয়েছে, তবে নারীদের ওপর নতুন করে যেন সমাজের একটি অংশ হামলে পড়েছে। এই অংশটিকে আমরা বেশ আদর করে ‘বখাটে’ বলে ডাকা শুরু করেছি। এবং নারীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসকে ‘ইভ টিজিং’ নামের বেশ টিজিং বর্ণনায় বয়ান করতে শুরু করেছি। একসময় যা ছিল সন্ত্রাস—যেমন এসিড সন্ত্রাস—তা এখন টিজিংয়ের আওতায় চলে গেলে নারীরা আরও নিরাপত্তাহীনতার মুখে পড়বে। তবে সরকার এ ক্ষেত্রে শক্ত অবস্থানে ছিল। নতুন আইন হয়েছে। সরকার আরও শক্ত হলে এর প্রকোপ নিশ্চয় কমবে।
সরকারের সাফল্য ছিল বিদেশনীতিতে, প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে। ভারত ও চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক শীতল থাকলে ক্ষতি আমাদেরই। বিশ্বায়নের ফলে অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি এখন এমনি যে ঘরের দরজা-জানালা আটকে বসে থাকলে লাভ নেই। গত দুই বছরে প্রমাণিত হয়েছে, বাংলাদেশ এখন উড়াল দেওয়ার অবস্থানে চলে এসেছে। এখন ক্রিকেটে যেমন, অর্থনীতিতেও তেমনি—এ দেশ যেকোনো দেশের সঙ্গে লড়তে পারে। ফলে বড় এ দুই দেশের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতা আমাদের জন্যই মঙ্গলজনক। চীন গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনে আগ্রহী। নেপালের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করতে পারবে। ভারত এ প্রকল্পসহ এখন অনেক ক্ষেত্রেই সহযোগিতার মনোভাব দেখাচ্ছে এবং তা তার নিজের প্রয়োজনেই। গত দুই বছর সরকার বেশ সফলভাবেই বিশ্বায়নের এই প্রভাব দেশের অনুকূলে এনেছে। অথচ বিরোধী দল এখনো ‘প্রতিবেশী দেশ ফেনী পর্যন্ত নিয়ে নেবে’ গানটি গেয়েই যাচ্ছে। গত ২০ বছর বিএনপির এই গানটি একটি ভাঙা গ্রামোফোন রেকর্ড থেকে এক জায়গাতেই বেজে চলছে।
৩.
সরকারের আরও সাফল্য আছে, তবে এ লেখার উদ্দেশ্য সাফল্যের তালিকা তৈরি করা নয়। বরং সফলতার প্রবণতা ও পেছনের কারণগুলো চিহ্নিত করা। সফলতার একটি প্রবণতা হচ্ছে কথা থেকে বেশি কাজ। খুব ঘনিষ্ঠভাবে দেখার দরকার নেই—সাদা চোখেই দেখা যায়, যেসব ক্ষেত্রে সরকার সফল, সেসব ক্ষেত্রে সাফল্যের দাবিদার ব্যক্তিরা কথার চেয়ে কাজ বেশি করেছেন। শিক্ষা বা খাদ্যমন্ত্রীকে নিজেদের বিষয়ের বাইরে বক্তব্য রাখতে আমি কখনো দেখিনি, বিরোধী দলের মুণ্ডুপাত করতেও দেখিনি। তাঁরা চুপচাপ নিজের কাজ করেছেন। বিপরীতে যোগাযোগমন্ত্রী যত কথা বলেছেন, কাজ করেছেন তত কম। দুই দিন আগে রাতের ট্রেনে সিলেটে গেলাম। যেতে লাগল সাড়ে নয় ঘণ্টা। অথচ ২০ বছর আগে লাগত সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা। যে ট্রেনে গেলাম, নিঃসন্দেহে তা পৃথিবীর দরিদ্রতম, ট্রেন হতে পারে আমাদের জন্য সবচেয়ে আধুনিক, নিরাপদ, পর্যাপ্ত, ঈপ্সিত যোগাযোগব্যবস্থা। অথচ এটি এখন মৃত্যুমুখে পড়ে ধুঁকছে। গত দুই বছরে ট্রেনের আয়ু আরও কমেছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে কথা বেশি শুনছি। কাজ যা হওয়ার তা হচ্ছে প্রাইভেট সেক্টরে। কেন? এ জন্য শুধু গত জোট সরকারকে দুষলে কি হবে? যানজটের জন্য, দ্রব্যমূল্যের জন্য শুধু জোট সরকারের ভুলত্রুটি তুলে ধরলে কি মানুষ কষ্ট ভুলে যাবে?
সরকারের যেসব সাফল্য, তা এসেছে সেই পুরোনো, পরীক্ষিত একটি পথে, যে পথে কাজ বেশি, কথা কম। কাজটাও হতে হবে নিঃস্বার্থ। এখানে দেশের স্বার্থটাকেই দেখতে হবে একমাত্র। যেসব মন্ত্রীর নামে নানান অভিযোগ, তাঁদের মন্ত্রণালয়ের রেকর্ডের দিকে দেখুন, প্রমাণিত হবে, স্বার্থপরতার (নিজ বা দলীয়) সঙ্গে বিপরীত অনুপাতে জড়িত উন্নয়ন ও সাফল্য। যত স্বার্থ তত অসফলতা, যত নিঃস্বার্থতা তত সাফল্য।
সরকার আগামী তিন বছরের জন্য দুটি স্লোগান নিয়ে কাজে নামতে পারে—১. কথা কম, কাজ বেশি; এবং ২. যত নিঃস্বার্থতা তত সাফল্য।
সেদিন কাগজে দেখলাম, এক সাংসদ তাঁর ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে এক নির্বাহী প্রকৌশলীর ওপর হামলে পড়েছেন। প্রকৌশলী তাঁকে বা তাঁর ছেলেকে কাজ দেননি সেই রাগে। একসময় বাবারা ছেলেদের সঙ্গে নিয়ে ভালো কাজে যেতেন। এখন যান খারাপ কাজে। সরকার তাই আরেকটি স্লোগান দিতে পারে, ভালো কাজ করব সবাই মিলে।
৪.
বিরোধী দল নিজেদের যতই আলাদা ভাবুক সরকার থেকে, আমি সব সময় একে সরকারের অংশ হিসেবেই দেখি। আদর্শ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তা-ই হয়ে থাকে। বিরোধী দলের একটি ছায়া-সরকার থাকার কথা। নেই। বেগম জিয়াকে যে রকম দৃষ্টিকটুভাবে তাঁর ক্যান্টনমেন্টের বাসা থেকে বের করা হলো, তা থেকে দেশবাসীর সহানুভূতি দলটি ভালোভাবে আদায় করে নিতে পারত। পারেনি ঈদের ঠিক আগে অপরিণামদর্শী এক হরতাল ডাকার কারণে। এটি দায়িত্বশীলতার পরিচায়ক হয়নি। বিরোধী দলকে ভাবতে হবে, তারা বিকল্প সরকার, এবং তা ভেবে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে মানুষের অধিকার সংরক্ষণে ভূমিকা রাখতে হবে।
৫.
সরকার দুই বছর মোটামুটি ভালোই করেছে বলে আমার মনে হয়েছে। তবে ভবিষ্যতে আরও ভালো আশা করি। সরকারের প্রধান যে শক্তি তা হচ্ছে বর্তমান সময়; এবং এর প্রতি তারুণ্যের সমর্থন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে প্রবল জনসমর্থন রয়েছে, হরতালের বিপক্ষে জনমত রয়েছে। তেমনি সরকার ক্ষমতায় আছে এমন একটি সময়ে যখন দেশটি উড়ালের অপেক্ষায়। এই সময়ের ডাইনামিকস সরকারের সঙ্গে গেছে। এখন কাজে নামতে হবে। দুর্নীতি তাড়াতে হবে নিজের গা থেকে। সহযোগী সংগঠনগুলোকে কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সরকারকে আরও সহিষ্ণু হতে হবে। সর্বোপরি, ওপরের তিনটি স্লোগান কণ্ঠে নিয়ে চললে আগামী বছর এর সফলতার তালিকাটি আরও বড় হবে নিঃসন্দেহে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments