সংসদকে কার্যকর করার দায়িত্বটি কার by ড.তারেক শামসুর রেহমান
দীর্ঘ ৬৪ দিন সংসদীয় কার্যক্রমে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকার পর গেল বৃহস্পতিবার বিএনপি সংসদে যোগ দিয়ে সংসদকে কার্যকর করার যে উদ্যোগ নিয়েছিল, সে উদ্যোগটি ভেস্তে গেল তাদের ওয়াকআউটের মধ্য দিয়ে। এখন বিএনপি আবার কবে নাগাদ সংসদে ফিরে যাবে, এটাও একটা প্রশ্ন।
বিএনপির সংসদীয় দলের নেতারা প্রেস ব্রিফিং করে জানিয়েছেন, পরে তারা সভা করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। স্বভাবতই যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দেয়, তা হচ্ছে বিএনপি কেন ওয়াকআউট করল এবং সংসদকে কার্যকর করার দায়িত্বটি কার? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৩০০ বিধিতে একটি বক্তব্য দিয়েছেন। তারপর বিএনপির সংসদ সদস্যরা বক্তব্য রাখতে চাইলে স্পিকার তাদের ফ্লোর দেননি। ফলে তারা ওয়াকআউট করেন। স্পিকার জানিয়েছিলেন, ৩০০ বিধির পর পয়েন্ট অব অর্ডারে ফ্লোর দেয়ার কোনো বিধান নেই। কিন্তু ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে : বিবৃতিদানকালে (মন্ত্রীর) কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। পরে প্রশ্ন করা যাবে। এখানে স্পিকার মহোদয়ের বক্তব্য ও বিরোধী দলের এমপির বক্তব্য পরস্পরবিরোধী হলেও, বাস্তবতা যা তা হচ্ছে মন্ত্রী যখন জিয়াউর রহমানকে ‘খুনি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন, তখন বিরোধী দল এর ব্যাখ্যা দেবে, এটাই স্বাভাবিক, তাদের সেই বক্তব্য রাখার সুযোগ দেয়া উচিত ছিল। স্পিকার তা দেননি। অথচ স্পিকার সবাইকে সংযত ভাষায় কথা বলার আহ্বান জানিয়েছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বয়সে সিনিয়র হলেও, প্রথমবারের মতো সংসদে এসেছেন। তিনি হয়তো জানেনই না, ‘পল্টন ময়দানের’ ভাষা আর সংসদের ভাষা এক নয়। পল্টনে যে ভাষায় কথা বলে জনগণকে উত্তেজিত করা যায়, সংসদে সে ভাষা ব্যবহার করা যায় না। কিছুদিন আগে ঢাকায় এমপিদের প্রশিক্ষণ দিতে এসে ভারতের লোকসভার সাবেক স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ও বলেছিলেন সে কথা—জনসভার ভাষা আর সংসদের ভাষা এক নয়। কিন্তু ‘নবীন সংসদ সদস্য’ সাহারা খাতুন সংসদে ‘পল্টনী ভাষায়’ কথা বললেন। ৩০০ বিধি ব্যবহার করলেন দলীয় স্বার্থে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে বললেন ‘খুনি’। আওয়ামী লীগের কিশোরগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি স্পিকার আবদুল হামিদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ওই বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করলেন না। সুতরাং যা হওয়ার তাই হলো। বিরোধী দল সংসদ থেকে ওয়াকআউট করল। সংসদ আবারও হয়ে পড়ল একদলীয়।
বিএনপি যখন সংসদে গেল, তখন প্রত্যাশা ছিল সবার যে সংসদ কার্যকর হবে। সরকারি দলের এমপিরা তাদের ‘যুদ্ধংদেহী’ মনোভাব পরিহার করবেন। সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে সংসদীয় গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার প্রশ্নে এক ধরনের সহাবস্থানের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এই সহাবস্থান বার বার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দাতা গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির এই দিকটি উন্মোচিত করছেন বারবার। তারা বারবার বলছেন, একটি সমঝোতা দরকার সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে। কিন্তু সেই সমঝোতাটি হচ্ছে না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দ্বিদলীয় রাজনীতির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একদিকে আওয়ামী লীগ, অন্যদিকে বিএনপি। একবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে, পরের বার বিএনপি ক্ষমতায় আসে। যদিও এককভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার কর্তৃত্ব দুটো দলই হারিয়েছে। দুটো দলের নেতৃত্বেই গঠিত হয়েছে দুটো জোট। তৃতীয় একটি জোটের কথা বারবার বলা হলেও এই তৃতীয় জোট গঠিত হয়নি। এমনকি ‘ওয়ান ইলেভেন’-এর পর তৃতীয় একটি দল বা ওই দলের নেতৃত্বে একটি জোটকে ক্ষমতায় বসানোর পরিকল্পনা কেউ কেউ করলেও বাস্তবতা বলে, জনগণ বড় দুটো দলের প্রতিই তাদের আস্থা রেখেছে। যদিও বিএনপির নির্বাচনে পরাজয় নিয়ে নানা কথা রয়েছে এবং সে কথাটা বিএনপির নেতৃবৃন্দ প্রকাশ্যেই বলছেন। নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়েছে। এর অর্থ ভোটাররা পরিবর্তন চেয়েছিল কি-না, তা অমীমাংসিতই রয়ে গেল। কিন্তু যে বিষয়টি আমরা প্রায়ই ভুলে যাই তা হচ্ছে, বিজিত দল নির্বাচনে হেরে গেলেও ভোটারদের একটা অংশের সমর্থন এখনও রয়েছে। পরিসংখ্যান বলে, ১৯৯১ সালে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর পর (সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরে আসা) বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক ধারা প্রবর্তন হয়েছে, তাতে ওই দুটো বড় দল ভোটারদের প্রায় ৮০ ভাগ এখন নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থাত্ যে ভোট পড়ে, তার প্রায় ৮০ ভাগ এ দুটো দল ভাগ করে নেয়। বাকি ২০ ভাগ ছোট দলগুলো পায়। একটি পরিসংখ্যান দিচ্ছি। ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রাপ্ত ভোটের পরিসংখ্যান ছিল ৩০.৮১ ভাগ, আর আওয়ামী লীগের ৩০.০৮ ভাগ। ১৯৯৬ সালে এটা পরিবর্তিত হয়ে আওয়ামী লীগ পায় ৩৭.৪৪ ভাগ আর বিএনপি পায় ৩৩.৬১ ভাগ। ২০০১ সালে বিএনপি পায় ৪০.৯৭ ভাগ আর আওয়ামী লীগ পায় ৪০.১৩ ভাগ। মনে রাখতে হবে, আজকের বিএনপির যে অবস্থা, ২০০১ সালে আওয়ামী লীগেরও একই পরিস্থিতি হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ভোট পেয়েছিল ৪০.১৩ ভাগ, কিন্তু আসন ছিল মাত্র ৬২টি। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের সর্বশেষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভোট প্রাপ্তি ৪৮.০৬ ভাগ, আর বিএনপির ভোট প্রাপ্তি ৩২.৪৫ ভাগ। যদিও বিএনপির আসন অনেক কম এখন। আমাদের দুর্ভাগ্য এটাই, যে দল ক্ষমতায় যায় সেই দল বিজিত দলকে অবজ্ঞা করে। এটাকে কোনো অবস্থাতেই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বলা যাবে না। সরকার ও বিরোধী দলকে নিয়ে যে যৌথ প্রয়াস, তাকেই বলে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। তাই সমঝোতার কথা যখন ওঠে, তখন সমঝোতা বলতে ওই বিরোধী দলকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টাকেই বোঝায়। আমরা বাংলাদেশের বিকাশমান গণতন্ত্রকে যদি উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই, তাহলে এই যৌথ প্রয়াস ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। বিরোধী দলকে আমরা আস্থায় নেই না বলেই বিপত্তি ঘটে। সংসদ বয়কট হয়। হরতাল আহ্বান করা হয়। অতীতে লাগাতার সংসদ বয়কটের সংস্কৃতি বিকাশমান গণতন্ত্রকে একটি ঝুঁকির মাঝে ঠেলে দিয়েছিল। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যকার আস্থার অভাব ও ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি যে ষড়যন্ত্রের বীজ রোপিত হয়েছিল, এটা কি আমরা অস্বীকার করতে পারি?
সরকারকে আজ যেমনি বিরোধী দলকে আস্থায় নিতে হবে, ঠিক তেমনি বিরোধী দলকেও সরকারের সঙ্গে একটি সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। আমরা বারবার বলে আসছি—সংসদে বিরোধী দলের যত কম আসনই হোক, তাদের বেশি সময় দিতে হবে। তাদের কথা বেশি শুনতে হবে। তাদের প্রস্তাবাবলি বিবেচনায় নিতে হবে বেশি করে। কিন্তু এই কাজটি হয় না। আমাদের গণতন্ত্রের ব্যর্থতা এখানেই। সরকারি দলের বেশকিছু সংসদ সদস্য রয়েছেন যারা সুযোগ পেলেই বিরোধী দলকে কটূক্তি করে বক্তব্য রাখেন। সুযোগ পেলেই অতীত টেনে আনেন। সুযোগ পেলেই দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পুরো বিষয়টি বিশ্লেষণ করেন। এতে করে সৃষ্টি হয় আস্থার সঙ্কট, সৃষ্টি হয় বিরোধিতা, সৃষ্টি হয় সংসদ বয়কটের মতো ঘটনা। এই মানসিকতা যদি পরিত্যাগ করা না যায়, তাহলে এদেশে গণতন্ত্র বিকশিত হবে না সঠিক অর্থে। মানুষ ভোট দেবে। একটি দলের ব্যর্থতায় জনগণ হতাশাগ্রস্ত হয়ে অন্য দলকে ভোট দেবে। তাদের ক্ষমতায় নিয়ে আসবে। এটাই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। গণতন্ত্র এ কথাটাই আমাদের শেখায়। আমরা এই গণতন্ত্রই বির্নিমাণ করতে চেয়েছি। স্বাধীনতার প্রায় ৪০ বছর হতে যাচ্ছে। সময়টা একেবারে কম নয়। অথচ বেশকিছু ইস্যুতে জাতি এখনও দ্বিধাবিভক্ত। ২০০৯ সালের ক্ষমতার পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে সবকিছু। বদলে গেছে নাম। নতুন করে নামকরণ শুরু হয়েছে। শুরু হয়েছে নগ্ন দলীয়করণ। এই বৃত্ত আমরা ভাঙতে পারছি না। আরও একটা কথা। সংবিধানের ৭০ নং অনুচ্ছেদটিতেও কিছু কিছু সংস্কার প্রয়োজন। এই অনুচ্ছেদটির কারণে একজন সংসদ সদস্য দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারেন না। ৭০ নং অনুচ্ছেদটির প্রয়োজন রয়েছে। না হলে সংসদে হর্স ট্রেডিং হবে। সংসদ সদস্যরা বিকিকিনির শিকার হবেন। যে দলের হাতে প্রচুর টাকা রয়েছে, তারা অপর দল থেকে সংসদ সদস্যদের ভাগিয়ে নিয়ে এসে সরকার গঠন করবে। এজন্যই ৭০ নং অনুচ্ছেদটি একটি রক্ষাকবচ। তবে এই অনুচ্ছেদটির সংস্কার প্রয়োজন। যুগের চাহিদার প্রতি সম্মান দেখিয়ে এই ধারায় কিছু কিছু পরিবর্তন আনা যায়। তাতে করে সংসদ সদস্যদের অধিকার কিছুটা হলেও রক্ষিত হবে। আমি বিশ্বাস করতে চাই, আওয়ামী লীগের মাঝে বেশকিছু শুভবুদ্ধির মানুষ রয়েছেন, যারা চান বিরোধী দল সংসদে থাকুক। কিন্তু কঠিন দলীয় আনুগত্য, নেত্রীর আস্থাহীনতার ভয়ে তাদের করার কিছুই থাকে না শুধু সংসদে ‘হাত তোলা’ ছাড়া।
আজ শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে মন্তব্য করেছেন, তার জবাব দেয়ার ভাষা আমার জানা নেই। এভাবে একজন জাতীয় পর্যায়ের নেতাকে নিয়ে কটূক্তি করা শুধু দৃষ্টিকটূই নয়, বরং এক ধরনের পাপ। স্পিকার যদি তার ক্ষমতাবলে ওই বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করেন, আমি খুশি হব। তিনি সংসদের অভিভাবক হিসেবে এ কাজটি করতে পারেন। কিন্তু তিনি যদি দলীয় আনুগত্যে বাঁধা থাকেন, তাহলে তিনি করবেন না, এটাই স্বাভাবিক। স্পিকার একজন অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান। ১৯৭৩ থেকে ২০০৮ সাল—৯টি সংসদ নির্বাচনের মধ্যে ৭টিতেই তিনি বিজয়ী হয়েছেন। আমরা তাকে ‘কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা’ হিসেবে দেখতে চাই না, দেখতে চাই সংসদের অভিভাবক হিসেবে। তার একটি সিদ্ধান্ত বিএনপি তথা চারদলীয় জোটকে পুনরায় সংসদে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। আজ সংসদে অনেক কথা বলার আছে। বিশেষ করে তথাকথিত ছাত্র রাজনীতির নামে যেভাবে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিদিন লাশ পড়ছে, তাতে করে আমরা আতঙ্কিত উচ্চ শিক্ষার ভবিষ্যত্ নিয়ে। এ নিয়ে সংসদে আলোচনা হওয়া উচিত এবং একটি সিদ্ধান্তে আসা উচিত। দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সঠিকভাবে মন্ত্রণালয় পরিচালনা করতে পারছেন বলে মনে হয় না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘোষণার পরপরই যখন শিবগঞ্জের ধাইনগর ইউনিয়নের চৈতন্যপুর গ্রামে শিবির কর্মী শাহীনকে গুলি করে হত্যা করা হয়, তখন সংসদে ওই বিষয়টি আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। শাহীন অভিযুক্ত হতে পারেন। কিন্তু তিনি দোষী কি-না, তার বিচার হয়নি। বিচারের আগেই হত্যা করা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, বিশেষ করে চালের ক্রয়মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। প্রধানমন্ত্রী অতীতে বারবার তথাকথিত ‘সিন্ডিকেটের’ কথা বলতেন। এখন সরকারি গুদামে প্রচুর চাল মজুত থাকা সত্ত্বেও চালের দাম বাড়লো কেন? এর কী জবাব দেবেন প্রধানমন্ত্রী? আমরা চাইব সংসদে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হোক। আলোচনা হোক প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর ও স্বাক্ষরিত ৩টি চুক্তি, সমঝোতা স্মারক ও যৌথ বিবৃতির বক্তব্য নিয়ে। বিএনপির সংসদে ফিরে আসার মধ্য দিয়ে একটা সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছিল। এখন আবার তা হতাশার কালোছায়ায় ঢেকে গেল। সরকারি দলকেই এখন উদ্যোগ নিতে হবে বিএনপিকে ফিরিয়ে আনতে। না হলে মানুষ মনে করবে, আওয়ামী লীগ একদলীয় সংসদ চায়। চায় না বিএনপি সংসদে ফিরে আসুক।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ই-মেইল : tsrahmanbd@yahoo.com
বিএনপি যখন সংসদে গেল, তখন প্রত্যাশা ছিল সবার যে সংসদ কার্যকর হবে। সরকারি দলের এমপিরা তাদের ‘যুদ্ধংদেহী’ মনোভাব পরিহার করবেন। সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে সংসদীয় গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার প্রশ্নে এক ধরনের সহাবস্থানের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এই সহাবস্থান বার বার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দাতা গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির এই দিকটি উন্মোচিত করছেন বারবার। তারা বারবার বলছেন, একটি সমঝোতা দরকার সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে। কিন্তু সেই সমঝোতাটি হচ্ছে না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দ্বিদলীয় রাজনীতির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একদিকে আওয়ামী লীগ, অন্যদিকে বিএনপি। একবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে, পরের বার বিএনপি ক্ষমতায় আসে। যদিও এককভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার কর্তৃত্ব দুটো দলই হারিয়েছে। দুটো দলের নেতৃত্বেই গঠিত হয়েছে দুটো জোট। তৃতীয় একটি জোটের কথা বারবার বলা হলেও এই তৃতীয় জোট গঠিত হয়নি। এমনকি ‘ওয়ান ইলেভেন’-এর পর তৃতীয় একটি দল বা ওই দলের নেতৃত্বে একটি জোটকে ক্ষমতায় বসানোর পরিকল্পনা কেউ কেউ করলেও বাস্তবতা বলে, জনগণ বড় দুটো দলের প্রতিই তাদের আস্থা রেখেছে। যদিও বিএনপির নির্বাচনে পরাজয় নিয়ে নানা কথা রয়েছে এবং সে কথাটা বিএনপির নেতৃবৃন্দ প্রকাশ্যেই বলছেন। নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়েছে। এর অর্থ ভোটাররা পরিবর্তন চেয়েছিল কি-না, তা অমীমাংসিতই রয়ে গেল। কিন্তু যে বিষয়টি আমরা প্রায়ই ভুলে যাই তা হচ্ছে, বিজিত দল নির্বাচনে হেরে গেলেও ভোটারদের একটা অংশের সমর্থন এখনও রয়েছে। পরিসংখ্যান বলে, ১৯৯১ সালে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর পর (সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরে আসা) বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক ধারা প্রবর্তন হয়েছে, তাতে ওই দুটো বড় দল ভোটারদের প্রায় ৮০ ভাগ এখন নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থাত্ যে ভোট পড়ে, তার প্রায় ৮০ ভাগ এ দুটো দল ভাগ করে নেয়। বাকি ২০ ভাগ ছোট দলগুলো পায়। একটি পরিসংখ্যান দিচ্ছি। ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রাপ্ত ভোটের পরিসংখ্যান ছিল ৩০.৮১ ভাগ, আর আওয়ামী লীগের ৩০.০৮ ভাগ। ১৯৯৬ সালে এটা পরিবর্তিত হয়ে আওয়ামী লীগ পায় ৩৭.৪৪ ভাগ আর বিএনপি পায় ৩৩.৬১ ভাগ। ২০০১ সালে বিএনপি পায় ৪০.৯৭ ভাগ আর আওয়ামী লীগ পায় ৪০.১৩ ভাগ। মনে রাখতে হবে, আজকের বিএনপির যে অবস্থা, ২০০১ সালে আওয়ামী লীগেরও একই পরিস্থিতি হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ভোট পেয়েছিল ৪০.১৩ ভাগ, কিন্তু আসন ছিল মাত্র ৬২টি। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের সর্বশেষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভোট প্রাপ্তি ৪৮.০৬ ভাগ, আর বিএনপির ভোট প্রাপ্তি ৩২.৪৫ ভাগ। যদিও বিএনপির আসন অনেক কম এখন। আমাদের দুর্ভাগ্য এটাই, যে দল ক্ষমতায় যায় সেই দল বিজিত দলকে অবজ্ঞা করে। এটাকে কোনো অবস্থাতেই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বলা যাবে না। সরকার ও বিরোধী দলকে নিয়ে যে যৌথ প্রয়াস, তাকেই বলে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। তাই সমঝোতার কথা যখন ওঠে, তখন সমঝোতা বলতে ওই বিরোধী দলকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টাকেই বোঝায়। আমরা বাংলাদেশের বিকাশমান গণতন্ত্রকে যদি উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই, তাহলে এই যৌথ প্রয়াস ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। বিরোধী দলকে আমরা আস্থায় নেই না বলেই বিপত্তি ঘটে। সংসদ বয়কট হয়। হরতাল আহ্বান করা হয়। অতীতে লাগাতার সংসদ বয়কটের সংস্কৃতি বিকাশমান গণতন্ত্রকে একটি ঝুঁকির মাঝে ঠেলে দিয়েছিল। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যকার আস্থার অভাব ও ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি যে ষড়যন্ত্রের বীজ রোপিত হয়েছিল, এটা কি আমরা অস্বীকার করতে পারি?
সরকারকে আজ যেমনি বিরোধী দলকে আস্থায় নিতে হবে, ঠিক তেমনি বিরোধী দলকেও সরকারের সঙ্গে একটি সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। আমরা বারবার বলে আসছি—সংসদে বিরোধী দলের যত কম আসনই হোক, তাদের বেশি সময় দিতে হবে। তাদের কথা বেশি শুনতে হবে। তাদের প্রস্তাবাবলি বিবেচনায় নিতে হবে বেশি করে। কিন্তু এই কাজটি হয় না। আমাদের গণতন্ত্রের ব্যর্থতা এখানেই। সরকারি দলের বেশকিছু সংসদ সদস্য রয়েছেন যারা সুযোগ পেলেই বিরোধী দলকে কটূক্তি করে বক্তব্য রাখেন। সুযোগ পেলেই অতীত টেনে আনেন। সুযোগ পেলেই দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পুরো বিষয়টি বিশ্লেষণ করেন। এতে করে সৃষ্টি হয় আস্থার সঙ্কট, সৃষ্টি হয় বিরোধিতা, সৃষ্টি হয় সংসদ বয়কটের মতো ঘটনা। এই মানসিকতা যদি পরিত্যাগ করা না যায়, তাহলে এদেশে গণতন্ত্র বিকশিত হবে না সঠিক অর্থে। মানুষ ভোট দেবে। একটি দলের ব্যর্থতায় জনগণ হতাশাগ্রস্ত হয়ে অন্য দলকে ভোট দেবে। তাদের ক্ষমতায় নিয়ে আসবে। এটাই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। গণতন্ত্র এ কথাটাই আমাদের শেখায়। আমরা এই গণতন্ত্রই বির্নিমাণ করতে চেয়েছি। স্বাধীনতার প্রায় ৪০ বছর হতে যাচ্ছে। সময়টা একেবারে কম নয়। অথচ বেশকিছু ইস্যুতে জাতি এখনও দ্বিধাবিভক্ত। ২০০৯ সালের ক্ষমতার পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে সবকিছু। বদলে গেছে নাম। নতুন করে নামকরণ শুরু হয়েছে। শুরু হয়েছে নগ্ন দলীয়করণ। এই বৃত্ত আমরা ভাঙতে পারছি না। আরও একটা কথা। সংবিধানের ৭০ নং অনুচ্ছেদটিতেও কিছু কিছু সংস্কার প্রয়োজন। এই অনুচ্ছেদটির কারণে একজন সংসদ সদস্য দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারেন না। ৭০ নং অনুচ্ছেদটির প্রয়োজন রয়েছে। না হলে সংসদে হর্স ট্রেডিং হবে। সংসদ সদস্যরা বিকিকিনির শিকার হবেন। যে দলের হাতে প্রচুর টাকা রয়েছে, তারা অপর দল থেকে সংসদ সদস্যদের ভাগিয়ে নিয়ে এসে সরকার গঠন করবে। এজন্যই ৭০ নং অনুচ্ছেদটি একটি রক্ষাকবচ। তবে এই অনুচ্ছেদটির সংস্কার প্রয়োজন। যুগের চাহিদার প্রতি সম্মান দেখিয়ে এই ধারায় কিছু কিছু পরিবর্তন আনা যায়। তাতে করে সংসদ সদস্যদের অধিকার কিছুটা হলেও রক্ষিত হবে। আমি বিশ্বাস করতে চাই, আওয়ামী লীগের মাঝে বেশকিছু শুভবুদ্ধির মানুষ রয়েছেন, যারা চান বিরোধী দল সংসদে থাকুক। কিন্তু কঠিন দলীয় আনুগত্য, নেত্রীর আস্থাহীনতার ভয়ে তাদের করার কিছুই থাকে না শুধু সংসদে ‘হাত তোলা’ ছাড়া।
আজ শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে মন্তব্য করেছেন, তার জবাব দেয়ার ভাষা আমার জানা নেই। এভাবে একজন জাতীয় পর্যায়ের নেতাকে নিয়ে কটূক্তি করা শুধু দৃষ্টিকটূই নয়, বরং এক ধরনের পাপ। স্পিকার যদি তার ক্ষমতাবলে ওই বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করেন, আমি খুশি হব। তিনি সংসদের অভিভাবক হিসেবে এ কাজটি করতে পারেন। কিন্তু তিনি যদি দলীয় আনুগত্যে বাঁধা থাকেন, তাহলে তিনি করবেন না, এটাই স্বাভাবিক। স্পিকার একজন অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান। ১৯৭৩ থেকে ২০০৮ সাল—৯টি সংসদ নির্বাচনের মধ্যে ৭টিতেই তিনি বিজয়ী হয়েছেন। আমরা তাকে ‘কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা’ হিসেবে দেখতে চাই না, দেখতে চাই সংসদের অভিভাবক হিসেবে। তার একটি সিদ্ধান্ত বিএনপি তথা চারদলীয় জোটকে পুনরায় সংসদে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। আজ সংসদে অনেক কথা বলার আছে। বিশেষ করে তথাকথিত ছাত্র রাজনীতির নামে যেভাবে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিদিন লাশ পড়ছে, তাতে করে আমরা আতঙ্কিত উচ্চ শিক্ষার ভবিষ্যত্ নিয়ে। এ নিয়ে সংসদে আলোচনা হওয়া উচিত এবং একটি সিদ্ধান্তে আসা উচিত। দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সঠিকভাবে মন্ত্রণালয় পরিচালনা করতে পারছেন বলে মনে হয় না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘোষণার পরপরই যখন শিবগঞ্জের ধাইনগর ইউনিয়নের চৈতন্যপুর গ্রামে শিবির কর্মী শাহীনকে গুলি করে হত্যা করা হয়, তখন সংসদে ওই বিষয়টি আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। শাহীন অভিযুক্ত হতে পারেন। কিন্তু তিনি দোষী কি-না, তার বিচার হয়নি। বিচারের আগেই হত্যা করা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, বিশেষ করে চালের ক্রয়মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। প্রধানমন্ত্রী অতীতে বারবার তথাকথিত ‘সিন্ডিকেটের’ কথা বলতেন। এখন সরকারি গুদামে প্রচুর চাল মজুত থাকা সত্ত্বেও চালের দাম বাড়লো কেন? এর কী জবাব দেবেন প্রধানমন্ত্রী? আমরা চাইব সংসদে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হোক। আলোচনা হোক প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর ও স্বাক্ষরিত ৩টি চুক্তি, সমঝোতা স্মারক ও যৌথ বিবৃতির বক্তব্য নিয়ে। বিএনপির সংসদে ফিরে আসার মধ্য দিয়ে একটা সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছিল। এখন আবার তা হতাশার কালোছায়ায় ঢেকে গেল। সরকারি দলকেই এখন উদ্যোগ নিতে হবে বিএনপিকে ফিরিয়ে আনতে। না হলে মানুষ মনে করবে, আওয়ামী লীগ একদলীয় সংসদ চায়। চায় না বিএনপি সংসদে ফিরে আসুক।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ই-মেইল : tsrahmanbd@yahoo.com
No comments