সাক্ষাৎকার- আমার ছবি চিরদিন বেঁচে থাকবে by মকবুল ফিদা হুসেন
ছবি এঁকে খুব কম শিল্পীই সেলিব্রেটি হতে পেরেছেন। হাতেগোনা সেই শিল্পীদের অন্যতম মকবুল ফিদা হুসেন। ৯৬ বছর বয়সে নির্বাসিত জীবনে লন্ডনে মৃত্যুবরণ করেন। ৩ মার্চ ২০১০ এনডিটিভিতে প্রচারিত বার্খ দত্তের নেওয়া সাক্ষাৎকারের স্ক্রিপ্ট অনুসরণে লেখাটি অনুবাদ করেছেন আন্দালিব রাশদী।
প্রশ্ন: আপনি ভারতীয় পাসপোর্ট সমর্পণ করে কাতারের নাগরিকত্ব গ্রহণ করলেন কেন?
এম এফ হুসেন: আমি কখনো বলিনি ভারত আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। আমি সব সময়ই বলেছি, এখানে সুযোগ বেশি, তাই চলে এসেছি। নাগরিকত্ব কী? এ তো এক টুকরা কাগজ। যখন কেউ আমাকে এত ভালোবাসা ও আদর সোহাগ দিয়ে নিমন্ত্রণ জানিয়েছে, আমি কি তাদের সঙ্গে ডিনার করতে যাব না? আমি কি তখন বলব, আমি মাংস চাই না, শুধু সবজি খাই? এসব ব্যাপারে আমার কোনো গোঁড়ামি নেই।কথায় বলে না, যেখানে ভালোবাসা, আমি সেখানেই। আমি একজন উঁচু দরের প্রেমিক। যেখানে উষ্ণতা পাই, সেখানকার মানুষকে ভালোবাসি। ভারতে নিশ্চয়ই শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষই আমাকে ভালোবাসে। এখনো ভালোবাসে। আর সৃষ্টিশীলতার ওপর রাজনীতির ক্ষতিকর প্রভাব সব সময়ই ছিল।
গ্যালিলিও থেকে কালিদাস—সব মহান শিল্পীকেই লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়েছে। এমনকি নেরুদা, (চার্লি) চ্যাপলিন অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। কারণ, শেষ পর্যন্ত এ ধরনের বিষয়ের সমাপ্তি ঘটে রাজনীতিতে। এটা যদি সামাজিক কিংবা আইনি কোনো সমস্যা হতো, এর একটা সমাধান হতো। কোর্ট তো একটি ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন। কিন্তু এটা হচ্ছে রাজনীতি। সবকিছু ভণ্ডুল করে দেওয়ার জন্য হাতেগোনা কজনই যথেষ্ট।
প্রশ্ন: আপনি কি দেশে ফেরার তাগিদ অনুভব করেন না?
এম এফ হুসেন: আমি তো আত্মিকভাবে দেশেই আছি। আমার সবকিছুই সেখানে। শারীরিক উপস্থিতিতে কী এসে যায়। আজকের পৃথিবীতে এত প্রযুক্তি ও যোগাযোগের মাধ্যম থাকায় আপনি তো সর্বত্রই অবস্থান করছেন—আর একজন সৃষ্টিশীল মানুষ কখনোই ভৌগোলিক সীমান্তে বাঁধা নন। কোথায় আপনার অবস্থান, তাতে কিছুই এসে যায় না। আমার বেলায় আমি একজন আদি ভারতীয় চিত্রশিল্পী, এবং শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত তা-ই থাকব।
প্রশ্ন: কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ভারতের অনেকেই বিশ্বাস করেন, সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো আপনার ভারতে ফিরে আসার প্রশ্নে অনেক বেশি ভূমিকা রাখতে পারত।
এম এফ হুসেন: এসব আলোচনায় আমি কোনো মনোযোগ দিই না। তারা যা ভাবার ভাবছে, যা করার করছে—এটা তাদের ব্যাপার। এতে আমি বিরক্ত বোধ করছি, আমার কাজও বন্ধ রাখছি না।
প্রশ্ন: থাকার জন্য আপনি একটি অগণতান্ত্রিক দেশ বেছে নিয়েছেন। কাতার কেন?
এম এফ হুসেন: বলেছিই তো, এখানে স্পনসর পেয়েছি, কাজ করার সব সুযোগ-সুবিধা পেয়েছি। আমি ৬০ বছর ধরে এসব কাজই করছি। পৃথিবীতে কোথাও আমার একটি স্টুডিওও নেই। আমি হোটেলে যাই, বন্ধুর বাসায় যাই, ক্যানভাস ছড়িয়ে আঁকতে বসে যাই। আমি লোকশিল্পীদের মতো—যত্রতত্র কাজ করতে পারি। এভাবেই আমি আমার ছবি আঁকার পথটা তৈরি করে নিয়েছি। অনেক বড় চিত্রশিল্পী আছেন, চিন্তাবিদ আছেন, আমি তাঁদের শ্রদ্ধা করি। তাঁরা তাঁদের পথে কাজ করেন, আমার পথ এটাই।
প্রশ্ন: আপনাকে যে ভারতীয় পাসপোর্ট সমর্পণ করতে হলো, এটা কি কষ্টকর একটি সিদ্ধান্ত ছিল না?
এম এফ হুসেন: যত কষ্ট আর যন্ত্রণা, সবই গণমাধ্যমগুলো পাচ্ছে। আমি পাচ্ছি না। আমি ৪০ বছর ধরে মহানন্দে আছি, ছবি বানাচ্ছি, দু-এক কলম লিখছি, ছবি আঁকছি। আমার যা কিছু প্রকাশ করার, তার মাত্র ১০ ভাগ প্রকাশ করতে পেরেছি, ৯০ ভাগই এখনো ভেতরে রয়ে গেছে। আমার মনে হয় না, তা প্রকাশ করে যেতে পারব। আমার সঙ্গেই তা কবরস্থ হবে।
প্রশ্ন: আপনার পরিবার, বন্ধুবান্ধব ছেলেমেয়ে সবার কাছে এর কী ব্যাখ্যা দিয়েছেন? তারা এটাকে কেমনভাবে নিয়েছে?
এম এফ হুসেন: তারা তো এই বৃক্ষের নিচেই বড় হয়েছে, কাজেই তারা আমাকে বোঝে। তবে একজন নায়িকাকে নিয়ে কাজ করার সময় তারা ভেবেছিল, আমি পাগল হয়ে গিয়েছি। এসব তো চলতে থাকে।
প্রশ্ন: আপনার বয়স এখন ৯৫ বছর—আলোছায়ার সময়ের ভেতর আপনি। এ সময় মানুষ সাধারণত বাড়ি ফিরতে চায়। জীবনের অন্য যেকোনো পর্যায়ের চেয়ে এ সময়ই বাড়ির প্রয়োজনটা বেশি অনুভব করে?
এম এফ হুসেন: আমার বয়স তো কুড়ি বছর নয় যে আমার একটা বাড়ি দরকার। আমি সেই পর্যায় অতিক্রম করে এসেছি। আপনি যখন তরুণ, শিকার ধরার মতো সবকিছুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য তৈরি থাকেন। সে সময় কতটা ধরে রাখা যায়—যেখানে যা পাও ভোগ করে নাও। আর এখন আমার যে সময়, তখন বলতে হয়—এটা নয়, এটা নয়।
এটি হচ্ছে সে সময়, যখন সবকিছু বর্জন করতে করতে শূন্যে এসে পৌঁছাতে হয়। আমি তা-ই চেষ্টা করছি। কিন্তু সে পর্যায়ে পৌঁছিনি। কেবল সাধুসন্তরা পৌঁছাতে পারেন।
প্রশ্ন: মানুষ এখনো জানতে চাচ্ছে, আপনি নিজে এসে কেন আদালতের মোকাবিলা করছেন না? আর মাত্র তিনটা মামলা বাকি। মানুষ চায় আপনি ফিরে আসুন এবং যা-ই ঘটুক মামলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুন।
এম এফ হুসেন: আমি তো ভারতেই আছি। আমি মনে করি না, মানুষ আমার গায়ে হাত দিয়ে দেখতে চায় আমি ভারতে ফিরেছি কি না। আমি যে ছবি রেখে গেলাম, তা চিরদিন বেঁচে থাকবে। আমার জীবনের ৭-৮ বছর তো কিছুই না। সময়ে ব্যাপ্ত পরিসরে এটা কিছুই না—মহাবিশ্ব নিয়ে নিচ্ছে; এটা কোনো সময়ই নয়।
প্রশ্ন: আপনার কথা বুঝতে পারিনি। আপনি কি অনুভব করছেন যে ভারতের জনগণ ও ভারতের সরকার আপনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে? আপনি কি মনে করেন, ব্যাপারটা কখনোই এ পর্যায়ে আসা উচিত হয়নি?
এম এফ হুসেন: না, মোটেও না। আমি কখনো এমন কথা বলিনি, এমন কথা কখনো বলব না। বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছি—এমন আমার কখনো মনে হয়নি। কিছুসংখ্যক মানুষ আধুনিক চিত্রকলার ভাষা বোঝে না, তারা মাত্র কজন। শিল্পকলা বরাবরই সময়ের চেয়ে এগিয়ে। আগামীতে তারা বুঝতে পারবে।
প্রশ্ন: আপনি কি মনে করেন, আপনার জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করার জন্য আরও অনেক করার ছিল?
এম এফ হুসেন: আমি তো বলেছিই সরকার তার কাজ করছে, আমি আমার কাজ করছি। কিছুই আমাকে থামিয়ে রাখছে না। আমি আগামীকালই ফিরতে পারি। তবে জেনে রাখুন, প্যারিস, লন্ডন, নিউইয়র্ক কিংবা কাতার—আমি যেখানেই ছবি আঁকি না কেন, আমি একজন ভারতীয় শিল্পীই রয়ে যাই। আমি একজন মুক্ত নাগরিক। আমি কোনো অপরাধ করিনি। কাউকে খুন করিনি, কারও কাছ থেকে একটি পয়সাও নিইনি।
প্রশ্ন: এখন আপনার বাড়ি কোথায় বলে অনুভব করছেন? এখনো কি ভারত?
এম এফ হুসেন: আপনি আবারও শারীরিক উপস্থিতির ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলছেন। আমি শরীরী অস্তিত্বের ঊর্ধ্বে। যাঁরা এটা বুঝতে পারেন, তাঁরা আমাকে মিস করেন না।
প্রশ্ন: প্রকাশের স্বাধীনতার বিস্তৃতি কত দূর হতে পারে বলে আপনি মনে করেন? অসহিষ্ণুতার রাজনীতি আমাদের ভারতের জ্ঞানচর্চার ওপর ছায়া ফেলছে বলে কি আপনার ধারণা?
এম এফ হুসেন: সৌভাগ্যবশত সৃজনশীল চিত্রকলার ওপর ভারতে বড় ধরনের কোনো আঘাত আসে না। বরোদাতে একবার আক্রমণের ঘটনা ঘটেছিল, এটা আমার কাছে তুচ্ছ ঘটনা। আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবেই আছি।
প্রশ্ন: আপনি কি মনে করেন, প্রকাশের স্বাধীনতাই চূড়ান্ত অধিকার হয়ে থাকবে? আপনি কি ভিন্নভাবে কিছু করেছেন?
এম এফ হুসেন: কতবার বলেছি, আমি যা সৃষ্টি করেছি, তা চিরদিনের জন্য রয়ে যাবে। আশা করি, আপনি আমাকে বুঝতে পেরেছেন।
প্রশ্ন: ৯৫ বছর বয়সে কোনো অসম্পূর্ণ স্বপ্ন?
এম এফ হুসেন: যত দিন বেঁচে থাকি দেশের মানুষের ভালোবাসা নিয়ে কেবল দেশের ভেতরে থেকে নয়, বাইরে থেকেও যেন কাজ করে যেতে পারি, সেই স্বপ্নই দেখে চলেছি। আমার দেশ আমাকে পুরো সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে, এক মুহূর্তের জন্যও মনে হয়নি, আমি বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছি। কেউ কেউ আমার ছবি বোঝে না, সময় হলে বুঝবে। আমি তাদেরও ভালোবাসি। মতামত জানানোর স্বাধীনতা সবারই আছে, মোটের ওপর আমরা যে একটি বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ।
No comments