রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবর্ষের সেমিনার- 'রবীন্দ্রনাথ, এই সময়ে'
রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবর্ষে এই সময়ের অভিজ্ঞতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রাসঙ্গিকতা বুঝে নেওয়ার প্রয়াসে ১৮ ও ১৯ জুন প্রথম আলো ও ব্র্যাক ব্যাংকের উদ্যোগে আয়োজন করা হয় সেমিনার ‘রবীন্দ্রনাথ, এই সময়ে’। দুই দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠানে অংশ নেন দেশের কবি-সাহিত্যিক-লেখক ও রবীন্দ্রভক্ত পাঠক। দুই দিনের জমাট সেই আসরের নানা দিক নিয়ে এই রচনা।
বিষয়: রবীন্দ্রনাথের কথাসাহিত্য
কাছে ফেরার তাগিদ
* কাজল রশীদ
১০০ বছর বা তারও আগে লেখা রবীন্দ্রনাথের গল্প-উপন্যাসের প্রয়োজন কি শুধুই একাডেমিক বা ঐতিহাসিক? প্রবন্ধকার ওয়াসি আহমেদ নিজে এ প্রশ্নের উত্তর অন্বেষণ করেছেন। আলোচকত্রয় ও সভাপতিও বিচিত্র পথে একই সত্য অনুসন্ধান করেছেন। ‘রবীন্দ্রনাথের কথাসাহিত্য বিষয়ে’ প্রবন্ধকার বলেন: ‘রবীন্দ্রনাথকে খণ্ডিত করে গল্প-উপন্যাসের রচয়িতা গণ্য করলেও তাঁর কথাসাহিত্যিক পরিচয়ের স্বয়ংসম্পূর্ণতা নিয়ে তর্কের অবকাশ থাকে না। ১০০টির কাছাকাছি গল্পই লেখেননি, বাংলা সাহিত্যের এই উজ্জ্বল শাখাটির তিনিই জনক। উপন্যাস লিখেছেন এক ডজনের বেশি। শ্রেণী বিভাগের প্রয়োজনে কথাসাহিত্যকে আলাদা করলেও রবীন্দ্রনাথের কবিতা-নাটকসহ বহুবিধ সৃজনী কর্মকাণ্ডের নির্যাসকে একটি অভিন্ন চিন্তাচেতনার ঐক্যে গাঁথা চলে। রবীন্দ্রনাথ কোনো ডকট্রাইনেয়ার দর্শনের প্রবক্তা ছিলেন না। মৌলিক চিন্তাভাবনাপ্রসূত কোনো নন্দনতাত্ত্বিক দর্শনও তিনি প্রতিষ্ঠিত করেননি। প্রয়োজনমতো নানা উৎস থেকে এর উপাদান সংগ্রহ করেছেন।’
ভাবনা, যৌক্তিকতা ও বিশ্লেষণের সমন্বয়ে কথাসাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথকে এভাবেই খুঁজে ফিরেছেন প্রবন্ধকার।
রবীন্দ্রনাথের সৃজনসম্ভারের সঙ্গে পূর্বাপর বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করেছেন কখনো প্রত্যক্ষে, কখনো বা পরোক্ষে। হাজির করেছেন তাঁর সমসাময়িক, আগের কিংবা পরের লেখক-সাহিত্যিক, কবি-সমালোচক, তাত্ত্বিক ও সাহিত্যবোদ্ধাদের। আন্তর্জাতিকতার নিরিখে, দেশজ প্রেক্ষাপটে, সমাজ-রাষ্ট্র-ব্যক্তির আলোকেও প্রবন্ধকার রবীন্দ্র কথাসাহিত্যের একটি স্বর্ণরেখা টেনেছেন। যে রেখা কখনো গন্তব্যে গেছে, কখনো যায়নি। তবে পরিব্রাজক সত্তাকে উন্মোচিত করেছেন। যার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্র কথাসাহিত্যের অপরূপ রূপ বিন্যস্ত হয়েছে।
প্রবন্ধকারের ভাষায়:
দার্শনিক বিবেচনায় রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক সাহিত্যকৃতিতে ঐক্যের সন্ধান মিললেও তাঁর গল্প ও উপন্যাসের জগৎ বিষয়ভাবনা ও প্রকারগত দিক থেকে একে অন্যের থেকে আলাদা।...গল্পগুচ্ছ-এ স্বল্প পরিসরে হলেও তিনি গল্পের ভেতর দিয়ে ভাবনাকে ছুঁয়েছেন, অন্যদিকে উপন্যাসে আইডিয়াকে দাঁড় করাতেই গল্পের কাঠামোর আশ্রয় নিয়েছেন, এমনকি চরিত্রেরও।
কথাসাহিত্যে তাঁর মানবতাবাদী শ্রেয়নীতিকে বলা যায় জীবনদেবতারই প্রতিরূপ।...এ প্রসঙ্গে ঘরে বাইরের দৃষ্টান্ত টানা যেতে পারে। উপন্যাসের ঢঙে এখানে রবীন্দ্রনাথ যা দাঁড় করিয়েছেন, প্রকৃতপক্ষে তা দেশ, জাতীয়তাবাদবিষয়ক থিসিস।...বিমলা-সন্দীপের রাজনৈতিক রোমান্সের সমাপ্তি ঘটাতে এবং নিখিলেশের থিসিসই যে শ্রেয়নীতি, তা প্রতিষ্ঠিত করতে সন্দীপকে কেবল শভিনিস্ট প্রমাণ করলে চলে না, তাকে হতে হয় লোভী, স্বার্থপর। কিন্তু মুশকিল হলো, সন্দীপ তো ব্যক্তিমাত্র, আর থিসিসের পটভূমি অগ্নিগর্ভ ভারতবর্ষ। তার পরও এক সন্দীপের উদাহরণেই শ্রেয়নীতি প্রতিষ্ঠা পায়। কথাসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথকে কাছের মানুষ অভিহিত করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মহীবুল আজিজ বলেন: ‘রবীন্দ্রনাথ কথাসাহিত্যে অনেক বেশি স্পষ্ট, কবিতার মতো রহস্যময়ী নন। তিনি সারা জীবন ছিলেন ঔপনিবেশিক লেখক, সে কারণে তাঁর ওপর একটা চাপ ছিল। সে চাপ তাঁর সমকালীন পশ্চিমা লেখকদের ছিল না। পূর্ববঙ্গবাস রবীন্দ্র কথাসাহিত্যের জন্য আশীর্বাদ, পরম পাওয়া। গল্পগুচ্ছ-এর গল্পগুলোয় যার প্রমাণ ও বৈশিষ্ট্য প্রকৃষ্টরূপে বিদ্যমান।’
তাঁর মতে, হোমারের ইলিয়াড, ওডেসিকে যেমন অস্বীকার করা যায় না, তেমনি বর্তমানের প্রাসঙ্গিকতায় রবীন্দ্রনাথের গোরাকেও অস্বীকার করা যায় না।
রবীন্দ্রনাথ জীবন-জগৎকে দেখার ক্ষেত্রে নানা প্রশ্নের মুখে পড়েছেন। বিষয়, আঙ্গিক, ভাবনায়, বিচিত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। আধুনিক কালের লেখকেরাও তা অব্যাহত রেখেছেন তাঁকে বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে সম্যকভাবে বিচার করার কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী।
রবীন্দ্রনাথ শুধু পথ চলেননি, পথ তৈরিও করেছেন। নিজের তৈরি ভাষায় লিখেছেন। বিশ্বসাহিত্যের প্রতিভাধর লেখকদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পার্থক্য এখানেই বলে উল্লেখ করেন প্রথম আলোর উপসম্পাদক কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক। প্রবন্ধকারের সঙ্গে সহমত প্রকাশ না করে তিনি বলেন: ‘রবীন্দ্রনাথ সোনার তরীর ‘বর্ষাযাপন’ কবিতায় ছোটগল্প সম্পর্কে যে কথা বলেছেন, তা মেনে ভালোই করেছেন। রবীন্দ্রনাথ আমাদের গল্প পড়তে শিখিয়েছেন। গল্পের অপূর্ব ভাষাভঙ্গির জন্যই তিনি প্রাসঙ্গিক ও বেঁচে থাকবেন।’
সভাপতি হাসান আজিজুল হক সহজ করে কঠিন কথাটি বলেছেন: ‘রবীন্দ্রনাথ আকাশের মতো উদার, আবার পলায়নপর। তাঁকে নিয়ে শেষ কথাটি বলা অত সহজ নয়।’
তিনি বলেন, সাহিত্য ক্ষেত্রে চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তিযোগ্য কিছুই নেই।
সত্যেরও যেমন নির্ধারিত রূপ নেই, মিথ্যারও নেই। দুটোই নড়াচড়া করছে। আসল কথা হলো, নিজেদের রবীন্দ্রনাথের কাছে নিয়ে যাওয়া। অন্যের মূল্যায়নের প্রতি নির্ভর না করে নিজে অনুসন্ধান করা। তাঁকে পড়া। সেখান থেকেই নিজের মতো করে গ্রহণ বা বর্জন করা। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানামুখী আলোচনা হচ্ছে। আলোচনা করে তিনি বড় কি ছোট, প্রমাণ করে লাভ নেই। আমাদের ভেতরের সব দেয়াল ভেঙে তাঁর কাছে ফেরার মধ্যেই রবীন্দ্র কথাসাহিত্যের প্রাসঙ্গিকতা অন্বেষণ সম্ভব।’
বিষয়: রবীন্দ্রনাথের কবিতা
নতুনের অপেক্ষায়
* পিয়াস মজিদ
রবীন্দ্রজন্মের ১৫০ বছর এবং প্রয়াণের ৭০ বছর পর সৈয়দ শামসুল হক রবীন্দ্রনাথের কবিতার দিকে নতুন দৃষ্টিতে তাকাতে চান। রবীন্দ্র-কবিতার বিষয়ভাগ নয়, বরং আঙ্গিকগত দিকই তাঁর আগ্রহের বস্তু। বিশেষত কবিজীবনের প্রথম থেকে শেষাবধি ছন্দের নানা নিরীক্ষা সৈয়দ হকের কাছে বিস্ময়-উদ্রেকী। ‘রবীন্দ্রনাথ: তাঁর কবিতা, আমার কাছে’ শীর্ষক প্রবন্ধে লেখকের বলার কথা এই যে মহৎ বক্তব্য পথে পড়ে থাকতে পাওয়া যায়। ইত্যাকার বক্তব্য উত্তরকালের কোনো সৃজনশীলের কাছে মহার্ঘ্য হতে পারে না। পূর্বজ কবির কাছ থেকে নেওয়ার যা থাকে তা হচ্ছে তার সৃষ্টির কারিগরি কাঠামো।
রবীন্দ্রনাথ সৈয়দ শামসুল হকের কাছে সোনার ঠাকুর নন; ভীষণভাবে একজন মানুষ কবি। তাই তিনি ফিরে তাকাতে চান তার বহুভঙ্গিম কবিজীবনের পানে। দেখেন রবীন্দ্রনাথেরও গেছে কবিতা-বন্ধ্যা সময়। দেখেন আবার এক দিনেও লিখেছেন স্মরণীয় একাধিক কবিতা। দেখেন কাটাকুটিময় কবিতার পাণ্ডুলিপি। অবিরাম শোধন-মার্জনের মধ্য দিয়ে তৈরি করছেন কবিতার কায়া। তখন অনুধাবন হয় যে কবিতা নেহায়েত ভাবের প্রসূন নয়, কবিতা কবির সচেতন নির্মাণ।
রবীন্দ্র-কবিতার কাছ থেকে এই শিক্ষা লাভ হয় আজকের কবির যে শব্দের পাশে শব্দ সংস্থাপনের ইন্দ্রজালবিদ্যা আয়ত্ত থাকতে হয় যেকোনো কবির। প্রবন্ধকার রবীন্দ্রনাথের কবিত্ব দৃষ্টিগোচরভাবে শনাক্ত করেন শব্দকে চিরকালের মতো নিজস্ব করে নেওয়ার প্রতিভাতে।
তবে রবীন্দ্র-কবিতার বিষয়ভাগে যে আধ্যাত্মিক জগতের বিস্তার তাকে সৈয়দ শামসুল হক নিজের জগৎ ভাবতে পারেন না। এ পথে সমসময়ের মানুষের মুক্তি বা স্ফূরণ সম্ভব কি না এ ব্যাপারে তিনি সংশয়াকীর্ণ। রবীন্দ্রনাথের সময় থেকে এ কালের কবির সময় গেছে বদলে। জীবন ও সমাজে এসেছে বিপুল পরিবর্তন। তাই রবীন্দ্র-কবিতার সেই দার্শনিক নেপথ্য-চালক ‘জীবনদেবতা’ এখন তার কাছে পূজনীয় নয়। দুটি মহাযুদ্ধ, সহিংসতা ও সমর, মানুষের পতন ও মূল্যবোধের বিপর্যয় ইত্যাদি নেতিমূলক পরিস্থিতির দ্রষ্টা কবিকে রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনদেবতা’র শান্ত-সৌম্য বাণী সম্মোহিত করে না। বরং ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি/ বিচিত্র ছলনাজালে/ হে ছলনাময়ী!’ রবীন্দ্র জীবনের অন্ত্যপর্যায়ী এই উচ্চারণেই সৈয়দ হক খুঁজে পান সমসাময়িক স্বরভঙ্গি।
আলোচকদের একজন খোন্দকার আশরাফ হোসেন প্রবন্ধকার সৈয়দ শামসুল হকের মতের বিরোধিতা করে বলেন যে তিনি রবীন্দ্র-কবিতার আঙ্গিকে আকর্ষিত নন বরং বিষয়ভাগের প্রতিই তাঁর মনোযোগ। ইউরোপবাহিত মডার্নিজমের চোখে রবীন্দ্রনাথের কবিতাকে দেখার ফলেই আমরা রবীন্দ্র-কবিতার স্বাদ-আস্বাদনে ব্যর্থ বলে মনে করেন তিনি। রবীন্দ্র-কবিতার ভূগোলব্যাপী আধ্যাত্মিকতার বিস্তার বলে সৈয়দ হক তাঁর ভেতর এই সময়ের কবির মুক্তি খুঁজে পান না কিন্তু খোন্দকার আশরাফ হোসেন আধ্যাত্মিকতাকেই একটি অচিকিৎস্য ব্যাপার বলে মনে করেন। টিএস এলিয়টের উদাহরণ দিয়ে আশরাফ বলেন যে তাঁর অধিকাংশ কবিতাই আধ্যাত্মিকতা-ভারাতুর কিন্তু এই সময়ের কবি বা পাঠকের কাছে তিনি মোটেও অগ্রহণীয় নন বরং দিনে দিনে এলিয়ট আরও বেশি পঠিত হচ্ছেন।
কবি নির্মলেন্দু গুণ রবীন্দ্রনাথকে দেখেন একজন পরিশ্রমী পূর্বজ কবি হিসেবে, রবীন্দ্রনাথের প্রভাব রবীন্দ্র-পরবর্তী কবিদের ভেতর প্রত্যক্ষভাবে না হলেও অন্তঃশীলে গভীরভাবে প্রবহমান বলে তাঁর ধারণা।
অপর আলোচক বিশ্বজিৎ ঘোষ দৃঢ়ভাবে মনে করেন রবীন্দ্র-কবিতার বিষয়বস্তু এখনো প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক। ফ্যাসিবাদী উন্মত্ততা, সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন, পরিবেশবিরোধী তৎপরতার কালে ‘আফ্রিকা’, ‘বৃক্ষবন্দনা’র মতো কবিতার কাছে বারবার যেতে হবে।
অধিবেশনের সভাপতি জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, সাহিত্যের ধর্মই পরিবর্তনশীলতা। সুতরাং এই সময়ের কবির কাছে রবীন্দ্র-কবিতা যে নতুনভাবে মূল্যায়িত হবে তা-ই স্বাভাবিক, তবে কবি রবীন্দ্রনাথের মূল গুরুত্বের জায়গা হচ্ছে তাঁর কবিতাভাষা। কারণ তিনি কবিতার তৈরি-ভাষা পাননি। মেধা ও শ্রমের যুগল সম্মিলনে রবীন্দ্রনাথ তৈরি করেছেন নিজের এবং বাংলার কবিতার ভাষা।
সেমিনারে অংশগ্রহণকারীদের তর্ক-বিতর্ক, বিশ্লেষণ-সংশ্লেষণে কোনো মীমাংসায় পৌঁছানো না গেলেও এই অভিন্ন উপলব্ধির কিনারে পৌঁছানো গেছে যে কবি রবীন্দ্রনাথ নতুন আবিষ্কারের অপেক্ষায়।
বিষয়: রবীন্দ্রনাথের গান
গানের ঝর্ণাতলায়
* আশীষ-উর-রহমান
‘গানের ভিতর দিয়ে যখন দেখি ভুবনখানি/ তখন তারে চিনি আমি, তখন তারে জানি’—এ কথা তিনি নিজেই বলেছিলেন। আবার সেই ভুবন ছেড়ে যাওয়ার সময় শেষ সম্বল হিসেবে যা নিতে চেয়েছেন তাঁর বিপুল সৃজনসম্ভারের মধ্য থেকে তাও গানই। গানের প্রতিই যে তাঁর আস্থা ছিল গভীর সে কথা আরও নানাভাবে ব্যক্ত করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর গান যে আমাদের গাইতেই হবে সে সম্পর্কেও নিঃসন্দেহ ছিলেন তিনি।
সেমিনারে প্রথম দিনের তৃতীয় অধিবেশনটি ছিল রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে। সভাপতি, প্রাবন্ধিক, আলোচক সবাই গানের জগতেরই মানুষ। তাঁরা যেমন রবীন্দ্রনাথের গানের বৈশিষ্ট্য, তাঁর অনন্যতা, তাঁর স্বাতন্ত্র্য এসব নিয়ে যুক্তিনিষ্ঠ বিচার-বিশ্লেষণ করেন, তেমনি তার সঙ্গে যোগ করেন গানের গায়কি কেমন হবে, হচ্ছে; কোথায় এ ক্ষেত্রে ভুলত্রুটিগুলো থেকে যাচ্ছে। রবীন্দ্রসংগীতচর্চার প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রে বাধা-প্রতিবন্ধকতার বিষয়ও তাতে বাদ পড়েনি। উপরন্তু এসব তত্ত্ব-পদ্ধতিগত আলোচনার সঙ্গে তারা যোগ করেছিলেন নিজেদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। ফলে পুরো আলোচনাটি যেমন বহুমাত্রিকতা পেয়েছিল, তেমনি হয়ে উঠেছিল রসোত্তীর্ণ।
এ পর্বে সভাপতিত্ব করেন সংগীতজ্ঞ অধ্যাপক করুণাময় গোস্বামী। প্রথমেই আসা যাক প্রবন্ধ প্রসঙ্গে। এটি উপস্থাপন করেছেন ড. মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী। প্রবন্ধটি তিনি রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথের বিচিত্র সৃজনসম্ভারের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে সেখানে গানের অবস্থানটি কোন পর্যায়ে, এবং বর্তমানে তার প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু সেই মূল্যায়ন করে। তিনি বলেন, ‘এই সময়ে মানে কোন সময়ে? বর্তমান বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত বিশ্বমন্দার এই প্রেক্ষাপটে? যদি তাই ধরে নিই তা-ই, তাহলে কবির কথা ধার করে বলতে হয়: “হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী, নিয়ত নিঠুর দ্বন্দ্ব”। এরই মধ্যে তাঁরই সৃষ্ট লেখনীতে সান্ত্বনা খুঁজে পাওয়া যায় এই পঙিক্তমালায় “বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি”।’
তিনি বলেন, ষড়ঋতুর রূপকল্প তাঁর গানের ভেতর দিয়ে যেমন অনুভব করা যায় তেমন আর কিছুতে পাওয়া যায় না। আমাদের পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনে তাঁর গান প্রেরণা জুগিয়েছে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রোধ আন্দোলনে রচিত গানগুলো বিশ্লেষণ করলে লক্ষ করা যাবে, কালোয়াতি-ধ্রুপদী গানের ছত্রচ্ছায়ায় বেড়ে উঠেও তিনি প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ও স্বদেশপ্রেমে জাতিকে উজ্জীবিত করতে বেছে নিয়েছিলেন স্বতোৎসারিত মাটি-মানুষের দেশজ লোকসুর। নিজেকে বাউল, ব্রাত্য বলতে দ্বিধাবোধ করেননি।
প্রবন্ধকার বলেন, জমিদারির দায়িত্বভার নিয়ে পূর্ববঙ্গে এসে তিনি ১৮৯০-১৯০১ পর্যন্ত প্রায় এক যুগ ধরে সাধারণ মানুষ ও লোকজ গানের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শ লাভ করেন। এ সময় তিনি অবহেলিত লোকসংগীত, গ্রাম্য ছড়াগান সংগ্রহ করেছেন। বাউল লালনের গান সংগ্রহ করে মাসিক প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশ করেছেন। লালনশিষ্য গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাব তারে’ গানের সুরে যে গানটি রচনা করেছিলেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’, সেই গানটি এখন আমাদের জাতীয় সংগীত।
আলোচনা পর্বে শিল্পী সাদি মহম্মদ প্রাধান্য দেন রবীন্দ্রসংগীত চর্চার বিষয়ে। এ ক্ষেত্রে সরকারি সংগীত মহাবিদ্যালয়ে তাঁর দীর্ঘদিনের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে বলেন, প্রধান সমস্যা হলো স্বরলিপি নিয়ে। আমরা অনেকেই স্বরলিপি বুঝতে চাই না। নবীন শিক্ষার্থীদের অনেকেই চর্চাটা শেষ পর্যন্ত অব্যাহত রাখে না। একটা পর্যায়ে গিয়ে ছেড়ে দেয়। এ ছাড়া বড় ধরনের আরও একটি সমস্যা রয়েছে উচ্চারণ নিয়ে। অনেকেই হয়তো বেশ ভালো গাইছে, গলায় সুরও আছে চমৎকার, কিন্তু উচ্চারণের বেলায় তাঁর আঞ্চলিকতার ত্রুটিগুলো এড়াতে পারে না। এগুলো এড়ানো জরুরি।
বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক ও শিল্পী লুভা নাহিদ চৌধুরী জোর দিয়েছেন নতুন প্রজন্মের কাছে রবীন্দ্রনাথকে তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তার ওপর। তিনি বলেন, ‘আমরা নতুন প্রজন্মের কাছে তাঁকে চেনাতে পারিনি। বাঙালি জাতীয়তাবোধের চেতনা জাগাতে তিনিই ছিলেন আশ্রয়। গানের মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের ছুঁয়ে গেছেন। এখন সময় বদলেছে। নতুন সময়ে তাঁর বোধ ও চেতনার আত্মীকরণের মধ্য দিয়েই তিনি প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবেন।’
শিল্পী অদিতি মহসীন বলেন, বাঙালির জীবনের নানা উপলক্ষ ও বোধকে তিনি গানটিতে স্পর্শ করেছেন। সুরের ক্ষেত্রে যেখানে যা ভালো মনে করেছেন তা আত্মস্থ করে নিজের মতো করে প্রয়োগ করেছেন।
অধ্যাপক করুণাময় গোস্বামী সভাপতির বক্তব্যে বলেন, ভাষা ও সংগীত মিলে গান তৈরি হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের গানের ভাষা এখনো পুরোনো হয়ে যায়নি। কিছু প্রেমের গানের ক্ষেত্রে, যেমন ‘চরণ ধরিতে দিও গো আমারে’, এমন করে আমরা এখন ‘চরণ’ শব্দ ব্যবহার করি না, তবে গানের অন্য ভাষা এখনো সমকালীন। কাজেই ভাষাগতভাবে তাঁর গান অনেক প্রাচীন বা দুর্বোধ্য হয়নি। সুরের ক্ষেত্রেও তিনি হিন্দুস্তানি রাগসংগীতের কড়াকড়ি থেকে বাংলা গানকে বের করে এনে আধুনিক করে তুলেছিলেন।
উপসংহারে তিনি বলেন, মানুষের ভাষা, দেশ-কাল আলাদা হলেও মানবিক অনুভূতি সব মানুষের প্রায় অভিন্ন। সেই মানবিক অনুভবের জায়গায় রবীন্দ্রনাথের গানের, তাঁর সুরের আবেদন থেকেই যাবে। সময় যত যাবে, তাঁর গানের শ্রোতাও তত বাড়তে থাকবে।
বিষয়: রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা
শেষ বয়সের প্রিয়া
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ জীবনের সৃজনসম্ভার মূলত তাঁর চিত্রকলা। আঁকাজোকার হাতেখড়ি অবশ্য হয়েছিল শৈশবেই। তবে কাব্য, সংগীত, সাহিত্যে যেভাবে আত্মনিবেদন করেছিলেন, আঁকাটা সে তুলনায় উপেক্ষিতই থেকে গিয়েছিল। কাব্য-সংগীত প্রভৃতি রচনাকর্মে পঙিক্ত-চরণ বদলানোর প্রয়োজনে কাটাকুটি করতেন প্রায়ই। সেসব কাটাকুটি কখনো কখনো অভিনব সব নকশা বা আবয়বের আকৃতিও পেয়ে যেত।
পাণ্ডুলিপি দেখে বিষয়টি তাঁর সচেতন গোচরীভূত করেছিলেন তাঁর অনুরাগী আর্জেন্টাই বিদুষী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। পেরুযাত্রার পথে অসুস্থ অবস্থায় যখন তিনি আর্জেন্টিনায় ওকাম্পোর আতিথ্য গ্রহণ করনে তখন পূরবীর কবিতাগুলো লিখছিলেন তিনি। সেই পাণ্ডুলিপির কাটাকুটি দেখে ওকাম্পোর মনে হয়েছিল, সেগুলোর ভেতরে শিল্পগুণ অন্তর্নিহিত আছে। কবিকে চিত্রকর হতে প্রণোদনা জুগিয়েছিলেন তিনি। এসবই আলোচিত হয় ‘রবীন্দ্রনাথ এই সময়ে’ নামের সেমিনারের প্রথম দিনের শেষ অধিবেশনে।
অধিবেশনটি ছিল ভিন্ন স্বাদের। সভাপতি ছিলেন বরেণ্য শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। শিল্পী আবুল মনসুর তাঁর নির্ধারিত প্রবন্ধটি না পড়ে তিনি প্রজেক্টরে রবীন্দ্রনাথের আঁকা এবং তাঁর সমকালে ভারত ও ইউরোপীয় বিভিন্ন শিল্পীর চিত্রকর্ম প্রদর্শন করে স্বতঃস্ফূর্ত আলোচনা করেছেন। তুলে ধরেছেন রবীন্দ্র চিত্রকলার বৈশিষ্ট্য।
প্রবন্ধকার বলেন, ধারণা করা হয় রবীন্দ্রনাথ ছবি আঁকা শুরু করেছিলেন ৬৭ বছর বয়সে। কবি নিজেই বলেছিলেন এটি তাঁর ‘শেষ বয়সের প্রিয়া’। রবীন্দ্রচিত্রকলার দুটো পর্ব ছিল। একটি ১৯২৭-২৮, দ্বিতীয়টি ১৯৪০-৪১ সাল পর্যন্ত। প্রথম পর্বের কাজে ছিল পাণ্ডুলিপির কাটাকুটি থেকে গড়ে ওঠা ছবি। এ পর্বের ছবি পরিকল্পনাবিহীনভাবে বেড়ে উঠেছে রূপ ও ছন্দ বিষয়ে সূক্ষ্ম সচেতনতা থেকে। এগুলো ঠিক পরিপূর্ণ চিত্র নয়। মূলত প্যাটার্ন বা সাদা ও কালোর বিন্যাস। এখানে তিনি রেখার ঘূর্ণন ও ছন্দময়তাকেই উদ্ভাসিত করার প্রয়াস পেয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় পর্বের চিত্রমালা অনেকখানিই ভিন্নতর। এ পর্বের কাজে কাল্পনিক প্রাণীগুলো বদলে এসেছে নারীমুখের ডৌল ঘিরে ব্যাকুল রহস্যময়তা। আছে প্রকৃতিচিত্রও।
এরপর এসেছে তাঁর আত্মপ্রতিকৃতি। নিজের ছবি এঁকেছেন রহস্যময়তার আবরণে। দৃষ্টিতে আছে বিষাদ বা বিপন্নতার ছাপ।
আলোচক শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারের মতে, রবীন্দ্রনাথ চিত্রকলার ব্যাপারে কোনো ঐতিহ্যের অনুসরণ করেননি। তিনি ছিলেন ঐতিহ্যছুট শিল্পী।
শিল্পী নিসার হোসেন বলেন, তাঁর ছবির অল্পকিছু আমরা দেখেছি। বহু ছবি অপ্রকাশিত রয়ে গেছে। কাজেই তাঁর চিত্রকলা নিয়ে চূড়ান্ত করে কিছু বলার সময় এখনো আসেনি।
শিল্পসমালোচক মইনুদ্দিন খালেদ বলেন, তিনি তাঁর কালের ইউরোপ, আমেরিকা, জাপানের শিল্পীদের কাজ দেখেছেন। আমেরিকান ইন্ডিয়ান শিল্পীদের কাজ, ইন্দোনেশিয়ার শিল্পীদের প্রাচীন ঐতিহ্যগত কাজের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। এসবের প্রভাব-প্রচ্ছায়া তাঁর ওপরে প্রভাব ফেলতে পারে কি না তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে তাঁর ছবিতে জীবনের সম্মুখীন হওয়ার ভীতি ও বিহ্বলতার প্রকাশ ঘটেছে।
সভাপতি কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, রবীন্দ্রনাথের সম্পূর্ণ কাজ এখনও প্রকাশিত হয়নি। সব কাজ প্রকাশিত হলে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। হয়তো ভীবষ্যতে অন্যান্য ক্ষেত্রের চেয়ে চিত্রকর রবীন্দ্রনাথই প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠবেন। কারণ তাঁর এ দিকটিই এখন পর্যন্ত তেমন সুবিস্তৃতভাবে আলোচনায় আসেনি। পশ্চিমা বিশ্ব যখন জাপান ও চীন ছাড়া প্রাচ্যের কোনো শিল্পকে স্বীকৃতি দিত না, সেখানে রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা প্রশংসিত হয়েছে। তিনি একটি নতুন শৈলী সৃষ্টি করেছিলেন। শিল্পসুষমা ও রং প্রয়োগের ক্ষেত্রেও তিনি বিস্ময়কর উৎকর্ষতায় এগিয়ে ছিলেন। তাঁর চিত্রকলা অমূল্য সম্পদ হয়েই থাকবে।
বিষয়: রবীন্দ্রনাথের নাটক
চির প্রাসঙ্গিকতায় ভাস্বর
* সুদীপ্ত শাহীন
রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক রচনার প্রাসঙ্গিকতা দেশ, কাল ও সমাজের মর্মমূলে প্রোথিত, যা কখনো ম্লান হওয়ার নয়। তাঁর রচনা চির নতুন ও চিরকালের, কারণ তিনি জগৎ ও জীবনকে দেখেছেন ‘আজকের চোখ’ দিয়ে, যে চোখটি তৈরি হয়েছিল অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ দর্শনের সমন্বিত অন্তর্দৃষ্টি থেকে; তাই তিনি সব সময়ই আজকের রবীন্দ্রনাথ। তাঁর নাট্য রচনায় এর ব্যত্যয় ঘটেনি। রবীন্দ্রনাথ নাট্য রচনায় ছিলেন বৈচিত্র্য সন্ধানী এবং সেই কারণে তাঁর নাটকে পাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মনোলোকের সন্ধান। রবীন্দ্রনাথ এই সময়ের সেমিনারের নাটক বিষয়ের প্রবন্ধকার আতাউর রহমান এভাবেই মূল্যায়ন-বিশ্লেষণ করেন রবীন্দ্র নাটকের।
তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথের সমগ্র নাট্যসাহিত্যে পাই ধর্মীয় ভণ্ডামি, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও ক্ষুদ্রতার স্বরূপ উদ্ঘাটন এবং প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের সোচ্চার উচ্চারণ। তিনি বাংলা নাট্যসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রূপকার, বিশ্বের অন্যতম সেরা নাট্যকারও। চির নতুন এবং চির প্রাসঙ্গিক। রবীন্দ্র নাটকের বিশ্ব পর্যটন বাস্তবতা ও সম্ভাবনা উন্মোচিত হয়েছে এই প্রবন্ধে। ব্যক্তি অভিজ্ঞতার নিরিখে তিনি নাটকগুলোর নানা মাত্রিক নির্যাস তুলে ধরেছেন।
প্রবন্ধকার শেষ রেখা টেনেছেন এভাবে—আমার বিশ্বাস, গীতাঞ্জলির ‘দুঃখে যেন করিতে পারি জয়’, তাঁর সমগ্র লেখনীসত্তার মূলমন্ত্র ছিল এবং তাঁর নাট্য রচনায় এই জীবনদর্শনের ব্যত্যয় ঘটেনি। ... রবীন্দ্রনাথ সমগ্র বিশ্বের অন্যতম সেরা নাট্যকার, চির নতুন এবং চির প্রাসঙ্গিক।
রবীন্দ্রনাথের আকুলভক্ত নন, তবে পরিসীমা বোঝার চেষ্টা করেন বলে আলোচনার সূত্রপাত করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ জামিল আহমেদ। তাঁর মতে, বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় রবীন্দ্রনাথ গৃহপালিত হয়ে আছেন। রবীন্দ্রনাথকে খুঁজতে গিয়ে তাঁকে সমালোচনা না করাই হবে সবচেয়ে বড় প্রবঞ্চনা। তিনি বলেন, নাটকের রবীন্দ্রনাথ দোদুল্যমানতায় আন্দোলিত। প্রথম দিকের নাটকে তিনি স্বদেশ ও সমাজ-সংলগ্ন হলেও পরবর্তী সময় সেই সংস্রব থেকে বেরিয়ে আসেন এবং রূপক-সাংকেতিক নাটক নির্মাণে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
রবীন্দ্রনাথ বাউলদের সঙ্গে ঈশ্বরকে খুঁজেছেন জীবন দেবতা রূপে উল্লেখ করে সৈয়দ জামিল আহমেদ স্পষ্ট করে বলেন, যে দেশে সেলফ সেন্সরশিপ হয়, সে দেশে রবীন্দ্র নাট্যচর্চা কিছুটা দুরূহ বৈকি।
রবীন্দ্রনাথের বেশির ভাগ নাটককে বর্তমান সময়ে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক বলে দাবি করেন অভিনয়শিল্পী সারা যাকের। তাঁর নাটকে বিষয়ের অনেক বেশি পুনরাবৃত্তি ঘটেছে বলে অভিমত দেন। তাসের দেশ, অচলায়তন, রক্তকরবী নাটকের বিষয়ও তুলে ধরেন।
বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় রবীন্দ্র নাটক অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক বলে সহমত প্রকাশ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক আফসার আহমেদ। তিনি বলেন, শুধু রাজনীতি চিন্তার কারণে নয়, মানুষের সর্বজনীনতায় ও জাতীয় সংকটে রবীন্দ্র নাটক পরম আশ্রয়স্থল।
সভাপতি অধ্যাপক অনুপম সেন বলেন, বহুমুখী প্রতিভা হিসেবে রবীন্দ্রনাথের তুলনা শুধু ভিক্টোর হুগো ও গ্যেটে। তাঁর মতে, রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে বলেছেন, যে জাতীয়তাবাদে কুফল আছে। তিনি বলেন, তাঁর নাটক সাংকেতিক বা রূপকধর্মী। এই নাটকের মৌলিকতা অতুলনীয়। বিশ্বসাহিত্যে এমন নাটক বিরল। তিনি একই সঙ্গে জাতীয়তাবাদী হয়েও আন্তর্জাতিকতাবাদী। বাঙালিত্বকে অসাধারণভাবে উপস্থাপন করেছেন। আবার সমাজের প্রত্যেক মানুষের মুক্তির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের মুক্তি ঘটবে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। নাটকে সেই বিশ্বাস পরস্ফুিট করে তুলেছেন। তিনি কেবল এই সময়েই প্রাসঙ্গিক নন, তিনি কালজয়ী। শেক্সপিয়র সম্পর্কে তলস্তয়ের তির্যক মন্তব্য উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, যতই সমালোচনা হোক, রবীন্দ্র নাটক আজ শুধু নয়, শত বছর পরেও পঠিত হবে, মঞ্চস্থ হবে। কেননা, তা সময়কে ধারণ করেছে, তার দাবি মিটিয়েছে। এ কারণে দীর্ঘকাল ধরে রবীন্দ্রনাথ শুধু বাঙালিকে নয়, সারা বিশ্বকে আনন্দ দেবে।
বিষয়:রবীন্দ্র-বিবেচনায় মনুষ্যত্বের দায়
কালের রবীন্দ্রনাথ
* তৈমুর রেজা
অর্থনৈতিক শোষণ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ—এটা প্রসঙ্গ হিসেবে বিরাট। আকবর আলি খান সংক্ষেপে তাই ব্রিটিশ শাসন, জমিদারি ব্যবস্থা, বঞ্চিত মানুষ—এ রকম কয়েকটি প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন।
ব্রিটিশ শাসনের সাম্রাজ্যবাদী দিকটার প্রতি রবীন্দ্রনাথের স্পষ্ট ঘৃণা ছিল। তাঁর বহু লেখায় তা এসেছে। তবে মহাত্মা গান্ধী বা কার্ল মার্ক্স যেভাবে ব্রিটিশ শাসনকে দেখেছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠিক সেভাবে দেখেননি। তিনি মাঝামাঝি একটা দৃষ্টিভঙ্গি বেছে নিয়েছিলেন। গান্ধীর মত ছিল, পাশ্চাত্য সভ্যতা খারাপ জিনিস, তাই বর্জনীয়। আর মার্ক্সের মত ছিল, ভারতবর্ষে ব্রিটিশ কলোনি আদতে ‘আনকনশাস টুল অব হিস্টরি’, এই শোষণের মধ্য দিয়েই সমাজ রূপান্তরিত হবে। গান্ধী সত্য হলে ভারতবর্ষ চরকায় সুতা কাটত। আর মার্ক্স সত্য হলে আমাদের সমাজ আমূল বদলে যেত। কিন্তু এ দুটির কোনোটিই ঘটেনি। রবীন্দ্রনাথের কথাই ফলেছে: প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের একটা সমন্বয় ঘটেছে।
জমিদারি সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের মত হলো, জমিদারি ছেড়ে দেওয়া উচিত, কিন্তু মুশকিল হলো, জমিদার চলে গেলে মহাজন ও রায়ত-খাদকদের প্রতিপত্তি বেড়ে যাবে। তাই আইন করে জমিদারি সমস্যার নিদান হবে না। ভেতর থেকে প্রাণসঞ্চার লাগবে। দারিদ্র্য প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ মার্ক্সীয় বা ধ্রুপদি কোনো অর্থনৈতিক ঘরানার মতামতই গ্রহণ করেননি। তিনি মানব উন্নয়নের ওপর জোর দিয়েছেন: দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে, ক্ষমতায়ন করতে হবে। তাঁর মৃত্যুর ৫০ বছর পর এসব কথা আমরা শুনছি অমর্ত্য সেনদের মতো উন্নয়ন-অর্থনীতিকদের মুখে। রবীন্দ্রনাথ শ্রেণিসংগ্রামে বিশ্বাস করতেন না। অর্থনৈতিক কাঠামো বদলালেই সমাজ রূপান্তর হবে, এমনটা তিনি ভাবেননি।
বর্ণবাদ বা জাতিভেদ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মত ঠিক কালোত্তীর্ণ নয়। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের আগে জাতিভেদ যতটা ছিল, পরে তার থেকে বহু গুণে বেড়েছে। কালোর ওপর সাদার শ্রেষ্ঠত্ব তৈরি করে তারাই বর্ণবাদের পত্তন করে। রবীন্দ্রনাথ চিরকাল অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে আপসহীন ছিলেন। তবে জাতিভেদের অন্যতর দিক, যেমন ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব, অসবর্ণ বিয়ে, বিভিন্ন জাতির মধ্যে আহারাদি—এসব নিয়ে তাঁর প্রতিবাদ নেই। বর্ণাশ্রমকে ‘মঙ্গল’ ভেবেছেন। শূদ্র প্রসঙ্গে তাঁর ধারণা ছিল, ‘যারা শূদ্র, শূদ্রত্বে তাদের অসন্তোষ নেই’। জাতিভেদ প্রসঙ্গে তাঁর চিন্তা আসলে দেবেন্দ্রনাথের চিন্তারই প্রতিধ্বনি।
নারীমুক্তির প্রশ্নে অনেক ক্ষেত্রেই তিনি উদারভাবে ‘পুরুষশাসিত সমাজের দুর্বলতা’র কথা বলেছেন। কিন্তু তিনি বোধহয় নারীর সামাজিক অবস্থা নিয়ে তেমন উদ্বিগ্ন ছিলেন না, নারীহূদয় নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। তাঁর মতে, আমাদের সমাজে স্ত্রীলোকেরা বেশ এক রকম সুখে আছে।
রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় নারীর অবস্থান কি এগিয়েছে? নারী-পুরুষের অনুপাত দেখলে এটা সহজে বোঝা যায়। জৈবিক নিয়মে নারীর সংখ্যা বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক, কম হলে বুঝতে হবে সমাজে বৈষম্য চলছে। অমর্ত্য সেন এসব হারিয়ে যাওয়া নারীকে বলেছেন ‘মিসিং উইমেন’। ১৮৭২ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত বাংলায় ক্রমাগতভাবে নারীর অনুপাত কমে গেছে। এর প্রধান কারণ বাল্যবিবাহ ও অপুষ্টির ফলে ঘটা মাতৃমৃত্যু। এগুলো নারীদের প্রকৃত সমস্যা। রবীন্দ্রনাথ এদিকে আকৃষ্ট হননি। নিজেও শিশুকে বিয়ে করেছেন, মেয়েদেরও শিশু অবস্থায় বিয়ে দিয়েছেন। তাঁর সাহিত্যে বাল্যবিবাহকে রোমান্টিক করেছেন। আমাদের মেয়েরা সবার খাওয়া শেষে যদি কিছু থাকে, তা-ই খায়। তিনি এর প্রশংসা করেছেন। কিন্তু এটাই আমাদের নারীর অপুষ্টির একটা বড় কারণ।
এসব সীমাবদ্ধতা তাঁর মধ্যে আছে। এমন ভাবার কোনো কারণ নেই যে সব ব্যাপারেই কালকে ছাড়িয়ে উঠবেন তিনি। এতে তাই আঁতকে ওঠার মতো কিছু নেই যে তিনি জাতিভেদ ও নারী প্রশ্নে ‘সেকেলে’ ছিলেন।
তাঁর লেখার প্রধান শক্তি দুটি: তিনি মানবতাবাদী ছিলেন এবং তিনি আদর্শবাদী ছিলেন না। আদর্শ বা মূল্যবোধের চেয়ে সব সময় তিনি মানুষকে ওপরে ঠাঁই দিয়েছেন। বিপ্লব তাঁর বাসনা ছিল না, কারণ বিপ্লবে সমস্যার নিরাময় ঘটে না বলেই তাঁর বিশ্বাস। তিনি চেয়েছেন বঞ্চিতের ক্ষমতায়ন, শিক্ষার প্রসার আর সচেতনতা।
সংক্ষেপে মোটামুটি এ রকমই দাঁড়াবে আকবর আলি খানের বক্তব্য। আলোচক হায়াৎ মামুদ বললেন, রবীন্দ্রনাথকে তো আর আমরা এভাবে বিচার করি না যে রবীন্দ্রনাথ সমাজসংস্কারক। তিনি নিজেও জানতেন, এ কাজ তাঁর নয়। তিনি যা সংস্কার করবেন তা হলো একটি দেশের, একটি জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সাহিত্য। মালেকা বেগমের মতে, রবীন্দ্রনাথ সমকালীন, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি আধুনিক ও উদার। তাঁকে সামগ্রিকভাবে বুঝতে হবে। রবীন্দ্রনাথ যখন বঞ্চিতের কথা বলেন, তার মধ্যে আমরা নারীকে পাই। খালিকুজ্জামান ইলিয়াস আইনস্টাইনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত তর্কের প্রসঙ্গ ধরে আলোচনা করেন।
সভাপতি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর বক্তব্যে জানালেন, গান্ধী ও মার্ক্স দুজনের থেকেই দূরে রবীন্দ্রনাথ। তবে গান্ধী থেকে যতটা দূরে, মার্ক্স থেকে অত দূরে ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথ ধর্মের সঙ্গে শিল্প-সমাজ-রাষ্ট্রকে গুলিয়ে ফেলার পক্ষপাতী ছিলেন না।
বিষয়: রবীন্দ্রনাথের জাতি-ভাবনা
কবির নো-নেশন
বিনায়ক সেনের প্রবন্ধটি কয়েকটি অংশে বিভক্ত। প্রথম ভাগ—মোহ ও মোহভঙ্গ। এই ভাগের আলাপের বিষয় রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনে নেশনের ঘোর, যে কালপর্বে ‘বাংলার বাইরের বিশ্বকে তিনি দেখছেন বাঙালির চোখ দিয়ে’। কিন্তু ১৯০৫ সালে হঠাৎ করেই রবীন্দ্রনাথ নিজেকে স্বদেশি আন্দোলন থেকে সরিয়ে নেন। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে চিঠিতে লেখেন, ‘...যতদিন আয়ু আছে, আমার এই প্রদীপটিকে জ্বালিয়া পথের ধারে বসিয়া থাকিব।’
দ্বিতীয় ভাগ—১৮৮৫-১৯০৯: নেশন-ভাবনার প্রথম পর্ব। এ পর্বে বিনায়ক সেন জানাচ্ছেন, একটি বিকল্প নেশনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু নেশনমাত্রই ব্যতিক্রমের ছদ্মাবরণে আসে, ক্রমে তার স্বভাব একই হয়ে দাঁড়ায়।
১৯১০ সালে গোরা উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথের মোহভঙ্গ ঘটে। তিনি নেশনের ওপর আস্থা হারান। নানা রকম সামাজিক বিভক্তি জারি থাকায় নেশন নির্মাণ সম্ভব নয়—এটাই ছিল তাঁর অনাস্থার মূল কারণ। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বহু দিন থেকে ‘একটা পাপ চলিয়া আসিতেছে’, আর শিক্ষিত-মূর্খের ফারাকটা এতদূর যে, আমরা ‘এক দেশে থাকিলেও’ এক দেশে নেই।
তৃতীয় ভাগ—১৯১০-১৯৪১: নেশন-ভাবনার দ্বিতীয় পর্ব। এই কাল-পর্বে রবীন্দ্রনাথ নেশন আইডিয়াকেই প্রশ্ন করলেন। ন্যাশনালিজমের তিনি নাম দিলেন ‘জিওগ্রাফিক্যাল ডেমন’। গোড়ার দিকে তাঁর ধারণা ছিল, ‘নেশন একটি মানস পদার্থ’। কিন্তু কিছুকাল পরেই তাঁর মতামত: নেশন হলো ‘সেই অস্বাভাবিক অবস্থা’ যা গোটা জনসাধারণকে ‘যান্ত্রিক প্রয়োজনে’ সংঘবদ্ধ করে।
ন্যাশনালিজম বিশেষ করে কেন ভারতবর্ষের বেলায় খাটবে না, সে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ: ইউরোপে শাসক-শোষিতের যে ভেদ ঘটেছিল, ‘তা জাতিগত ভেদ নয়, শ্রেণীগত ভেদ’। অথচ ভারতবর্ষে ভেদ ঘটছে মূলত ধর্ম ও জাতির ছুতোয়। ভারতবর্ষে যখন স্বরাজ আন্দোলনের জোয়ার চলছে, তখন রবীন্দ্রনাথের মন পড়ে আছে সমাজের ‘বিচিত্র ছলনাজালে’। তিনি নাছোড়বান্দার মতো বলছেন, আগে চাই আত্মশক্তি, তারপর স্বরাজ। রবীন্দ্রনাথের এই চরমপন্থা তখনকার রাজনীতিতে কলকে পায়নি। কিন্তু তাতে তিনি চঞ্চল হননি, তার কারণ বোধহয় রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন প্রবল ভেদের ‘দুর্বল ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে নেশন গড়ার আন্দোলন... এসব ভেদবুদ্ধিকেই আরো বাড়িয়ে তুলবে।’
পরের ভাগ—অনাধুনিক না উত্তর-আধুনিক? এই অংশে রাবীন্দ্রিক-নেশন প্রসঙ্গে পার্থ চট্টোপাধ্যায় যে সমালোচনা দিয়েছেন, সেটা নিয়ে আলাপ তুলছেন সেন। পার্থের মোদ্দা কথা হলো, আধুনিক কল্যাণমুখী রাষ্ট্র বা গণতন্ত্রের ধারণা রবীন্দ্রনাথের আমলে ছিল না, যন্ত্র বোঝার ধৈর্যও তাঁর ছিল না। এখনকার নেশন-স্টেট বুঝতে রবীন্দ্রনাথ ধরতাই হিসেবে তাই সেকেলে।
পার্থ চট্টোপাধ্যায় যেমন একদিকে রবীন্দ্রনাথের নেশন-ভাবনাকে ‘বেহুদা’ বলছেন, অন্যদিকে আবার কেউ কেউ তাঁকে ভাবছেন, ‘উত্তর-আধুনিক’। ই পি থম্পসনের এ ব্যাপারে সাক্ষ্য আছে, আশিষ নন্দীও রবীন্দ্রনাথের নেশন বিরোধী সমালোচনায় খুঁজে পাচ্ছেন ‘স্টেট বিরোধী এক মতাদর্শ যাতে স্বদেশপ্রেমের জায়গা আছে কিন্তু নেশনালিজমের নেই’। আর ইসাহ্ বার্লিন চোখে রবীন্দ্রনাথ ‘দুঃসাধ্য মধ্যপন্থার’ সাধনায় একাকী পথিক।
শেষ ভাগ—নো-নেশনের সমাজ। রবীন্দ্রনাথ কড়া ভাষায় নেশনের সমালোচনা করেছেন, কিন্তু অতটা কড়া ছোপে ‘নো-নেশনের’ ছবি আঁকেননি। কিছু ছিটেফোঁটা চিন্তার খোঁজ মিলবে। ঐক্য রাখার প্রয়োজনে তিনি ‘ভারতবর্ষে এক রাষ্ট্র শাসন না হয়ে যুক্তরাষ্ট্র শাসননীতির প্রবর্তন’ হোক, এটা মেনে নিয়েছিলেন। নো-নেশনের সমাজের দৃষ্টান্ত তিনি খুঁজে পেয়েছেন ভারতবর্ষের বাইরে: চীন, জাপান, পারস্য ও তুরস্কে। তাঁর মতে, নো-নেশনের সমাজের একটা প্রধান অবলম্বন হবে সমগ্র জনসাধারণের উদ্ভাবনী শক্তি। আমলাতন্ত্রেরও কঠোর সমালোচনা করেছেন তিনি।
যন্ত্র বোঝার ধৈর্য তাঁর ছিল না—এই অভিযোগ সর্বাংশে সত্য নয়। বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় ‘যৌথতার নতুন নির্মাণের’ তিনি স্তুতি করেছেন বটে, আবার মানব চরিত্রের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার রীতিও তিনি ঠিক মনে করেননি।
বিনায়ক সেন সিদ্ধান্ত টানছেন, রবীন্দ্রনাথ ‘এ ভূখণ্ডের রাজনৈতিক চিন্তার ইতিহাসে এক ট্রাজিক চরিত্র’। তিনি যা বিশ্বাস করতেন, তা-ই বলতেন, তাঁর ‘এই-বলার’ সঙ্গে ‘ঐ-বলা’ সব সময় মেলেনি। কিন্তু তিনি দাঁড় বেয়েছেন স্রোতের বিপরীতে। ফলে সমকালীন চিন্তার স্রোত থেকে তিনি ছিটকে গেছেন। সে জন্যই জীবনের উপান্তে নিজেকে তিনি দেখেছেন ব্রাত্যহীনদের দলে।
আলোচকদের মধ্যে সলিমুল্লাহ খান রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের সম্পর্ক নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন। আর সভাপতি আনিসুজ্জামান তাঁর আলোচনায় সামগ্রিকভাবে রবীন্দ্রনাথের জাতি-ভাবনার একটি রূপ নির্মাণ করেছেন।
বিষয়: রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা
পথের দিশা
* জসীম মজুমদার
প্রথম আলো ও ব্র্যাক ব্যাংক আয়োজিত ‘রবীন্দ্রনাথ, এই সময়ে’ শীর্ষক দুই দিনের সেমিনারের সর্বশেষ অধিবেশনের বিষয় ছিল রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সভাপতিত্বে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রাবন্ধিক-সাংবাদিক আবুল মোমেন। আলোচক ছিলেন মোহিত উল আলম, গোলাম মোস্তফা ও দ্বিজেন শর্মা। প্রবন্ধকার জানান, ইংরেজ-প্রবর্তিত চলমান শিক্ষাব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতা নিয়ে বাঙালি সারস্বত সমাজে বরাবরই সমালোচনা ছিল। গত পঞ্চাশ বছরে তা জোরদার হয়ে শিক্ষায় নানা রকম সংস্কার ও নবায়ন চলছে বটে কিন্তু তাতেও আশানুরূপ উন্নতি যে হচ্ছে না সে বিষয়েও আমরা সবাই সজাগ। বরং ইদানীং উন্নত বিশ্বে এবং তার রেশ ধরে আমাদের এ অঞ্চলেও পেশা নয় ‘জীবনের জন্য শিক্ষার’ কথাবার্তাও কিছু কিছু শোনা যাচ্ছে। এই পটভূমিতে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শন আবার যেন প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
অন্যের চাপিয়ে দেওয়া শিক্ষাব্যবস্থায় যে আমরা প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারব না তা কিন্তু তখনই রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন এবং আক্ষেপ করে বলেছিলেন, আধুনিক শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি বলে তা মাঝপথেই অনেকখানি হারিয়ে যায়।
আলোচক অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা যেমন বলছেন, রবীন্দ্রনাথ তখনো আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন, আমাদের দেশে কিছু বৃত্তিজীবী তৈরি হবে, মানুষ তৈরি হবে না। রবীন্দ্রনাথ এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থার কথা ভেবেছিলেন যেটিতে শৃঙ্খল থাকবে না, মুক্তির আনন্দ থাকবে।
রবীন্দ্রনাথের আনন্দের ধারণাটিও বুঝতে হবে তাঁর সৃষ্ট সাহিত্য ও শিল্পের প্রেক্ষাপটে।
রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তায় শিক্ষক ও শিক্ষালয়ের পরিবেশ প্রধান দুটি বিষয়। ১৩৪৩ সনে তিনি শান্তিনিকেতনে স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট বলতে গিয়ে লিখেছেন, ‘অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে আমার মনে এই কথাটি জেগে উঠেছিল, ছেলেদের মানুষ করে তোলবার জন্যে যে একটা যন্ত্র তৈরি হয়েছে, যার নাম ইস্কুল, সেটার ভিতর দিয়ে মানবশিশুর শিক্ষার সম্পূর্ণতা হতেই পারে না।’
দ্বিজেন শর্মা বলছেন, পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থা কিন্তু নৃভিত্তিক এবং এই ক্ষেত্রে তারা সফল। আর আমরা যা করছি তা হচ্ছে পাশ্চাত্য শিক্ষা পদ্ধতিরই অবিকল সংস্করণ। আমরা যেমন এটা এখন উপলব্ধি করছি, রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তখনই বলেছিলেন, আমাদের শিক্ষাকে আমাদের নিজেদের হাতে নিতে হবে। অর্থাৎ আমাদের উপযোগী করেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
মোহিত উল আলম এর উত্তরণে আবার আমাদের জানাচ্ছেন, আনন্দময় জীবনযাপন বা জীবন উদ্যাপনের মস্ত আকাঙ্ক্ষা মানুষের তা সার্থক হবে তার দুটি সামর্থ্যের ভিত্তিতে—আত্মবিকাশ ও আত্মপ্রকাশ।
বিকাশ হলো ব্যক্তির প্রস্তুতির অংশ আর প্রকাশ হলো সেই প্রস্তুতির ফসল। একটি ঘটবে ভেতরে ভেতরে আর অন্যটি ফুটবে বাইরে। একদিকে অনুশীলন ও সাধনা, অন্যদিকে সক্রিয়তা ও সৃষ্টি। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন মানুষের সব চর্চার চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে—বিকশিত হওয়া, প্রকাশিত হওয়া।
আত্মবিকাশ ও আত্মপ্রকাশের পথটি কীভাবে তৈরি হবে শিশুর জন্য তার জন্য রবীন্দ্র-সাহিত্য থেকেই কতগুলো উপায় বের করেছেন প্রবন্ধকার আবুল মোমেন— ১. শিশুর জন্য ঘরে ও স্কুলে অভয় মন্ত্রে অনুকূল সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে; ২. তার আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদার বোধে কোনো আঘাত দেওয়া যাবে না, তা সযত্নে রক্ষা করতে হবে; ৩. তার সুপ্ত সহজাত মৌলিক ক্ষমতার বিকাশে সহায়তা দিতে হবে, যেমন—তার সব ইন্দ্রিয়শক্তির এবং ভাষা, সুর ও দৃশ্যমানের রূপ ও রঙের বোধ; ৪. গাছপালা-নদী-জলাশয়-মাঠ-খেত-সমুদ্র-পর্বত, আকাশ-মহাজগৎ ইত্যাদি সম্পর্কে তাকে সচেতন ও সংবেদনশীল করে তুলতে হবে; ৫. পরিবার-প্রতিবেশ ছাড়াও সাধারণভাবে মানুষ সম্পর্কে তাকে আগ্রহী ও দায়িত্বশীল করে তুলতে হবে; ৬. তার সহজাত যুক্তি-বিবেচনা ও দায়বোধকে এবং বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষমতাকে ক্রমশ উন্নত ও পরিণত করে তুলতে হবে; ৭. তার জন্য সব কাজে প্রত্যক্ষ ও সক্রিয় অংশগ্রহণের এবং প্রশ্ন তোলার ও করার অবারিত সুযোগ দিতে হবে; ৮. সৃজনশীল ও প্রায়োগিক কলা চর্চায় তাকে উদ্বুদ্ধ ও সর্বোচ্চ সুযোগ দিতে হবে; ৯. স্বাজাত্যবোধ, মানবসভ্যতার উত্তরাধিকার ও বৈশ্বিক চেতনায় তাকে পুষ্ট করতে হবে; ১০. সমকালীন যেসব ইস্যু প্রকৃতি, মানুষ ও বিশ্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা ও উদ্বেগের কারণ সেগুলো সম্পর্কে সচেতন ও সংবেদনশীল হবে।
চাকরি বা অর্থ উপার্জন যদি শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য হয় তবে তার চেয়ে ভয়ংকর আর কিছু নেই। দ্বিজেন শর্মা যেমন আশা প্রকাশ করেছেন, হয়তো কোনো মনীষী নতুন কোনো শিক্ষাব্যবস্থা আনবেন, যেটা হবে প্রকৃতিবান্ধব এবং শিক্ষাক্ষেত্র হবে সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতামূলক।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ আলোচনার ইতি টানেন এভাবে: রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এই উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ রেনেসাঁ-মানব। তিনি এমন এক শিক্ষাব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছিলেন যার মাধ্যমে এই রেনেসাঁ-মানব তৈরি হবে।
কাছে ফেরার তাগিদ
* কাজল রশীদ
১০০ বছর বা তারও আগে লেখা রবীন্দ্রনাথের গল্প-উপন্যাসের প্রয়োজন কি শুধুই একাডেমিক বা ঐতিহাসিক? প্রবন্ধকার ওয়াসি আহমেদ নিজে এ প্রশ্নের উত্তর অন্বেষণ করেছেন। আলোচকত্রয় ও সভাপতিও বিচিত্র পথে একই সত্য অনুসন্ধান করেছেন। ‘রবীন্দ্রনাথের কথাসাহিত্য বিষয়ে’ প্রবন্ধকার বলেন: ‘রবীন্দ্রনাথকে খণ্ডিত করে গল্প-উপন্যাসের রচয়িতা গণ্য করলেও তাঁর কথাসাহিত্যিক পরিচয়ের স্বয়ংসম্পূর্ণতা নিয়ে তর্কের অবকাশ থাকে না। ১০০টির কাছাকাছি গল্পই লেখেননি, বাংলা সাহিত্যের এই উজ্জ্বল শাখাটির তিনিই জনক। উপন্যাস লিখেছেন এক ডজনের বেশি। শ্রেণী বিভাগের প্রয়োজনে কথাসাহিত্যকে আলাদা করলেও রবীন্দ্রনাথের কবিতা-নাটকসহ বহুবিধ সৃজনী কর্মকাণ্ডের নির্যাসকে একটি অভিন্ন চিন্তাচেতনার ঐক্যে গাঁথা চলে। রবীন্দ্রনাথ কোনো ডকট্রাইনেয়ার দর্শনের প্রবক্তা ছিলেন না। মৌলিক চিন্তাভাবনাপ্রসূত কোনো নন্দনতাত্ত্বিক দর্শনও তিনি প্রতিষ্ঠিত করেননি। প্রয়োজনমতো নানা উৎস থেকে এর উপাদান সংগ্রহ করেছেন।’
ভাবনা, যৌক্তিকতা ও বিশ্লেষণের সমন্বয়ে কথাসাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথকে এভাবেই খুঁজে ফিরেছেন প্রবন্ধকার।
রবীন্দ্রনাথের সৃজনসম্ভারের সঙ্গে পূর্বাপর বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করেছেন কখনো প্রত্যক্ষে, কখনো বা পরোক্ষে। হাজির করেছেন তাঁর সমসাময়িক, আগের কিংবা পরের লেখক-সাহিত্যিক, কবি-সমালোচক, তাত্ত্বিক ও সাহিত্যবোদ্ধাদের। আন্তর্জাতিকতার নিরিখে, দেশজ প্রেক্ষাপটে, সমাজ-রাষ্ট্র-ব্যক্তির আলোকেও প্রবন্ধকার রবীন্দ্র কথাসাহিত্যের একটি স্বর্ণরেখা টেনেছেন। যে রেখা কখনো গন্তব্যে গেছে, কখনো যায়নি। তবে পরিব্রাজক সত্তাকে উন্মোচিত করেছেন। যার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্র কথাসাহিত্যের অপরূপ রূপ বিন্যস্ত হয়েছে।
প্রবন্ধকারের ভাষায়:
দার্শনিক বিবেচনায় রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক সাহিত্যকৃতিতে ঐক্যের সন্ধান মিললেও তাঁর গল্প ও উপন্যাসের জগৎ বিষয়ভাবনা ও প্রকারগত দিক থেকে একে অন্যের থেকে আলাদা।...গল্পগুচ্ছ-এ স্বল্প পরিসরে হলেও তিনি গল্পের ভেতর দিয়ে ভাবনাকে ছুঁয়েছেন, অন্যদিকে উপন্যাসে আইডিয়াকে দাঁড় করাতেই গল্পের কাঠামোর আশ্রয় নিয়েছেন, এমনকি চরিত্রেরও।
কথাসাহিত্যে তাঁর মানবতাবাদী শ্রেয়নীতিকে বলা যায় জীবনদেবতারই প্রতিরূপ।...এ প্রসঙ্গে ঘরে বাইরের দৃষ্টান্ত টানা যেতে পারে। উপন্যাসের ঢঙে এখানে রবীন্দ্রনাথ যা দাঁড় করিয়েছেন, প্রকৃতপক্ষে তা দেশ, জাতীয়তাবাদবিষয়ক থিসিস।...বিমলা-সন্দীপের রাজনৈতিক রোমান্সের সমাপ্তি ঘটাতে এবং নিখিলেশের থিসিসই যে শ্রেয়নীতি, তা প্রতিষ্ঠিত করতে সন্দীপকে কেবল শভিনিস্ট প্রমাণ করলে চলে না, তাকে হতে হয় লোভী, স্বার্থপর। কিন্তু মুশকিল হলো, সন্দীপ তো ব্যক্তিমাত্র, আর থিসিসের পটভূমি অগ্নিগর্ভ ভারতবর্ষ। তার পরও এক সন্দীপের উদাহরণেই শ্রেয়নীতি প্রতিষ্ঠা পায়। কথাসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথকে কাছের মানুষ অভিহিত করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মহীবুল আজিজ বলেন: ‘রবীন্দ্রনাথ কথাসাহিত্যে অনেক বেশি স্পষ্ট, কবিতার মতো রহস্যময়ী নন। তিনি সারা জীবন ছিলেন ঔপনিবেশিক লেখক, সে কারণে তাঁর ওপর একটা চাপ ছিল। সে চাপ তাঁর সমকালীন পশ্চিমা লেখকদের ছিল না। পূর্ববঙ্গবাস রবীন্দ্র কথাসাহিত্যের জন্য আশীর্বাদ, পরম পাওয়া। গল্পগুচ্ছ-এর গল্পগুলোয় যার প্রমাণ ও বৈশিষ্ট্য প্রকৃষ্টরূপে বিদ্যমান।’
তাঁর মতে, হোমারের ইলিয়াড, ওডেসিকে যেমন অস্বীকার করা যায় না, তেমনি বর্তমানের প্রাসঙ্গিকতায় রবীন্দ্রনাথের গোরাকেও অস্বীকার করা যায় না।
রবীন্দ্রনাথ জীবন-জগৎকে দেখার ক্ষেত্রে নানা প্রশ্নের মুখে পড়েছেন। বিষয়, আঙ্গিক, ভাবনায়, বিচিত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। আধুনিক কালের লেখকেরাও তা অব্যাহত রেখেছেন তাঁকে বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে সম্যকভাবে বিচার করার কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী।
রবীন্দ্রনাথ শুধু পথ চলেননি, পথ তৈরিও করেছেন। নিজের তৈরি ভাষায় লিখেছেন। বিশ্বসাহিত্যের প্রতিভাধর লেখকদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পার্থক্য এখানেই বলে উল্লেখ করেন প্রথম আলোর উপসম্পাদক কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক। প্রবন্ধকারের সঙ্গে সহমত প্রকাশ না করে তিনি বলেন: ‘রবীন্দ্রনাথ সোনার তরীর ‘বর্ষাযাপন’ কবিতায় ছোটগল্প সম্পর্কে যে কথা বলেছেন, তা মেনে ভালোই করেছেন। রবীন্দ্রনাথ আমাদের গল্প পড়তে শিখিয়েছেন। গল্পের অপূর্ব ভাষাভঙ্গির জন্যই তিনি প্রাসঙ্গিক ও বেঁচে থাকবেন।’
সভাপতি হাসান আজিজুল হক সহজ করে কঠিন কথাটি বলেছেন: ‘রবীন্দ্রনাথ আকাশের মতো উদার, আবার পলায়নপর। তাঁকে নিয়ে শেষ কথাটি বলা অত সহজ নয়।’
তিনি বলেন, সাহিত্য ক্ষেত্রে চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তিযোগ্য কিছুই নেই।
সত্যেরও যেমন নির্ধারিত রূপ নেই, মিথ্যারও নেই। দুটোই নড়াচড়া করছে। আসল কথা হলো, নিজেদের রবীন্দ্রনাথের কাছে নিয়ে যাওয়া। অন্যের মূল্যায়নের প্রতি নির্ভর না করে নিজে অনুসন্ধান করা। তাঁকে পড়া। সেখান থেকেই নিজের মতো করে গ্রহণ বা বর্জন করা। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানামুখী আলোচনা হচ্ছে। আলোচনা করে তিনি বড় কি ছোট, প্রমাণ করে লাভ নেই। আমাদের ভেতরের সব দেয়াল ভেঙে তাঁর কাছে ফেরার মধ্যেই রবীন্দ্র কথাসাহিত্যের প্রাসঙ্গিকতা অন্বেষণ সম্ভব।’
বিষয়: রবীন্দ্রনাথের কবিতা
নতুনের অপেক্ষায়
* পিয়াস মজিদ
রবীন্দ্রজন্মের ১৫০ বছর এবং প্রয়াণের ৭০ বছর পর সৈয়দ শামসুল হক রবীন্দ্রনাথের কবিতার দিকে নতুন দৃষ্টিতে তাকাতে চান। রবীন্দ্র-কবিতার বিষয়ভাগ নয়, বরং আঙ্গিকগত দিকই তাঁর আগ্রহের বস্তু। বিশেষত কবিজীবনের প্রথম থেকে শেষাবধি ছন্দের নানা নিরীক্ষা সৈয়দ হকের কাছে বিস্ময়-উদ্রেকী। ‘রবীন্দ্রনাথ: তাঁর কবিতা, আমার কাছে’ শীর্ষক প্রবন্ধে লেখকের বলার কথা এই যে মহৎ বক্তব্য পথে পড়ে থাকতে পাওয়া যায়। ইত্যাকার বক্তব্য উত্তরকালের কোনো সৃজনশীলের কাছে মহার্ঘ্য হতে পারে না। পূর্বজ কবির কাছ থেকে নেওয়ার যা থাকে তা হচ্ছে তার সৃষ্টির কারিগরি কাঠামো।
রবীন্দ্রনাথ সৈয়দ শামসুল হকের কাছে সোনার ঠাকুর নন; ভীষণভাবে একজন মানুষ কবি। তাই তিনি ফিরে তাকাতে চান তার বহুভঙ্গিম কবিজীবনের পানে। দেখেন রবীন্দ্রনাথেরও গেছে কবিতা-বন্ধ্যা সময়। দেখেন আবার এক দিনেও লিখেছেন স্মরণীয় একাধিক কবিতা। দেখেন কাটাকুটিময় কবিতার পাণ্ডুলিপি। অবিরাম শোধন-মার্জনের মধ্য দিয়ে তৈরি করছেন কবিতার কায়া। তখন অনুধাবন হয় যে কবিতা নেহায়েত ভাবের প্রসূন নয়, কবিতা কবির সচেতন নির্মাণ।
রবীন্দ্র-কবিতার কাছ থেকে এই শিক্ষা লাভ হয় আজকের কবির যে শব্দের পাশে শব্দ সংস্থাপনের ইন্দ্রজালবিদ্যা আয়ত্ত থাকতে হয় যেকোনো কবির। প্রবন্ধকার রবীন্দ্রনাথের কবিত্ব দৃষ্টিগোচরভাবে শনাক্ত করেন শব্দকে চিরকালের মতো নিজস্ব করে নেওয়ার প্রতিভাতে।
তবে রবীন্দ্র-কবিতার বিষয়ভাগে যে আধ্যাত্মিক জগতের বিস্তার তাকে সৈয়দ শামসুল হক নিজের জগৎ ভাবতে পারেন না। এ পথে সমসময়ের মানুষের মুক্তি বা স্ফূরণ সম্ভব কি না এ ব্যাপারে তিনি সংশয়াকীর্ণ। রবীন্দ্রনাথের সময় থেকে এ কালের কবির সময় গেছে বদলে। জীবন ও সমাজে এসেছে বিপুল পরিবর্তন। তাই রবীন্দ্র-কবিতার সেই দার্শনিক নেপথ্য-চালক ‘জীবনদেবতা’ এখন তার কাছে পূজনীয় নয়। দুটি মহাযুদ্ধ, সহিংসতা ও সমর, মানুষের পতন ও মূল্যবোধের বিপর্যয় ইত্যাদি নেতিমূলক পরিস্থিতির দ্রষ্টা কবিকে রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনদেবতা’র শান্ত-সৌম্য বাণী সম্মোহিত করে না। বরং ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি/ বিচিত্র ছলনাজালে/ হে ছলনাময়ী!’ রবীন্দ্র জীবনের অন্ত্যপর্যায়ী এই উচ্চারণেই সৈয়দ হক খুঁজে পান সমসাময়িক স্বরভঙ্গি।
আলোচকদের একজন খোন্দকার আশরাফ হোসেন প্রবন্ধকার সৈয়দ শামসুল হকের মতের বিরোধিতা করে বলেন যে তিনি রবীন্দ্র-কবিতার আঙ্গিকে আকর্ষিত নন বরং বিষয়ভাগের প্রতিই তাঁর মনোযোগ। ইউরোপবাহিত মডার্নিজমের চোখে রবীন্দ্রনাথের কবিতাকে দেখার ফলেই আমরা রবীন্দ্র-কবিতার স্বাদ-আস্বাদনে ব্যর্থ বলে মনে করেন তিনি। রবীন্দ্র-কবিতার ভূগোলব্যাপী আধ্যাত্মিকতার বিস্তার বলে সৈয়দ হক তাঁর ভেতর এই সময়ের কবির মুক্তি খুঁজে পান না কিন্তু খোন্দকার আশরাফ হোসেন আধ্যাত্মিকতাকেই একটি অচিকিৎস্য ব্যাপার বলে মনে করেন। টিএস এলিয়টের উদাহরণ দিয়ে আশরাফ বলেন যে তাঁর অধিকাংশ কবিতাই আধ্যাত্মিকতা-ভারাতুর কিন্তু এই সময়ের কবি বা পাঠকের কাছে তিনি মোটেও অগ্রহণীয় নন বরং দিনে দিনে এলিয়ট আরও বেশি পঠিত হচ্ছেন।
কবি নির্মলেন্দু গুণ রবীন্দ্রনাথকে দেখেন একজন পরিশ্রমী পূর্বজ কবি হিসেবে, রবীন্দ্রনাথের প্রভাব রবীন্দ্র-পরবর্তী কবিদের ভেতর প্রত্যক্ষভাবে না হলেও অন্তঃশীলে গভীরভাবে প্রবহমান বলে তাঁর ধারণা।
অপর আলোচক বিশ্বজিৎ ঘোষ দৃঢ়ভাবে মনে করেন রবীন্দ্র-কবিতার বিষয়বস্তু এখনো প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক। ফ্যাসিবাদী উন্মত্ততা, সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন, পরিবেশবিরোধী তৎপরতার কালে ‘আফ্রিকা’, ‘বৃক্ষবন্দনা’র মতো কবিতার কাছে বারবার যেতে হবে।
অধিবেশনের সভাপতি জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, সাহিত্যের ধর্মই পরিবর্তনশীলতা। সুতরাং এই সময়ের কবির কাছে রবীন্দ্র-কবিতা যে নতুনভাবে মূল্যায়িত হবে তা-ই স্বাভাবিক, তবে কবি রবীন্দ্রনাথের মূল গুরুত্বের জায়গা হচ্ছে তাঁর কবিতাভাষা। কারণ তিনি কবিতার তৈরি-ভাষা পাননি। মেধা ও শ্রমের যুগল সম্মিলনে রবীন্দ্রনাথ তৈরি করেছেন নিজের এবং বাংলার কবিতার ভাষা।
সেমিনারে অংশগ্রহণকারীদের তর্ক-বিতর্ক, বিশ্লেষণ-সংশ্লেষণে কোনো মীমাংসায় পৌঁছানো না গেলেও এই অভিন্ন উপলব্ধির কিনারে পৌঁছানো গেছে যে কবি রবীন্দ্রনাথ নতুন আবিষ্কারের অপেক্ষায়।
বিষয়: রবীন্দ্রনাথের গান
গানের ঝর্ণাতলায়
* আশীষ-উর-রহমান
‘গানের ভিতর দিয়ে যখন দেখি ভুবনখানি/ তখন তারে চিনি আমি, তখন তারে জানি’—এ কথা তিনি নিজেই বলেছিলেন। আবার সেই ভুবন ছেড়ে যাওয়ার সময় শেষ সম্বল হিসেবে যা নিতে চেয়েছেন তাঁর বিপুল সৃজনসম্ভারের মধ্য থেকে তাও গানই। গানের প্রতিই যে তাঁর আস্থা ছিল গভীর সে কথা আরও নানাভাবে ব্যক্ত করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর গান যে আমাদের গাইতেই হবে সে সম্পর্কেও নিঃসন্দেহ ছিলেন তিনি।
সেমিনারে প্রথম দিনের তৃতীয় অধিবেশনটি ছিল রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে। সভাপতি, প্রাবন্ধিক, আলোচক সবাই গানের জগতেরই মানুষ। তাঁরা যেমন রবীন্দ্রনাথের গানের বৈশিষ্ট্য, তাঁর অনন্যতা, তাঁর স্বাতন্ত্র্য এসব নিয়ে যুক্তিনিষ্ঠ বিচার-বিশ্লেষণ করেন, তেমনি তার সঙ্গে যোগ করেন গানের গায়কি কেমন হবে, হচ্ছে; কোথায় এ ক্ষেত্রে ভুলত্রুটিগুলো থেকে যাচ্ছে। রবীন্দ্রসংগীতচর্চার প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রে বাধা-প্রতিবন্ধকতার বিষয়ও তাতে বাদ পড়েনি। উপরন্তু এসব তত্ত্ব-পদ্ধতিগত আলোচনার সঙ্গে তারা যোগ করেছিলেন নিজেদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। ফলে পুরো আলোচনাটি যেমন বহুমাত্রিকতা পেয়েছিল, তেমনি হয়ে উঠেছিল রসোত্তীর্ণ।
এ পর্বে সভাপতিত্ব করেন সংগীতজ্ঞ অধ্যাপক করুণাময় গোস্বামী। প্রথমেই আসা যাক প্রবন্ধ প্রসঙ্গে। এটি উপস্থাপন করেছেন ড. মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী। প্রবন্ধটি তিনি রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথের বিচিত্র সৃজনসম্ভারের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে সেখানে গানের অবস্থানটি কোন পর্যায়ে, এবং বর্তমানে তার প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু সেই মূল্যায়ন করে। তিনি বলেন, ‘এই সময়ে মানে কোন সময়ে? বর্তমান বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত বিশ্বমন্দার এই প্রেক্ষাপটে? যদি তাই ধরে নিই তা-ই, তাহলে কবির কথা ধার করে বলতে হয়: “হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী, নিয়ত নিঠুর দ্বন্দ্ব”। এরই মধ্যে তাঁরই সৃষ্ট লেখনীতে সান্ত্বনা খুঁজে পাওয়া যায় এই পঙিক্তমালায় “বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি”।’
তিনি বলেন, ষড়ঋতুর রূপকল্প তাঁর গানের ভেতর দিয়ে যেমন অনুভব করা যায় তেমন আর কিছুতে পাওয়া যায় না। আমাদের পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনে তাঁর গান প্রেরণা জুগিয়েছে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রোধ আন্দোলনে রচিত গানগুলো বিশ্লেষণ করলে লক্ষ করা যাবে, কালোয়াতি-ধ্রুপদী গানের ছত্রচ্ছায়ায় বেড়ে উঠেও তিনি প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ও স্বদেশপ্রেমে জাতিকে উজ্জীবিত করতে বেছে নিয়েছিলেন স্বতোৎসারিত মাটি-মানুষের দেশজ লোকসুর। নিজেকে বাউল, ব্রাত্য বলতে দ্বিধাবোধ করেননি।
প্রবন্ধকার বলেন, জমিদারির দায়িত্বভার নিয়ে পূর্ববঙ্গে এসে তিনি ১৮৯০-১৯০১ পর্যন্ত প্রায় এক যুগ ধরে সাধারণ মানুষ ও লোকজ গানের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শ লাভ করেন। এ সময় তিনি অবহেলিত লোকসংগীত, গ্রাম্য ছড়াগান সংগ্রহ করেছেন। বাউল লালনের গান সংগ্রহ করে মাসিক প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশ করেছেন। লালনশিষ্য গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাব তারে’ গানের সুরে যে গানটি রচনা করেছিলেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’, সেই গানটি এখন আমাদের জাতীয় সংগীত।
আলোচনা পর্বে শিল্পী সাদি মহম্মদ প্রাধান্য দেন রবীন্দ্রসংগীত চর্চার বিষয়ে। এ ক্ষেত্রে সরকারি সংগীত মহাবিদ্যালয়ে তাঁর দীর্ঘদিনের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে বলেন, প্রধান সমস্যা হলো স্বরলিপি নিয়ে। আমরা অনেকেই স্বরলিপি বুঝতে চাই না। নবীন শিক্ষার্থীদের অনেকেই চর্চাটা শেষ পর্যন্ত অব্যাহত রাখে না। একটা পর্যায়ে গিয়ে ছেড়ে দেয়। এ ছাড়া বড় ধরনের আরও একটি সমস্যা রয়েছে উচ্চারণ নিয়ে। অনেকেই হয়তো বেশ ভালো গাইছে, গলায় সুরও আছে চমৎকার, কিন্তু উচ্চারণের বেলায় তাঁর আঞ্চলিকতার ত্রুটিগুলো এড়াতে পারে না। এগুলো এড়ানো জরুরি।
বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক ও শিল্পী লুভা নাহিদ চৌধুরী জোর দিয়েছেন নতুন প্রজন্মের কাছে রবীন্দ্রনাথকে তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তার ওপর। তিনি বলেন, ‘আমরা নতুন প্রজন্মের কাছে তাঁকে চেনাতে পারিনি। বাঙালি জাতীয়তাবোধের চেতনা জাগাতে তিনিই ছিলেন আশ্রয়। গানের মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের ছুঁয়ে গেছেন। এখন সময় বদলেছে। নতুন সময়ে তাঁর বোধ ও চেতনার আত্মীকরণের মধ্য দিয়েই তিনি প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবেন।’
শিল্পী অদিতি মহসীন বলেন, বাঙালির জীবনের নানা উপলক্ষ ও বোধকে তিনি গানটিতে স্পর্শ করেছেন। সুরের ক্ষেত্রে যেখানে যা ভালো মনে করেছেন তা আত্মস্থ করে নিজের মতো করে প্রয়োগ করেছেন।
অধ্যাপক করুণাময় গোস্বামী সভাপতির বক্তব্যে বলেন, ভাষা ও সংগীত মিলে গান তৈরি হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের গানের ভাষা এখনো পুরোনো হয়ে যায়নি। কিছু প্রেমের গানের ক্ষেত্রে, যেমন ‘চরণ ধরিতে দিও গো আমারে’, এমন করে আমরা এখন ‘চরণ’ শব্দ ব্যবহার করি না, তবে গানের অন্য ভাষা এখনো সমকালীন। কাজেই ভাষাগতভাবে তাঁর গান অনেক প্রাচীন বা দুর্বোধ্য হয়নি। সুরের ক্ষেত্রেও তিনি হিন্দুস্তানি রাগসংগীতের কড়াকড়ি থেকে বাংলা গানকে বের করে এনে আধুনিক করে তুলেছিলেন।
উপসংহারে তিনি বলেন, মানুষের ভাষা, দেশ-কাল আলাদা হলেও মানবিক অনুভূতি সব মানুষের প্রায় অভিন্ন। সেই মানবিক অনুভবের জায়গায় রবীন্দ্রনাথের গানের, তাঁর সুরের আবেদন থেকেই যাবে। সময় যত যাবে, তাঁর গানের শ্রোতাও তত বাড়তে থাকবে।
বিষয়: রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা
শেষ বয়সের প্রিয়া
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ জীবনের সৃজনসম্ভার মূলত তাঁর চিত্রকলা। আঁকাজোকার হাতেখড়ি অবশ্য হয়েছিল শৈশবেই। তবে কাব্য, সংগীত, সাহিত্যে যেভাবে আত্মনিবেদন করেছিলেন, আঁকাটা সে তুলনায় উপেক্ষিতই থেকে গিয়েছিল। কাব্য-সংগীত প্রভৃতি রচনাকর্মে পঙিক্ত-চরণ বদলানোর প্রয়োজনে কাটাকুটি করতেন প্রায়ই। সেসব কাটাকুটি কখনো কখনো অভিনব সব নকশা বা আবয়বের আকৃতিও পেয়ে যেত।
পাণ্ডুলিপি দেখে বিষয়টি তাঁর সচেতন গোচরীভূত করেছিলেন তাঁর অনুরাগী আর্জেন্টাই বিদুষী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। পেরুযাত্রার পথে অসুস্থ অবস্থায় যখন তিনি আর্জেন্টিনায় ওকাম্পোর আতিথ্য গ্রহণ করনে তখন পূরবীর কবিতাগুলো লিখছিলেন তিনি। সেই পাণ্ডুলিপির কাটাকুটি দেখে ওকাম্পোর মনে হয়েছিল, সেগুলোর ভেতরে শিল্পগুণ অন্তর্নিহিত আছে। কবিকে চিত্রকর হতে প্রণোদনা জুগিয়েছিলেন তিনি। এসবই আলোচিত হয় ‘রবীন্দ্রনাথ এই সময়ে’ নামের সেমিনারের প্রথম দিনের শেষ অধিবেশনে।
অধিবেশনটি ছিল ভিন্ন স্বাদের। সভাপতি ছিলেন বরেণ্য শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। শিল্পী আবুল মনসুর তাঁর নির্ধারিত প্রবন্ধটি না পড়ে তিনি প্রজেক্টরে রবীন্দ্রনাথের আঁকা এবং তাঁর সমকালে ভারত ও ইউরোপীয় বিভিন্ন শিল্পীর চিত্রকর্ম প্রদর্শন করে স্বতঃস্ফূর্ত আলোচনা করেছেন। তুলে ধরেছেন রবীন্দ্র চিত্রকলার বৈশিষ্ট্য।
প্রবন্ধকার বলেন, ধারণা করা হয় রবীন্দ্রনাথ ছবি আঁকা শুরু করেছিলেন ৬৭ বছর বয়সে। কবি নিজেই বলেছিলেন এটি তাঁর ‘শেষ বয়সের প্রিয়া’। রবীন্দ্রচিত্রকলার দুটো পর্ব ছিল। একটি ১৯২৭-২৮, দ্বিতীয়টি ১৯৪০-৪১ সাল পর্যন্ত। প্রথম পর্বের কাজে ছিল পাণ্ডুলিপির কাটাকুটি থেকে গড়ে ওঠা ছবি। এ পর্বের ছবি পরিকল্পনাবিহীনভাবে বেড়ে উঠেছে রূপ ও ছন্দ বিষয়ে সূক্ষ্ম সচেতনতা থেকে। এগুলো ঠিক পরিপূর্ণ চিত্র নয়। মূলত প্যাটার্ন বা সাদা ও কালোর বিন্যাস। এখানে তিনি রেখার ঘূর্ণন ও ছন্দময়তাকেই উদ্ভাসিত করার প্রয়াস পেয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় পর্বের চিত্রমালা অনেকখানিই ভিন্নতর। এ পর্বের কাজে কাল্পনিক প্রাণীগুলো বদলে এসেছে নারীমুখের ডৌল ঘিরে ব্যাকুল রহস্যময়তা। আছে প্রকৃতিচিত্রও।
এরপর এসেছে তাঁর আত্মপ্রতিকৃতি। নিজের ছবি এঁকেছেন রহস্যময়তার আবরণে। দৃষ্টিতে আছে বিষাদ বা বিপন্নতার ছাপ।
আলোচক শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারের মতে, রবীন্দ্রনাথ চিত্রকলার ব্যাপারে কোনো ঐতিহ্যের অনুসরণ করেননি। তিনি ছিলেন ঐতিহ্যছুট শিল্পী।
শিল্পী নিসার হোসেন বলেন, তাঁর ছবির অল্পকিছু আমরা দেখেছি। বহু ছবি অপ্রকাশিত রয়ে গেছে। কাজেই তাঁর চিত্রকলা নিয়ে চূড়ান্ত করে কিছু বলার সময় এখনো আসেনি।
শিল্পসমালোচক মইনুদ্দিন খালেদ বলেন, তিনি তাঁর কালের ইউরোপ, আমেরিকা, জাপানের শিল্পীদের কাজ দেখেছেন। আমেরিকান ইন্ডিয়ান শিল্পীদের কাজ, ইন্দোনেশিয়ার শিল্পীদের প্রাচীন ঐতিহ্যগত কাজের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। এসবের প্রভাব-প্রচ্ছায়া তাঁর ওপরে প্রভাব ফেলতে পারে কি না তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে তাঁর ছবিতে জীবনের সম্মুখীন হওয়ার ভীতি ও বিহ্বলতার প্রকাশ ঘটেছে।
সভাপতি কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, রবীন্দ্রনাথের সম্পূর্ণ কাজ এখনও প্রকাশিত হয়নি। সব কাজ প্রকাশিত হলে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। হয়তো ভীবষ্যতে অন্যান্য ক্ষেত্রের চেয়ে চিত্রকর রবীন্দ্রনাথই প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠবেন। কারণ তাঁর এ দিকটিই এখন পর্যন্ত তেমন সুবিস্তৃতভাবে আলোচনায় আসেনি। পশ্চিমা বিশ্ব যখন জাপান ও চীন ছাড়া প্রাচ্যের কোনো শিল্পকে স্বীকৃতি দিত না, সেখানে রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা প্রশংসিত হয়েছে। তিনি একটি নতুন শৈলী সৃষ্টি করেছিলেন। শিল্পসুষমা ও রং প্রয়োগের ক্ষেত্রেও তিনি বিস্ময়কর উৎকর্ষতায় এগিয়ে ছিলেন। তাঁর চিত্রকলা অমূল্য সম্পদ হয়েই থাকবে।
বিষয়: রবীন্দ্রনাথের নাটক
চির প্রাসঙ্গিকতায় ভাস্বর
* সুদীপ্ত শাহীন
রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক রচনার প্রাসঙ্গিকতা দেশ, কাল ও সমাজের মর্মমূলে প্রোথিত, যা কখনো ম্লান হওয়ার নয়। তাঁর রচনা চির নতুন ও চিরকালের, কারণ তিনি জগৎ ও জীবনকে দেখেছেন ‘আজকের চোখ’ দিয়ে, যে চোখটি তৈরি হয়েছিল অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ দর্শনের সমন্বিত অন্তর্দৃষ্টি থেকে; তাই তিনি সব সময়ই আজকের রবীন্দ্রনাথ। তাঁর নাট্য রচনায় এর ব্যত্যয় ঘটেনি। রবীন্দ্রনাথ নাট্য রচনায় ছিলেন বৈচিত্র্য সন্ধানী এবং সেই কারণে তাঁর নাটকে পাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মনোলোকের সন্ধান। রবীন্দ্রনাথ এই সময়ের সেমিনারের নাটক বিষয়ের প্রবন্ধকার আতাউর রহমান এভাবেই মূল্যায়ন-বিশ্লেষণ করেন রবীন্দ্র নাটকের।
তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথের সমগ্র নাট্যসাহিত্যে পাই ধর্মীয় ভণ্ডামি, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও ক্ষুদ্রতার স্বরূপ উদ্ঘাটন এবং প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের সোচ্চার উচ্চারণ। তিনি বাংলা নাট্যসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রূপকার, বিশ্বের অন্যতম সেরা নাট্যকারও। চির নতুন এবং চির প্রাসঙ্গিক। রবীন্দ্র নাটকের বিশ্ব পর্যটন বাস্তবতা ও সম্ভাবনা উন্মোচিত হয়েছে এই প্রবন্ধে। ব্যক্তি অভিজ্ঞতার নিরিখে তিনি নাটকগুলোর নানা মাত্রিক নির্যাস তুলে ধরেছেন।
প্রবন্ধকার শেষ রেখা টেনেছেন এভাবে—আমার বিশ্বাস, গীতাঞ্জলির ‘দুঃখে যেন করিতে পারি জয়’, তাঁর সমগ্র লেখনীসত্তার মূলমন্ত্র ছিল এবং তাঁর নাট্য রচনায় এই জীবনদর্শনের ব্যত্যয় ঘটেনি। ... রবীন্দ্রনাথ সমগ্র বিশ্বের অন্যতম সেরা নাট্যকার, চির নতুন এবং চির প্রাসঙ্গিক।
রবীন্দ্রনাথের আকুলভক্ত নন, তবে পরিসীমা বোঝার চেষ্টা করেন বলে আলোচনার সূত্রপাত করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ জামিল আহমেদ। তাঁর মতে, বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় রবীন্দ্রনাথ গৃহপালিত হয়ে আছেন। রবীন্দ্রনাথকে খুঁজতে গিয়ে তাঁকে সমালোচনা না করাই হবে সবচেয়ে বড় প্রবঞ্চনা। তিনি বলেন, নাটকের রবীন্দ্রনাথ দোদুল্যমানতায় আন্দোলিত। প্রথম দিকের নাটকে তিনি স্বদেশ ও সমাজ-সংলগ্ন হলেও পরবর্তী সময় সেই সংস্রব থেকে বেরিয়ে আসেন এবং রূপক-সাংকেতিক নাটক নির্মাণে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
রবীন্দ্রনাথ বাউলদের সঙ্গে ঈশ্বরকে খুঁজেছেন জীবন দেবতা রূপে উল্লেখ করে সৈয়দ জামিল আহমেদ স্পষ্ট করে বলেন, যে দেশে সেলফ সেন্সরশিপ হয়, সে দেশে রবীন্দ্র নাট্যচর্চা কিছুটা দুরূহ বৈকি।
রবীন্দ্রনাথের বেশির ভাগ নাটককে বর্তমান সময়ে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক বলে দাবি করেন অভিনয়শিল্পী সারা যাকের। তাঁর নাটকে বিষয়ের অনেক বেশি পুনরাবৃত্তি ঘটেছে বলে অভিমত দেন। তাসের দেশ, অচলায়তন, রক্তকরবী নাটকের বিষয়ও তুলে ধরেন।
বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় রবীন্দ্র নাটক অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক বলে সহমত প্রকাশ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক আফসার আহমেদ। তিনি বলেন, শুধু রাজনীতি চিন্তার কারণে নয়, মানুষের সর্বজনীনতায় ও জাতীয় সংকটে রবীন্দ্র নাটক পরম আশ্রয়স্থল।
সভাপতি অধ্যাপক অনুপম সেন বলেন, বহুমুখী প্রতিভা হিসেবে রবীন্দ্রনাথের তুলনা শুধু ভিক্টোর হুগো ও গ্যেটে। তাঁর মতে, রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে বলেছেন, যে জাতীয়তাবাদে কুফল আছে। তিনি বলেন, তাঁর নাটক সাংকেতিক বা রূপকধর্মী। এই নাটকের মৌলিকতা অতুলনীয়। বিশ্বসাহিত্যে এমন নাটক বিরল। তিনি একই সঙ্গে জাতীয়তাবাদী হয়েও আন্তর্জাতিকতাবাদী। বাঙালিত্বকে অসাধারণভাবে উপস্থাপন করেছেন। আবার সমাজের প্রত্যেক মানুষের মুক্তির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের মুক্তি ঘটবে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। নাটকে সেই বিশ্বাস পরস্ফুিট করে তুলেছেন। তিনি কেবল এই সময়েই প্রাসঙ্গিক নন, তিনি কালজয়ী। শেক্সপিয়র সম্পর্কে তলস্তয়ের তির্যক মন্তব্য উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, যতই সমালোচনা হোক, রবীন্দ্র নাটক আজ শুধু নয়, শত বছর পরেও পঠিত হবে, মঞ্চস্থ হবে। কেননা, তা সময়কে ধারণ করেছে, তার দাবি মিটিয়েছে। এ কারণে দীর্ঘকাল ধরে রবীন্দ্রনাথ শুধু বাঙালিকে নয়, সারা বিশ্বকে আনন্দ দেবে।
বিষয়:রবীন্দ্র-বিবেচনায় মনুষ্যত্বের দায়
কালের রবীন্দ্রনাথ
* তৈমুর রেজা
অর্থনৈতিক শোষণ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ—এটা প্রসঙ্গ হিসেবে বিরাট। আকবর আলি খান সংক্ষেপে তাই ব্রিটিশ শাসন, জমিদারি ব্যবস্থা, বঞ্চিত মানুষ—এ রকম কয়েকটি প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন।
ব্রিটিশ শাসনের সাম্রাজ্যবাদী দিকটার প্রতি রবীন্দ্রনাথের স্পষ্ট ঘৃণা ছিল। তাঁর বহু লেখায় তা এসেছে। তবে মহাত্মা গান্ধী বা কার্ল মার্ক্স যেভাবে ব্রিটিশ শাসনকে দেখেছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠিক সেভাবে দেখেননি। তিনি মাঝামাঝি একটা দৃষ্টিভঙ্গি বেছে নিয়েছিলেন। গান্ধীর মত ছিল, পাশ্চাত্য সভ্যতা খারাপ জিনিস, তাই বর্জনীয়। আর মার্ক্সের মত ছিল, ভারতবর্ষে ব্রিটিশ কলোনি আদতে ‘আনকনশাস টুল অব হিস্টরি’, এই শোষণের মধ্য দিয়েই সমাজ রূপান্তরিত হবে। গান্ধী সত্য হলে ভারতবর্ষ চরকায় সুতা কাটত। আর মার্ক্স সত্য হলে আমাদের সমাজ আমূল বদলে যেত। কিন্তু এ দুটির কোনোটিই ঘটেনি। রবীন্দ্রনাথের কথাই ফলেছে: প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের একটা সমন্বয় ঘটেছে।
জমিদারি সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের মত হলো, জমিদারি ছেড়ে দেওয়া উচিত, কিন্তু মুশকিল হলো, জমিদার চলে গেলে মহাজন ও রায়ত-খাদকদের প্রতিপত্তি বেড়ে যাবে। তাই আইন করে জমিদারি সমস্যার নিদান হবে না। ভেতর থেকে প্রাণসঞ্চার লাগবে। দারিদ্র্য প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ মার্ক্সীয় বা ধ্রুপদি কোনো অর্থনৈতিক ঘরানার মতামতই গ্রহণ করেননি। তিনি মানব উন্নয়নের ওপর জোর দিয়েছেন: দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে, ক্ষমতায়ন করতে হবে। তাঁর মৃত্যুর ৫০ বছর পর এসব কথা আমরা শুনছি অমর্ত্য সেনদের মতো উন্নয়ন-অর্থনীতিকদের মুখে। রবীন্দ্রনাথ শ্রেণিসংগ্রামে বিশ্বাস করতেন না। অর্থনৈতিক কাঠামো বদলালেই সমাজ রূপান্তর হবে, এমনটা তিনি ভাবেননি।
বর্ণবাদ বা জাতিভেদ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মত ঠিক কালোত্তীর্ণ নয়। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের আগে জাতিভেদ যতটা ছিল, পরে তার থেকে বহু গুণে বেড়েছে। কালোর ওপর সাদার শ্রেষ্ঠত্ব তৈরি করে তারাই বর্ণবাদের পত্তন করে। রবীন্দ্রনাথ চিরকাল অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে আপসহীন ছিলেন। তবে জাতিভেদের অন্যতর দিক, যেমন ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব, অসবর্ণ বিয়ে, বিভিন্ন জাতির মধ্যে আহারাদি—এসব নিয়ে তাঁর প্রতিবাদ নেই। বর্ণাশ্রমকে ‘মঙ্গল’ ভেবেছেন। শূদ্র প্রসঙ্গে তাঁর ধারণা ছিল, ‘যারা শূদ্র, শূদ্রত্বে তাদের অসন্তোষ নেই’। জাতিভেদ প্রসঙ্গে তাঁর চিন্তা আসলে দেবেন্দ্রনাথের চিন্তারই প্রতিধ্বনি।
নারীমুক্তির প্রশ্নে অনেক ক্ষেত্রেই তিনি উদারভাবে ‘পুরুষশাসিত সমাজের দুর্বলতা’র কথা বলেছেন। কিন্তু তিনি বোধহয় নারীর সামাজিক অবস্থা নিয়ে তেমন উদ্বিগ্ন ছিলেন না, নারীহূদয় নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। তাঁর মতে, আমাদের সমাজে স্ত্রীলোকেরা বেশ এক রকম সুখে আছে।
রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় নারীর অবস্থান কি এগিয়েছে? নারী-পুরুষের অনুপাত দেখলে এটা সহজে বোঝা যায়। জৈবিক নিয়মে নারীর সংখ্যা বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক, কম হলে বুঝতে হবে সমাজে বৈষম্য চলছে। অমর্ত্য সেন এসব হারিয়ে যাওয়া নারীকে বলেছেন ‘মিসিং উইমেন’। ১৮৭২ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত বাংলায় ক্রমাগতভাবে নারীর অনুপাত কমে গেছে। এর প্রধান কারণ বাল্যবিবাহ ও অপুষ্টির ফলে ঘটা মাতৃমৃত্যু। এগুলো নারীদের প্রকৃত সমস্যা। রবীন্দ্রনাথ এদিকে আকৃষ্ট হননি। নিজেও শিশুকে বিয়ে করেছেন, মেয়েদেরও শিশু অবস্থায় বিয়ে দিয়েছেন। তাঁর সাহিত্যে বাল্যবিবাহকে রোমান্টিক করেছেন। আমাদের মেয়েরা সবার খাওয়া শেষে যদি কিছু থাকে, তা-ই খায়। তিনি এর প্রশংসা করেছেন। কিন্তু এটাই আমাদের নারীর অপুষ্টির একটা বড় কারণ।
এসব সীমাবদ্ধতা তাঁর মধ্যে আছে। এমন ভাবার কোনো কারণ নেই যে সব ব্যাপারেই কালকে ছাড়িয়ে উঠবেন তিনি। এতে তাই আঁতকে ওঠার মতো কিছু নেই যে তিনি জাতিভেদ ও নারী প্রশ্নে ‘সেকেলে’ ছিলেন।
তাঁর লেখার প্রধান শক্তি দুটি: তিনি মানবতাবাদী ছিলেন এবং তিনি আদর্শবাদী ছিলেন না। আদর্শ বা মূল্যবোধের চেয়ে সব সময় তিনি মানুষকে ওপরে ঠাঁই দিয়েছেন। বিপ্লব তাঁর বাসনা ছিল না, কারণ বিপ্লবে সমস্যার নিরাময় ঘটে না বলেই তাঁর বিশ্বাস। তিনি চেয়েছেন বঞ্চিতের ক্ষমতায়ন, শিক্ষার প্রসার আর সচেতনতা।
সংক্ষেপে মোটামুটি এ রকমই দাঁড়াবে আকবর আলি খানের বক্তব্য। আলোচক হায়াৎ মামুদ বললেন, রবীন্দ্রনাথকে তো আর আমরা এভাবে বিচার করি না যে রবীন্দ্রনাথ সমাজসংস্কারক। তিনি নিজেও জানতেন, এ কাজ তাঁর নয়। তিনি যা সংস্কার করবেন তা হলো একটি দেশের, একটি জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সাহিত্য। মালেকা বেগমের মতে, রবীন্দ্রনাথ সমকালীন, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি আধুনিক ও উদার। তাঁকে সামগ্রিকভাবে বুঝতে হবে। রবীন্দ্রনাথ যখন বঞ্চিতের কথা বলেন, তার মধ্যে আমরা নারীকে পাই। খালিকুজ্জামান ইলিয়াস আইনস্টাইনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত তর্কের প্রসঙ্গ ধরে আলোচনা করেন।
সভাপতি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর বক্তব্যে জানালেন, গান্ধী ও মার্ক্স দুজনের থেকেই দূরে রবীন্দ্রনাথ। তবে গান্ধী থেকে যতটা দূরে, মার্ক্স থেকে অত দূরে ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথ ধর্মের সঙ্গে শিল্প-সমাজ-রাষ্ট্রকে গুলিয়ে ফেলার পক্ষপাতী ছিলেন না।
বিষয়: রবীন্দ্রনাথের জাতি-ভাবনা
কবির নো-নেশন
বিনায়ক সেনের প্রবন্ধটি কয়েকটি অংশে বিভক্ত। প্রথম ভাগ—মোহ ও মোহভঙ্গ। এই ভাগের আলাপের বিষয় রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনে নেশনের ঘোর, যে কালপর্বে ‘বাংলার বাইরের বিশ্বকে তিনি দেখছেন বাঙালির চোখ দিয়ে’। কিন্তু ১৯০৫ সালে হঠাৎ করেই রবীন্দ্রনাথ নিজেকে স্বদেশি আন্দোলন থেকে সরিয়ে নেন। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে চিঠিতে লেখেন, ‘...যতদিন আয়ু আছে, আমার এই প্রদীপটিকে জ্বালিয়া পথের ধারে বসিয়া থাকিব।’
দ্বিতীয় ভাগ—১৮৮৫-১৯০৯: নেশন-ভাবনার প্রথম পর্ব। এ পর্বে বিনায়ক সেন জানাচ্ছেন, একটি বিকল্প নেশনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু নেশনমাত্রই ব্যতিক্রমের ছদ্মাবরণে আসে, ক্রমে তার স্বভাব একই হয়ে দাঁড়ায়।
১৯১০ সালে গোরা উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথের মোহভঙ্গ ঘটে। তিনি নেশনের ওপর আস্থা হারান। নানা রকম সামাজিক বিভক্তি জারি থাকায় নেশন নির্মাণ সম্ভব নয়—এটাই ছিল তাঁর অনাস্থার মূল কারণ। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বহু দিন থেকে ‘একটা পাপ চলিয়া আসিতেছে’, আর শিক্ষিত-মূর্খের ফারাকটা এতদূর যে, আমরা ‘এক দেশে থাকিলেও’ এক দেশে নেই।
তৃতীয় ভাগ—১৯১০-১৯৪১: নেশন-ভাবনার দ্বিতীয় পর্ব। এই কাল-পর্বে রবীন্দ্রনাথ নেশন আইডিয়াকেই প্রশ্ন করলেন। ন্যাশনালিজমের তিনি নাম দিলেন ‘জিওগ্রাফিক্যাল ডেমন’। গোড়ার দিকে তাঁর ধারণা ছিল, ‘নেশন একটি মানস পদার্থ’। কিন্তু কিছুকাল পরেই তাঁর মতামত: নেশন হলো ‘সেই অস্বাভাবিক অবস্থা’ যা গোটা জনসাধারণকে ‘যান্ত্রিক প্রয়োজনে’ সংঘবদ্ধ করে।
ন্যাশনালিজম বিশেষ করে কেন ভারতবর্ষের বেলায় খাটবে না, সে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ: ইউরোপে শাসক-শোষিতের যে ভেদ ঘটেছিল, ‘তা জাতিগত ভেদ নয়, শ্রেণীগত ভেদ’। অথচ ভারতবর্ষে ভেদ ঘটছে মূলত ধর্ম ও জাতির ছুতোয়। ভারতবর্ষে যখন স্বরাজ আন্দোলনের জোয়ার চলছে, তখন রবীন্দ্রনাথের মন পড়ে আছে সমাজের ‘বিচিত্র ছলনাজালে’। তিনি নাছোড়বান্দার মতো বলছেন, আগে চাই আত্মশক্তি, তারপর স্বরাজ। রবীন্দ্রনাথের এই চরমপন্থা তখনকার রাজনীতিতে কলকে পায়নি। কিন্তু তাতে তিনি চঞ্চল হননি, তার কারণ বোধহয় রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন প্রবল ভেদের ‘দুর্বল ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে নেশন গড়ার আন্দোলন... এসব ভেদবুদ্ধিকেই আরো বাড়িয়ে তুলবে।’
পরের ভাগ—অনাধুনিক না উত্তর-আধুনিক? এই অংশে রাবীন্দ্রিক-নেশন প্রসঙ্গে পার্থ চট্টোপাধ্যায় যে সমালোচনা দিয়েছেন, সেটা নিয়ে আলাপ তুলছেন সেন। পার্থের মোদ্দা কথা হলো, আধুনিক কল্যাণমুখী রাষ্ট্র বা গণতন্ত্রের ধারণা রবীন্দ্রনাথের আমলে ছিল না, যন্ত্র বোঝার ধৈর্যও তাঁর ছিল না। এখনকার নেশন-স্টেট বুঝতে রবীন্দ্রনাথ ধরতাই হিসেবে তাই সেকেলে।
পার্থ চট্টোপাধ্যায় যেমন একদিকে রবীন্দ্রনাথের নেশন-ভাবনাকে ‘বেহুদা’ বলছেন, অন্যদিকে আবার কেউ কেউ তাঁকে ভাবছেন, ‘উত্তর-আধুনিক’। ই পি থম্পসনের এ ব্যাপারে সাক্ষ্য আছে, আশিষ নন্দীও রবীন্দ্রনাথের নেশন বিরোধী সমালোচনায় খুঁজে পাচ্ছেন ‘স্টেট বিরোধী এক মতাদর্শ যাতে স্বদেশপ্রেমের জায়গা আছে কিন্তু নেশনালিজমের নেই’। আর ইসাহ্ বার্লিন চোখে রবীন্দ্রনাথ ‘দুঃসাধ্য মধ্যপন্থার’ সাধনায় একাকী পথিক।
শেষ ভাগ—নো-নেশনের সমাজ। রবীন্দ্রনাথ কড়া ভাষায় নেশনের সমালোচনা করেছেন, কিন্তু অতটা কড়া ছোপে ‘নো-নেশনের’ ছবি আঁকেননি। কিছু ছিটেফোঁটা চিন্তার খোঁজ মিলবে। ঐক্য রাখার প্রয়োজনে তিনি ‘ভারতবর্ষে এক রাষ্ট্র শাসন না হয়ে যুক্তরাষ্ট্র শাসননীতির প্রবর্তন’ হোক, এটা মেনে নিয়েছিলেন। নো-নেশনের সমাজের দৃষ্টান্ত তিনি খুঁজে পেয়েছেন ভারতবর্ষের বাইরে: চীন, জাপান, পারস্য ও তুরস্কে। তাঁর মতে, নো-নেশনের সমাজের একটা প্রধান অবলম্বন হবে সমগ্র জনসাধারণের উদ্ভাবনী শক্তি। আমলাতন্ত্রেরও কঠোর সমালোচনা করেছেন তিনি।
যন্ত্র বোঝার ধৈর্য তাঁর ছিল না—এই অভিযোগ সর্বাংশে সত্য নয়। বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় ‘যৌথতার নতুন নির্মাণের’ তিনি স্তুতি করেছেন বটে, আবার মানব চরিত্রের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার রীতিও তিনি ঠিক মনে করেননি।
বিনায়ক সেন সিদ্ধান্ত টানছেন, রবীন্দ্রনাথ ‘এ ভূখণ্ডের রাজনৈতিক চিন্তার ইতিহাসে এক ট্রাজিক চরিত্র’। তিনি যা বিশ্বাস করতেন, তা-ই বলতেন, তাঁর ‘এই-বলার’ সঙ্গে ‘ঐ-বলা’ সব সময় মেলেনি। কিন্তু তিনি দাঁড় বেয়েছেন স্রোতের বিপরীতে। ফলে সমকালীন চিন্তার স্রোত থেকে তিনি ছিটকে গেছেন। সে জন্যই জীবনের উপান্তে নিজেকে তিনি দেখেছেন ব্রাত্যহীনদের দলে।
আলোচকদের মধ্যে সলিমুল্লাহ খান রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের সম্পর্ক নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন। আর সভাপতি আনিসুজ্জামান তাঁর আলোচনায় সামগ্রিকভাবে রবীন্দ্রনাথের জাতি-ভাবনার একটি রূপ নির্মাণ করেছেন।
বিষয়: রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা
পথের দিশা
* জসীম মজুমদার
প্রথম আলো ও ব্র্যাক ব্যাংক আয়োজিত ‘রবীন্দ্রনাথ, এই সময়ে’ শীর্ষক দুই দিনের সেমিনারের সর্বশেষ অধিবেশনের বিষয় ছিল রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সভাপতিত্বে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রাবন্ধিক-সাংবাদিক আবুল মোমেন। আলোচক ছিলেন মোহিত উল আলম, গোলাম মোস্তফা ও দ্বিজেন শর্মা। প্রবন্ধকার জানান, ইংরেজ-প্রবর্তিত চলমান শিক্ষাব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতা নিয়ে বাঙালি সারস্বত সমাজে বরাবরই সমালোচনা ছিল। গত পঞ্চাশ বছরে তা জোরদার হয়ে শিক্ষায় নানা রকম সংস্কার ও নবায়ন চলছে বটে কিন্তু তাতেও আশানুরূপ উন্নতি যে হচ্ছে না সে বিষয়েও আমরা সবাই সজাগ। বরং ইদানীং উন্নত বিশ্বে এবং তার রেশ ধরে আমাদের এ অঞ্চলেও পেশা নয় ‘জীবনের জন্য শিক্ষার’ কথাবার্তাও কিছু কিছু শোনা যাচ্ছে। এই পটভূমিতে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শন আবার যেন প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
অন্যের চাপিয়ে দেওয়া শিক্ষাব্যবস্থায় যে আমরা প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারব না তা কিন্তু তখনই রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন এবং আক্ষেপ করে বলেছিলেন, আধুনিক শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি বলে তা মাঝপথেই অনেকখানি হারিয়ে যায়।
আলোচক অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা যেমন বলছেন, রবীন্দ্রনাথ তখনো আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন, আমাদের দেশে কিছু বৃত্তিজীবী তৈরি হবে, মানুষ তৈরি হবে না। রবীন্দ্রনাথ এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থার কথা ভেবেছিলেন যেটিতে শৃঙ্খল থাকবে না, মুক্তির আনন্দ থাকবে।
রবীন্দ্রনাথের আনন্দের ধারণাটিও বুঝতে হবে তাঁর সৃষ্ট সাহিত্য ও শিল্পের প্রেক্ষাপটে।
রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তায় শিক্ষক ও শিক্ষালয়ের পরিবেশ প্রধান দুটি বিষয়। ১৩৪৩ সনে তিনি শান্তিনিকেতনে স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট বলতে গিয়ে লিখেছেন, ‘অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে আমার মনে এই কথাটি জেগে উঠেছিল, ছেলেদের মানুষ করে তোলবার জন্যে যে একটা যন্ত্র তৈরি হয়েছে, যার নাম ইস্কুল, সেটার ভিতর দিয়ে মানবশিশুর শিক্ষার সম্পূর্ণতা হতেই পারে না।’
দ্বিজেন শর্মা বলছেন, পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থা কিন্তু নৃভিত্তিক এবং এই ক্ষেত্রে তারা সফল। আর আমরা যা করছি তা হচ্ছে পাশ্চাত্য শিক্ষা পদ্ধতিরই অবিকল সংস্করণ। আমরা যেমন এটা এখন উপলব্ধি করছি, রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তখনই বলেছিলেন, আমাদের শিক্ষাকে আমাদের নিজেদের হাতে নিতে হবে। অর্থাৎ আমাদের উপযোগী করেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
মোহিত উল আলম এর উত্তরণে আবার আমাদের জানাচ্ছেন, আনন্দময় জীবনযাপন বা জীবন উদ্যাপনের মস্ত আকাঙ্ক্ষা মানুষের তা সার্থক হবে তার দুটি সামর্থ্যের ভিত্তিতে—আত্মবিকাশ ও আত্মপ্রকাশ।
বিকাশ হলো ব্যক্তির প্রস্তুতির অংশ আর প্রকাশ হলো সেই প্রস্তুতির ফসল। একটি ঘটবে ভেতরে ভেতরে আর অন্যটি ফুটবে বাইরে। একদিকে অনুশীলন ও সাধনা, অন্যদিকে সক্রিয়তা ও সৃষ্টি। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন মানুষের সব চর্চার চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে—বিকশিত হওয়া, প্রকাশিত হওয়া।
আত্মবিকাশ ও আত্মপ্রকাশের পথটি কীভাবে তৈরি হবে শিশুর জন্য তার জন্য রবীন্দ্র-সাহিত্য থেকেই কতগুলো উপায় বের করেছেন প্রবন্ধকার আবুল মোমেন— ১. শিশুর জন্য ঘরে ও স্কুলে অভয় মন্ত্রে অনুকূল সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে; ২. তার আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদার বোধে কোনো আঘাত দেওয়া যাবে না, তা সযত্নে রক্ষা করতে হবে; ৩. তার সুপ্ত সহজাত মৌলিক ক্ষমতার বিকাশে সহায়তা দিতে হবে, যেমন—তার সব ইন্দ্রিয়শক্তির এবং ভাষা, সুর ও দৃশ্যমানের রূপ ও রঙের বোধ; ৪. গাছপালা-নদী-জলাশয়-মাঠ-খেত-সমুদ্র-পর্বত, আকাশ-মহাজগৎ ইত্যাদি সম্পর্কে তাকে সচেতন ও সংবেদনশীল করে তুলতে হবে; ৫. পরিবার-প্রতিবেশ ছাড়াও সাধারণভাবে মানুষ সম্পর্কে তাকে আগ্রহী ও দায়িত্বশীল করে তুলতে হবে; ৬. তার সহজাত যুক্তি-বিবেচনা ও দায়বোধকে এবং বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষমতাকে ক্রমশ উন্নত ও পরিণত করে তুলতে হবে; ৭. তার জন্য সব কাজে প্রত্যক্ষ ও সক্রিয় অংশগ্রহণের এবং প্রশ্ন তোলার ও করার অবারিত সুযোগ দিতে হবে; ৮. সৃজনশীল ও প্রায়োগিক কলা চর্চায় তাকে উদ্বুদ্ধ ও সর্বোচ্চ সুযোগ দিতে হবে; ৯. স্বাজাত্যবোধ, মানবসভ্যতার উত্তরাধিকার ও বৈশ্বিক চেতনায় তাকে পুষ্ট করতে হবে; ১০. সমকালীন যেসব ইস্যু প্রকৃতি, মানুষ ও বিশ্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা ও উদ্বেগের কারণ সেগুলো সম্পর্কে সচেতন ও সংবেদনশীল হবে।
চাকরি বা অর্থ উপার্জন যদি শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য হয় তবে তার চেয়ে ভয়ংকর আর কিছু নেই। দ্বিজেন শর্মা যেমন আশা প্রকাশ করেছেন, হয়তো কোনো মনীষী নতুন কোনো শিক্ষাব্যবস্থা আনবেন, যেটা হবে প্রকৃতিবান্ধব এবং শিক্ষাক্ষেত্র হবে সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতামূলক।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ আলোচনার ইতি টানেন এভাবে: রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এই উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ রেনেসাঁ-মানব। তিনি এমন এক শিক্ষাব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছিলেন যার মাধ্যমে এই রেনেসাঁ-মানব তৈরি হবে।
No comments