বিশ্বব্যাংকের পর পদ্মা সেতুর অর্থায়ন স্থগিত করেছে এডিবি ও জাইকা

বিশ্বব্যাংকের পর এবার এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও জাপান ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশন এজেন্সি (জাইকা) পদ্মা সেতুর অর্থায়ন স্থগিত করে দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ১২০ কোটি ডলার, এডিবির ৬১ কোটি ডলার ও জাইকার ৪০ কোটি ডলার মিলিয়ে মোট ২২১ কোটি ডলারের ঋণ সহায়তা স্থগিত করা হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগ সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য অপেক্ষার কথা জানিয়েছেন জাইকার বাংলাদেশ বিষয়ক শাখার পরিচালক ইচিগুচি তোমিহিদে। একই কথা জানিয়েছে এডিবিও।


এ অবস্থায় পদ্মা সেতু নির্মাণের বিষয়টি আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়ল। তবে সরকারের কোনো পর্যায় থেকে এডিবি ও জাইকার ঋণ সহায়তা স্থগিত করার কথা এখন পর্যন্ত স্বীকার করা হয়নি। এদিকে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের দুর্নীতির কথা এরই মধ্যে ফাঁস করেছে। এ দুর্নীতির শেকড় আরও গভীরে বিস্তৃত বলে সূত্র জানিয়েছে। এ প্রকল্পে পাঁচটি কোম্পানি থেকে ঘুষ লেনদেন হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে স্বচ্ছতা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত পদ্মা সেতু নির্মাণে কোনো অর্থ ছাড় না দেয়ার কথা পুনরায় উল্লেখ করেছেন বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর অ্যালেন গোল্ড স্টেইন। গতকাল ঢাকায় স্থানীয় একটি হোটেলে আয়োজিত বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক উন্নয়ন প্রতিবেদন প্রকাশনা অনুষ্ঠান শেষে একথা বলেন তিনি। গোল্ড স্টেইন বলেন, দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে চলমান তদন্ত শেষে পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে। বিশ্বব্যাংক সরকারের সুশাসন ও সম্পদের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে নিশ্চয়তা চাচ্ছে। কান্ট্রি ডিরেক্টর বলেন, বাংলাদেশ অবশ্যই আমাদের সম্পূর্ণ সাহায্য পাবে। তবে কাজের ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করেই সাহায্য করা হবে। একই অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানান, এক সপ্তাহের মধ্যে পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে প্রেসনোট জারি করা হবে। তিনি বলেন, তবে সরকার বরাবরই বলে আসছে, এখন পর্যন্ত এ প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি হয়নি।
চ্যানেল আই জানায়, গত ২৮ মার্চ পদ্মার বুকে মহাউত্সবে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণ চুক্তি সই যে ৬ মাসের মাথায় বিষাদে পরিণত হবে সেজন্য প্রস্তত ছিল না কেউই। বিশ্বব্যাংকের পর একে একে ঋণ চুক্তি হয়েছে এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক, জাইকা ও ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক-আইডিবির সঙ্গে। এ বছরের মধ্যে ২৯০ কোটি ডলার ব্যয়ে সেতুটির নির্মাণ কাজ শুরু হচ্ছে—এমন স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশের মানুষের। তারও আগে শুরু হওয়ার কথা ছিল মাওয়া জাজিরা প্রান্তে সাড়ে ১১ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণ। তবে বিশ্বব্যাংকের আনা দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতুর স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে চলেছে। ধীরে চলা নীতি নিয়েছে জাইকাও। বিভিন্ন বিষয়ে দুর্নীতির অভিযোগ পাঠানো হয়েছে টোকিওতে জাইকার সদর দফতরে। তবে এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে চান না জাইকা কর্মকর্তারা। কবে আবার অর্থায়ন শুুরু হতে পারে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।
৬ দশমিক ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৯০ কোটি ডলার (প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা)। এর মধ্যে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকাই ঋণ-সহায়তা থেকে সংকুলান করা হবে। বিশ্বব্যাংকের ঋণ-সহায়তা দেয়ার কথা ১২০ কোটি ডলার (প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা)। এছাড়া এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ৬১ কোটি ডলার, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) ১৪ কোটি ডলার ও জাইকার ৪০ কোটি ডলার দেয়ার কথা। বাকি অর্থ জোগান দেবে বাংলাদেশ সরকার।
বিশ্বব্যাংক ঋণ-সহায়তা স্থগিত করে দেয়ায় প্রকল্প নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। কারণ, বিশ্বব্যাংক ছিল এই প্রকল্পের অন্য উন্নয়ন সহযোগীদের সমন্বয়ক। আশঙ্কা করা হয়েছিল, বিশ্বব্যাংকের ঘোষণার পর স্বাভাবিকভাবেই আটকে যেতে পারে এডিবি, জাইকা ও আইডিবির ঋণ-সহায়তা। সেই আশঙ্কাই গতকাল সত্যে পরিণত হলো।
এদিকে পদ্মা সেতু নির্মাণে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের দুর্নীতির কথা সরকারকে এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। তারা বলেছে, মন্ত্রীর জড়িত থাকার বিষয়ে তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য প্রমাণাদিও রয়েছে। গত ২১ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাংক অর্থমন্ত্রীকে একটি চিঠি দেয়। বিশ্বব্যাংক কর্মকর্তা লিওনার্দ এফ ম্যাকার্থির লেখা এই চিঠির সঙ্গে তদন্তের সারসংক্ষেপও পাঠানো হয়। এতে জানানো হয়, বিশ্বব্যাংক গ্রুপের ইন্টেগ্রিটি ভাইস প্রেসিডেন্সি (আইএনটি) বিশ্বব্যাংক অর্থায়নে নির্মিতব্য এ সেতু নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করেছে। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১০ সালের ১১ এপ্রিল অগ্রিম ক্রয় কার্যাদেশের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেতু বিভাগ প্রাকযোগ্যতা যাচাইয়ের বিজ্ঞপ্তি দেয়।
২০১০ সালের ১০ অক্টোবর দুর্নীতি ও প্রাকযোগ্যতার শর্ত পরিবর্তনের কারণে এই প্রক্রিয়া বাতিল করা হয়। তার পরদিন সেতু বিভাগ কর্তৃপক্ষ ফের প্রাকযোগ্যতা তালিকার জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। বিশ্বব্যাংক ২০১১ সালের জুলাইয়ের শুরুতে প্রধান সেতু চুক্তির প্রাকযোগ্যতা তালিকায় অনাপত্তি প্রদান করে। তারপর আইএনটি যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন ও তার কোম্পানি সাকোর ঊর্ধ্বতন প্রতিনিধিদের ব্যাপারে বিপুলসংখ্যক অভিযোগ পায়। এসব অভিযোগে বলা হয়, সাকো পরোক্ষ কমিশন এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে আইএনটি তদন্ত হাতে নেয় এবং পাঁচ সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ৪টি দেশের সম্পৃক্ত একডজনেরও বেশি লোকের সঙ্গে কথা বলে। আইএনটির মতে, গ্রহণযোগ্য এমন কিছু তথ্য-প্রমাণ আসে যা যোগাযোগমন্ত্রী ও তার কোম্পানি সাকোর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সাপোর্ট করে। যোগাযোগমন্ত্রীর কোম্পানি সাকোকে ‘সাইলেন্ট এজেন্ট’ হিসেবে নিয়োগ ও মোটা অংকের ‘ঘুষ’ দেয়ার শর্তে কাজ পাইয়ে দেয়ার কথা বলা হয়। অন্যথা হলে পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার হুমকিও দেয়া হয়। তদন্তকারীদের একটি কোম্পানির কর্মকর্তা তথ্য-প্রমাণ দেন যে, তার কাছে সাকোর পরিচয়ে এক ব্যক্তি দেখা করতে আসে এবং তাকে বলে, তিনি যোগাযোগমন্ত্রীর নির্দেশনা নিয়ে এসেছেন। সাকোর ওই প্রতিনিধি তদন্তকারীকে বলেছেন, পদ্মা সেতুর মোট চুক্তির মূল্যের একটি অংশ কমিশন হিসেবে দিলে পদ্মার মূল সেতু নির্মাণের প্রাকযোগ্যতা বাছাইয়ে ওই কোম্পানিকে মন্ত্রী সহযোগিতা করবেন।
তদন্তকারী আইএনটি আরও বলেছে, মন্ত্রী হওয়ার পর যোগাযোগমন্ত্রী সাকো থেকে পদত্যাগ করলেও ওয়েবসাইটে দেখা গেছে তার স্ত্রী ও দুই কন্যা ঠিকই কোম্পানির পরিচালনা পরিষদে রয়েছেন। অন্য কোম্পানির কাছেও সাকোকে পরোক্ষভাবে এজেন্ট হিসেবে নেয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন মন্ত্রী।
তবে এতকিছুর পরও যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন বলেছেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পে সরকারের তরফে কোনো দুর্নীতি হয়নি। তবে বিশ্বব্যাংক, দুদক এবং প্রয়োজনে বিএনপিকে বিষয়টি তদন্ত করে দেখার কথা বলেন।

No comments

Powered by Blogger.