ঊর্ধ্বগতিতেই ছুটছে ডলারের মূল্য

ত বৃহস্পতিবার ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের মূল্য দাঁড়িয়েছে ৭৫ টাকা ৫৮ পয়সায়। এর আগে ১০ অক্টোবরে ডলারের মূল্য ছিল ৭৫ টাকা ৪৫ পয়সা। গত ৮ অক্টোবর মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৭৫ টাকা ২৪ পয়সা। ২০ সেপ্টেম্বর ডলারের দাম ছিল ৭৫ টাকা ১৫ পয়সা। এর ১৫ দিন আগেও দাম ছিল ৭৪ টাকা। প্রতিনিয়তই ডলারের মূল্য ঊর্ধ্বগতিতে ছুটছে। সংশ্লিষ্টদের মনে এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এভাবে প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকলে কোথায় গিয়ে ঠেকবে ডলারের দাম। এদিকে ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে আমদানি মূল্য বেশি পড়ছে।


ফলে বাড়ছে মূল্যস্ফীতির চাপ। ডলারের ঊর্ধ্বগতিতে শঙ্কাগ্রস্ত হয়ে গত ১০ অক্টোবর বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) এক জরুরি বৈঠক করেছে। বৈঠকে ডলারের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানানো হয়। কিন্তু ডলার মূল্যের ঊর্ধ্বগতি যেন কিছুতেই ধরে রাখা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তিন বছর পর দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আবারও ১০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। এখন রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলারে। রিজার্ভ কমে আসায় ডলারের বিপরীতে টাকা মানহীন হয়ে পড়েছে।
রেমিট্যান্স আয়ের গতি কমে আসার পাশাপাশি বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বৈদেশিক ঋণ এবং রফতানি প্রত্যাশা অনুযায়ী না হওয়ায় দেশের রিজার্ভে চাপ পড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টের জন্য অতিরিক্ত পরিমাণে জ্বালানি তেল আমদানিকে রিজার্ভের ওপর বড় ধরনের চাপ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রিজার্ভের ওপর বড় ধরনের চাপ পড়ায় প্রতিনিয়তই ডলারের বিপরীতে টাকা মানহীন হয়ে পড়ছে। এদিকে টাকার মানহীন হয়ে পড়ার এ ধারাকে মোটেও ভালো দৃষ্টিতে দেখছেন না বিশ্লেষকরা।
রিজার্ভ কমে যাওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্স আয়ে তেমন একটা প্রবৃদ্ধি নেই। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) রেমিট্যান্স প্রবাহে ১৫ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি হলেও সেপ্টেম্বর মাসে তা কমে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে জুলাই মাসে প্রবাসীরা ১০৩ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন। আগস্ট মাসেও রেমিট্যান্স সন্তোষজনক ছিল। আগস্ট মাসের তুলনায় সেপ্টেম্বর মাসে রেমিট্যান্স আয় আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। সেপ্টেম্বর মাসে রেমিট্যান্স আয় হয়েছে ৮৪৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যেখানে আগের মাসে অর্থাত্ আগস্ট মাসে রেমিট্যান্স আয় ছিল ১ হাজার ১০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এক মাসের ব্যবধানে রেমিট্যান্স আয় কমেছে ২৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ। গত অর্থবছরে রেমিট্যান্স আয়ের প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ শতাংশ। এর আগের অর্থবছরে (২০০৯-১০) রেমিট্যান্স আয়ের প্রবৃদ্ধি ছিল সাড়ে ১৩ শতাংশ। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে রেমিট্যান্স আয়ের প্রবৃদ্ধির হার ছিল সাড়ে ২২ শতাংশ। এভাবে ধীরে ধীরে কমে আসছে দেশের রেমিট্যান্স আয়ের প্রবৃদ্ধি। রেমিট্যান্স আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি আমদানির তুলনায় রফতানি বাড়ছে না। ফলে বাড়ছে বাণিজ্য ঘাটতি। কমছে রিজার্ভের পরিমাণ।
ইউরোপজুড়ে মন্দার ধাক্কা এবং দেশে একের পর এক শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আবারও ঋণাত্মক ধারায় রফতানি আয়। অর্থবছরের প্রথম মাসের (জুলাই) তুলনায় সেপ্টেম্বরে আয় কমে গেছে ৩৮ শতাংশ। অন্যদিকে আগস্টের তুলনায় আয় কমেছে ৩৯ শতাংশ। প্রধান খাতগুলোর বেশিরভাগই সেপ্টেম্বরে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রফতানি আয় অর্জনে ব্যর্থ। সেপ্টেম্বরে টার্গেটের তুলনায় আয় ২৩ ভাগ কম হয়েছে।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে রফতানি আয় অনেক কমে গেছে। এ মাসে মোট রফতানি আয় হয়েছে ১৪৪৭ দশমিক ৪৭ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ১০ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২৩ শতাংশ কম। চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরের প্রথম মাসে (জুলাই) রফতানি আয় হয়েছিল ২৩৩৯ দশমিক ৫২ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ১৭ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকা। জুলাইয়ের তুলনায় সেপ্টেম্বরে আয় কমেছে প্রায় ৬ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা বা ৩৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। গত আগস্টেও রফতানি আয় ভালো ছিল বলে জানিয়েছে ইপিবি। আগস্টে মোট আয় ছিল ২৩৭৬ দশমিক ৭৪ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ১৭ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, একদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, খাদ্যের দামে অস্থিরতা, বিদ্যুত্ উত্পাদনে অতিরিক্ত ভর্তুকি প্রদান এবং আমদানি খাতে উচ্চ প্রবৃদ্ধির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ভাণ্ডারে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। অনেকেই ধারণা করছেন, বিপুল পরিমাণে ডলার বিদেশে পাচারও হয়ে যাচ্ছে। ফলে ডলারের রিজার্ভের ওপর চাপ তীব্র হয়ে উঠছে। অন্যদিকে রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি বাড়লেও রেমিট্যান্স প্রবাহের ধারা এবং বৈদেশিক ঋণের অর্থছাড়ের ক্ষেত্রে স্বল্পতা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে সঙ্কটময় করে তুলছে। এ অবস্থায় বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের মাধ্যমগুলোকে শক্তিশালী করতে না পারলে দেশের ডলার সঙ্কটের তীব্রতায় বিনিময় হারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

No comments

Powered by Blogger.