প্লাস্টিক পণ্যে স্বনির্ভরতার দিকে বাংলাদেশ by শুভংকর কর্মকার
দেশের প্লাস্টিক দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদনে নীরব বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে। একসময়ের আমদানিনির্ভর এসব পণ্যের প্রায় সবই এখন দেশে তৈরি হচ্ছে। এভাবে প্লাস্টিক পণ্যে স্বনির্ভরতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আর তাই দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশের তৈরি প্লাস্টিক পণ্য। চাহিদা অনুযায়ী উদ্যোক্তারা মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন করায় প্রতিবছর রপ্তানি আয়ের পরিমাণ বাড়ছে। সেই সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সামর্থ্যও জোরদার হচ্ছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি করে ২০১০-১১ অর্থবছরে ছয় কোটি ৮৭ লাখ ডলার আয় হয়।
২০০৯-১০ অর্থবছরে এই আয় ছিল পাঁচ কোটি ছয় লাখ ডলার। এর আগের অর্থবছরের রপ্তানি আয় পাঁচ কোটি ২৩ লাখ ডলার। চলতি অর্থবছরে এই খাতে আট কোটি ৪২ লাখ ডলার পরিমাণ রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে গত জুলাই-আগস্ট অর্থাৎ প্রথম দুই মাসে এক কোটি ৩৩ লাখ ডলার রপ্তানি আয় হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, দেশের বাজারে সব ধরনের প্লাস্টিক পণ্যের চাহিদার পরিমাণ প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা। চাহিদার পুরোটাই এখন মেটাচ্ছে সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ছোট-মাঝারি ও বড় প্রায় তিন হাজার প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান।
তবে প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনের কাঁচামালের পুরোটাই সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও ভারত থেকে আমদানি করতে হয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ কাঁচামাল আমদানিতে ব্যয় হয়। এখন বছরে প্রায় সাড়ে সাত লাখ টন কাঁচামাল প্রয়োজন হচ্ছে বলে জানা গেছে। দেশীয়ভাবে কাঁচামাল উৎপাদন ও সরবরাহ করা সম্ভব হলে এক সময়ে এসে প্রকৃত স্বনির্ভরতা অর্জিত হবে বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা।
বাংলাদেশ প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিজিএমইএ) সভাপতি সামিম আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্লাস্টিক শিল্পটি পুরোটাই বিদ্যুৎনির্ভর। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ না পাওয়ায় সামর্থ্য অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারছে না।’
বিপিজিএমইএর সভাপতি আরও বলেন, সরকার অন্যান্য সম্ভাবনাময় খাতের মতো প্লাস্টিক খাতটিতে নজর দেওয়া উচিত। নীতি সমর্থন ও নগদ সহায়তা দিলে এই খাতটি দেশের অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখতে সক্ষম বলে মনে করেন তিনি।
খাতটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যবসায়ী জানান, দেশে প্লাস্টিক পণ্যসামগ্রী তৈরির ইতিহাস একবারে নতুন নয়। ষাটের দশকে অল্প বিস্তর গৃহস্থালি ব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রী তৈরি হতো। তখন ভারত ও চীন থেকে প্রয়োজনীয় প্লাস্টিক পণ্য আমদানি করা হতো। তবে আশির দশকে এসে দেশের এসব পণ্য উৎপাদন ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।
নব্বইয়ের দশকে পোশাক খাতের জন্য হ্যাঙ্গার, পলিব্যাগ, বোতামসহ বিভিন্ন উপকরণ তৈরির মধ্য দিয়ে প্লাস্টিক শিল্পে বিপ্লব শুরু হয়। প্রচ্ছন্ন এই (সরাসরি নয়) রপ্তানির পরপরই মূলত চাহিদা অনুযায়ী অন্যান্য পণ্যসামগ্রীও উৎপাদন করতে থাকেন উদ্যোক্তারা। একই সঙ্গে প্রচ্ছন্ন রপ্তানির পাশাপাশি সরাসরি রপ্তানি হতে থাকে।
এক ব্যবসায়ী নেতা জানান, ২০০০ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে প্রয়োজনীয় প্রায় সব ধরনের প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনে সক্ষমতা দেখাতে থাকেন উদ্যোক্তারা। এর পরই সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করে এসব পণ্য আমদানি বন্ধের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। গত পাঁচ-ছয় বছরে আমদানি নেমে এসেছে শূন্যের কোটায়। ফলে দেশের চাহিদা এখন দেশের উৎপাদকেরাই মেটাচ্ছেন।
বিপিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে দুই হাজার ৯৯৭টি প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আছে। এর মধ্যে এক হাজার ৯৬৫টি ছোট, মাঝারি ৯৮০টি ও বড় মাপের ৫২টি প্রতিষ্ঠান। এগুলোর মধ্যে প্রচ্ছন্ন রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ৩৭৩টি, সরাসরি ছয়টি ও উভয় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দুটি। প্রচ্ছন্ন রপ্তানিকারক বলতে মূলত তৈরি পোশাকপণ্যের আনুষঙ্গ হিসেবে রপ্তানি হওয়া প্লাস্টিক পণ্যগুলোকে বোঝানো হয়।
বিপিজিএমইএ জানায়, প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৬৫ শতাংশ ঢাকায়, ২০ শতাংশ চট্টগ্রামে, ১০ শতাংশ নারায়ণগঞ্জে এবং বাকি ৫ শতাংশ খুলনা, কুমিল্লা, বগুড়া ও রাজশাহীতে অবস্থিত। প্রায় ২০ লাখের বেশি লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই খাতের সঙ্গে জড়িত।
প্লাস্টিকের যত পণ্য: সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কারখানাগুলোতে বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে পোশাক খাতের জন্য পলিব্যাগ, হ্যাঙ্গার, প্লাস্টিক ক্লিপ, বোতাম; খেলনা সামগ্রীর মধ্যে পুতুল, বল, ইয়োইয়ো; গৃহে ব্যবহারের জন্য চেয়ার, টেবিল, বাথটাব, জগ, মগ, ঝুড়ি, প্লেট, গ্লাস, চামচ; অফিসে ব্যবহারের জন্য পেপারওয়েট, স্কেল, টেবিল ক্যালেন্ডার, বলপেন, ফাইল কভার ইত্যাদি অন্যতম।
এ ছাড়া গৃহনির্মাণ সামগ্রী জানালা ও দরজা; চিকিৎসা উপকরণ রক্তের ব্যাগ, ওষুধ কনটেইনার, ইনজেকশন, স্যালাইন ব্যাগ; কৃষি খাতের জন্য প্লাস্টিক পাইপ, বড় চৌবাচ্চা; গাড়ি ও সাইকেলের যন্ত্রাংশের মধ্যে বাম্পার, হাতলের কভার, ব্যাক লাইট, স্পোক লাইট; পোলট্রি ও মৎস্য খাতের পট, জার, মাছের জাল, বল, মাছ ও ডিম রাখার ঝুড়ি; ভিডিও ও অডিও ক্যাসেট, কম্পিউটারের উপকরণসহ বিভিন্ন প্লাস্টিক সামগ্রী তৈরি হচ্ছে দেশেই।
বিদেশের বাজার: বর্তমানে বিশ্বের ২৩টি দেশে প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। এর মধ্যে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশ, জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, কানাডা ও মালয়েশিয়ায় সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি হয়।
বিপিজিএমইএ সূত্র জানায়, এসবের বাইরে সার্কভুক্ত দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা ও নেপালে বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি হয়। এর মধ্যে ভারতের পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয়।
পোশাক খাতের জন্য হ্যাঙ্গার, পলিব্যাগ, বোতাম ইত্যাদি দিয়ে এ খাতের প্রচ্ছন্ন রপ্তানি শুরু হয়। দেশের পোশাক খাতের এসব উপকরণের শতভাগই দেশীয় উৎপাদকেরা মেটাচ্ছেন। একই সঙ্গে বর্তমানে সরাসরিভাবে ওভেন পলিপ্রোপাইলিন প্লাস্টিক ব্যাগ, প্লাস্টিক ফার্নিচার, পিভিসি পাইপ, গৃহস্থালি পণ্য, খেলনা, দস্তানা, ইলেকট্রিক সুইচ, টুথব্রাশ, বলপেন, কৃত্রিম ফুল, অডিও ও ভিডিও ক্যাসেট ইত্যাদি প্লাস্টিক পণ্যসামগ্রী রপ্তানি হচ্ছে।
কিছু পরিসংখ্যান: ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩-০৪ অর্থবছর থেকে ধারাবাহিকভাবে প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানিতে সাফল্য দেখাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। ওই অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল দুই কোটি ২০ লাখ ডলার। পরের বছর রপ্তানি আয় দাঁড়ায় তিন কোটি ৮৮ লাখ ডলার অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি হয় ২৯ দশমিক ২১ শতাংশ। ২০০৫-০৬ ও ২০০৬-০৭ অর্থবছরে রপ্তানির পরিমাণ যথাক্রমে চার কোটি ৪৪ লাখ ও চার কোটি ৮০ লাখ ডলার। ওই দুই অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয় ২৩ দশমিক ২০ ও ৬৩ দশমিক ২৪ শতাংশ। এ ছাড়া ২০০৭-০৮ অর্থবছরের এই খাতে রপ্তানি আয় হয় পাঁচ কোটি ৪১ লাখ ডলার।
রপ্তানি আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জিডিপিতেও খাতটির অবদান বাড়তে থাকে। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে জিডিপিতে খাতটির অবদান ছিল এক দশমিক ০৭ শতাংশ। এর আগের বছর ছিল শূন্য দশমিক ৪৩ শতাংশ। বর্তমানে এই হার আরও বেড়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
প্রস্তুতকারকেরা আরও জানান, প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনের ফলে যে পরিমাণ বর্জ্য সৃষ্টি হয়, তার প্রায় ৬০ শতাংশই এখন পুনর্ব্যবহার (রিসাইকেল) করা সম্ভব হচ্ছে। এতে পরিবেশের ক্ষতি রোধে ভূমিকা রাখা যাচ্ছে।
বিপিজিএমইএর সাধারণ সম্পাদক কে এম ইকবাল হোসেন বলেন, ‘উন্নত দেশে প্লাস্টিক পণ্য নিয়ে অনেক গবেষণা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সেই সুযোগ নেই। গত বিএনপি সরকারের সময় এ বিষয়ে কিছুটা অগ্রগতি হলেও পরে তা থেমে যায়।’
সাধারণ সম্পাদক আরও বলেন, প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনের পলি প্রোপাইলিন, পলি ইথাইলিন, এইচআইপিএফ, জিপিপিএস ইত্যাদি কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কিন্তু এসব কাঁচামাল দেশেই উৎপাদন সম্ভব। এ ক্ষেত্রে বড় বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে এলে এ খাতের পুরো চিত্রটাই পাল্টে যাবে।
তবে প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনের কাঁচামালের পুরোটাই সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও ভারত থেকে আমদানি করতে হয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ কাঁচামাল আমদানিতে ব্যয় হয়। এখন বছরে প্রায় সাড়ে সাত লাখ টন কাঁচামাল প্রয়োজন হচ্ছে বলে জানা গেছে। দেশীয়ভাবে কাঁচামাল উৎপাদন ও সরবরাহ করা সম্ভব হলে এক সময়ে এসে প্রকৃত স্বনির্ভরতা অর্জিত হবে বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা।
বাংলাদেশ প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিজিএমইএ) সভাপতি সামিম আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্লাস্টিক শিল্পটি পুরোটাই বিদ্যুৎনির্ভর। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ না পাওয়ায় সামর্থ্য অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারছে না।’
বিপিজিএমইএর সভাপতি আরও বলেন, সরকার অন্যান্য সম্ভাবনাময় খাতের মতো প্লাস্টিক খাতটিতে নজর দেওয়া উচিত। নীতি সমর্থন ও নগদ সহায়তা দিলে এই খাতটি দেশের অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখতে সক্ষম বলে মনে করেন তিনি।
খাতটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যবসায়ী জানান, দেশে প্লাস্টিক পণ্যসামগ্রী তৈরির ইতিহাস একবারে নতুন নয়। ষাটের দশকে অল্প বিস্তর গৃহস্থালি ব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রী তৈরি হতো। তখন ভারত ও চীন থেকে প্রয়োজনীয় প্লাস্টিক পণ্য আমদানি করা হতো। তবে আশির দশকে এসে দেশের এসব পণ্য উৎপাদন ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।
নব্বইয়ের দশকে পোশাক খাতের জন্য হ্যাঙ্গার, পলিব্যাগ, বোতামসহ বিভিন্ন উপকরণ তৈরির মধ্য দিয়ে প্লাস্টিক শিল্পে বিপ্লব শুরু হয়। প্রচ্ছন্ন এই (সরাসরি নয়) রপ্তানির পরপরই মূলত চাহিদা অনুযায়ী অন্যান্য পণ্যসামগ্রীও উৎপাদন করতে থাকেন উদ্যোক্তারা। একই সঙ্গে প্রচ্ছন্ন রপ্তানির পাশাপাশি সরাসরি রপ্তানি হতে থাকে।
এক ব্যবসায়ী নেতা জানান, ২০০০ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে প্রয়োজনীয় প্রায় সব ধরনের প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনে সক্ষমতা দেখাতে থাকেন উদ্যোক্তারা। এর পরই সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করে এসব পণ্য আমদানি বন্ধের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। গত পাঁচ-ছয় বছরে আমদানি নেমে এসেছে শূন্যের কোটায়। ফলে দেশের চাহিদা এখন দেশের উৎপাদকেরাই মেটাচ্ছেন।
বিপিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে দুই হাজার ৯৯৭টি প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আছে। এর মধ্যে এক হাজার ৯৬৫টি ছোট, মাঝারি ৯৮০টি ও বড় মাপের ৫২টি প্রতিষ্ঠান। এগুলোর মধ্যে প্রচ্ছন্ন রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ৩৭৩টি, সরাসরি ছয়টি ও উভয় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দুটি। প্রচ্ছন্ন রপ্তানিকারক বলতে মূলত তৈরি পোশাকপণ্যের আনুষঙ্গ হিসেবে রপ্তানি হওয়া প্লাস্টিক পণ্যগুলোকে বোঝানো হয়।
বিপিজিএমইএ জানায়, প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৬৫ শতাংশ ঢাকায়, ২০ শতাংশ চট্টগ্রামে, ১০ শতাংশ নারায়ণগঞ্জে এবং বাকি ৫ শতাংশ খুলনা, কুমিল্লা, বগুড়া ও রাজশাহীতে অবস্থিত। প্রায় ২০ লাখের বেশি লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই খাতের সঙ্গে জড়িত।
প্লাস্টিকের যত পণ্য: সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কারখানাগুলোতে বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে পোশাক খাতের জন্য পলিব্যাগ, হ্যাঙ্গার, প্লাস্টিক ক্লিপ, বোতাম; খেলনা সামগ্রীর মধ্যে পুতুল, বল, ইয়োইয়ো; গৃহে ব্যবহারের জন্য চেয়ার, টেবিল, বাথটাব, জগ, মগ, ঝুড়ি, প্লেট, গ্লাস, চামচ; অফিসে ব্যবহারের জন্য পেপারওয়েট, স্কেল, টেবিল ক্যালেন্ডার, বলপেন, ফাইল কভার ইত্যাদি অন্যতম।
এ ছাড়া গৃহনির্মাণ সামগ্রী জানালা ও দরজা; চিকিৎসা উপকরণ রক্তের ব্যাগ, ওষুধ কনটেইনার, ইনজেকশন, স্যালাইন ব্যাগ; কৃষি খাতের জন্য প্লাস্টিক পাইপ, বড় চৌবাচ্চা; গাড়ি ও সাইকেলের যন্ত্রাংশের মধ্যে বাম্পার, হাতলের কভার, ব্যাক লাইট, স্পোক লাইট; পোলট্রি ও মৎস্য খাতের পট, জার, মাছের জাল, বল, মাছ ও ডিম রাখার ঝুড়ি; ভিডিও ও অডিও ক্যাসেট, কম্পিউটারের উপকরণসহ বিভিন্ন প্লাস্টিক সামগ্রী তৈরি হচ্ছে দেশেই।
বিদেশের বাজার: বর্তমানে বিশ্বের ২৩টি দেশে প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। এর মধ্যে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশ, জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, কানাডা ও মালয়েশিয়ায় সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি হয়।
বিপিজিএমইএ সূত্র জানায়, এসবের বাইরে সার্কভুক্ত দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা ও নেপালে বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি হয়। এর মধ্যে ভারতের পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয়।
পোশাক খাতের জন্য হ্যাঙ্গার, পলিব্যাগ, বোতাম ইত্যাদি দিয়ে এ খাতের প্রচ্ছন্ন রপ্তানি শুরু হয়। দেশের পোশাক খাতের এসব উপকরণের শতভাগই দেশীয় উৎপাদকেরা মেটাচ্ছেন। একই সঙ্গে বর্তমানে সরাসরিভাবে ওভেন পলিপ্রোপাইলিন প্লাস্টিক ব্যাগ, প্লাস্টিক ফার্নিচার, পিভিসি পাইপ, গৃহস্থালি পণ্য, খেলনা, দস্তানা, ইলেকট্রিক সুইচ, টুথব্রাশ, বলপেন, কৃত্রিম ফুল, অডিও ও ভিডিও ক্যাসেট ইত্যাদি প্লাস্টিক পণ্যসামগ্রী রপ্তানি হচ্ছে।
কিছু পরিসংখ্যান: ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩-০৪ অর্থবছর থেকে ধারাবাহিকভাবে প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানিতে সাফল্য দেখাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। ওই অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল দুই কোটি ২০ লাখ ডলার। পরের বছর রপ্তানি আয় দাঁড়ায় তিন কোটি ৮৮ লাখ ডলার অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি হয় ২৯ দশমিক ২১ শতাংশ। ২০০৫-০৬ ও ২০০৬-০৭ অর্থবছরে রপ্তানির পরিমাণ যথাক্রমে চার কোটি ৪৪ লাখ ও চার কোটি ৮০ লাখ ডলার। ওই দুই অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয় ২৩ দশমিক ২০ ও ৬৩ দশমিক ২৪ শতাংশ। এ ছাড়া ২০০৭-০৮ অর্থবছরের এই খাতে রপ্তানি আয় হয় পাঁচ কোটি ৪১ লাখ ডলার।
রপ্তানি আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জিডিপিতেও খাতটির অবদান বাড়তে থাকে। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে জিডিপিতে খাতটির অবদান ছিল এক দশমিক ০৭ শতাংশ। এর আগের বছর ছিল শূন্য দশমিক ৪৩ শতাংশ। বর্তমানে এই হার আরও বেড়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
প্রস্তুতকারকেরা আরও জানান, প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনের ফলে যে পরিমাণ বর্জ্য সৃষ্টি হয়, তার প্রায় ৬০ শতাংশই এখন পুনর্ব্যবহার (রিসাইকেল) করা সম্ভব হচ্ছে। এতে পরিবেশের ক্ষতি রোধে ভূমিকা রাখা যাচ্ছে।
বিপিজিএমইএর সাধারণ সম্পাদক কে এম ইকবাল হোসেন বলেন, ‘উন্নত দেশে প্লাস্টিক পণ্য নিয়ে অনেক গবেষণা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সেই সুযোগ নেই। গত বিএনপি সরকারের সময় এ বিষয়ে কিছুটা অগ্রগতি হলেও পরে তা থেমে যায়।’
সাধারণ সম্পাদক আরও বলেন, প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনের পলি প্রোপাইলিন, পলি ইথাইলিন, এইচআইপিএফ, জিপিপিএস ইত্যাদি কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কিন্তু এসব কাঁচামাল দেশেই উৎপাদন সম্ভব। এ ক্ষেত্রে বড় বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে এলে এ খাতের পুরো চিত্রটাই পাল্টে যাবে।
No comments