চট্টগ্রামে অধিকার-এর আলোচনা : রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক চরিত্র হারাচ্ছে বলেই গুম খুন বাড়ছে

ত্যা ও গুম নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে চট্টগ্রামের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার প্রতিনিধিরা বলেছেন, রাষ্ট্র দিন দিন গণতান্ত্রিক চরিত্র হারাচ্ছে বলেই এসব অপরাধ বাড়ছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রযন্ত্রের অংশ বিভিন্ন পোশাকধারী বাহিনীর হাতে নাগরিকদের গুম হওয়ার ঘটনা যে হারে দিন দিন বাড়ছে, তা জঘন্য মানবতাবিরোধী অপরাধের আওতায় পড়ে। দেশে একদিকে আইন-আদালত থাকবে আর অন্যদিকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলতে থাকবে—তা হতে পারে না। তাহলে দেশে আইন-আদালত থেকেইবা লাভ কী। বক্তারা র্যাবের সমালোচনা করে বলেছেন, এই বাহিনীকে সঠিকভাবে পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়ে উঠবে।


আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ কারও জীবন কেড়ে নেয়া নয়, বরং জীবনের নিরাপত্তা দেয়া। গুম হতে রেহাই পেতে হলে এ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করতে সরকারকে বাধ্য করানোর পাশাপাশি দেশে গড়ে তুলতে হবে গণসচেতনতা ও সামাজিক আন্দোলন। নিশ্চিত করতে হবে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। গতকাল নগরীর একটি রেস্টুরেন্টে গুম হওয়া থেকে সবাইকে সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক সনদ অনুমোদনের প্রচারাভিযানের অংশ হিসেবে মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা অধিকার আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
তারা আরও বলেন, মধ্যরাতে পোশাকধারী বাহিনী ঘর থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র কিংবা জনপ্রতিনিধিদের। ঢাকার কাউন্সিলর চৌধুরী আলম ও চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর ইউপি চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম বাছাসহ গুম হওয়া অনেকেরই এখনও কোনো খোঁজ মেলেনি। দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে প্রতিটি দিন কাটাতে হচ্ছে তাদের স্বজনদের। লিমন কিংবা কাদেরের মতো নির্মম পরিণতিও ভোগ করতে হচ্ছে অনেককেই। যেন পোশাকধারী বাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হয়েছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের লাইসেন্স। ভিন্নমত দমনের অংশ হিসেবে ক্ষমতাসীনরা পোশাকধারী বাহিনীকে ব্যবহার করে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে। জঘন্য এই অপরাধ একের পর এক ঘটে চললেও সরকার কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না। তারা পালন করছে নীরব ভূমিকা। আর এ সুযোগে অনেকে পোশাকধারী বাহিনীকে ব্যক্তিগত কাজেও ব্যবহার করতে শুরু করেছে—যা কোনো সভ্য সমাজে চলতে পারে না। সরকার একদিকে মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে, অন্যদিকে বিচারবহির্ভূত হত্যার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়ে একনায়ক চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে।
অধিকারের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট আদিলুর রহমান খানের পরিচালনায় আলোচনা সভায় প্রধান আলোচক ছিলেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের নির্বাহী সভাপতি মাইনুদ্দিন খান বাদল এমপি। আরও বক্তৃতা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহফুজ পারভেজ, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালেহ উদ্দিন হায়দার সিদ্দিকী, চট্টগ্রাম মহানগর আ’লীগ সহ-সভাপতি নাইমুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, মহানগর বিএনপি সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেন, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নাজিমুদ্দিন শ্যামল, মানবাধিকার নেত্রী মাসুদা বিলকিস, জাসদ নেতা বেলায়েত হোসেন, ওয়ার্কার্স পার্টির রাজা মিয়া, অ্যাডভোকেট আবু হানিফ, বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির নেতা হাকিম মাহফুজুল্লাহ, কমিউনিস্ট পার্টির কমরেড শাহ আলম, গণসংহতি আন্দোলনের হাসান মারুফ রুমী, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক সঞ্চনা চাকমা প্রমুখ।
মাইনুদ্দিন খান বাদল এমপি বলেন, গুম মানবতাবিরোধী অপরাধ। যে কোনো মূল্যে এর বিরোধিতা করতে হবে। গুম করার যন্ত্রণা একটি পরিবারকে ভেতর থেকে তিলে তিলে শেষ করে দেয়। এটা প্রতিদিনের যন্ত্রণা। যে পরিবারের সদস্য গুম হয়েছে, শুধু সেই পরিবারের লোকজনই জানেন এ যন্ত্রণা কতটা ভয়াবহ। কেউ বিনাবিচারে কাউকে শাস্তি দিতে পারে না। যারা গুম হচ্ছে, তাদের এক শতাংশও ফেরত আসছে না। এর বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। এ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করা উচিত সরকারের।
তিনি বলেন, অতীতে যারা র্যাব গঠন করেছিলেন আর এখন যারা র্যাবকে পরিচালিত করছেন, তারা একটা ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তৈরি করছেন। একসময় ব্রাজিলে বাংলাদেশের র্যাবের মতো একটি বাহিনী করা হয়েছিল। ওই বাহিনীকে সরকার বিচারবহির্ভূত হত্যার সুযোগ দিয়েছিল। একপর্যায়ে খুনের নেশা চড়ে গিয়েছিল তাদের। র্যাব যেন এ ধরনের বাহিনীতে পরিণত না হয়। কোনো বাহিনী আইনের ঊর্ধ্বে গেলে তা ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। আমরা যেন জ্ঞান বা অজ্ঞতার কারণে কোনো ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তৈরি না করি।
ড. মাহফুজ পারভেজ বলেন, বাংলাদেশ মানবাধিকার সমস্যায় জর্জরিত। এ থেকে সবাই বের হয়ে আসতে চাইছে। গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ থেকে মুক্তি পেতে হলে মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা ও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
অ্যাডভোকেট সালেহউদ্দিন হায়দার সিদ্দিকী বলেন, যে দেশে গুমের মতো অপরাধ হয়, সেই দেশকে কোনোভাবেই সভ্য ও গণতান্ত্রিক বলতে পারি না। সরকার নিজেকে একদিকে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি বলছে, অন্যদিকে দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন চলছে। জনগণের বিপক্ষে যত আইন হওয়া দরকার, তার সবই নির্বিঘ্নে হয়ে যাচ্ছে কিন্তু গুমের মতো অপরাধের কোনো সুনির্দিষ্ট আইন নেই। এ ব্যাপারে আইন করতে হবে। সৃষ্টি করতে হবে মতৈক্য।
ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, বিভিন্ন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী গত দু’বছরে দেশে ৩৪ ব্যক্তি গুম হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকার বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম ও চট্টগ্রামের নজরুল ইসলাম চেয়ারম্যানসহ ভিন্নমতাবলম্বী অনেকেই রয়েছেন। ২০২১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার প্রক্রিয়া হিসেবে এসব গুম করানো হয়েছে। দেশে আজ মানবাধিকার বলতে কিছু নেই। গণতন্ত্র পিষ্ট হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বুটের তলায়। যে দেশের বেশিরভাগ মন্ত্রীই দায়িত্ব পালনে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেন, সেদেশে আর যাই হোক, মানবাধিকার থাকবে—এমনটা আশা করা যায় না।
অ্যাডভোকেট আবু হানিফ বলেন, পত্রপত্রিকা খুললেই দেখি সাদা পোশাকে র্যাব বা পুলিশ কাউকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। পরে তার আর খোঁজ মিলছে না। র্যাবের সঙ্গে গোলাগুলিতে নিহত হচ্ছে শুধু ভিকটিম। এভাবে পোশাকধারী বাহিনীকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের লাইসেন্স দিয়ে দেয়া হয়েছে। দেশে ন্যূনতম গণতন্ত্র থাকলেও এ ধরনের ঘটনা ঘটানো সম্ভব হয় না। শুধু রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক যন্ত্রের মধ্যেই গুম সীমাবদ্ধ নেই। এখন এটা ব্যক্তিগত ও আর্থিক স্বার্থেও করা হচ্ছে।
রাজা মিয়া বলেন, সরকার তার ভিন্নমতের লোকজনকে চুপ করিয়ে দিতে পোশাকি বাহিনী দিয়ে একের পর এক ভিন্নমতের লোকদের গুম করছে। ব্যক্তিগত শত্রুতা থেকেও মানুষ গুম করার ঘটনা ঘটছে।
সঞ্চনা চাকমা বলেন, প্রায়ই আদিবাসী লোকজন গুম হয়ে যাচ্ছে। সরকার কিছুই করছে না। এ সরকার মুখেই শুধু গণতন্ত্রের কথা বলছে কিন্তু কাজে তারা একনায়কতন্ত্র কায়েম করছে।

No comments

Powered by Blogger.