কানা ও দ্রষ্টার হাট by পবন চক্রবর্তী
সাংস্কৃতিক-অধ্যয়ন এ দেশে খুব অর্বাচীন ব্যাপার নয়, অল্প হলেও লেখালেখি হয়েছে। এটা মনে রেখেই বলতে হবে, সুমন রহমান প্রণীত কানার হাটবাজার একটি পাইওনিয়ার গ্রন্থ। কারণ, দুইআনা-ছয়আনা নয়, গোটা বইটিই সাংস্কৃতিক-অধ্যয়নের মানসে রচিত। সুমন রহমান জানাচ্ছেন: নগর, জনসংস্কৃতি ও গণমাধ্যম—‘এই তিন পরস্পর-সম্পর্কিত বলয়ে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর আত্মপরিচয় বিনির্মাণের ধারণা কীভাবে বিকশিত হয়েছে’ সেটাই এই বইতে তাঁর অনুসন্ধানের বিষয়। কীভাবে অনুসন্ধান করছেন তিনি?
‘আমার পদ্ধতি সমন্বিত: প্রথমত, একটি সাংস্কৃতিক টেক্সটকে আমি চিহ্নতত্ত্বীয় পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করছি এবং তার পর আমার এথনোগ্রাফিক পর্যবেক্ষণের সাথে এর সমন্বয় করছি।’ কিন্তু পড়তে গিয়ে শুরুতেই হোঁচট খেতে হলো। জনসংস্কৃতি, নগর বা গণমাধ্যম—এগুলোর কোনো সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি; ফলে অনেক কথা আঁতকা ঠেকে। বইয়ের শুরুর ভাগে, এন্তার তাত্ত্বিকের নাম দিয়ে নানা কথা প্রচারিত হয়েছে, এটা সলতে পাকানোর কাজ। এসব বাতচিতের কোনো তথ্যসূত্র লেখা হয়নি। লেখক ‘ব্যক্তিগত কথনভঙ্গি’র কথা বলেছেন, কিন্তু বিদ্যায়তনিক পরিসরে তথ্যসূত্র না লেখার অধিকার এত অল্পে কারও জন্মায় না। এটা আরও বে-আবরু হয়েছে যখন দেখা গেল, কোথাও কোথাও তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে তথ্যসূত্র দিচ্ছেন। ফলে লেখককে অত্যন্ত অগোছালো ও খানিক হলেও ‘অ্যামেচার’ ঠেকে।
ভয়, তারুণ্য, মৃত্যু, টিভি, সিনেমা, নিম্নবর্গের আর্ট—এ রকম ছয়টি ভাগে বইটি বিন্যস্ত; পর্ব-ভাগ অতি সুচিন্তিত, যৌক্তিক। এই ষড়ভুজা বইটি এত প্রকাণ্ড যে সবদিকে আলো ফেলার ফুরসত নেই। শুধু কয়েকটি প্রবণতা দাগিয়ে রাখা যাক। লেখক সযত্নে একটি ভূমিকা দিয়েছেন, কিন্তু বইটি বুঝতে ভূমিকাটা তেমন কাজে লাগে না। এখানে আলোচনার পরম্পরা রক্ষিত হয়নি, অনেক ক্ষেত্রে ‘অবসকিউর’ ঠেকেছে; এবং পুরো ভূমিকা পড়লে কোনো সংহত মানে তৈরি হয় না।
কানার হাটবাজার গ্রন্থের সবচেয়ে বড় শক্তি বোধ হয় সুমন রহমানের দৃষ্টি। তিনি অনেক কিছু দেখতে পান, বুঝতে পারেন; ঘাপটি মেরে থাকা অর্থের অরণ্যে ঘাই তুলে দেন। আলোচিত খুনি রসু খাঁকে নিয়ে লেখা একেবারে গোড়ার প্রবন্ধ থেকে পড়া যাক। তিনি লিখছেন, ‘রসু খাঁ নয় বরং ক্রসফায়ারই আমাদের সবচে নারকীয় সিরিয়াল কিলার?’ বস্তির ছেলে মজিবুর লেখককে বলছেন, ‘লাল মানে মাইজভাণ্ডার আর নীল মানে সুরেশ্বর। লাল হোক আর নীল হোক, গান দিয়াই আমরা আল্লারে ডাকি’। চটিবইতে পাওয়া নারী-চরিত্র প্রসঙ্গে লেখকের মন্তব্য, ‘রোকেয়াবিবি সীতা ও রূপবানের একটি ইন্টারেস্টিং শংকর। রোকেয়াবিবি যেন সীতার অনমনীয় পৌরাণিক চরিত্রের একটি লৌকিক সমালোচনা।’ একটু নাড়াচাড়া করলেই বই থেকে পেন্ডোরার বাক্সের মতো এ রকম অসামান্য সব দৃষ্টিকোণ, পর্যালোচনা পাঠকের নজরে বিঁধবে।
এর সঙ্গে যোগ করুন তাঁর আলটপকা মন্তব্যের নমুনা, ‘যে হারে সহিংসতা বেড়েছে, তাতে বাংলাদেশের অর্ধেক লোকের রসু খাঁ হয়ে যাওয়ার কথা।’ তাঁর লেখার সবচেয়ে ক্লান্তিকর দিক হবে ‘ভালগার জেনারালাইজেশন’ এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই ব্রহ্মাস্ত্রের শিকার তাঁর অসহায় পাঠক। তিনি পাঠককে ‘আপনি’ সম্বোধনে প্রায়ই ‘এককাট্টা শ্রেণী’ হিসেবে নিয়েছেন। উদাহরণ দিচ্ছি: ‘প্রিয় পাঠক, হে অদূর ভবিষ্যতের সেলিব্রিটি, আপনাকে সালাম।’ নিজের মনোভাব তিনি জোর করে ঘাড় গুঁজে দেওয়ার মতো পাঠকের ওপর চাপিয়ে দেন: বসুন্ধরা সিটির অগ্নিকাণ্ড প্রসঙ্গে ‘ইতিমধ্যেই আমরা টের পেতে শুরু করেছি এটা রীতিমতো ফুল লেংথ মুভির চেয়ে বড় লেংথের বিনোদন’, বা বিডিআর বিদ্রোহ প্রসঙ্গে ‘তাদের নৃশংসতায় আমাদের গা শিউরে উঠছে, তারা যে “সাধারণ ক্ষমা”র অযোগ্য এ বিষয়ে আমাদের কোনো সংশয় আর নেই।’ এভাবে নিজের মনস্তত্ত্বের উতোর-চাপান পাঠকের ওপর নির্বিকার চলতে থাকলে একসময় পীড়নের মতো লাগে।
সেমিওটিক পদ্ধতিতে চিহ্ন-পাঠের অসামান্য ক্ষমতা আছে লেখকের। সাংস্কৃতিক-অধ্যয়নের ক্ষেত্রে এই বিরল ক্ষমতাই তাঁর মূল পুঁজি। ‘এক বক্তা, এক শ্রোতা’ প্রসঙ্গে তিনি একটি আলোকচিত্রের যে-পাঠ লিখেছেন, তা ইতিমধ্যে কিংবদন্তি (যদিও বল্গাহীনভাবে ফিকশনালাইজ করা হয়েছে এখানে)। ‘দুইরকম তারুণ্য’ লেখাটি, তিনি যে রচনা-রীতি গ্রহণ করেছেন, তার সবচেয়ে সফল দৃষ্টান্ত। পাঠককে মুখ্য-সুখ্য ধরে নেওয়ার কেশর-ফোলানো ভাব নয়, আন্তরিকভাবে তিনি দুই প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গির অর্থের খোঁজ করছেন। মাটির ময়না ছবিটি, তাঁর অসামান্য বিশ্লেষণে ধরা পড়ছে: ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদেরই একটি সাংস্কৃতিক প্রকল্প’ হিসেবে। বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে লিখতে গিয়ে খচ করে রায় লিখে দেন, ‘সে ইতিহাসের পাতায় খলনায়ক হয়ে থেকে’ যাবে।
খুচরো আলোচনা শেষ, এবার উপসংহার। কানার হাটবাজার অবশ্য-পাঠ্যগ্রন্থ। বইটি ওপেন-এন্ডেড, তাই ঠোরামুরির জায়গা আছে বেশুমার। তাতে লেখক-পাঠক দুই পক্ষেরই জিত। সুমন রহমান এই প্রজন্মের সবচেয়ে শক্তিশালী বিশ্লেষকদের অন্যতম, এ বইতে অন্তত সেই দড়টা টের পাওয়া যাচ্ছে।
No comments