কাচ-কাগজের জলজ মায়া by সিলভিয়া নাজনীন

ময়ের সংকট ব্যক্তিমানসে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করে। শিল্পীর অনুভবের তীব্রতা আর সৃষ্টিশৈলীর স্বাতন্ত্র্যে তৈরি হয় নতুন নির্মাণ। সৃজন উৎকর্ষ এ দেশের চিত্রকলার গতিপ্রকৃতিকে প্রাণবন্ত করে তুলছে প্রতিনিয়ত। নিত্য সৃজনপ্রয়াসী একজন শিল্পী কাজী রকিব। ‘গ্লাস অ্যান্ড পেপার’ শিরোনামে একটি বৈচিত্র্যময় প্রদর্শনী চলছে উত্তরার গ্যালারি ‘কায়া’তে। শিল্পী কাজী রকিব ট্রান্সপারেন্ট মিডিয়াম হিসেবে গ্লাসকে ব্যবহার করছেন বহুদিন থেকেই। তিনি বলেন, এ দেশের অধিকাংশ স্থাপত্য এখন গ্লাস দিয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে পেইন্টিং লাগানো অসুবিধাজনক।

অথচ এই গ্লাস পেইন্টিংয়ের দুই পাশেই ইচ্ছেমতো পেইন্টিং করার সুযোগ রয়েছে, আর তাতে আলোর চলাচল হয় অবারিত। তিনি আলোকে ব্যবহার করার চেষ্টা করেন তাঁর ত্রিমাত্রিক স্থাপনা ও ভাস্কর্যে। মাধ্যমের সুযোগকে যথাযথভাবে ব্যবহার করার দক্ষতা রয়েছে রকিবের। নানা মাধ্যমকে পেইন্টিং বা সৃজনশীলতায় ব্যবহার করা রকিবের দীর্ঘদিনের অভ্যাস। যখনই নতুন কোনো উপাদান ভালো লাগে, তখন তা নিয়ে নানা রকম নিরীক্ষা-পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে রূপান্তরের প্রচেষ্টায় মগ্ন থাকেন তিনি। শিল্পী মনে করেন, সৃষ্টিশীল রূপান্তরের বাসনা বুকে ধারণ করে ম্যাটেরিয়াল একজন শিল্পীর অপেক্ষায় থাকে। রকিবের এই প্রদর্শনীতে গ্লাস অ্যাচিং, মুখোশ, ভাস্কর্যের পাশাপাশি জলরঙে আঁকা চিত্রকর্মও রয়েছে; গত দুই বছরে আঁকা পেইন্টিং নিয়ে এই প্রদর্শনী। শিল্পী রকিবের দুঃসময়, নিঃসঙ্গতা, অনিশ্চয়তা এবং নতুন করে বাঁচার তাগিদ, প্রেরণা—এ সবকিছুর ধারাবাহিকতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে উপস্থাপিত তাঁর শিল্পকর্মে। জীবনের কঠিন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে তিনি কোনো রঙিন ছবি আঁকতে পারেননি। শিল্পীর ভাষায়, ‘পৃথিবীর সবকিছুই একটি ফিল্টারের মাধ্যমে যেন দেখতাম!’ শুধু চায়ের লিকারে তিনি এঁকেছেন দৃষ্টিনন্দিত সব ছবি।
ফিগারেটিভ, নন-ফিগারেটিভ, সেমি-অ্যাবস্ট্রাক্ট, অ্যাবস্ট্রাক্ট, নানা অবয়ব, মাছ, সবুজ নিসর্গ, গভীর জলের নিনাদ—এ সবকিছুই তিনি এঁকে চলেছেন আপন মনে। অস্থিরতা শিল্পী রকিবের শিল্পকর্মকে নতুন মাত্রায় উন্নীত করে। একই ধরনের কাজ বারবার করাকে একঘেয়েমি মনে করেন তিনি। বৈচিত্র্যসন্ধানী এই শিল্পীর নতুন নিরীক্ষা, ভাবনা, বহুমুখী অভিব্যক্তি, উপলব্ধি প্রাণময় করে তোলে তাঁর শিল্পকর্মকে। ‘স্টাইলাইজেশন সৃজনশীলতাকে বাধাগ্রস্ত করে, একটা দীর্ঘ সময় পর হয়তো আমার কাজের একটা ক্যারেক্টার পাওয়া যেতে পারে। তবে এ নিয়ে আলাদাভাবে ভাবনার কিছু নেই।’
শিল্পকে জীবনযাপনের নানা ক্ষেত্রে, দৈনন্দিন জীবনের নানা উপকরণ থেকে গৃহসজ্জার বিবিধ অনুষঙ্গে ছড়িয়ে দেন তিনি। স্থপতিদের ইন্টেরিয়র ডিজাইনের সঙ্গে যুক্ত করতে থাকেন তাঁর বিভিন্ন মাধ্যমের কাজগুলোকে। এখানেই গ্লাস অ্যাচিংয়ের প্রতি তাঁর আকর্ষণ। সৃষ্টিশীলতা এবং অপূর্ব দক্ষতায় কাজী রকিবের গ্লাস অ্যাচিং আধুনিক ইন্টেরিয়র সজ্জায় নতুন মাত্রা যোগ করে, যা বাংলাদেশে প্রথম—তিনি এর পুরোধা কৃতিত্বের দাবিদার। এই মাধ্যমে দীর্ঘদিন একাত্ম থেকে কাচকে নিজের মতো গলিয়ে তৈরি করেন ভাস্কর্য এবং শিল্পমাধ্যম হিসেবে বেছে নেন পরম মমতায়। বর্তমান প্রদর্শনী এর উজ্জ্বল প্রমাণ। কাচে অ্যাচিং ও স্বচ্ছ রং ব্যবহার করে তিনি যে শিল্পকর্ম তৈরি করেন, তাতে প্রাধান্য পেয়েছে আলংকারিক পাখি, ফুল, মাছ ও নানা লতাগুল্ম। কখনো বা অস্বচ্ছ কাচে চকচক করছে বৃষ্টির ফোঁটা। আয়নার রূপ বদলে যায় নানা প্রলেপে। কোথাও ডিজিটাল স্বচ্ছ প্রলেপের ওপর বসিয়ে দিয়েছেন গ্লাস অ্যাচিং বা স্বচ্ছ রঙের প্রলেপ। রকিবের এই প্রদর্শনীতে কাচের ওপর কাচ ছাড়াও রয়েছে কাগজে জলরঙের বেশ কিছু চিত্রকর্ম। মূর্ত-আধা বিমূর্ত, বিমূর্ত—এসব জলরং একটা বিশেষ সময়ের দলিল যেন। সাদা জমিনে চায়ের লিকারের নানা স্তর দিয়ে গড়ে ওঠা চিত্রমালার জন্ম হাসপাতালের কেবিনে বসে। ২০০৯ থেকে সাম্প্রতিক সময়ের নানা পর্বের শিল্পকর্মের এ প্রদর্শনী প্রমাণ দেয় কাজী রকিব কোনো নির্দিষ্ট মাধ্যম বা রীতির মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখতে পছন্দ করেন না। ক্রমাগত বৈচিত্র্যের সন্ধান এবং নতুন সৃষ্টির অতল পিপাসা আমাদের সৃজনশীলতায় যুক্ত করবে নন্দনবৈভব।

No comments

Powered by Blogger.