কৈশোরক স্মৃতিলহরি by মশিউল আলম

ই যে রৌদ্রছায়াশব্দগন্ধময় ছেলেবেলা! কথার পরে কথা সাজিয়ে ঝিঁকিয়ে তোলা ছবি: নিখুঁত, নিটোল চলচ্চিত্র! ভালোবাসা-ঘৃণা, সংহতি-বিদ্বেষ নিয়ে কলরব করে যে মানবজীবন, এক বালকের চোখের ভেতর দিয়ে সেই জীবনের ছবি ফুটে উঠল। সে বালক সদ্য মহাজীবনের মহাজগতের দিগন্তপানে উঁকি দিচ্ছে। তার চোখে এখনো লেগে রয়েছে না দেখার, না জানার বিস্ময়কুয়াশা।
ছবিগুলো আঁকছেন কিন্তু সপ্ততিপর এক মানুষ, ইতিহাস, রাষ্ট্রনীতি, ধর্ম, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা সম্বন্ধে যাঁর ধারণা ও বিশ্বাস পাকা। তিনি লেখক, আজীবন ছোটগল্পই লিখে চলেছেন; উপন্যাস বলতে লিখেছেন কুল্লে একখানা, সম্ভবত এই কারণে যে, তিনি সাধনা করেছেন ছোট আখ্যানের শৈল্পিক উৎকর্ষের চুড়ো স্পর্শ করার। অথবা আরেকটু গুছিয়ে বললে, তিনি পরখ করে দেখতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথের হাতে জন্ম নেওয়া বাংলা ছোটগল্পকে উৎকর্ষের কোন উচ্চতায় নেওয়া যায়। তিনি যে আগাপাছতলা একজন কথাশিল্পী, তার স্বাক্ষর বারে বারে পাই—কি তাঁর কল্পনাশ্রয়ী কাহিনিগদ্যে (ফিকশন), কি নিবন্ধে-প্রবন্ধে, কি সত্য কাহিনির বিবরণে।
গল্প-উপন্যাসে তিনি প্রায় সর্বদা আড়ালে রেখেছেন নিজেকে। গল্প লিখেছেন অন্য মানুষদের নিয়ে, যাদের বেশির ভাগই গরিব; যাদের অবস্থান সমাজ ও রাষ্ট্রের একদম প্রান্তসীমায়। যারা বিরূপ প্রকৃতি আর বৈরী রাষ্ট্রব্যবস্থার মার খেতে খেতে, মরে যেতে যেতে ফের বেঁচে ওঠে, তাদের টিকে থাকার নিরন্তর সংগ্রামের মধ্যে মানবজীবনের অর্থময়তা দেখেন যে কথাশিল্পী, তাঁর অবকাশ কোথায় নিজের মধ্যবিত্ত তথাকথিত ভদ্রজীবনের ছবি আঁকার? গল্প-উপন্যাসে তিনি তা করেননি। তবে যাঁরা তাঁর অনুরাগী পাঠক এবং ভবিষ্যতে যাঁরা তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করবেন, তাঁদের জন্য বড় সুখকর সংবাদ এই যে বছর দুই আগে তিনি যে আত্মস্মৃতি লিখতে শুরু করেছেন, তা অব্যাহত রেখেছেন। এর আগে আমরা পেয়েছি তাঁর শৈশবের স্মৃতিকহন: ফিরে যাই ফিরে আসি। একদম আঁতুড়ঘর থেকে শুরু হয়েছে সেই কহন এবং এ বছরের বইমেলায় আমরা পেলাম তাঁর কিশোরবেলার স্মৃতিকথা: উঁকি দিয়ে দিগন্ত। পাঠশালার পড়ো, পঞ্চম শ্রেণী পার হয়ে স্কুলে যাবে, তার প্রস্তুতি থেকে পরীক্ষার ফল বের হওয়া পর্যন্ত বছর দুয়েক সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ কাহিনি, তাতেই দুই শ পৃষ্ঠা!
আত্মজীবনী কত রকমের হতে পারে, জানি না। কিন্তু হাসান আজিজুল হকের স্মৃতিলহরির প্রথম খণ্ড ফিরে যাই ফিরে আসি আর দ্বিতীয় খণ্ড উঁকি দিয়ে দিগন্ত পড়ার পর মুগ্ধ বিস্ময়ে যেন আবিষ্কার করি—অটোবায়োগ্রাফি তো এ রকমও হতে পারে! ইউরোপের লোকেরা যেটাকে ‘নভেল’ বলে, খানিকটা বা অনেকখানি সেই রকম। এ কথার মানে এই নয় যে ফিকশন আর নন-ফিকশন একাকার হয়ে যাচ্ছে। সত্য কাহিনির অকপটতা অনুভব করা যায়; পড়তে পড়তে মন বারবার সায় দিয়ে বলে, সত্য সত্য, এ রকমই হয়। জীবন এমনই! নিজের জীবন যখন লেখার বিষয়, তখন আত্মপরতা বেশি রকম ক্রিয়াশীল হয়ে উঠতে পারে। উত্তম পুরুষে লেখা দস্তইয়েফস্কির আত্মজৈবনিক উপন্যাস কৈশোর-এর নায়ক বলে, অতি মাত্রায় নির্লজ্জ না হলে কেউ আত্মজীবনী লিখতে পারে না। রাগী, একপেশে মন্তব্য বটে। কিন্তু এতে এইটুকুন সত্য আছে যে পৃথিবীতে অনেক আত্মজীবনী লেখা হয়েছে অমরত্ব লাভের আত্মম্ভর আশায়, যেখানে জীবনের একটিমাত্র পিঠ শুধু দেখা যায়। বিশেষত বাঙালি সমাজে অনেক আত্মজীবনী লেখা হয়েছে নিজের ও পূর্বপুরুষের মহিমা প্রকাশের বাসনায়।
কিন্তু সচেতন পাঠকের অনুভবে অথবা সজ্ঞায় আত্মপরতার সেই খাদ ধরা পড়ে। গভীর মনোযোগের সঙ্গে হাসান আজিজুল হকের উঁকি দিয়ে দিগন্ত পাঠ করতে করতে মনে সেই কথাটাও উঁকি মারে—কোথাও লেখক নিজেকে লুকোচ্ছেন না তো? এ যে বয়ঃসন্ধিকাল, কত গ্লানি উঁকি মারে এই কালে! সেসব কথা এড়িয়ে যাননি তো লেখক? দেখলাম, না, মোটেও বাদ রাখেননি। বাৎস্যায়নের পোকায় কাটা কামসূত্র হাতে পেয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে বইটির ছবিগুলো দেখতে দেখতে কিশোর হাসানের মনে ও শরীরে কী সব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, তার বিবরণ এখানে রয়েছে এবং সেই সূত্রে তিনি বছর দুয়েক আগের এক স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছেন। মরদানা নামের এক পাড়াতো বুবু, যার বিয়ে হয়েছিল, কিন্তু স্বামী অকম্মা বলে তার সঙ্গে যে থাকে না, যার বুকজোড়া ছিল কাঁচা বেলের মতো এবং সেই বেল দুটোর দুই বোঁটা ছোরার মতো যখন তাঁর বুকে খচ করে লেগেছিল, তখন তাঁর চোখে কেমন পানি চলে এসেছিল! আর কামসূত্র পড়ার বয়সে সেই প্রসঙ্গটি স্মরণ করে কী মনে হয়েছিল—এই সমস্ত কথা অকপটে লিখেছেন তিনি।
আত্মজৈবনিক রচনা করে সেতু—অতীতের সঙ্গে ভবিষ্যতের। হাসান আজিজুল হকের উঁকি দিয়ে দিগন্ত তেমনই একটি সেতু। এ লেখায় সন-তারিখের বালাই নেই; কিন্তু সময়টি চিনে নিতে একটুও কষ্ট হয় না। ঘটনাপ্রবাহ পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের এক গ্রামীণ জনপদের। কিন্তু সারা দেশের ও সমস্ত পৃথিবীর ঢেউ ছুঁয়ে যায় সেই জনপদের মানুষগুলোকে। বিশ্বযুদ্ধ, মহামারি, বভুক্ষা, হিন্দু-মুসলমান কাটাকাটি-ভাগাভাগি, কংগ্রেস-মুসলিম লীগ—সবকিছু এসে পড়ে। এবং সবই দেখা যায় পাঠশালার পড়ো এক বালকের চোখ দিয়ে। আবার এই সমস্ত বড় বড় ঘটনার অন্তরালেই বয়ে চলে মানুষের চিরন্তন জীবনপ্রবাহ, দেশ-কাল নির্বিশেষে যেখানে মানুষ শুধুই মানুষ। কত মানুষ, কত ঘটনা, কত কথা, কত দৃশ্য, কত মুহূর্ত, কত অনুভব—সম্পূর্ণ একটি ভুবন। কিন্তু সেই ভুবন আজ হারিয়ে গেছে, যেমন সেই কিশোরটিকে আজ আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
এত কথা বলার পরও কিছুই বলা হলো না আসলে। এ যে সমাজগবেষকের, ইতিহাসবিদের, নৃতত্ত্ব-পণ্ডিতের কাজ নয়—সে কথাও বলা দরকার। কিন্তু তাতেও সব কথা বলা হয় না; উঁকি দিয়ে দিগন্ত থেকে যা পাওয়া যায়, তা যে আর কোনো ধরনের রচনা থেকে এবং হাসান আজিজুল হক ছাড়া আর কারও কাছ থেকেই পাওয়ার নয়—এই কথাটি বারে বারে মনে হয়। সে জন্য প্রত্যাশা করি, তাঁর স্মৃতিলহরির পরবর্তী পর্বগুলিও রচিত হবে।

No comments

Powered by Blogger.