বনলতা সেনের স্বরূপ উদ্ঘাটন by মিজানুর রহমান খান
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো থেকে বইয়ের নামকরণ যথার্থ। ড. আকবর আলি খানের অফুরান জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় অন্ধকারের উৎস হতে অন্ধকার বিদূরিত, পুরোপুরি আলোকিত। বাংলা সাহিত্যের মোনালিসা বনলতা সেনের স্বরূপ উদ্ঘাটনের প্রয়াস তাঁর প্রবন্ধগুচ্ছের মধ্যে সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক। প্রতিটি প্রবন্ধই রীতিমতো মৌলিক গবেষণাধর্মী। কিন্তু তাঁর দাবি, লেখা হয়েছে রম্য রচনার আদলে। তবে ১৪টি সারণি বইটিকে নীতিনির্ধারক, গবেষক ও লেখকদের জন্য এক দরকারি হ্যান্ডবুকেও পরিণত করেছে।
আকবর আলি খান জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেনকে অধিকতর মৌলিকত্ব দিয়েছেন। সমালোচনার দায়মোচনে তাঁর প্রয়াসে যত্ন ও দরদ উপচানো। সমালোচকেরা বলার চেষ্টা করেন যে বনলতা সেন কবিতায় অন্তত দুটি ইংরেজি কবিতার প্রভাব রয়েছে। এর একটি মার্কিনি কবি এডগার এলান পোর প্রথম প্রেমের নৈবেদ্য ‘টু হেলেন’ (মূল কবিতা ১৮৩১-এর, বইয়ে ১৮৪৫-এর পরিমার্জিত রূপটি ছাপা হয়েছে)। অন্যটি গ্রিক কবি হোমারের ইলিয়াডের চ্যাপম্যানকৃত অনুবাদ পড়ে রোমান্টিক ইংরেজ কবি জন কিটসের লেখা চতুর্দশপদী। আকবর আলি খানের মতে, এসবের প্রভাব ‘অতি নগণ্য’। বাঙালি সংস্কৃতির প্রগাঢ় জারকরসেই বনলতা সেন সিক্ত। তবে পো প্রেমিকা হেলেনের ‘ক্ল্যাসিক ফেস’ কী শ্রাবস্তির কারুকার্য, ‘পারফিউমড সি’ কী দারুচিনি দ্বীপ—সেই প্রশ্নের গুঞ্জরন এড়ানোর নয়। সন্দেহ কী, ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছে’ এর চৌকস অনুবাদ কিটসের সনেটের প্রথম লাইন ‘মাচ হ্যাভ আই ট্রাভেলড ইন দ্য রিয়েলম অব গোল্ড’ হতে পারেই। এমনকি পো ও কিটসের বাইরেও ‘জোনাকির রঙে ঝিলমিল’ সন্ধ্যার সঙ্গে ইয়েটসের ‘দেয়ার মিডনাইটস অল গ্লিটার’ ঠিকই স্মরণ করিয়ে দেবে।
জীবনানন্দ দাশ নিজেই বনলতা সেনের ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন। আনাড়িরা বলবেন, কাঁচা। আকবর আলি খান বলেছেন, ‘প্রহেলিকা’। পো ও হেলেন সম্পর্কে এত কথা জীবনানন্দ জানতেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন আকবর আলি খান। তবে ইংরেজির শিক্ষক হওয়ায় এর বিপরীত সম্ভাবনা হয়তো একেবারে উড়িয়ে দেওয়া কঠিন।
বইটিতে বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদ, ভাষা ও ধর্মের সঙ্গে তার সম্পর্ক, জাতীয়তাবাদী বিপ্লবের তাৎপর্য, পরিবেশ সমস্যা বিশেষ করে টিপাইমুখ বাঁধ, বাংলাদেশ অর্থনীতির সবলতা ও দুর্বলতা, শহুরে গরিবির রকমফের, ব্যাংক-ব্যবস্থায় নৈতিকতার টানাপোড়েন গভীরতায় বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তবে বইটিতে হরতালসর্বস্ব রাজনীতির মুখোশ খুলে দেওয়া, ধর্মের সঙ্গে বাঙালি মুসলিমের আত্মপ্রবঞ্চনা এবং সংবিধান সংশোধনবিষয়ক সুপারিশ বইটিকে সময়োপযোগী ও সমৃদ্ধ করেছে।
পাকিস্তানি আমলের ‘আজগুবি’ জাতীয়তাবাদের পাকচক্রে আজও আমরা ঘুরপাক খাচ্ছি। ধর্মেই মানুষের প্রথম পরিচয়, ভারতীয় উপমহাদেশের সব মুসলমান একটি জাতি—এই পাকিস্তানি ভুয়ো দর্শনের লিগেসি আজও আমাদের মানুষ হতে বাধা দিচ্ছে। আকবর আলি খান লিখেছেন, ‘ইসলামি উম্মাহর আদর্শকে আরবিভাষী মুসলমানদের মধ্যেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। সংলগ্ন ভূখণ্ডে বসবাসকারী আরবরা কমপক্ষে ২২টি জাতিরাষ্ট্রে বিভক্ত।’ (পৃ. ৮৯)। এটা পাঠে পাঠকদের মনে পড়বেই, বাহাত্তরের সেক্যুলার সংবিধানে ফেরার প্রবক্তাদের অনেকে ইতিমধ্যে ক্লান্ত ও বিভ্রান্ত। তাঁরা ভোটের রাজনীতির কারণে সংবিধান থেকে উম্মাহর গন্ধ মুছতে দোদুল্যমান, পলায়নপর।
সংবিধান সংশোধনে লেখকের ভাবনা ২০১০ সালে প্রকাশিত তাঁর হাম্পটি ডাম্পটি বইয়েও দেখেছি। কিন্তু পরিহাস হলো, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করাসহ তাঁর সুনির্দিষ্ট সুপারিশগুলো সংসদের বিশেষ কমিটির প্রতিবেদনে অগ্রাহ্য থেকেছে। চরমতম পরিহাস হলো, এসব নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে কোনো আলাপ-আলোচনা পর্যন্ত নেই। বুদ্ধিজীবীরাও নির্বাক। তবে এ নিয়ে উচ্চকিত হওয়ার সময় শেষ হয়ে যায়নি। আকবর আলি খান যেসব প্রশ্ন তুলেছেন, সেগুলোকে বাদ দিয়ে আমরা অবশ্যই কোনো গণতান্ত্রিক সংবিধান পেতে পারি না। তাঁর ‘ক্রীড়াতত্ত্ব’ আমাদের ‘রাজনীতিবিদদের’ জন্য অবশ্য পাঠ্য। বিশেষ করে, বিরোধী দলের নেতার প্রতি সরকারপ্রধানের সাম্প্রতিক ‘খাল কেটে কুমির আনা’ প্রসঙ্গে আকবর আলি খানের ‘কয়েদিদের উভয় সংকট’ (প্রিজনার্স ডিলেমা) অতীব প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। তাঁর ক্রীড়াতত্ত্বের (গেম থিওরি) সার কথা হলো, যুক্তভাবে দোষী দুই আসামিকে পুলিশ কয়েদে পাঠায়। কিন্তু পুলিশের কাছে তাদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ নেই। পুলিশ এই অবস্থায় তাদের একজনকে আরেকজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে উৎসাহিত করতে চারটি প্রস্তাব দেয় (পৃ. ১১৭)। এই প্রস্তাবগুলোর মূল কথা হলো, তারা যদি পরস্পরকে বিশ্বাস করে, তাহলে মাত্র এক বছরের সাজা ভোগ করে তারা মুক্তি পাবে। কিন্তু এই গেম থিওরির মজাটাই এই যে তারা নিজেদের সন্দেহ ও অবিশ্বাস করে এবং এর ফলে তারা যুক্তভাবে সর্বোচ্চ সাজা ভোগ করে। অবিশ্বাসের কারণে বাংলাদেশে বহুকাল ধরে সর্বোচ্চ সাজা ভোগের রাজনীতি চলছে।
আকবর আলি খানের হরতাল-সংক্রান্ত বিশ্লেষণ সরকারি প্রচারমাধ্যম বিশেষ করে বিটিভি ব্যাপকভাবে প্রচারে আনন্দ পেতে পারে। একটি হরতালে গড় ক্ষতি ৬০ মিলিয়ন ডলার। ইউএনডিপির মতে, ১৯৯১-২০০০ সময়কালে হরতালের মোট ক্ষতি জাতীয় উৎপাদনের ৩ থেকে ৪ শতাংশ। আকবর আলি খান মনে করেন, এসব তথ্য অতিরঞ্জিত। এটা বড়জোর দশমিক ৫ শতাংশ হতে ১ শতাংশ হতে পারে। তাঁর মন্তব্য, ‘সম্ভবত এ জন্যই রাজনৈতিক অস্থিরতার বড় প্রভাব অর্থনীতিতে দেখা যায় না।’
হরতালের ক্ষতি বড় করে দেখালে বিরোধী দলকে আরও হরতাল দিতে উন্মাদনায় পেয়ে বসে। বরং সত্যিটা বললে হয়তো তারা কিঞ্চিৎ হলেও নিরুৎসাহিত হতে পারে।
আকবর আলি খানের পাণ্ডিত্যপূর্ণ বাক ও বাক্যশৈলী অসাধারণ। নান্দনিকতায় যুক্তিশক্তির বহিঃপ্রকাশের এ এক বিরল দৃষ্টান্ত। তাঁর রূপকল্প ও গাঁথুনি অবশ্যই চেনা রম্য নয়, এক অনিন্দ্যসুন্দর নির্ভার গদ্য।
জীবনানন্দ দাশ নিজেই বনলতা সেনের ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন। আনাড়িরা বলবেন, কাঁচা। আকবর আলি খান বলেছেন, ‘প্রহেলিকা’। পো ও হেলেন সম্পর্কে এত কথা জীবনানন্দ জানতেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন আকবর আলি খান। তবে ইংরেজির শিক্ষক হওয়ায় এর বিপরীত সম্ভাবনা হয়তো একেবারে উড়িয়ে দেওয়া কঠিন।
বইটিতে বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদ, ভাষা ও ধর্মের সঙ্গে তার সম্পর্ক, জাতীয়তাবাদী বিপ্লবের তাৎপর্য, পরিবেশ সমস্যা বিশেষ করে টিপাইমুখ বাঁধ, বাংলাদেশ অর্থনীতির সবলতা ও দুর্বলতা, শহুরে গরিবির রকমফের, ব্যাংক-ব্যবস্থায় নৈতিকতার টানাপোড়েন গভীরতায় বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তবে বইটিতে হরতালসর্বস্ব রাজনীতির মুখোশ খুলে দেওয়া, ধর্মের সঙ্গে বাঙালি মুসলিমের আত্মপ্রবঞ্চনা এবং সংবিধান সংশোধনবিষয়ক সুপারিশ বইটিকে সময়োপযোগী ও সমৃদ্ধ করেছে।
পাকিস্তানি আমলের ‘আজগুবি’ জাতীয়তাবাদের পাকচক্রে আজও আমরা ঘুরপাক খাচ্ছি। ধর্মেই মানুষের প্রথম পরিচয়, ভারতীয় উপমহাদেশের সব মুসলমান একটি জাতি—এই পাকিস্তানি ভুয়ো দর্শনের লিগেসি আজও আমাদের মানুষ হতে বাধা দিচ্ছে। আকবর আলি খান লিখেছেন, ‘ইসলামি উম্মাহর আদর্শকে আরবিভাষী মুসলমানদের মধ্যেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। সংলগ্ন ভূখণ্ডে বসবাসকারী আরবরা কমপক্ষে ২২টি জাতিরাষ্ট্রে বিভক্ত।’ (পৃ. ৮৯)। এটা পাঠে পাঠকদের মনে পড়বেই, বাহাত্তরের সেক্যুলার সংবিধানে ফেরার প্রবক্তাদের অনেকে ইতিমধ্যে ক্লান্ত ও বিভ্রান্ত। তাঁরা ভোটের রাজনীতির কারণে সংবিধান থেকে উম্মাহর গন্ধ মুছতে দোদুল্যমান, পলায়নপর।
সংবিধান সংশোধনে লেখকের ভাবনা ২০১০ সালে প্রকাশিত তাঁর হাম্পটি ডাম্পটি বইয়েও দেখেছি। কিন্তু পরিহাস হলো, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করাসহ তাঁর সুনির্দিষ্ট সুপারিশগুলো সংসদের বিশেষ কমিটির প্রতিবেদনে অগ্রাহ্য থেকেছে। চরমতম পরিহাস হলো, এসব নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে কোনো আলাপ-আলোচনা পর্যন্ত নেই। বুদ্ধিজীবীরাও নির্বাক। তবে এ নিয়ে উচ্চকিত হওয়ার সময় শেষ হয়ে যায়নি। আকবর আলি খান যেসব প্রশ্ন তুলেছেন, সেগুলোকে বাদ দিয়ে আমরা অবশ্যই কোনো গণতান্ত্রিক সংবিধান পেতে পারি না। তাঁর ‘ক্রীড়াতত্ত্ব’ আমাদের ‘রাজনীতিবিদদের’ জন্য অবশ্য পাঠ্য। বিশেষ করে, বিরোধী দলের নেতার প্রতি সরকারপ্রধানের সাম্প্রতিক ‘খাল কেটে কুমির আনা’ প্রসঙ্গে আকবর আলি খানের ‘কয়েদিদের উভয় সংকট’ (প্রিজনার্স ডিলেমা) অতীব প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। তাঁর ক্রীড়াতত্ত্বের (গেম থিওরি) সার কথা হলো, যুক্তভাবে দোষী দুই আসামিকে পুলিশ কয়েদে পাঠায়। কিন্তু পুলিশের কাছে তাদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ নেই। পুলিশ এই অবস্থায় তাদের একজনকে আরেকজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে উৎসাহিত করতে চারটি প্রস্তাব দেয় (পৃ. ১১৭)। এই প্রস্তাবগুলোর মূল কথা হলো, তারা যদি পরস্পরকে বিশ্বাস করে, তাহলে মাত্র এক বছরের সাজা ভোগ করে তারা মুক্তি পাবে। কিন্তু এই গেম থিওরির মজাটাই এই যে তারা নিজেদের সন্দেহ ও অবিশ্বাস করে এবং এর ফলে তারা যুক্তভাবে সর্বোচ্চ সাজা ভোগ করে। অবিশ্বাসের কারণে বাংলাদেশে বহুকাল ধরে সর্বোচ্চ সাজা ভোগের রাজনীতি চলছে।
আকবর আলি খানের হরতাল-সংক্রান্ত বিশ্লেষণ সরকারি প্রচারমাধ্যম বিশেষ করে বিটিভি ব্যাপকভাবে প্রচারে আনন্দ পেতে পারে। একটি হরতালে গড় ক্ষতি ৬০ মিলিয়ন ডলার। ইউএনডিপির মতে, ১৯৯১-২০০০ সময়কালে হরতালের মোট ক্ষতি জাতীয় উৎপাদনের ৩ থেকে ৪ শতাংশ। আকবর আলি খান মনে করেন, এসব তথ্য অতিরঞ্জিত। এটা বড়জোর দশমিক ৫ শতাংশ হতে ১ শতাংশ হতে পারে। তাঁর মন্তব্য, ‘সম্ভবত এ জন্যই রাজনৈতিক অস্থিরতার বড় প্রভাব অর্থনীতিতে দেখা যায় না।’
হরতালের ক্ষতি বড় করে দেখালে বিরোধী দলকে আরও হরতাল দিতে উন্মাদনায় পেয়ে বসে। বরং সত্যিটা বললে হয়তো তারা কিঞ্চিৎ হলেও নিরুৎসাহিত হতে পারে।
আকবর আলি খানের পাণ্ডিত্যপূর্ণ বাক ও বাক্যশৈলী অসাধারণ। নান্দনিকতায় যুক্তিশক্তির বহিঃপ্রকাশের এ এক বিরল দৃষ্টান্ত। তাঁর রূপকল্প ও গাঁথুনি অবশ্যই চেনা রম্য নয়, এক অনিন্দ্যসুন্দর নির্ভার গদ্য।
No comments