আশুগঞ্জ নৌবন্দরঃ কিছু ঠিক নেই, তবু ট্রানজিট by জাহাঙ্গীর শাহ ও দুলাল ঘোষ
নেই কোনো স্থায়ী অবকাঠামো। অস্থায়ী ঘাট বানানো হয়েছে বালুর বস্তা দিয়ে। অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) অফিস চলছে পেট্রলপাম্পের দুটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে। কর্মকর্তা সাকল্যে একজন। এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ আশুগঞ্জ বন্দরের চিত্র। কোনো কিছুই ঠিক নেই। এভাবেই আশুগঞ্জ নৌবন্দর দিয়ে ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিদ্যমান নৌ প্রটোকলের আওতায় ট্রানজিট পণ্য ত্রিপুরার আগরতলায় যাচ্ছে। ইতিমধ্যে দুটি পরীক্ষামূলক চালানও আগরতলায় চলে গেছে।
এখন শুরু হয়েছে নিয়মিত চালান খালাস। নৌ প্রটোকলের আওতায় এসব ট্রানজিট পণ্যে কোনো মাশুল দিতে হচ্ছে না। শুধু আশুগঞ্জ নৌবন্দর আর আখাউড়া স্থলবন্দর ব্যবহারের মাশুল আরোপ করা হয়েছে। নৌ প্রটোকলের আওতায় মাশুল ছাড়া পণ্য পরিবহনে শুল্ক আনুষ্ঠানিকতা-সংক্রান্ত আদেশ জারি করেছে এনবিআর। এর আওতায় আশুগঞ্জ বন্দর পর্যন্ত নৌপথে আর আখাউড়া পর্যন্ত সড়কপথে পণ্য পরিবহন করা হবে।
সড়ক, রেল ও নৌপথে বহুমাত্রিক ট্রানজিট সুবিধা দেওয়ার উদ্যোগ আপাতত স্থগিত থাকলেও শুধু নৌ প্রটোকলের আওতায় আশুগঞ্জ বন্দর ব্যবহার করে ভারত পণ্য আনা-নেওয়াকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ও ট্রানজিট নিয়ে গঠিত কোর কমিটির সদস্য ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ট্রানজিটের জন্য যে কটি রুট চিহ্নিত করা হয়েছে, এর মধ্যে আশুগঞ্জ বন্দর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই রুট দিয়ে নিয়মিত ট্রানজিট পরিচালনা করতে হলে অবকাঠামো খাতে বড় ধরনের বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে। সুতরাং এমনভাবে বিভিন্ন চার্জ নির্ধারণ করতে হবে, যাতে বিনিয়োগ ফিরে পাওয়াসহ কিছু মুনাফা হয়। সরকারের কোর কমিটি এই সুপারিশই করেছিল।
অবকাঠামোবিহীন নৌবন্দর: দুটি পরীক্ষামূলক চালানের পর ১২ অক্টোবর থেকে আশুগঞ্জ বন্দর দিয়ে নিয়মিত চালান আখাউড়া স্থলবন্দরে যাওয়া শুরু হয়েছে। এমভি নীলকণ্ঠ নামের বাংলাদেশি জাহাজ কলকাতা থেকে ৬২১ টন লোহাজাতীয় পণ্য (কাঁচা লোহা) এনে আশুগঞ্জ বন্দর দিয়ে খালাস করছে। এগুলো ত্রিপুরা ইস্পাত কোম্পানির পণ্য।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বালুর বস্তা দিয়ে বানানো ঘাটে মালামাল খালাস করা হচ্ছে। এমনকি মালামাল খালাস করার সময় কোনো শুল্ক কর্মকর্তা ও বিআইডব্লিউটিএর কোনো কর্মকর্তা তদারকিতে নেই। জাহাজের লোকজনই মাল ট্রাকে ওঠানোর কাজ তদারক করছেন।
নীলকণ্ঠের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ নজির প্রথম আলোকে জানান, কোনো মাশুল না দিলেও ব্যাংক গ্যারান্টি দিয়ে এসব মাল খালাস হচ্ছে। স্থায়ী অবকাঠামো না থাকায় মাল খালাস করতে ব্যয় বাড়ছে। বেশি শ্রমিক নিতে হচ্ছে।
এর আগে পরীক্ষামূলক চালান হিসেবে লোহার পাতের দুটি চালান ইতিমধ্যে আগরতলায় গেছে। তবে এই চালানের জন্য কোনো মাশুল বা ব্যাংক গ্যারান্টি দিতে হয়নি ভারতীয় ব্যবসায়ীদের।
ত্রিপুরার পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভারী যন্ত্রাংশ জাহাজ থেকে নামাতে আশুগঞ্জের পুরোনো ফেরিঘাটের পাশে অস্থায়ী ঘাট তৈরি করা হয়েছে। এখন ওই ঘাটেই বালুর বস্তা ফেলে উঁচু করে ট্রানজিট মালামাল ওঠানো-নামানোর উপযোগী করা হয়েছে। আর এখানেই ঝুঁকি নিয়ে ট্রানজিটের পণ্য জাহাজ থেকে সরাসরি ট্রাকে তোলা হচ্ছে। এখানে পণ্য রাখার কোনো স্থান ও গুদাম নেই।
বালুর ঘাট থেকে মূল মহাসড়ক পর্যন্ত প্রায় আধা কিলোমিটার অংশে সড়ক নেই। বালুময় পথ পাড়ি দিতে হয় পণ্যবাহী ভারী ট্রাকগুলোকে।
ট্রানজিট পণ্য আনা জাহাজগুলোর জন্য ঘাট এবং ওঠানো-নামানোর মাশুল হিসেবে প্রতি টনে ৩০ টাকা করে রাখা হয়। আর বন্দরে অবস্থান করলেও এর জন্য মাশুল আরোপ করা হয়।
আশুগঞ্জ নৌবন্দরের জন্য নেই কোনো স্থায়ী অফিস। সম্প্রতি আশুগঞ্জের চিশতি ফিলিং সেন্টারের দোতলায় মাসিক আট হাজার টাকায় দুটি কক্ষ ভাড়া নেওয়া হয়েছে। ভৈরব থেকে এসে অনিয়মিতভাবে একজন ট্রাফিক পরিদর্শক এখানে দায়িত্ব পালন করেন।
ট্রাফিক পরিদর্শক শাহ আলম এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘লোকবল না থাকায় কাজের সমস্যা হয়। আমাকে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনব্যবস্থাও দেখতে হয়। আশা করি দু-তিন মাসের মধ্যে স্থায়ী জেটি হবে।’ তিনি জানান, ইতিমধ্যে আশুগঞ্জ বন্দরে লোকবল নিয়োগের জন্য নৌ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব জমা দিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ।
আশুগঞ্জ কনটেইনার বন্দর নির্মাণের উদ্যোগ থমকে আছে: ভারতীয় ঋণের ২৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে আশুগঞ্জ কনটেইনার বন্দর স্থাপন করা হবে। কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন না হওয়ায় বন্দর নির্মাণের কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। ভৈরব-আশুগঞ্জ রেলসেতুর পশ্চিম পাশে আশুগঞ্জ অংশে মেঘনা নদীর তীরে এই বন্দর নির্মাণের কথা।
ভারত ২১টি প্রকল্পে ১০০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এর মধ্যে ১৩টি প্রকল্পের ঋণ অনুমোদন দিয়েছে। এতে আশুগঞ্জ কনটেইনার বন্দর নির্মাণের প্রকল্প নেই।
গত ডিসেম্বর মাসে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) প্রকল্পটি পাস হয়। কিন্তু ভারতের ঋণের টাকা না পাওয়ায় এখনো কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। এই বন্দর নির্মাণের জন্য মোট ৩২ একর জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হবে।
কয়েক মাস আগে জমি অধিগ্রহণের জন্য স্থানীয় এলাকাবাসীকে নোটিশ দেওয়া হলেও এখন আর সেই উদ্যোগ নেই বলে জানান অনেকেই। আশুগঞ্জের চরচারতলা ইউনিয়নের মহরমপাড়ার অধিবাসী ইসমাইল মিয়া (৬২) বলেন, ‘কয়েক মাস আগে জমিজমা নেওয়ার জন্য লেইখ্যা নিলেও এখন আর কেউ আসে না। ধানিজমি-বসতভিটা গেলে থাকুম কই?’
প্রকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী, আশুগঞ্জ বন্দর দিয়ে বছরে প্রায় চার লাখ টিইইউ (২০ ফুট দৈর্ঘ্যের) কনটেইনার যাবে। এর প্রায় পুরোটাই ভারতীয় পণ্য। এই প্রকল্পের আওতায় কনটেইনার ঘাট, বহুমুখী ব্যবহারের ঘাট ও পণ্য রাখার স্থান, সেতুসহ সংযোগ সড়ক, তীর সংরক্ষণ, ছাউনি ও অফিস ভবন নির্মাণ করা হবে।
আশুগঞ্জ-আখাউড়া সড়ক ভারী যান চলাচলের অনুপযোগী: আশুগঞ্জ নৌবন্দর থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত সড়কপথের দৈর্ঘ্য ৪৭ কিলোমিটার। এই সড়ক পণ্যবাহী ভারী যান চলাচলের জন্য কোনোভাবেই উপযোগী নয়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, শুধু আশুগঞ্জ থেকে সরাইল বিশ্বরোড মোড় পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার সড়ক সিলেট মহাসড়কের অংশ হওয়ায় তা ভারী যান চলাচলের অনেকটা উপযোগী। আর বাকি ৩৬ কিলোমিটার সড়ক কোথাও খানাখন্দে ভরা, আবার কোথাও সড়ক এতটাই সরু যে দুটি গাড়ি মুখোমুখি পার হতে পারে না। এসব সড়কে বিদ্যমান সেতু বা কালভার্টগুলো বেশ পুরোনো।
সরাইল থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে সুলতানপুর মোড় পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার সড়কের বিভিন্ন স্থানে খানাখন্দ রয়েছে। সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এই রাস্তায় ভারী পণ্যবাহী ট্রাক, বাস চলাচলের প্রায় অনুপযোগী। এই সড়কের রামরাইল সেতুটি পরিত্যক্ত। সেতুর পাশে অস্থায়ী বেইলি সেতু করা হলেও তা দিয়ে ভারী যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বিকল্প একটি সড়ক তৈরি করা হলেও সেটিও এখন ঝুঁকিপূর্ণ।
তবে সুলতানপুর থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত রাস্তা চওড়া করার পাশাপাশি সংস্কারকাজ চলছে। এতে আগের চেয়ে অনেক সহজে পণ্যবাহী ট্রাক আসা-যাওয়া করতে পারছে।
অপর্যাপ্ত অবকাঠামো ও লোকবল: একজন ট্রাফিক পরিদর্শক ও তত্ত্বাবধায়ক দিয়েই চলে আখাউড়া স্থলবন্দরের কাজ। আর নিরাপত্তার জন্য রয়েছে আটজন কর্মী। এই লোকবল দিয়েই চলে স্থলবন্দরটি।
অথচ বন্দর কার্যক্রমের আওতায় প্রতিদিন (পিক মৌসুমে) ১০০ থেকে ১২০টি পণ্যবাহী ট্রাক আগরতলায় আসা-যাওয়া করে। বর্ষাকালে (অফ পিক মৌসুমে) প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০টি ট্রাক আসা-যাওয়া করে। এখন পর্যন্ত এটি মূলত রপ্তানিমুখী স্থলবন্দর।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বন্দরে যে খোলা জায়গা রয়েছে, তাতে শতাধিক ট্রাকের স্থানসংকুলান হয় না। প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০টি রপ্তানি পণ্যবাহী ট্রাক আসে। এ কারণে প্রতিদিন সরু রাস্তায় অনেক ট্রাককে অপেক্ষা করতে হয়।
পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাত্র অর্ধেক যন্ত্রাংশ আগরতলায় গেছে: পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আনা সব ভারী যন্ত্রাংশ আশুগঞ্জ নৌবন্দর ও আখাউড়া স্থলবন্দর হয়ে আগরতলায় নেওয়া সম্ভব হয়নি। আশুগঞ্জ নৌবন্দরে অপেক্ষারত জাহাজে ও কয়েকটি স্থানে এখনো ৪৩টি মডিউল (যন্ত্রাংশ বহনকারী বৃহৎ আকারের কনটেইনার) রয়েছে। ৪৭টি মডিউল ইতিমধ্যে আগরতলায় চলে গেছে।
এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রাংশ পরিবহনের বাংলাদেশি এজেন্ট হলো গালফ ওরিয়েন্ট সি ওয়েজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এর নির্বাহী কর্মকর্তা নুরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এখন প্রতি সপ্তাহে একটিমাত্র মডিউল নেওয়া সম্ভব হয়। প্রতিটি খুলে চার ভাগে বিভক্ত করে পরিবহন করা হচ্ছে। বাকিগুলো পরিবহন করতে আরও তিন-চার মাস লাগতে পারে।
সড়ক, রেল ও নৌপথে বহুমাত্রিক ট্রানজিট সুবিধা দেওয়ার উদ্যোগ আপাতত স্থগিত থাকলেও শুধু নৌ প্রটোকলের আওতায় আশুগঞ্জ বন্দর ব্যবহার করে ভারত পণ্য আনা-নেওয়াকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ও ট্রানজিট নিয়ে গঠিত কোর কমিটির সদস্য ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ট্রানজিটের জন্য যে কটি রুট চিহ্নিত করা হয়েছে, এর মধ্যে আশুগঞ্জ বন্দর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই রুট দিয়ে নিয়মিত ট্রানজিট পরিচালনা করতে হলে অবকাঠামো খাতে বড় ধরনের বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে। সুতরাং এমনভাবে বিভিন্ন চার্জ নির্ধারণ করতে হবে, যাতে বিনিয়োগ ফিরে পাওয়াসহ কিছু মুনাফা হয়। সরকারের কোর কমিটি এই সুপারিশই করেছিল।
অবকাঠামোবিহীন নৌবন্দর: দুটি পরীক্ষামূলক চালানের পর ১২ অক্টোবর থেকে আশুগঞ্জ বন্দর দিয়ে নিয়মিত চালান আখাউড়া স্থলবন্দরে যাওয়া শুরু হয়েছে। এমভি নীলকণ্ঠ নামের বাংলাদেশি জাহাজ কলকাতা থেকে ৬২১ টন লোহাজাতীয় পণ্য (কাঁচা লোহা) এনে আশুগঞ্জ বন্দর দিয়ে খালাস করছে। এগুলো ত্রিপুরা ইস্পাত কোম্পানির পণ্য।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বালুর বস্তা দিয়ে বানানো ঘাটে মালামাল খালাস করা হচ্ছে। এমনকি মালামাল খালাস করার সময় কোনো শুল্ক কর্মকর্তা ও বিআইডব্লিউটিএর কোনো কর্মকর্তা তদারকিতে নেই। জাহাজের লোকজনই মাল ট্রাকে ওঠানোর কাজ তদারক করছেন।
নীলকণ্ঠের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ নজির প্রথম আলোকে জানান, কোনো মাশুল না দিলেও ব্যাংক গ্যারান্টি দিয়ে এসব মাল খালাস হচ্ছে। স্থায়ী অবকাঠামো না থাকায় মাল খালাস করতে ব্যয় বাড়ছে। বেশি শ্রমিক নিতে হচ্ছে।
এর আগে পরীক্ষামূলক চালান হিসেবে লোহার পাতের দুটি চালান ইতিমধ্যে আগরতলায় গেছে। তবে এই চালানের জন্য কোনো মাশুল বা ব্যাংক গ্যারান্টি দিতে হয়নি ভারতীয় ব্যবসায়ীদের।
ত্রিপুরার পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভারী যন্ত্রাংশ জাহাজ থেকে নামাতে আশুগঞ্জের পুরোনো ফেরিঘাটের পাশে অস্থায়ী ঘাট তৈরি করা হয়েছে। এখন ওই ঘাটেই বালুর বস্তা ফেলে উঁচু করে ট্রানজিট মালামাল ওঠানো-নামানোর উপযোগী করা হয়েছে। আর এখানেই ঝুঁকি নিয়ে ট্রানজিটের পণ্য জাহাজ থেকে সরাসরি ট্রাকে তোলা হচ্ছে। এখানে পণ্য রাখার কোনো স্থান ও গুদাম নেই।
বালুর ঘাট থেকে মূল মহাসড়ক পর্যন্ত প্রায় আধা কিলোমিটার অংশে সড়ক নেই। বালুময় পথ পাড়ি দিতে হয় পণ্যবাহী ভারী ট্রাকগুলোকে।
ট্রানজিট পণ্য আনা জাহাজগুলোর জন্য ঘাট এবং ওঠানো-নামানোর মাশুল হিসেবে প্রতি টনে ৩০ টাকা করে রাখা হয়। আর বন্দরে অবস্থান করলেও এর জন্য মাশুল আরোপ করা হয়।
আশুগঞ্জ নৌবন্দরের জন্য নেই কোনো স্থায়ী অফিস। সম্প্রতি আশুগঞ্জের চিশতি ফিলিং সেন্টারের দোতলায় মাসিক আট হাজার টাকায় দুটি কক্ষ ভাড়া নেওয়া হয়েছে। ভৈরব থেকে এসে অনিয়মিতভাবে একজন ট্রাফিক পরিদর্শক এখানে দায়িত্ব পালন করেন।
ট্রাফিক পরিদর্শক শাহ আলম এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘লোকবল না থাকায় কাজের সমস্যা হয়। আমাকে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনব্যবস্থাও দেখতে হয়। আশা করি দু-তিন মাসের মধ্যে স্থায়ী জেটি হবে।’ তিনি জানান, ইতিমধ্যে আশুগঞ্জ বন্দরে লোকবল নিয়োগের জন্য নৌ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব জমা দিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ।
আশুগঞ্জ কনটেইনার বন্দর নির্মাণের উদ্যোগ থমকে আছে: ভারতীয় ঋণের ২৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে আশুগঞ্জ কনটেইনার বন্দর স্থাপন করা হবে। কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন না হওয়ায় বন্দর নির্মাণের কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। ভৈরব-আশুগঞ্জ রেলসেতুর পশ্চিম পাশে আশুগঞ্জ অংশে মেঘনা নদীর তীরে এই বন্দর নির্মাণের কথা।
ভারত ২১টি প্রকল্পে ১০০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এর মধ্যে ১৩টি প্রকল্পের ঋণ অনুমোদন দিয়েছে। এতে আশুগঞ্জ কনটেইনার বন্দর নির্মাণের প্রকল্প নেই।
গত ডিসেম্বর মাসে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) প্রকল্পটি পাস হয়। কিন্তু ভারতের ঋণের টাকা না পাওয়ায় এখনো কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। এই বন্দর নির্মাণের জন্য মোট ৩২ একর জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হবে।
কয়েক মাস আগে জমি অধিগ্রহণের জন্য স্থানীয় এলাকাবাসীকে নোটিশ দেওয়া হলেও এখন আর সেই উদ্যোগ নেই বলে জানান অনেকেই। আশুগঞ্জের চরচারতলা ইউনিয়নের মহরমপাড়ার অধিবাসী ইসমাইল মিয়া (৬২) বলেন, ‘কয়েক মাস আগে জমিজমা নেওয়ার জন্য লেইখ্যা নিলেও এখন আর কেউ আসে না। ধানিজমি-বসতভিটা গেলে থাকুম কই?’
প্রকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী, আশুগঞ্জ বন্দর দিয়ে বছরে প্রায় চার লাখ টিইইউ (২০ ফুট দৈর্ঘ্যের) কনটেইনার যাবে। এর প্রায় পুরোটাই ভারতীয় পণ্য। এই প্রকল্পের আওতায় কনটেইনার ঘাট, বহুমুখী ব্যবহারের ঘাট ও পণ্য রাখার স্থান, সেতুসহ সংযোগ সড়ক, তীর সংরক্ষণ, ছাউনি ও অফিস ভবন নির্মাণ করা হবে।
আশুগঞ্জ-আখাউড়া সড়ক ভারী যান চলাচলের অনুপযোগী: আশুগঞ্জ নৌবন্দর থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত সড়কপথের দৈর্ঘ্য ৪৭ কিলোমিটার। এই সড়ক পণ্যবাহী ভারী যান চলাচলের জন্য কোনোভাবেই উপযোগী নয়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, শুধু আশুগঞ্জ থেকে সরাইল বিশ্বরোড মোড় পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার সড়ক সিলেট মহাসড়কের অংশ হওয়ায় তা ভারী যান চলাচলের অনেকটা উপযোগী। আর বাকি ৩৬ কিলোমিটার সড়ক কোথাও খানাখন্দে ভরা, আবার কোথাও সড়ক এতটাই সরু যে দুটি গাড়ি মুখোমুখি পার হতে পারে না। এসব সড়কে বিদ্যমান সেতু বা কালভার্টগুলো বেশ পুরোনো।
সরাইল থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে সুলতানপুর মোড় পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার সড়কের বিভিন্ন স্থানে খানাখন্দ রয়েছে। সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এই রাস্তায় ভারী পণ্যবাহী ট্রাক, বাস চলাচলের প্রায় অনুপযোগী। এই সড়কের রামরাইল সেতুটি পরিত্যক্ত। সেতুর পাশে অস্থায়ী বেইলি সেতু করা হলেও তা দিয়ে ভারী যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বিকল্প একটি সড়ক তৈরি করা হলেও সেটিও এখন ঝুঁকিপূর্ণ।
তবে সুলতানপুর থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত রাস্তা চওড়া করার পাশাপাশি সংস্কারকাজ চলছে। এতে আগের চেয়ে অনেক সহজে পণ্যবাহী ট্রাক আসা-যাওয়া করতে পারছে।
অপর্যাপ্ত অবকাঠামো ও লোকবল: একজন ট্রাফিক পরিদর্শক ও তত্ত্বাবধায়ক দিয়েই চলে আখাউড়া স্থলবন্দরের কাজ। আর নিরাপত্তার জন্য রয়েছে আটজন কর্মী। এই লোকবল দিয়েই চলে স্থলবন্দরটি।
অথচ বন্দর কার্যক্রমের আওতায় প্রতিদিন (পিক মৌসুমে) ১০০ থেকে ১২০টি পণ্যবাহী ট্রাক আগরতলায় আসা-যাওয়া করে। বর্ষাকালে (অফ পিক মৌসুমে) প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০টি ট্রাক আসা-যাওয়া করে। এখন পর্যন্ত এটি মূলত রপ্তানিমুখী স্থলবন্দর।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বন্দরে যে খোলা জায়গা রয়েছে, তাতে শতাধিক ট্রাকের স্থানসংকুলান হয় না। প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০টি রপ্তানি পণ্যবাহী ট্রাক আসে। এ কারণে প্রতিদিন সরু রাস্তায় অনেক ট্রাককে অপেক্ষা করতে হয়।
পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাত্র অর্ধেক যন্ত্রাংশ আগরতলায় গেছে: পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আনা সব ভারী যন্ত্রাংশ আশুগঞ্জ নৌবন্দর ও আখাউড়া স্থলবন্দর হয়ে আগরতলায় নেওয়া সম্ভব হয়নি। আশুগঞ্জ নৌবন্দরে অপেক্ষারত জাহাজে ও কয়েকটি স্থানে এখনো ৪৩টি মডিউল (যন্ত্রাংশ বহনকারী বৃহৎ আকারের কনটেইনার) রয়েছে। ৪৭টি মডিউল ইতিমধ্যে আগরতলায় চলে গেছে।
এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রাংশ পরিবহনের বাংলাদেশি এজেন্ট হলো গালফ ওরিয়েন্ট সি ওয়েজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এর নির্বাহী কর্মকর্তা নুরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এখন প্রতি সপ্তাহে একটিমাত্র মডিউল নেওয়া সম্ভব হয়। প্রতিটি খুলে চার ভাগে বিভক্ত করে পরিবহন করা হচ্ছে। বাকিগুলো পরিবহন করতে আরও তিন-চার মাস লাগতে পারে।
No comments