সরকারি-বেসরকারি অফিসেও ঢুকে পড়ছে ইয়াবা by ওমর ফারুক

রাজধানীর পুরান ঢাকার বাসিন্দা ইমন ঢাকার বেসরকারি এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তিনি সিগারেট পর্যন্ত টানেন না। সেই ইমনের কিছুদিন আগে কী কারণে ইচ্ছা হয় ইয়াবা সেবনের। এরপর ইমন নামেন ইয়াবার সন্ধানে এবং শেষ পর্যন্ত পেয়েও যান। শখ করে ইয়াবা সেবন করতে গিয়ে একসময় ইমন পুরোপুরি মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। বিষয়টি ধরতে পেরে তাঁর পরিবারের লোকজন তাঁকে একটি মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন সেন্টারে নিয়ে যায়। সেখানেই এখন তাঁর চিকিৎসা চলছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ইমনের মতো অনেকেই এভাবে ইয়াবার অন্ধকার জগতে ঢুকে যাচ্ছে। ফলে আক্রান্ত হচ্ছে বিভিন্ন মনোদৈহিক ব্যাধিতে।


কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময়কেন্দ্রের প্রধান পরামর্শক (পরিচালক) ডা. মোহাম্মদ নাজমুল আহসান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বর্তমানে যেসব মাদকাসক্ত রোগী আসছে, এর মধ্যে বেশির ভাগই ইয়াবা-আসক্ত।'
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, ইয়াবা সেবনের অবস্থা এতটাই মারাত্মক যে শুধু ছাত্রছাত্রী নয়, চিকিৎসক, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও এ মাদকে আসক্ত হচ্ছেন। তিনি জানান, এমন কর্মকর্তার নামও পাওয়া যায় যে তাঁরা ইয়াবা সেবন করেন, তা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়।
গোয়েন্দা কর্মকর্তা আরো জানান, দেশে ইয়াবা-আসক্তি কী কারণে বাড়ছে, তা নিয়ে তাঁরা কাজ করছেন। তাঁরা জানতে পেরেছেন, ফেনসিডিলের বিকল্প হিসেবে ইয়াবা সেবন বেড়েছে। একটি ফেনসিডিলের বোতলের তুলনায় ইয়াবা সহজ বহনযোগ্য হওয়ায়, তা সেবনের দিকে ঝুঁকছে মাদকসেবীরা। তিনি জানান, সরকারি-বেসকারি প্রতিষ্ঠানের অনেক বড় কর্মকর্তাও ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়ছেন। নামিদামি কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরাও ইয়াবা বিক্রির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। ওই সব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ওপর নজরদারি চলছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
এ সমস্যার প্রতিকার কী জানতে চাওয়া হলে ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, দেশে ইয়াবা তৈরি হয় না। অন্য দেশের কোন কোন রুট দিয়ে এ ইয়াবা আসছে, তা সবারই জানা। ওই সব রুটে সংশ্লিষ্ট সংস্থা আরো বেশি জোরদার ভূমিকা পালন করলে ইয়াবার প্রবেশ রোধ করা সম্ভব। তিনি আরো বলেন, ইয়াবা বড়ি আকারে তৈরি হয়। একজন পকেটে করে ইয়াবা নিয়ে গেলেও বোঝার কোনো উপায় থাকে না। এ কারণে ইয়াবার প্রবেশ রোধ করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত জানুয়ারি থেকে গত শুক্রবার পর্যন্ত লক্ষাধিক ইয়াবা বড়িসহ আট শতাধিক ইয়াবা ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে পাঁচ শতাধিক ব্যবসায়ীকে। র‌্যাব গ্রেপ্তার করেছে ২৩৪ জনকে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে শতাধিক ব্যবসায়ীকে এবং কোস্টগার্ড সমুদ্র থেকে আটক করেছে ছয়জনকে। এর মধ্যে র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৭৮ হাজার ৭৪৫টি ইয়াবা বড়ি। অন্যদিকে মিয়ানমার থেকে জেলে সেজে সমুদ্রপথে ইয়াবা নিয়ে আসার সময় কোস্টগার্ডের হাতে আটক ছয় মাদক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ১৬ হাজার ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করা হয়েছে।
পুলিশের গোয়েন্দা শাখার উপকমিশনার মো. মনিরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, এ বছর ইয়াবাসহ গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে দুই শতাধিক ব্যবসায়ীর এরই মধ্যে সাজাও হয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে বিচার ও তদন্ত কার্যক্রম চলছে।
কোস্টগার্ডের লেফটেন্যান্ট কমান্ডার আহসান উদ্দিন কালের কণ্ঠকে জানান, সমুদ্রপথে যাতে ইয়াবা দেশে আসতে না পারে সে জন্য কোস্টগার্ড চেষ্টা করে যাচ্ছে। জেলে সেজে নৌকায় মাছের ভেতরে করে ইয়াবা নিয়ে যাওয়ার সময় কিছুদিন আগে ১০ হাজার ইয়াবা বড়িসহ ব্যবসায়ীদের আটক করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়েছে।
র‌্যাব জানায়, ইয়াবার প্রবেশরোধে প্রতিদিন পরিচালিত হচ্ছে অভিযান। রাজধানীর ঢাকায় মাদকের মূল চোরাচালানকারীদের গ্রেপ্তারের জন্য র‌্যাব-১ বিশেষ পরিকল্পনা অনুযায়ী কার্যকর অভিযান পরিচালনা করে আসছে। ইয়াবা মনিটরিং সেলের মাধ্যমে তারা বড় বড় ইয়াবা ব্যবসায়ীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে তাদের ইয়াবার চালানসহ গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হচ্ছে। গত ২৮ সেপ্টেম্বর ছয় হাজার ইয়াবা বড়িসহ ইয়াবা ডন জামালকে গ্রেপ্তারের পর র‌্যাব জানতে পারে আবদুর রাজ্জাক ওরফে সাগর টেকনাফ থেকে বড় মাপের ইয়াবার চালান ঢাকায় এনে অন্যান্য ব্যবসায়ীর চেয়ে স্বল্প মূল্যে বাজারে ছেড়ে খুব দ্রুত বড় ব্যবসায়ীতে পরিণত হয়েছে। এরপর র‌্যাব-১-এর মনিটরিং সেলের মাধ্যমে তার গতিবিধির ওপর নজরদারি শুরু করা হয়। ইয়াবা চোরাচালানের সঙ্গে তার সংশ্লি্লষ্টতা নিশ্চিত হওয়ার পর গত বৃহস্পতিবার ভোর ৫টার দিকে সূত্রাপুরের বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তার দেহ ও বাসা তল্লাশি করে ১০ হাজার ইয়াবা বড়ি এবং ইয়াবা বিক্রির তিন লাখ ১৫ হাজার ৩০০ টাকা জব্দ করা হয়। গ্রেপ্তারের পর সাগর জানায়, টেকনাফ থেকে জহুর নামের একজন ইয়াবা ডিলারের কাছ থেকে ইয়াবা কিনে টেকনাফ থেকে ঢাকাগামী বিভিন্ন পরিবহনের মাধ্যমে ঢাকায় নিয়ে আসে।
র‌্যাব আরো জানায়, গত কয়েক দিনে ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে বিভিন্ন স্থান থেকে আরো ৯ জনকে গ্রেপ্তার করেন র‌্যাব-১-এর সদস্যরা। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় সাড়ে ১১ হাজার ইয়াবা বড়ি। র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এ এইচ এম আনোয়ার পাশার নেতৃত্বাধীন মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে তাদের সবাইকে দুই বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, অধিদপ্তরের অভিযানে গত দুই বছরে (২০০৯ ও ২০১০) মোট ১৮ হাজার ৫০৯টি ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করা হয়েছে। চলতি বছরও রাজধানীতে অভিযান চালিয়ে কয়েক হাজার ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে শতাধিক ব্যবসায়ীকে। র‌্যাব সদর দপ্তর সূত্র জানায়, গত বছর সারা দেশ থেকে র‌্যাবের অভিযানে দুই লাখ ৯৯ হাজার ৯৮৮টি ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করা হয়েছিল।

No comments

Powered by Blogger.