উন্নয়ন অন্বেষণের গবেষণা পুষ্টিবিষয়ক এমডিজি অর্জনে বড় প্রতিবন্ধকতা উচ্চ মূল্যস্ফীতি

নারী ও শিশুদের পুষ্টিবিষয়ক সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনের ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং অসমতা। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য অনেক বেশি পরিমাণে বেড়ে যাওয়ায় প্রান্তিক জনগণ শুধু তাদের খাবারের পরিমাণই কমিয়ে দিচ্ছে না, সেই সঙ্গে খাবারের গুণগত মানও কমিয়ে দিচ্ছে। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতি মানুষের পুষ্টিহীনতাকে আরও ত্বরান্বিত করবে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন অন্বেষণের পুষ্টি বিষয়ক এমডিজি অর্জনের গতিপ্রকৃতি বিষয়ক এক গবেষণায় এসব বলা হয়েছে।


দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি পুষ্টির জন্য হুমকিস্বরূপ আখ্যা দিয়ে গবেষণায় বলা হয় যে, চাল এবং আটা মানুষের প্রধান খাদ্য হলেও ২০০৫ থেকে ২০১১ সালে চালের বাজার মূল্য শতকরা ১০০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সময় আটার মূল্য শতকরা ৬৭ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে মানুষ ভোগের পরিমাণ কমাতে বাধ্য হয়েছে। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, ২০০৫ সালে এই দুই খাদ্যপণ্যের প্রতিদিন মাথাপিছু ভোগ ছিল ৪৫১ দশমিক ৭২ গ্রাম। ২০১০ সালে মাথাপিছু ভোগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৫১ গ্রাম। অর্থাত্ মাথাপিছু ভোগ ২ দশমিক ১৩ শতাংশ কমে ৪৪২ দশমিক ২১ গ্রামে দাঁড়িয়েছে। যদি ভোগের পরিমাণ কমার এই ধারা অব্যাহত থাকে, তাহলে নারী ও শিশুদের পুষ্টি নিশ্চিত করা দুরূহ হয়ে পড়বে। সেই সঙ্গে এমডিজি অর্জন অসম্ভব হয়ে পড়বে বলে মন্তব্য করা হয়েছে উন্নয়ন অন্বেষণের এই গবেষণায়। গবেষণায় বলা হয়েছে, অপুষ্টির ব্যাপকতা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে অনেক বেশি। লাখ লাখ শিশু ও নারী বিভিন্ন রকম পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। এর মধ্যে রয়েছে জন্মের সময় কম ওজন, বয়সের তুলনায় কম উচ্চতা, উচ্চতা অনুযায়ী কম ওজন ইত্যাদি। বর্তমানে অপুষ্টি শুধু ব্যক্তিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে না, সেই সঙ্গে এর প্রভাব প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে স্থানান্তরিত হয়।
শিশু পুষ্টির সঙ্গে সম্পর্কিত এমডিজির একটি লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে, বয়সের তুলনায় কম উচ্চতার শিশুদের হার ২০১৫ সালের মধ্যে শতকরা ৩১ ভাগে কমিয়ে আনা। তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, ১৯৯৬-৯৭ থেকে ২০০৭ সালে কম উচ্চতার শিশুদের হার কমিয়ে আনা হয়েছিল ১ দশমিক ০৪ শতাংশ। হ্রাসের এ হার অব্যাহত থাকলে ২০১৫ সালে বয়সের তুলনায় কম উচ্চতার শিশুদের শতকরা হার ৩৫ ভাগে দাঁড়াতে পারে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪ শতাংশ বেশি। শহর এলাকা থেকে গ্রাম এলাকায় বয়সের তুলনায় কম উচ্চতার শিশুদের সংখ্যা বেশি হলেও গ্রাম এলাকায় এটি হ্রাসের হার শহর এলাকার চেয়ে বেশি। ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের ক্ষেত্রে এ হ্রাসের শতকরা হার বেশি হলেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে খুবই কম। শিক্ষিত মায়ের সন্তানের ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হলেও অশিক্ষিত মায়েদের ক্ষেত্রে তা অনেকটাই দুরূহ। ধনী পরিবারের শিশুদের ক্ষেত্রে এ হ্রাসের হার সন্তোষজনক হলেও গরিব বা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সন্তানদের ক্ষেত্রে তা যথেষ্ট নয়।
শিশু পুষ্টি সম্পর্কিত আরেকটি লক্ষ্যমাত্রা হলো উচ্চতা অনুযায়ী কম ওজনের শিশুর সংখ্যা ২০১৫ সালের মধ্যে শতকরা ৮ ভাগে নামিয়ে আনা। তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, দেশে উচ্চতা অনুযায়ী কম ওজনের শিশুদের সংখ্যা ১৯৯৬-৯৭ থেকে শূন্য দশমিক ১২ শতাংশ হারে কমে ২০০৭ সালে শতকরা ১৭ দশমিক ৪ ভাগে দাঁড়ায়। হ্রাসের এ হার অব্যাহত থাকলে এমডিজি অর্জন অনেকটাই অসম্ভব। একই সময়ে শহর এলাকায় হ্রাসের হার শূন্য দশমিক ১৫ শতাংশ, যা গ্রাম এলাকার তুলনায় শূন্য দশমিক ১২ শতাংশ বেশি। ২০১৫ সালে চট্টগ্রাম বিভাগ লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি থাকলেও অন্যান্য বিভাগ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি দূরে অবস্থান করার কথা। ছেলে এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে উচ্চতা অনুযায়ী কম ওজনের শিশুদের হ্রাসের হার অনেক ধীরগতির। ধনী পরিবার এবং যাদের মা শিক্ষিত এ রকম শিশুদের মধ্যে এ ধরনের পুষ্টিহীনতা গরিব বা মধ্যবিত্ত এবং যাদের মা অশিক্ষিত তাদের তুলনায় কম হলেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অনেকটাই অসম্ভব।

শিশু পুষ্টি সম্পর্কিত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অন্যতম হচ্ছে বয়সের তুলনায় কম ওজনের শিশুর সংখ্যা ২০১৫ সালের মধ্যে শতকরা ৩৩ ভাগে নামিয়ে আনা। গবেষণায় দেখা যায় যে, ১৯৯৬-৯৭ সাল থেকে ২০০৭-এ যে হারে বয়সের তুলনায় কম ওজনের শিশুর সংখ্যা কমছে তাতে নির্দিষ্ট সময়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের কিছুটা সম্ভাবনা রয়েছে। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে শহর এবং গ্রাম এলাকা উভয়ই ভালো অবস্থানে আছে। ছেলেরা মেয়েদের তুলনায় নির্দিষ্ট সময়ের আগেই লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে পারে। শিক্ষিত মায়েদের সন্তানের ক্ষেত্রে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হলেও অশিক্ষিত মায়েদের ক্ষেত্রে সম্ভব নাও হতে পারে।
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় অপুষ্টিতে ভোগা নারীদের সংখ্যা ২০১৫ সালের মধ্যে শতকরা ২০ ভাগের নিচে নামিয়ে আনার কথা। তথ্য-বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, ১৯৯৬-৯৭ থেকে ২০০৭ সালে অপুষ্টিতে ভোগা নারীদের সংখ্যা ২ দশমিক ০৩ শতাংশ হারে হ্রাস পেয়েছে। এতে বোঝা যায়, লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হতে পারে। এক্ষেত্রে গ্রাম ও শহর এলাকার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ভালো অবস্থানে আছে। বিভিন্ন বিভাগের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, বরিশাল এবং সিলেট বিভাগ ছাড়া অন্য বিভাগগুলো লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সঠিক পথে আছে। শিক্ষিত নারীদের চেয়ে উচ্চতা অনুযায়ী কম ওজনের নারীরা অপুষ্টিতে বেশি ভোগে এবং সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন শিক্ষিত নারীদের ক্ষেত্রে সম্ভব হলেও অশিক্ষিত নারীরা এক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে থাকবে। ধনী পরিবারের নারীরা এরই মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করলেও ম্যধবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত নারীদের ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যাবে না বলেই মনে হচ্ছে।
উন্নয়ন অন্বেষণের গবেষণায় বলা হয়েছে, পুষ্টি সম্পর্কিত সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কিছুটা অগ্রগতি হলেও কয়েকটি কারণে তা সন্তোষজনক নয়। কারণগুলো হলো মূল্যস্ফীতি, সামাজিক কাঠামো, কম বাজেট বরাদ্দ, শরীরচর্চার অভাব এবং পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাব। নারীরা জন্মলগ্ন থেকেই বিভিন্ন বৈষম্যের শিকার। তারা খাদ্যদ্রব্য গ্রহণের ক্ষেত্রেও পুরুষের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। সে কারণে অপুষ্টিতে ভোগা নারীর সংখ্যা পুরুষের তুলনায় বেশি। একজন অপুষ্টিতে ভোগা নারীর সন্তান পুষ্টি সমস্যায় পড়বে এটাই স্বাভাবিক। বর্তমান অর্থবছরে (২০১১-১২) স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দের পরিমাণ মাত্র ৮ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ। ১৪২ দশমিক ৩ মিলিয়ন মানুষের জন্য এ বরাদ্দ খুব কম। অর্থাত্ বাজেটে এ পরিমাণ বরাদ্দ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অপ্রতুল। উচ্চ বাজারমূল্যের জন্য প্রান্তিক মানুষ তাদের পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা করতে পারছে না। বরং তাদের খাদ্য তালিকা থেকে অনেক খাবার কমিয়েছে, যা অপুষ্টিকে ত্বরান্বিত করছে।

No comments

Powered by Blogger.