ভিন্ন চোখে রবীন্দ্রনাথ by সোহরাব হাসান

বীন্দ্রনাথ চিরায়ত। তাঁর গল্প, কবিতা, গান বাঙালি পাঠক-শ্রোতার কাছে কখনো পুরোনো হয় না। চির নতুন হিসেবে ধরা দেয়। তাঁর অমর সাহিত্যকীর্তি সময়ের ব্যবধানে হারিয়ে যায়নি; বরং যুগে যুগে গবেষকেরা পুনর্বিবেচনা ও পুনরাবিষ্কারে সচেষ্ট রয়েছেন। দেড় শ বছর পরও তিনি কতটা বাঙালি মনকে আচ্ছন্ন করে আছেন, তারই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পাই নবীন ও প্রবীণ গবেষকদের লেখায়।

রুশিদান ইসলাম রহমান। প্রথাগত রবীন্দ্র-গবেষক নন। তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র অর্থনীতি। কাজ করেন বাংলাদেশের উন্নয়নের গতিপ্রকৃতি নিয়ে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁকে কীভাবে আচ্ছন্ন করে আছে, তারই প্রতিফলন দেখি তাঁর দেড়শত বর্ষ পরে রবীন্দ্র ভুবনে বইয়ে। নিবন্ধগুলো আগেই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
রুশিদান বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘মহান কাব্যকীর্তি ও সাহিত্যের সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা করতে না পারলেও প্রত্যেক পাঠকই তাঁর স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে সেটা গ্রহণ করতে পারেন এবং অর্থানুসন্ধান করতে পারেন। এই লেখাগুলো অর্থানুসন্ধানের ফসল।’ এ বইটি মূলত সেই পাঠকের মূল্যায়ন প্রয়াস।
রুশিদান এ বইয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গান, গল্প ও উপন্যাস নিয়ে বিক্ষিপ্ত আলোচনা করেছেন। তিনি বেছে নিয়েছেন সেসব ছোটগল্প ও উপন্যাস, যেখানে তাঁর প্রার্থিত চরিত্র ও ‘উন্নয়নদর্শন’ খুঁজে পেয়েছেন। গান প্রসঙ্গে লেখক লিখেছেন, ‘খুব সহজ কথার মধ্য দিয়ে মনে পৌঁছে যায় বলেই রবীন্দ্রসংগীতের একটি প্রবল আকর্ষণ আছে।’ তবে তিনি গানের ভেতরে কতটা যেতে পেরেছেন, সে ব্যাপারে সংশয় আছে। লেখক বিশ্লেষণ করেছেন মূলত গানের বিন্যাস ও বিষয় নিয়ে। অনেকটা পাঠ্যবইয়ের শিক্ষার্থীদের অনুশীলনের মতো। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান তো কথা ও সুরকে ছাড়িয়ে শ্রোতাদের অন্য এক ভাবালোকে নিয়ে যায়।
বইয়ের আকর্ষণীয় দিক হলো রবীন্দ্রনাথের গল্প ও কবিতা নিয়ে ভিন্ন মাত্রা ও দৃষ্টিতে আলোচনার। যেসব গল্পের চরিত্রের পেশা ও আবাসস্থল গ্রাম কিংবা শহর, সেগুলোর মধ্য দিয়ে লেখক সামাজিক বিবর্তন তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়েছেন। এর মধ্যে আছে ‘দেনা-পাওনা’, ‘পোস্টমাস্টার’, ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’, ‘কংকাল’, ‘মুক্তির উপায়’, ‘সমস্যা পূরণ’, ‘মধ্যবর্তী’, ‘শাণিত শুভ দৃষ্টি’, ‘দুর্বাদ্ধ’, ‘যজ্ঞেশ্বরের যজ্ঞ’, ‘নষ্টনীড়’, ‘মাস্টার মশায়’ ইত্যাদি।
লেখকের বিশ্লেষণ হচ্ছে, ‘পেশার বৈশিষ্ট্য এবং পেশার বন্ধনে পরিচিতি ঘটেছে সময়ের সঙ্গে। সময়ের সঙ্গে কর্মস্থলেরও বিবর্তন ঘটেছে। প্রথম পর্বের গল্পগুলোর পটভূমি গ্রাম, দ্বিতীয় পর্বের গ্রাম থেকে শহর এবং শেষ পর্বের গল্পগুলোর পটভূমি শহর।’
এই স্থান বদলে চরিত্রগুলো কতটা বদলে গেছে, সেটাই দেখিয়েছেন লেখক।
বইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ সম্ভবত রবীন্দ্র সাহিত্য ও বহির্জগতে নারীর পদক্ষেপ। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের দুর্বলতার কথাও রুশিদান উল্লেখ করেছেন। তাঁর গল্প, উপন্যাসের নায়িকারা সর্বক্ষেত্রে সেই সীমানা ভাঙতে পারেনি। বহির্জগতে প্রতারিত ও বঞ্চিত নারী শেষ পর্যন্ত ঘরেই আশ্রয় খোঁজে। কিন্তু ‘ঘরে বাইরে’র অনেক পরে লেখা ‘নারী’ প্রবন্ধে কবির উপলব্ধি হচ্ছে ‘সকল দেশেই মেয়েরা আপন ব্যক্তিগত সংসারের গণ্ডি পেরিয়ে আসছে। আধুনিক এশিয়াতেও তার লক্ষণ দেখতে পাই। তার প্রধান কারণ, সর্বত্রই সীমানা ভাঙার যুগ এসে পড়েছে; কিন্তু নারী যখন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে, সমাজ নিয়ন্ত্রণে অবদান রাখবেন, বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করবেন, তার মধ্যে এমন দিকনির্দেশনা থাকতে হবে, যা পুরুষশাসিত সমাজ থেকে আসছে না।’ পুরুষশাসিত সমাজের উন্নয়নও পুরুষের উন্নয়ন, সমাজের অপরাংশ সেখানে বঞ্চিতই থাকে।
রুশিদান ইসলাম রহমান রবীন্দ্রনাথের গল্প ও উপন্যাসে নারীর মুক্তির আকাঙ্ক্ষারই সন্ধান করেছেন। সাধারণ পাঠকের কাতারে থেকেও কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, যা ভবিষ্যতের রবীন্দ্র-গবেষকদের ভাবতে সাহায্য করবে।

No comments

Powered by Blogger.