‘বাঙাল’ রবীন্দ্রনাথ by তৈমুর রেজা

রামায়ণ কাব্যে আছে: রামের আদেশবলে সীতা বনবাসী হয়েছেন। ওঁর সঙ্গে দুই পুত্র—লব আর কুশ। লব-কুশ মায়ের সঙ্গে থাকে বাল্মীকির আশ্রমে, আর বনে বনে রামের ভজন গেয়ে বেড়ায়। পূর্ববঙ্গের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক বুঝতে এটা বোধ করি উপমা হিসেবে খাটে। একনিষ্ঠ দীনতার সঙ্গে বহুকাল পূর্ববঙ্গের বাঙালরা রবীন্দ্রনাথের দহলিজে ধরনা দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ যে রামের মতো গোমড়া মুখে বসে ছিলেন, তেমন নয়। তাঁর যৌবনের প্রায় পুরোটাই তো কেটেছে পূর্ববঙ্গে। তবু তাঁর লেখা পত্র থেকে টের হয়—পূর্ববঙ্গকে তিনি যতটা নিসর্গ হিসেবে নিয়েছেন, ‘আইডিয়া’ হিসেবে ততটা নেননি।

কিন্তু ‘বিজাতীয় পায়জামা’ পরা বাঙালের দল প্রায় সাধকের ধ্যানে কবিতে আত্মীকৃত করে নিল। এভাবে কবির দখল নেওয়ার ফলে কী ঘটল, সেটা সহজ ভাষায় বলে দিচ্ছেন আনিসুজ্জামান: ‘আমাদের রুচি তিনিই [রবীন্দ্রনাথ] গঠন করে দিয়ে গেলেন’। কবির পুঁজি-পাট্টা থেকেই রুচির জোগান হলো, কিন্তু সেখানে ঘটকালি করলেন কতক বাঙালি মুসলমান। এঁরাই বহুকাল ধরে বার্নিশ করে করে কবিকে আমাদের সঙ্গে প্রায় একাকার করে এনেছেন।
যাঁদের স্মরণে রেখে এই কথাগুলো বলছি, আনিসুজ্জামান তাঁদের অন্যতম। ষাটের দশকে তিনি রবীন্দ্রনাথ (১৯৬৮) নাম দিয়ে একটি সংকলন করেছিলেন। সে সময়ের যেসব চিহ্ন আজও মুছে যায়নি, তার একটি এই সংকলন। যৌবন থেকে অদ্যাবধি আনিসুজ্জামান রবীন্দ্র-চেতনার সোনার কাঠি হয়েই আছেন, রবীন্দ্রনাথ: একালের চোখে বইটি তার সাবুদ। এই বইয়ের কলজের মধ্যেও সেই পুরাতনী বার্তা খোদিত: রবীন্দ্রনাথ আমাদেরই লোক। বইয়ের দ্বিতীয় বার্তা হলো: রবীন্দ্রনাথ সেকেলে নন, সমকালীন। এই ‘কলের যুগে’ রবীন্দ্রনাথ কেমন করে ঠাঁই পাচ্ছেন, সেটা বোঝাতে তাঁর ‘স্বদেশ-শিক্ষা-সমাজের বিবিধ’ ভাবনার ‘সমকালীন দৃষ্টিভঙ্গি’তে বিশ্লেষণ করছেন আনিসুজ্জামান। কবি যে আমাদেরই লোক, এই বার্তা রটেছে পুরো বইতেই। সমকালীনতার দাবিটি আসছে আরেকটু নির্দিষ্ট আকারে; ‘শুধু গীতাঞ্জলি নয়’, ‘রবীন্দ্রনাথ ও বাংলাদেশ’, ‘গণতান্ত্রিক চেতনা ও রবীন্দ্রনাথ’—এ রকম কয়েকটি প্রবন্ধে।
লেখক গোড়াতেই মেনে নিচ্ছেন—রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে হবে তাঁর অসংগতি দিয়েই; কারণ তাঁর চিন্তার ধাত হলো: ‘বেশ কিছুকালের জন্যে একটা বিশেষ ভাবনা যখন তাঁকে আশ্রয় করে, তারপরই তিনি সেই ভাবনার কিছু ত্রুটি আবিষ্কার করেন, ব্যগ্র হয়ে পড়েন সেই পরিমণ্ডল থেকে বের হয়ে আসতে।’ ফলে রবীন্দ্রনাথের জবান দু-রকম হলেও তিনি বিগড়ে যাননি, বা একটাকে আড়াল করে অন্যটাতে ফুঁ করেননি—দুটোই শরমিন্দার ধার না ধেরে অবলীলায় বলে গেছেন। দুই বাংলাজুড়ে রবীন্দ্রচর্চায় এই কাণ্ডজ্ঞানের প্রতিফলন অতি সামান্য; চৌদ্দআনা লেখাতেই কবিকে লুকিয়ে-ছাপিয়ে দেখানো হয়েছে। ফলে আনিসুজ্জামানের এই নৈষ্ঠিক পাঠে রবীন্দ্রনাথকে আরেকটু অখণ্ডভাবে টের হচ্ছে। খণ্ডিত পাঠের অন্তত একটি বিপদ লেখক বেশ যত্ন করে দেখাচ্ছেন। পাশ্চাত্যে গীতাঞ্জলির ঘাড়ে সওয়ার হয়ে রবীন্দ্রনাথের একটি ঋষি ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে। এই কোণঠাসা পাঠের দোষেই পশ্চিমে কবির কদর বেশি দিন টেকেনি।
লেখক বইয়ের মুখবন্ধে বলে দিচ্ছেন, ‘সংকলিত প্রবন্ধগুলো ৪৪ বছরের পরিসরে লেখা’। এর ‘কিছু গভীর স্বভাবের, কিছু হালকা চালের’। দোষের মধ্যে আছে ‘নানা রচনার মধ্যে কিছু পুনরাবৃত্তি’। এই দোষটা বড্ড চোখে লাগে, কতক জায়গায় একই উদ্ধৃতি তিন জায়গায় খাটানো হয়েছে। কয়েকটি প্রবন্ধ বাদ দিলে বেশির ভাগই অগোছালো, আচম্বিতে প্রসঙ্গ পাল্টে যাওয়ার দরুন খেই পাওয়া মুশকিল। খেটেখুটে তৈরি করা প্রবন্ধগুলোর পাশে ঢেঁকি-গেলা ফরমাশি লেখাগুলো বিসদৃশ ঠেকেছে।
তাঁর প্রবন্ধগুলো কেমন? ‘রবীন্দ্রনাথের কবিতা, দ্বিজেন্দ্রলালের সমালোচনা’ প্রবন্ধটি সংহত, নতুন; মেজাজটাও ভারি রসিক। রবিবাবুর সঙ্গে দ্বিজু রায়ের এই ঝগড়া বাংলা সাহিত্যে প্রায় কিংবদন্তি। দ্বিজেন্দ্রলাল ‘সোনার তরী’ কবিতার নিন্দা করতে গিয়ে লিখছেন, ‘...কবিতাটির গদ্যার্থ যা দাঁড়ায় তাহা নিতান্ত অস্বাভাবিক। কোন কৃষক রাশি রাশি ধান কাটিয়া, কি করিবে ভাবিয়া না পাইয়া, কূলে নির্ভরসা হইয়া বসিয়া থাকে না; সে ধান সে বাড়ি লইয়া যায়’। রবীন্দ্রনাথ নরম ভাষায় এর ‘ইঙ্গিতময় প্রত্যুত্তর’ দিলেন। কিন্তু দ্বিজু রায় তাতে নিরস্ত নন, ফিরে চিত্রাঙ্গদার খুব একচোট নিন্দা করলেন। এই কোঁদলের যে ইতিহাস লেখক তুলে ধরছেন, তাতে ফুর্তি তো আছেই, কিন্তু শিরদাঁড়াটা খুঁজতে হবে আরও নিচে, যেখানে লেখক এই দুজনের মতান্তরের মধ্যে ‘বাংলা সাহিত্যের একটা বিশেষ যুগের মনোবৃত্তি ও রুচিবোধের’ ইতিহাস তুলে ধরছেন।
আনিসুজ্জামানের লেখালেখির ধাতটাই এমন; নিস্তরঙ্গ, হিল্লোল তুলে দেওয়ার মতো হুড়োহুড়ি নেই, কিন্তু সন্তর্পণে মধু জমে, নির্জল করে ভাবলে তলানির ক্ষারটা পাওয়া যায়। একটি প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনের ধ্রুবতারা’ গানটির ইতিহাস জানাচ্ছেন লেখক, যে-গান কবি নিবেদন করেছিলেন এক মানবীকে: ‘চার মাসের মধ্যেই, একটু বদল করে তা-ই দেয়া হলো ব্রহ্মকে’। আনিসুজ্জামান অসীমের স্পন্দ বইয়ের ওপর করা তাঁর আলোচনার সঙ্গে বইটির লেখক আনিসুর রহমানের জবাব জুড়ে দিয়েছেন। প্রাজ্ঞ-তর্কের একটি নজির হিসেবেও এটা পাঠ করা চলে।
একটা দ্বিধার কথা জানানো দরকার। রবীন্দ্রনাথের সূত্রে লেখক এক জায়গায় বলছেন, ‘জাতিগত স্বধর্ম পালন করতে গিয়ে নিম্ন-বর্ণের মানুষের মন মরে গেছে। সে যন্ত্র হয়ে একই কাজের পুনরাবৃত্তি করে চলেছে।’ কিংবা গান্ধী প্রসঙ্গে লেখক জানাচ্ছেন: ‘রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের যোগ ঘটানোই যে গান্ধী-রাজনীতির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা, সে-কথা রবীন্দ্রনাথের মতো আর কেউ তখন উপলব্ধি করেননি।’ নিম্নবর্গকে নিষ্ক্রিয় শ্রেণী হিসেবে ভাবা, বা তার ধর্মবোধকে হীনজ্ঞান করার জন্য রবীন্দ্রনাথ এখনকার পণ্ডিতদের কাছে খুব বকাঝকা খাচ্ছেন; বিশেষত, সাবলটার্ন ধারার তাত্ত্বিকেরা এখানে স্পষ্ট করেই রবীন্দ্রনাথকে ভুল ভাবছেন। কিন্তু এই ঝকমারি বিতর্কের আঁচ আনিসুজ্জামানের বইতে কোথাও লাগেনি।
কিছু প্রবন্ধ আছে দীর্ঘ, কিন্তু সেখানে চলতি কথাই বেশি।

No comments

Powered by Blogger.