অভিজ্ঞতায় আস্থা নাকি তারুণ্যে বিনিয়োগ by নোমান মোহাম্মদ

বাংলাদেশের নির্বাচকদের কি তাহলে ভুল কারণে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়?প্রশ্নটি উঠছে। প্রবলভাবেই উঠছে। আর সেটি তুলে দিচ্ছেন স্বয়ং ক্রিকেটাররা। অভিজ্ঞ ও তরুণদের বিপরীতমুখী পারফরম্যান্সে যে নির্বাচকদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার যথেষ্ট উপাদান বিদ্যমান।এমনিতে নির্বাচকদের কাজটি পুরোপুরি 'থ্যাঙ্কলেস জব'। ফুটবলের রেফারি বা ক্রিকেটের আম্পায়ারের মতো। ভালো করলে মনে হবে, এ আর এমন কী, এমনটাই তো করার কথা! অথচ একটু উল্টোপাল্টা হলেই সর্বনাশ। সমালোচনায় ক্ষতবিক্ষত হন তাঁরা। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের নির্বাচকদের জন্য আগে এই কাজটি ছিল আরো বেদনাদায়ক।


প্রায় ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো বিনা পারিশ্রমিকে তা করে দিতেন তাঁরা। ফারুক আহমেদের সময় থেকে নির্বাচকদের আনা হয় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের বেতনের আওতায়। এরপর রফিকুল আলম হয়ে বর্তমানে আকরাম খানের নেতৃত্বাধীন কমিটিও ভোগ করছে সেই সুবিধা। সঙ্গে 'ফাও' হিসেবে ওই সমালোচনার ঝড়।
এই সমালোচনার অন্যতম কারণ বাংলাদেশ জাতীয় দলকে বরাবরই কচি-কাঁচার আসর বানিয়ে রাখা। কেউ অভিজ্ঞ হলো তো ব্যস, ছেঁটে ফেলা হয় তাঁকে। অনেকটা চা গাছের মতো। এই করে করে ১৯৯৯ সালে বিশ্বকাপে অভিষেকের পরের তিনটি আসরে বাংলাদেশ জাতীয় দলের গড় বয়স কেবল কমেছেই। এখনো প্রতিনিয়ত কমছে। প্রায় অনূর্ধ্ব-২২ দলে এসে ঠেকেছে তা। এ জন্য সমালোচনার বর্শায় প্রায়ই ফালি ফালি হতে হয় নির্বাচকদের। অভিজ্ঞদের 'বুড়ো' অপবাদে ছেঁটে ফেলে তাঁরাই তো বাংলাদেশকে দল হিসেবে পরিণত হতে দিচ্ছেন না!
ঠিক। আবার ঠিকও না। অভিজ্ঞরা যদি পারফরম করতে না পারেন, তাহলে বোঝা তাঁদের বয়ে বেড়াবে কেন? তার চেয়ে তারুণ্যের ঝলকে কি উপকৃত হয় না বাংলাদেশ? সেই তারুণ্যে বিনিয়োগ করলে ভবিষ্যতে আরো ভালো কিছুর সম্ভাবনা তৈরি হয় না? কাল মোহাম্মদ আশরাফুল ও নাসির হোসেনের বিপরীতমুখী দুটি ইনিংসে এই প্রশ্নটি আবার সামনে চলে এসেছে জোরেশোরে।
আশরাফুল। হায় আশরাফুল! বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক অনন্ত আক্ষেপের নাম। বাংলাদেশ ক্রিকেটে তাঁর মতো প্রতিভা নিয়ে আর কারো আবির্ভাব হয়নি। তাঁর মতো আশার ফানুস ওড়ানো হয়নি আর কাউকে নিয়ে। আবার এই আশরাফুলের মতো আশাভঙ্গের বেদনায়ও সমর্থকদের পোড়াননি কেউ। আগের কোচ জেমি সিডন্সের শ্যেনদৃষ্টি ছিল তাঁর ওপর। কিন্তু নতুন কোচ স্টুয়ার্ট ল'র গুড বুকে আছেন তিনি। আগের অধিনায়কের সঙ্গে তাঁর দূরত্বের কথা সর্বজনবিদিত। মুশফিকুর রহিমের সঙ্গে সম্পর্ক ঘিরে তেমন কিছু শোনা যায়নি। আগের নির্বাচক কমিটি সব সময় আশরাফুলকে ছায়া দিতে পারেননি। আকরাম খান, মিনহাজুল আবেদীন, হাবিবুল বাশাররা তো মহীরুহের ছায়া দিয়ে আগলে রেখেছেন তাঁকে। তাতেও বা লাভ কী! ম্যাচের পর ম্যাচ তো সেই একই নাটকের পুনর্মঞ্চায়ন! একই রকমভাবে সবাইকে ডুবিয়ে নিজেও চোরাবালির অতলে ডুবে যাচ্ছেন আশরাফুল। ১৭১ ওয়ানডে ম্যাচ খেলার পরও যদি এমন অবস্থা হয়, তাহলে কি সেটি অভিজ্ঞতায় ভরসা রাখার তত্ত্বকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে না?
কাল তিনি ক্রিজে গিয়েছিলেন ইনিংসের পঞ্চম বলেই। মুখোমুখি হওয়া প্রথম ৪ বলে রান করতে পারেননি। এর মধ্যে চতুর্থ বলটি যেমন সুন্দরভাবে ছাড়লেন, তাতে বড় কিছুর প্রতিশ্রুতিই ছিল। কিন্তু তিনি যে আশরাফুল! পঞ্চম বলেই তাই দিয়ে দিলেন আত্মাহুতি। কেমার রোচের করা গড়পড়তা এক বলে খোঁচা মেরে দ্বিতীয় স্লিপে ক্যাচ প্র্যাকটিস করালেন তিনি। স্কোরারকে ঝামেলায় না ফেলে রানের খাতা খোলার আগেই প্যাভিলিয়নমুখী আশরাফুল। বলাই বাহুল্য, দর্শকদের গালিগালাজ-বৃষ্টির ভেতর দিয়ে।
এই দর্শকরা একেবারে তিতিবিরক্ত আশরাফুলের ওপর। হবে না কেন? বারংবারের এই হতাশা কাঁহাতক আর সহ্য হয়? এমন তো নয় যে আশরাফুলের কালকের আউটটি ব্যতিক্রম। এটি আসলে এখন নিয়মে পরিণত। বিশেষত ওয়ানডে ক্রিকেটে আশরাফুলের ব্যাট হাসতে যেন ভুলে গেছে। গত বছরের ৪ জানুয়ারি শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ত্রিদেশীয় ওয়ানডেতে সর্বশেষ ফিফটির দেখা পেয়েছিলেন তিনি। এরপর মহাকালের গর্ভে হারিয়ে গেছে ৬৪৯ দিন। খেলে ফেলেছেন ১৮টি ওয়ানডে। কিন্তু ফিফটির দেখা আর মেলেনি। এ সময়ে খেলা আশরাফুলের ইনিংসগুলোতে একবার চোখ বোলান_২৯, ১৩, ৪, ৫, ১, ৩১, ২০, ৯, ১৪, ১৩, ৬, ১, ১১, ২, ৬, ১৫, ২ ও ০। ১৮ ইনিংসে সাকুল্যে ১৮২ রান করেছেন ১০.১১ গড়ে! সর্বোচ্চ ৩১, স্ট্রাইক রেট ৪৮.২৭। শুধু শুধুই তো আর সিডন্স আশরাফুলের পরিসংখ্যান মনে করিয়ে 'তোমাদের সেরা ব্যাটসম্যান' বলে ব্যঙ্গ করতেন না!
তো এমন একজন ব্যাটসম্যান আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এক দশকের অভিজ্ঞ হলেই বা কী! ১৭১ ম্যাচ ওয়ানডে খেলে ফেলারই বা মূল্য কোথায়! নির্বাচকরা এমন অভিজ্ঞকে বাদ দিয়ে যদি তরুণ কারো ওপরে বিনিয়োগ করেন, তাঁদের দোষ দেওয়ার উপায় কী! বিশেষত অতীত যখন বলে, বাংলাদেশের তরুণরা বেশির ভাগ সময়ই প্রতিভার ঝিলিকে শুরুটা করেন দারুণ। আর বর্তমান তো সেটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে নাসির হোসেনের সাফল্যে।
রংপুরের এই তরুণের বয়স এখনো ২০ পেরোয়নি। মাস দুয়েক আগে অভিষেকের পর ক্রিজে গিয়েছেন মোটে পাঁচবার। তাতেই কী দারুণ প্রতিশ্রুতি! অভিষেক ম্যাচে আট নম্বরে নেমে ৯২ বলে ৬৩ রানের পরিণত এক ইনিংস খেলেছিলেন নাসির। ৫৮ রানে ৬ উইকেট পড়ার পর উইকেটে গিয়েছিলেন, এরপর তাঁর হাফ সেঞ্চুরিতেই ১৮৮ পর্যন্ত যেতে পারে দল। কালকের ইনিংসটিও প্রায় অভিন্ন। সেই ৮ নম্বরেই নেমেছিলেন, ৬ উইকেটে ১১৫ হয়ে যাওয়ার পর। এরপর খেললেন ৫৪ বলে ৫০ রানের সাহসী-সুন্দর এক ইনিংস। যা সাজানো তিনটি বাউন্ডারির সঙ্গে আন্দ্রে রাসেলকে মিড উইকেটের ওপর দিয়ে মারা এক ছক্কায়। মুশফিকের হাফ সেঞ্চুরির সমান্তরালে নাসিরের এই অনবদ্য ইনিংসেই তো তিন অঙ্কের আগে গুটিয়ে যাওয়ার শঙ্কা ঝেড়ে ২২০ পর্যন্ত যেতে পারে বাংলাদেশ।
আকরাম খানদের ওপর এখন তাই ক্রমে বড় হচ্ছে প্রশ্নটি। অভিজ্ঞতায় আরো আস্থা রাখবেন তাঁরা, নাকি বিনিয়োগ করবেন তারুণ্যে?

No comments

Powered by Blogger.