বস্তিতে ধুঁকছেন পোশাক শ্রমিকরা by আবুল কাশেম

রাজধানীর সদাব্যস্ত এলাকাগুলোর অন্যতম একটি রামপুরা। এখানকার ব্যস্ততার অন্যতম কারণ তৈরি পোশাক কারখানার আধিক্য। পাশেই হাজীপাড়ার একটি পোশাক কারখানা 'এমএ ফ্যাশন'। এখানে হেলপার পদে চাকরি করেন নারগিস। ছুটিছাটার বালাই নেই। প্রতিদিন সকাল ৮টার মধ্যে কারখানার গেট দিয়ে ভেতরে ঢোকেন। বাধ্যতামূলক ওভারটাইম করে প্রায় প্রতিদিন তিনি কারখানা থেকে বের হন রাত ১০টায়। মাসে ৩০ দিন গড়ে ১৪ ঘণ্টা ডিউটি করে মাস শেষে তিনি পান তিন হাজার ৭০০ টাকা। নারগিসের ভাষায়, 'ঢাহা শহরে ওই ট্যাহায় কী অয়? দিনরাত খাইট্যাও ভালো-মন্দ খাইতে পারি না।


গেরামে ট্যাহা দিতে পারি না। সারা দিন কাপড় সিলাই, নিজে ভালো কাপড় কিন্না পরতে পারি না। খাইয়া না খাইয়া কোনোমতে জীবনডারে বাঁচাইয়া রাখছি।'
রামপুরার কেএস গার্মেন্টের হেলপার সুমীর অবস্থাও এর ব্যতিক্রম নয়। তিনি বলেন, দিনরাত 'গাধার খাটনি' খাটিয়ে মালিক যে টাকা দেন, আসলেই তা দিয়ে জীবন বাঁচানো দায়। তাঁর হিসাবে, মাস শেষে তিন হাজার ৩০০ টাকা মজুরি পান। থাকেন হাজীপাড়ার স্যাঁতসেঁতে নোংরা পরিবেশের এক বস্তিতে। এক হাজার ২০০ টাকা ভাড়া দিয়ে মেস করে থাকেন অন্য নারী শ্রমিকদের সঙ্গে। সকালের নাস্তায় ১০০ গ্রাম চালের ভাত, সঙ্গে যেকোনো একটা সবজি খেতেই খরচ হয় ১২-১৩ টাকা। দুপুরে সবজি, ডাল আর ভাত খেতেই খরচ পড়ে ২৫ টাকা। রাতের খাবারেও কমবেশি একই খরচ। এই হিসাবে কোনো দিন মাছ-মাংস না খেলেও মাসে শুধু খাবারের পেছনেই খরচ হয় ১৯২০ টাকা। বাসাভাড়া আর খাওয়ার খরচ বাদ দিলে সুমীর কাছে থাকে মাত্র ২৮০ টাকা। ওই টাকায় তাঁর সারা মাসে একটি গায়ে মাখার সাবান, দুটি কাপড় কাচার সাবান, শ্যাম্পু, মাথায় দেওয়ার সামান্য পরিমাণ তেল কেনার খরচও মেটে না।
মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার অ্যাসেনশিয়াল নামের পোশাক কারখানায় অপারেটর পদে চাকরি করেন রানু বেগম। তিনি বলেন, শ্রমিকদের পরিশ্রমের টাকায় মালিকরা দামি গাড়ি হাঁকান। অর্থের পাহাড় গড়েন। কিন্তু শ্রমিকরা কিভাবে বাঁচবে তা নিয়ে চিন্তা করার ফুরসৎ তাঁদের নেই। তাঁর প্রশ্ন, 'গত বছর যখন সরকার মজুরি বাড়াইল, এরপর জিনিসপত্রের দাম অনেক বাড়ছে। শুনছি, বিদেশে কাপড়ের দামও বাড়ছে। তাহলে আমাদের বেতন বাড়বে না কেন?'
এই জীবনযাত্রার চিত্র কেবল উলি্লখিত তিন নারী শ্রমিকের নয়; ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের জীবনযাত্রারই প্রতিচিত্র। সামান্য কমবেশি বিবেচনায় না নিলে সবারই এমন কষ্টের জীবন। দিনমান হাড়ভাঙা খাটুনির পরও দুই বেলা দুই মুঠো ভাতের সংস্থান করতেই জেরবার অবস্থা। স্বজন-পোষ্যদের জন্য কিছু করতে পারা তো দূরের কথা, নিজের জীবনটা টেনে নিতেই প্রাণ ওষ্ঠাগত।
তৈরি পোশাক কারখানার মালিকরা রয়েছেন পুরো বিপরীত অবস্থানে। সরকারকে অনেকটা জিম্মি করে একের পর এক ছাড়ের সুবিধা তাঁরা আদায় করে নিচ্ছেন। অথচ শ্রমিকের দিকে তাকানোর ফুরসৎ তাঁদের নেই। শ্রমিকের হাহাকারকে সাক্ষী করে তাঁদের বিত্ত-বৈভবের বিশালতা দিনকে দিন বিশালতর হচ্ছে।
শ্রম মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে বলেন, নিগৃহীত এই শ্রমিকদের ঘামেই পোশাক শিল্প মালিকরা দেশের শীর্ষ ধনিক শ্রেণীর কাতারে শামিল হচ্ছেন। দামি গাড়ি-বাড়ি, বিলাসী জীবন আর স্ফীত ব্যাংক ব্যালেন্স তাঁদের। বিশাল এই খাত থেকে সরকার উল্লেখযোগ্য রাজস্বও পাচ্ছে না। সরকারের নগদ সহায়তা, ব্যাক টু ব্যাক পদ্ধতিতে শুল্কমুক্ত আমদানি সুবিধা, করমুক্ত রপ্তানি আয়, স্বল্প সুদের ব্যাংক ঋণ আর সস্তা জ্বালানি সুবিধা, মাত্র ১ শতাংশ সুদে শ্রমিকদের জন্য আবাসন নির্মাণের নামে ঋণ সুবিধা পাচ্ছেন তৈরি পোশাক মালিকরা। অন্যান্য খাতে যেখানে ১৭ থেকে ১৮ শতাংশ সুদে ঋণ নিতে হয়, সেখানে রপ্তানি খাত হিসেবে মাত্র ৭ শতাংশ সুদে ব্যাংক ঋণ, আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে বীমার প্রিমিয়ামেও ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় সুবিধাসহ নানা সুবিধাই ভোগ করছেন তাঁরা। এমনকি তাঁরা নিজেদের কারখানার জন্য দক্ষ শ্রমিক তৈরির জন্য সরকারের অবকাঠামো ব্যবহারের পাশাপাশি নগদ অর্থ সুবিধাও নিচ্ছেন। সরকার এত কিছু করছে কেবল ৩০ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থানের বিষয়টি বিবেচনা করে।
গত বছর নূ্যনতম মজুরি কাঠামো ঘোষণার আগে পোশাক মালিকদের ডেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চেষ্টা করেছিলেন শ্রমিকদের নূ্যনতম মজুরি যতটা বাড়ানো যায়। কিন্তু মালিকরা তখন ২৫০০-২৮০০০এর ওপরে কোনমতেই উঠতে রাজি হচ্ছিলেন না। তখন প্রধানমন্ত্রী তাঁদের অনুরোধ করে বলেছিলেন, 'আপনারা নিজের সংসারের জন্য এক দিন বাজারে গিয়ে যে টাকা খরচ করেন, একজন শ্রমিকের সারা মাসের মজুরি হিসেবে অন্তত সেই টাকাটা দিন।' প্রধানমন্ত্রীর ওই অনুরোধ মেনে তাঁরা শেষ পর্যন্ত ৩ হাজার টাকা নূ্যনতম মজুরি নির্ধারণে রাজি হন। অবশ্য এর বিপরীতে ওই সময়ই তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে অঙ্গীকার আদায় করে নেন, তাঁদের বাংলাদেশ ব্যাংকের গৃহনির্মাণ তহবিল থেকে ১ শতাংশ সুদে ঋণ দিতে হবে। শ্রমিকদের জন্য আবাসন নির্মাণের কথা বলে ওই সুবিধা আদায় করে নিলেও কোনো কারখানা মালিকই আবাসনের ব্যবস্থা করেননি। নিম্ন আয়ের ৩০-৪০ লাখ শ্রমিকের বেশির ভাগই ঢাকার বিভিন্ন বস্তিতে মানবেতন জীবন যাপন করছেন। ক্ষুদ্র ওই আবাস থেকে দিনে কমপক্ষে দুই বার তাঁদের কারখানায় হেঁটে যাতায়াত করতে হয় অনেকটা মিছিল করে।
বিজিএমইএর সদস্য ও রপ্তানিকারক এবং ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) সভাপতি আসিফ ইব্রাহীম গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে এক অনুষ্ঠানে এক কেস স্টাডিতে দেখিয়েছেন, ২০০ সেলাই মেশিনের একটি শার্ট তৈরির কারখানায় ৫০০ শ্রমিক এক বছরে মোট তিন লাখ ১০ হাজার ডলার মজুরি পান। ওই কারখানার মালিক বছর শেষে মুনাফা করেন এক লাখ ৫৪ হাজার ডলার। অর্থাৎ ২৫০ জন শ্রমিকের এক বছরের মজুরির সমান একজন মালিকের মুনাফা। এর পরও শ্রমিকদের স্বার্থের বিষয়টি আলোচনায় এলেই কথায় কথায় 'কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে' বলে হাহাকার শুরু করে দেন কারখানার মালিকরা।
নূ্যনতম মজুরি কাঠামো ঘোষণার আগে বিজিএমইএর তৎকালীন সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী প্রায়ই বলতেন, নূ্যনতম তিন হাজার টাকা মজুরি নির্ধারণ করা হলে কমপক্ষে ৭০ ভাগ কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু ওই কাঠামো ঘোষণার পর কোনো কারখানা বন্ধ হওয়ার খবর আজও মেলেনি।
রিকশাওয়ালা, রাস্তার বাদাম-চা বিক্রেতাও শতভাগ রপ্তানিমুখী গার্মেন্ট শ্রমিকদের তুলনায় বেশি আয় করছেন। আর সে কারণেই বেকারে ভরা বাংলাদেশে শ্রমিক সংকটে ভুগতে হচ্ছে গার্মেন্ট শিল্পকে। দেশের যুবসমাজ যেখানে হন্যে হয়ে কাজের সন্ধান করছে, সেখানে পোশাক শিল্প ভুগছে ১০ লাখ শ্রমিক সংকটে। এ থেকেই স্পষ্ট, পোশাক কারখানায় পরিশ্রমের তুলনায় মজুরির পরিমাণ কতটা কম।
অবশ্য শ্রমিকরা যে ভালো নেই সে কথা মুখে স্বীকার করেন পোশাক শিল্প মালিকরা। বিজিএমইএ সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন এ প্রসঙ্গে বলেন, গত বছর শ্রমিকদের মজুরি 'অনেক বেশি' বাড়ার পরও মূল্যস্ফীতির কারণে তাঁরা কষ্টে আছেন। শ্রমিকরা যাতে স্বাভাবিকভাবে চলতে পারেন সে জন্য রেশনিং, স্বাস্থ্যসেবাসহ তাঁদের আবাসনের ব্যবস্থা করা জরুরি হয়ে পড়ছে। কিন্তু পোশাক শিল্পের অবস্থাও খারাপের দিকে যাচ্ছে। ফলে এই খাতে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। অনেক মালিকই শ্রমিকদের বেতন দিতে পারছেন না। আন্তর্জাতিক বাজারে পোশাকের চাহিদা দিন দিন কমছে। লোডশেডিং বেড়ে গেছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছে। ফলে উৎপাদন খরচও বাড়ছে। সরকার বস্ত্র খাতের জন্য সম্প্রতি প্রণোদনার হার ৫ শতাংশ বাড়িয়েছে সময়ের দাবি মেটাতেই। এ অবস্থায় চট্টগ্রামে তিন হাজার শ্রমিকের জন্য ভবন নির্মাণ করা হবে। আশুলিয়ায়ও শ্রমিকদের জন্য আবাসিক ভবন হবে। এগুলো যত বেশি করা হবে শ্রমিকরা তত ভালো থাকবেন।

No comments

Powered by Blogger.