খাদ্য কেনার ক্ষমতা বেড়েছে কৃষি শ্রমিকের by আবুল কাশেম

চালের দামের তুলনায় মজুরি বেশি বাড়ায় আগের চেয়ে বেশি পরিমাণ খাদ্য কিনতে পারছেন কৃষি শ্রমিকরা। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও)-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দৈনিক মজুরির টাকায় ২০০৮ সালের তুলনায় এখন প্রায় দ্বিগুণ চাল কিনতে পারছেন তাঁরা।সংস্থাটির 'বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ বুলেটিন ২০১১'-এ বলা হয়েছে, ২০০৮ সালের তুলনায় ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে কৃষি শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে ৭৯ শতাংশ। তবে একই সময়ে চালের দামও বেড়েছে ৩ শতাংশ। ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে ধান কাটার সময় কৃষি শ্রমিকদের চাল কেনার ক্ষমতা ২০১০ সালের তুলনায় ৮ শতাংশ বেশি ছিল।


তবে কৃষি খাতে যখন কাজ থাকে না, তখন তাঁদের উপার্জনের সুযোগও অনেক কমে যায়। ফলে তখন প্রয়োজনীয় পরিমাণ খাবার কেনা তাঁদের জন্য কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়।
এফএওর হিসাবে, গত জানুয়ারিতে বোরো আবাদের সময় কৃষি শ্রমিকদের গড়ে দৈনিক মজুরি ছিল ২৩৩ টাকা। তখন দেশজুড়ে মোটা চালের কেজি ছিল গড়ে ৩৫ টাকা। একজন শ্রমিক তাঁর এক দিনের মজুরি দিয়ে দৈনিক ছয়-সাত কেজি চাল কিনতে পারতেন। তবে ২০০৮ সালে এক দিনের মজুরি দিয়ে চার-পাঁচ কেজিরও কম চাল পেতেন তাঁরা। কৃষি শ্রমিকের মজুরি সময়ে সময়ে বাড়ে ও কমে। শ্রমিকের মজুরি বাড়ে ধানের চারা লাগানো ও কাটার সময়_এপ্রিল-মে, আগস্ট ও নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে। আবার সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ও মার্চ-এপ্রিল সময়ে কৃষি খাতে কাজ না থাকায় মজুরি কমে যায়।
জাতিসংঘের সংস্থাটির মতে, কৃষিশ্রমিকদের ক্রয়ক্ষমতাও নির্ভর করে চাল, আটা, পাম তেল ও ডালের দামের ওপর। গত জানুয়ারি মাসে এসব পণ্যের প্রতি কেজিতে গড়ে খরচ হয়েছে ৬৪ টাকা। বর্তমানে একজন কৃষি শ্রমিকের বাণিজ্য সুবিধা (টার্মস অব ট্রেড) দৈনিক চার কেজি, যা গত বছরের চেয়ে ২৬ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ, গতবারের তুলনায় একজন দিনমজুরের ক্রয়ক্ষমতা ২৬ শতাংশ বেড়েছে। আর ২০০৮ সালের তুলনায় এই ক্রয়ক্ষমতা ৮০ শতাংশ বেশি। তবে কৃষি খাতে যখন কাজ থাকে না, তখন এই উচ্চমূল্যে খাদ্যগ্রহণ করা কৃষি শ্রমিকের পক্ষে খুবই দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়। তা ছাড়া নিম্ন বেতনভুক্ত নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ চালসহ খাদ্যপণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে কষ্টে দিনাদিপাত করছেন বলেও মনে করছে সংস্থাটি। এফএওর মতে, খাদ্যপণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে ২০০৮ সালের তুলনায় আরো বেশি পরিমাণ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, অপুষ্টি ও প্রয়োজনীয় ক্যালোরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এফএওর 'বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ বুলেটিন ২০১১'-এ বলা হয়েছে, ২০০৮ সালে বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতির সময়ের তুলনায়ও এখন পণ্যের মূল্য বেশি। ২০০৮ সালের জুলাই মাসের পর গত জানুয়ারিতে এফএও সিরিয়াল প্রাইস ইনডেঙ্ গড়ে ২৪৫ পয়েন্ট বেড়েছে। মূলত আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি ও সরবরাহ সংকটের কারণেই এমনটি হয়েছে। এফএওর মতে, ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশে খাদ্যমূল্য রেকর্ড পর্যায়ে পেঁৗছেছে। অন্যান্য নিত্যপণ্যের সঙ্গে চালের দামও বাড়ছে। ২০০৮ সালে দেশে যখন খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছিল, এখন ঢাকার বাজারে চালের দাম ওই সময়ের তুলনায়ও বেশি। আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্য সরবরাহ সংকট ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আরো ছয় মাস দেশের প্রধান খাদ্য চালের মূল্য এমন উচ্চই থাকবে বলে আশঙ্কা করেছে সংস্থাটি। ২০০৮ সালের তুলনায় ঢাকার খুচরা বাজারে চালের দাম এ বছর ৩ শতাংশ বেশি উল্লেখ করে সংস্থাটি বলছে, অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যও ২০০৮ সালের মূল্যের পর্যায়ে পেঁৗছেছে। প্রধান খাদ্যপণ্যগুলোর দাম ২০০৮ সালের সর্বোচ্চ দামের পর্যায়ে পেঁৗছাচ্ছে। এসব পণ্যের বর্তমান মূল্য ২০১০ সালের তুলনায়ও বেশি।
বাংলাদেশের খাদ্যমূল্য পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এফএও বলছে, ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিশেষ করে চালের খুচরা মূল্য বাড়ছে। বোরো ও আমন মৌসুমে ধানের ভালো ফলন হওয়া সত্ত্বেও ২০১০ সালের জুন মাস থেকে দাম উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকায় মোটা চালের দাম ছিল ৩৫ টাকা কেজি। মোটা চালের এই দাম ২০০৮ সালে চালের উচ্চমূল্যের সময়ের তুলনায়ও ১ শতাংশ বেশি। তা ছাড়া অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিশেষ করে ভোজ্য তেল ও ডালের দাম ২০০৮ সালের উচ্চমূল্য ছুঁয়েছে। এমনকি আটার দামও দিন দিন বাড়ছে। ২০০৮ সালে আটার যে দাম ছিল, পরে বাড়তে বাড়তে এখন তা থেকে ২০ শতাংশ দূরে আছে। বাংলাদেশে সাধারণত চাল, আটা, ভোজ্য তেল ও ডালের মূল্য ধরেই একটি পরিবারের খাদ্যমূল্য হিসাব করা হয়। এসব পণ্যের মূল্য পরিস্থিতি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ঢাকা শহরে এই খরচ ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসের তুলনায় ২০১১ সালের জানুয়ারিতে ৯ শতাংশ বেড়েছে। আর ২০১০ সালের জানুয়ারির তুলনায় ২০১১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বেড়েছে ৩৬ শতাংশ। ২০১১ সালের অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যমূল্য বাবদ খরচ (কস্ট অব বেসিক ফুড বাস্কেট) ২০০৮ সালে খাদ্য সংকটের সময়কার সমানে পেঁৗছেছে। এফএওর বিশ্ব ক্ষুধা রিপোর্ট ২০১১-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, খাদ্য ও অর্থ সংকটে ছোট ও আমদানিকারক দেশগুলো, বিশেষ করে আফ্রিকার দেশগুলো গভীর সংকটে আবদ্ধ হতে পারে। কিছু বড় দেশ রপ্তানির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে নিজেদের বাজার স্থিতিশীল রাখতে পারলেও এ ধরনের নিয়ন্ত্রণ দাম বাড়িয়ে আন্তর্জাতিক বাজারকে ঘোলাটে করে তুলবে। এর ফলে ছোট কৃষক ও দরিদ্র ভোক্তারা আরো নাজুক অবস্থায় পড়বেন। কারণ, খাদ্যই কৃষকের উপার্জনের বড় অংশ ও খাদ্যমূল্য মেটানোই দরিদ্র মানুষের বাজেট।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাদ্যমূল্যের চলমান ঊর্ধ্বমুখিতার কারণে নিম্ন আয়ের চাকরিজীবীদের কষ্টে দিনাতিপাত হচ্ছে। ভবিষ্যতে দ্রব্যমূল্য আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে অনেক দেশের কৃষক গরিব হতে পারেন, অনেক ক্রেতা দরিদ্র হতে পারেন। অনেক দেশ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় পড়বে। এ অবস্থায় ছোট ও আমদানিনির্ভর দেশগুলো বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। গত ২০০৬-০৮ সালের মতো অনেক দেশ খাদ্য ও অর্থনীতি সংকটের মতো সমস্যার মুখোমুখি হবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেন, খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। আর কেবল উৎপাদন বাড়লেই খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। এ জন্য সাধারণ মানুষের আয় বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। একই সঙ্গে নিরাপদ স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ খাদ্যও নিশ্চিত করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.