জাহাজভাঙা শিল্পে বছরে হাজার কোটি টাকা রাজস্ব সম্ভব by নিখিল ভদ্র

জাহাজভাঙা শিল্পকে অপার সম্ভাবনাময় খাত আখ্যা দিয়ে এই শিল্পে শ্রমবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে ১১ দফা সুপারিশ চূড়ান্ত করেছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। সুপারিশ কার্যকর হলে এই খাতে লক্ষাধিক শ্রমিকের কর্মসংস্থান হবে। একই সঙ্গে এই খাত থেকে সরকার হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব পাবে বলে কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এই খাত নিয়ে বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠনের অভিযোগ অমূলক বলেও দাবি করেছে সংসদীয় কমিটি।সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদনে অন্যতম বৃহৎ এই শিল্পে শ্রমবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে তুলে ধরা সুপারিশে বলা হয়েছে, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়া কোনো জাহাজ ডক-ইয়ার্ডে আনা যাবে না।


আদালতের আদেশ ও নির্দেশনা এই শিল্প মালিকদের মেনে চলতে হবে। আরো বলা হয়েছে, এই শিল্পের শ্রমিকদের জন্য বৈষম্যহীন বেতন কাঠামো তৈরি করতে হবে। সব কারখানায় চাকরি স্থায়ীকরণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। সব শিল্পে অগি্ননির্বাপক সরঞ্জামাদি প্রস্তুত রাখতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য সার্বক্ষণিক চিকিৎসক নিয়োগ করতে হবে। দ্রুত সেবা নিশ্চিত করার জন্য পর্যাপ্ত অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা রাখতে হবে। শ্রমিকদের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা রাখতে হবে। আরো বলা হয়েছে, এই শিল্পের বর্জ্য পরিকল্পিতভাবে সংগ্রহ ও পরিবেশসম্মতভাবে অপসারণ করতে হবে। এই শিল্পের ওপর সরকারের তদারকি বাড়াতে হবে। সবশেষে এই শিল্পের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা ও প্রকাশনা মোকাবিলায় ইতিবাচক প্রচারণা চালানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে সংসদীয় কমিটির সভাপতি মো. ইসরাফিল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে সীতাকুণ্ড সবচেয়ে সম্ভাবনাময় জাহাজভাঙা শিল্পাঞ্চল। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারলে এই শিল্পাঞ্চল দেশের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় তৈরি করা সংসদীয় কমিটির এই সুপারিশ ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে তিনি দাবি করেন।
কমিটি অনুমোদিত চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটি স্বার্থান্বেষী মহল অপপ্রচার চালিয়ে জাহাজভাঙা শিল্পকে ধ্বংসের অপচেষ্টা করছে, যে কারণে বাংলাদেশে জাহাজভাঙা শিল্প পিছিয়ে পড়ছে। আর ভারত, চীন ও পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্র এগিয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড শিল্প এলাকা সরেজমিন পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলা হয়েছে, কিছু পরিবেশবাদী সংগঠন জাহাজভাঙা শিল্প পরিবেশ দূষণ করছে বলে অভিযোগ করলেও বাস্তবে এর কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। ওই সব কারখানার পাশে সবজির বাগান ও যথেষ্ট গাছগাছালি রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
দ্রুত পরিকল্পিত ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ না করলে বিভিন্ন মহলের অপতৎপরতার কারণে জাহাজভাঙা শিল্প হুমকির মুখে পড়বে বলে প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ২০০৫ সালে ৫৯ শতাংশ জাহাজ ভেঙে এই শিল্পে এগিয়ে থাকলেও ২০০৯ সালে ৩৮ শতাংশ কাজ করে ভারত সে স্থান দখল করে নিয়েছে। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ ২৩ শতাংশ জাহাজ ভেঙেছে। আর ২০০৫ সালে চীন ৬ শতাংশ জাহাজ ভাঙলেও ২০০৯ সালে ২৭ শতাংশ জাহাজ ভেঙেছে। এভাবেই ভারত ও চীন এগিয়ে যাচ্ছে। এই শিল্প পিছিয়ে পড়ার কারণে আবাসন শিল্পের পাশাপাশি দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে বলে দাবি করা হয়েছে।
সংসদীয় কমিটির সভাপতি বলেন, এই শিল্পে এখন ৫০ হাজার শ্রমিক কর্মরত রয়েছে। সংসদীয় কমিটির সুপারিশ কার্যকর হলে এই শিল্পের আরো প্রসার ঘটবে। আর শ্রমিকের সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে যাবে। তিনি বলেন, বর্তমানে এই শিল্পে তিন লাখের বেশি লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। আর এই শিল্পের ওপর নির্ভর করে আবাসন খাত, যোগাযোগ অবকাঠামো খাতসহ অনেক খাতই চলছে। ফলে সম্ভাবনাময় এই খাতটি টিকিয়ে রাখা জরুরি। তিনি এ বিষয়ে দ্রুত পরিকল্পিত ও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান।
উল্লেখ্য, জাহাজ ভাঙা শিল্পের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ নিয়ে ২০১০ সালের ৫ অক্টোবর সংসদীয় কমিটির বৈঠকে আলোচনা হয়। এরপর মন্ত্রণালয় ও সংসদীয় কমিটি যৌথভাবে শিল্প এলাকা পরিদর্শন করে সুপারিশ চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানসহ সংসদীয় কমিটির সদস্য ও মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা গত ২৪ এপ্রিল চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ১২টি জাহাজভাঙা শিল্প পরিদর্শন করেন। এরপর গত ১৮ আগস্ট খসড়া প্রতিবেদন সংসদীয় কমিটির বৈঠকে উত্থাপন করা হয়। কমিটির বৈঠকে আলোচনার পর গত ১২ অক্টোবর প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.