নতুন মানুষের আকাঙ্ক্ষায় লজিকবিদ্যা by মোহাম্মদ আজম
তিমির জন্য লেখা হয়েছে যে বই, তাতে কি আর সবাই দাঁত বসাতে পারবে? তিমি তো যে সে মেয়ে নয়—সাগর আর শঙ্খের সন্তান। খাসা মগজ। অফুরান আগ্রহ। দেদার খাটতে পারে। দিব্যি ছক কেটে এঁকে ফেলে লজিকের নতুন কারখানা। বিনা আয়াসেই উচ্চারণ করে দিব্যবাণী, যা তার ওস্তাদেরই মনের কথা। লেখক অবশ্য আমাদের অভয় জুগিয়ে যান—ঠারেঠুরে জানিয়ে দেন, সম্ভব। বোঝা তো সম্ভবই, আমল করাও এমন কিছু কঠিন নয়। কেবল ভিতরবাগে নজর দেওয়ার কৌতূহল চাই, চাই নিষ্ঠা আর শ্রম।
তাহলেই তিমির জন্য লেখা বইটি হয়ে উঠবে ‘তিমিদের’ জন্য। তিনি পথের কতক ইশারা বাতলানোর কাজ নিয়েছেন কেবল। সে পথ চিন্তার। জ্ঞান ও জ্ঞানতত্ত্বের। মানুষ হিসাবে নিজের সম্ভাবনায় ইমান রাখার। তিমির জন্য লজিকবিদ্যা বাংলাভাষীদের জন্য সেই নতুনলোকের বলিষ্ঠ আহ্বান। বইটির নামের মধ্যে ফাঁক বা ফাঁকি বিশেষ নেই। এটা লজিকেরই বই। কিন্তু যুক্তির শুকনা ছকে পাঠক যেন হাঁফিয়ে না ওঠে, তার জন্য যথেষ্ট কায়দা-কসরত করেছেন লেখক। কিংবা হয়তো তাঁকে বাড়তি কিছুই করতে হয়নি। যেহেতু আমাদের কোনো কোনো সময় কাটে ‘সজল নৈঃশব্দ্যের মধ্যে, লজিক এবং লজিকের অনুপস্থিতির মাঝখানে’, তাই কাব্যের জন্য, উপন্যাসের জন্য একটা পরিসর তৈরি হয়েই থাকে। এ বইয়ের উপন্যাস অংশ তাই লজিক-গণিত-বিজ্ঞান-দর্শনের নাছোড় হিসাব-নিকাশকে জড়িয়ে-পেঁচিয়ে নিয়ে ঠিকই আপন সুরতে রূপবান হয়ে ওঠে। আদিতে তিমিকে সাগর আর শঙ্খের পয়দা বলে চিনিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে কল্পনা আর বাস্তবের যে মিশেল তৈরি হয়, তাকে পর্যাপ্ত মূল্য দিয়ে তিমি বাস করতে থাকে ইট-কাঠ-পাথরের এই নগরে। দিব্যি জ্বরে ভোগে, আইসক্রিম খায়, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা-বেড়ানো চলতে থাকে। তার বন্দী খোঁপা কাঁধের ওপর মুক্তি পেলে স্পষ্ট শোনা যায় ‘শঙ্খের আওয়াজ’। আবার তার হাস্য-লাস্য-স্নিগ্ধতা-খুনসুটির মধ্যেই বুদ্ধির শান চাবুকের মতো বশীভূত করে তার ওস্তাদকেও—যিনি কবি, কিন্তু ‘কবি’ অভিধাটির চালু তাৎপর্যে স্পষ্টতই বিব্রত।
আমরা অবশ্য এসব নরম আরামের অবসর বইটিতে খুব বেশি পাই না। তিমি এখানে জ্বরে ভোগে বটে, কিন্তু সে জ্বরে ভাইরাসের চেয়ে ‘চিন্তাশীলতা’র ভূমিকাই প্রবল। বহুদিনের খরার পর বৃষ্টি নামলে ‘বাংলার বৃষ্টি’ ‘ইট, লোহা আর পাথর ভেঙে’ নিজের স্রোত তৈরি করে নেয়। তদুপরি, এখানকার সাগরের জল ‘জননীমূলক’। বলা যায়, উপন্যাসত্ব বা কবিত্বের লোভে না পড়ে লজিকবিদ্যার ভাষ্য তৈরির কাজেই বইটি নির্বিকার এগোতে থাকে।
সে ভাষ্যের প্রথম লক্ষ্য যুক্তিশাস্ত্রের গোড়ার কথাগুলো খোলাসা করে বলা। বলা হয়েছে সরল ভাষায়, সংক্ষেপে; কিন্তু জটিল এই বিষয়টির গভীরতা যেন ক্ষুণ্ন না হয়, সেদিকে পুরোমাত্রায় হুঁশিয়ার থেকে। ধাপে ধাপে, কখনো কথা চালাচালির মাধ্যমে, কখনো চিঠি লিখে, কখনো বা আস্ত প্রবন্ধের মতো নোটে চলেছে যুক্তিশাস্ত্র শেখার নানা পর্ব। এ শিক্ষার সবচেয়ে মূল্যবান দিক বোধ করি সৃজনশীলতা—পশ্চিমা শাস্ত্রটি তোতাপাখির মতো না শিখে কীভাবে নিজের জীবনে ও কাজে সৃষ্টিশীলভাবে খাটানো যায়, তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ফলে কথা উঠেছে পাঠ্যপুস্তকের হালচাল এবং শিক্ষার পদ্ধতিগত দিক নিয়ে। কথাগুলো নতুন নয়। কিন্তু বাস্তব নজির হিসেবে দুই ক্ষেত্রেই এই ছোট্ট বইটি আমাদের জন্য পথনির্দেশক হয়ে উঠতে পারে। বইটি জোর দিয়েছে নিজের ভাষায় যুক্তিশাস্ত্রের চর্চার ওপর। দৈনন্দিন জীবনযাপনের ভাষায়। স্বভাবতই পরিভাষার কথা এসেছে। কথাগুলো বাংলায় পরিভাষা প্রণয়নের ক্ষেত্রে মনে রাখলে আমরা উপকৃত হব।
এ বইয়ের বড় অংশজুড়ে আছে পশ্চিমা যুক্তিবিদ্যার ইতিবৃত্ত। তার কাজের ধরন, সংকটের জায়গা, প্রগতি ও সীমাবদ্ধতা। ধারাবাহিক খতিয়ান পেশ করে লেখক দেখিয়েছেন, পশ্চিম বুদ্ধি দিয়েই বুদ্ধির সীমাবদ্ধতা টের পেয়েছে, বুঝেছে প্রজ্ঞার মহিমা। ফলে বাংলার পুরোনো ভাবমণ্ডলকে নতুন দুনিয়ার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করে আবিষ্কার করার বিরাট সুযোগ এখন আমাদের সামনে। এটাই এ গ্রন্থের অন্তর্নিহিত আকাঙ্ক্ষা—যুক্তি-বুদ্ধির সর্দারি আর টেকনোলজির দৌরাত্ম্যে পীড়িত দুনিয়াকে মুক্ত করে নতুন মানুষ গড়ার অভিযানে বাংলার ভাবের কার্যকর অংশগ্রহণ। মজহারের কবিতা-গদ্যে এ কথা বহুবার শুনেছি আমরা। এ বইতে যুক্তিবিদ্যার শাস্ত্রীয় সিঁড়ির ছায়ায় ব্যাপারটা দেখিয়ে দেওয়া হলো।
বইটি সাজানো হয়েছে সংগীতের আদলে। পরিচ্ছেদের নাম দেওয়া হয়েছে সাংগীতিক পরিভাষা থেকে। সঙ্গে আছে সংশ্লিষ্ট পরিভাষার ছোট ছোট ভাষ্য। ভাষ্যগুলো বাংলায় সংগীতবিষয়ক লেখালেখির সাবালক দৃষ্টান্ত হিসেবে গণ্য হওয়ার যোগ্য। উপলব্ধির এক প্রজ্ঞাময় স্তরে যুক্তি-গণিত-বিজ্ঞান-দর্শন-সংগীত তো বটেই, এমনকি কাব্য আর ভাষার অন্য সব কারিগরিও একাকার হয়ে যায়। তিমির জন্য লজিকবিদ্যা সেই সামঞ্জস্যের উত্তম নজির।
আমরা অবশ্য এসব নরম আরামের অবসর বইটিতে খুব বেশি পাই না। তিমি এখানে জ্বরে ভোগে বটে, কিন্তু সে জ্বরে ভাইরাসের চেয়ে ‘চিন্তাশীলতা’র ভূমিকাই প্রবল। বহুদিনের খরার পর বৃষ্টি নামলে ‘বাংলার বৃষ্টি’ ‘ইট, লোহা আর পাথর ভেঙে’ নিজের স্রোত তৈরি করে নেয়। তদুপরি, এখানকার সাগরের জল ‘জননীমূলক’। বলা যায়, উপন্যাসত্ব বা কবিত্বের লোভে না পড়ে লজিকবিদ্যার ভাষ্য তৈরির কাজেই বইটি নির্বিকার এগোতে থাকে।
সে ভাষ্যের প্রথম লক্ষ্য যুক্তিশাস্ত্রের গোড়ার কথাগুলো খোলাসা করে বলা। বলা হয়েছে সরল ভাষায়, সংক্ষেপে; কিন্তু জটিল এই বিষয়টির গভীরতা যেন ক্ষুণ্ন না হয়, সেদিকে পুরোমাত্রায় হুঁশিয়ার থেকে। ধাপে ধাপে, কখনো কথা চালাচালির মাধ্যমে, কখনো চিঠি লিখে, কখনো বা আস্ত প্রবন্ধের মতো নোটে চলেছে যুক্তিশাস্ত্র শেখার নানা পর্ব। এ শিক্ষার সবচেয়ে মূল্যবান দিক বোধ করি সৃজনশীলতা—পশ্চিমা শাস্ত্রটি তোতাপাখির মতো না শিখে কীভাবে নিজের জীবনে ও কাজে সৃষ্টিশীলভাবে খাটানো যায়, তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ফলে কথা উঠেছে পাঠ্যপুস্তকের হালচাল এবং শিক্ষার পদ্ধতিগত দিক নিয়ে। কথাগুলো নতুন নয়। কিন্তু বাস্তব নজির হিসেবে দুই ক্ষেত্রেই এই ছোট্ট বইটি আমাদের জন্য পথনির্দেশক হয়ে উঠতে পারে। বইটি জোর দিয়েছে নিজের ভাষায় যুক্তিশাস্ত্রের চর্চার ওপর। দৈনন্দিন জীবনযাপনের ভাষায়। স্বভাবতই পরিভাষার কথা এসেছে। কথাগুলো বাংলায় পরিভাষা প্রণয়নের ক্ষেত্রে মনে রাখলে আমরা উপকৃত হব।
এ বইয়ের বড় অংশজুড়ে আছে পশ্চিমা যুক্তিবিদ্যার ইতিবৃত্ত। তার কাজের ধরন, সংকটের জায়গা, প্রগতি ও সীমাবদ্ধতা। ধারাবাহিক খতিয়ান পেশ করে লেখক দেখিয়েছেন, পশ্চিম বুদ্ধি দিয়েই বুদ্ধির সীমাবদ্ধতা টের পেয়েছে, বুঝেছে প্রজ্ঞার মহিমা। ফলে বাংলার পুরোনো ভাবমণ্ডলকে নতুন দুনিয়ার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করে আবিষ্কার করার বিরাট সুযোগ এখন আমাদের সামনে। এটাই এ গ্রন্থের অন্তর্নিহিত আকাঙ্ক্ষা—যুক্তি-বুদ্ধির সর্দারি আর টেকনোলজির দৌরাত্ম্যে পীড়িত দুনিয়াকে মুক্ত করে নতুন মানুষ গড়ার অভিযানে বাংলার ভাবের কার্যকর অংশগ্রহণ। মজহারের কবিতা-গদ্যে এ কথা বহুবার শুনেছি আমরা। এ বইতে যুক্তিবিদ্যার শাস্ত্রীয় সিঁড়ির ছায়ায় ব্যাপারটা দেখিয়ে দেওয়া হলো।
বইটি সাজানো হয়েছে সংগীতের আদলে। পরিচ্ছেদের নাম দেওয়া হয়েছে সাংগীতিক পরিভাষা থেকে। সঙ্গে আছে সংশ্লিষ্ট পরিভাষার ছোট ছোট ভাষ্য। ভাষ্যগুলো বাংলায় সংগীতবিষয়ক লেখালেখির সাবালক দৃষ্টান্ত হিসেবে গণ্য হওয়ার যোগ্য। উপলব্ধির এক প্রজ্ঞাময় স্তরে যুক্তি-গণিত-বিজ্ঞান-দর্শন-সংগীত তো বটেই, এমনকি কাব্য আর ভাষার অন্য সব কারিগরিও একাকার হয়ে যায়। তিমির জন্য লজিকবিদ্যা সেই সামঞ্জস্যের উত্তম নজির।
No comments