অনেক দূরের ঢাকা by জাহীদ রেজা নূর
ঢাকা শহরেই আমাদের বেড়ে ওঠা। সত্তরের শুরুতে নতুন ঢাকার রাস্তাগুলোই ছিল অপ্রশস্ত। ক’জন মানুষেরই বা গাড়ি ছিল তখন? যে জ্যাম আজ ঢাকা মহানগরীর ললাটলিখন, তার দেখা মিলত কেবল নবাবপুর-সদরঘাটের দিকে গেলে। তাও গাড়ি-বাসের নয়, রিকশার; মাঝে মাঝে অটোরিকশার। সেই ঢাকাই দু-তিন দশকের মধ্যে বেমালুম পাল্টে গেল। ভরাট হয়ে গেল জলাভূমি, মাঠগুলো আর থাকল না, বাইরে লনওয়ালা বাড়িগুলো হারিয়ে গিয়ে উঠল অ্যাপার্টমেন্টের পর অ্যাপার্টমেন্ট—এক চিলতে জায়গাও ছাড়া হলো না।
যে মোহাম্মদপুর বা মিরপুরের শরীরে মফস্বলের সুবাস পাওয়া যেত, তা-ও ছেয়ে গেল ইট-কাঠ-কংক্রিটে। ঢাকা শহর তার কেন্দ্রের চতুর্দিকে মেলে দিল ডানা। সে ডানা কেবলই প্রশস্ত হচ্ছে। যে কারণে নতুন প্রজন্ম যখন বেয়াড়া প্রশ্ন করে বসে তা যথেষ্ট বিব্রতকর: এক শায়েস্তা খাঁ’র আমলে টাকায় আট মন চাল পাওয়া যেত— এ কথা বলে ওদের কাছে আর নিস্তার নেই—হাতীর পুল নাম কেন হলো এই রাস্তার, এখানে কি হাতীর চলাচল ছিল? মালিবাগে কি মালীরা থাকত? এই জায়গাটার নাম লোহারপুল কেন? ধানমন্ডি নামের কারণ কী? তোমরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে রেসকোর্স বল কেন?—প্রশ্নের পর প্রশ্নে নাভিশ্বাস উঠে যাওয়ার উপক্রম।
মীজানুর রহমান আমাদের বাঁচিয়ে দিলেন। ঢাকা শহরের শিরা-উপশিরার সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দিলেন। এমন নয় যে ঢাকার ইতিহাস আগে কেউ লেখেননি, কিংবা মীজানের পর এ বিষয়ে লেখা থেমে থেকেছে। তারপরও বলা যায়, মীজানের ঢাকা পুরাণ বইটি মন কাড়ে আড্ডার ভাষা আর রসের ভিয়েন দিয়ে তথ্য পরিবেশনার অসাধারণ ঢংয়ের কারণে। এক একটি অধ্যায়ে প্রবেশ মানেই আজকের পুরনো ঢাকার এক একটি রহস্যের উন্মোচন। শুরুতে সত্তর দশকের ঢাকার কথা বলেছি। মীজানুর রহমান আমাদের নিয়ে যান তার চেয়েও অনেক দূরের এক ঢাকায়। সত্তরের দেখা ঢাকার কথা আমরা যখন বলি, তখন আমাদের সন্তানেরা যে অপার বিস্ময় নিয়ে তা শোনে, মীজানুরের কাছ থেকে তারও বহু আগের ঢাকার কথা শুনে আমাদের মধ্যে সে একই বিস্ময়ের জন্ম হয়। মীজানুর তাঁর দেখা এবং তাঁর গবেষণা দিয়ে অজানা ঢাকাকে খুলে দিলেন আমাদের সামনে।
মনোযোগী পাঠকের জন্য এ এক সোনার খনি। ঢাকার বিভিন্ন এলাকার নামকরণ, ঐহিত্যবাহী খাবার-দাবার, বাজার, সিনেমা হল, মসজিদ-মন্দির, বইয়ের দোকান, আহসান মঞ্জিলসহ পুরনো প্রাসাদ, পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা, ঘোড়দৌড়ের মাঠ, জিন্দাবাহার-সাঁচিবন্দরসহ এমন অনেক বিষয় উঠে এসেছে, যাকে নতুন করে চিনে নিতে হচ্ছে, যার অনেককিছুই আজকের ঢাকায় পাওয়া যাবে না। আলোর ঝলকানির মতোই মাঝে মাঝে কিছু নাম উঠে এসেছে। হাবিবুল্লাহ বাহার, বুদ্ধদেব বসু, জসীমউদদীন, প্রেমেন্দ্র মিত্র, ভানু বন্দোপাধ্যায়, শহীদ নিজামুদ্দীন আহমেদ, মাহমুদুল হক, কাইয়ুম চৌধুরী...এ রকম অনেক। সেগুলো তথ্য হিসেবে স্থির হয়ে থাকেনি, বরং ইতিহাসের গল্প হয়ে উঠেছে। তাই উল্টো করেই বলি, আমাদের চেনাজানা শহরটাকে এক বইয়ের আঘাতে অচেনা করে দিলেন মীজানুর রহমান। নতুন করে চিনতে হচ্ছে নিজেকে, নিজের শহরকে।
তাই বইটি শেষ করেও মাঝে মাঝে পাতা উল্টিয়ে বার বার পড়ার আনন্দেই বিভিন্ন অধ্যায়ে চোখ রাখতে হয়। দ্বিতীয়বার, তৃতীয়বার...বহুবার ভাষা ও বিষয়বস্তুর কারণে ফিরে যেতে হয় বইটির কাছে। এ বড় আনন্দ যে, বইটি স্রোতস্বীনী নদীর মতোই টেনে নিয়ে যেতে পারে পাঠককে, এককালের প্রমত্তা ধোলাই খালের প্রবাহকে যেমন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, সেভাবে বন্ধ হয় না বইটির সচলতা, বরং পুনর্বার পঠনে তা আরো বেগবান হয়ে ওঠে।
No comments