কবিতার বরপুত্র শামসুর রাহমানের আজ ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী

ছন্দময় ও শিল্পিত শব্দের প্রক্ষেপণে কবিতায় দেশ ও মানুষের কথা বলে গেছেন একইসঙ্গে বাঙালীর ও বাংলাভাষার কবি শামসুর রাহমান। সমকালীনতা ধারণকারী অনন্য প্রতিভায় উজ্জ্বল এই নাগরিক কবি ছিলেন বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। কাব্য রচনায় সৃষ্টি ও মননের দ্যুতিময় উপস্থাপনা তাঁকে দিয়েছে


কবিতার বরপুত্রের উপাধি। আজ শুক্রবার দেশ, মাটি ও মানুষের কথা বলা এ কবির ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট তিনি পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। কবির প্রয়াণ দিবসের আগের দিন বৃহস্পতিবার কথা হয় তাঁর স্নেহধন্য পুত্রবধূ টিয়া রহমানের সঙ্গে। বাকরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, সম্পর্কে শ্বশুর হলেও তিনি ছিলেন আমার বাবার মতো। আজও তাঁর ঘরের লিখতে বসার চেয়ার, টেবিলসহ সবকিছু একইরকম আছে। সবই আছে, শুধু মানুষটি নেই। জীবন থেকে হারিয়ে চলে গেলেন স্মৃতির পাতায়। ১৭ আগস্টের বিশেষ দিনটিতে পরিবারের সবাই নিমজ্জিত হয় তাঁকে হারানোর বেদনায়। এসব কথার পর শোকের বাতাবরণ থেকে বেরিয়ে টিয়া রহমান বললেন, শুক্রবার সকালে পরিবারের পক্ষ থেকে কবির বনানীর কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। এছাড়াও কবির স্মৃতি বিজড়িত শ্যামলীর বাসায় কোরান খতম ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।
এর বাইরে কবির মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা নিবেদন করবে জাতীয় কবিতা পরিষদ। পরিষদের সভাপতি কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী জানান, শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় সংগঠনের পক্ষ থেকে শামসুর রাহমানের কবরে ফুলেল শ্রদ্ধা জানানো হবে।
১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর তিলোত্তমা শহর ঢাকার মাহুতটুলিতে জন্মেছিলেন কবি শামসুর রাহমান। জন্ম ও মৃত্যুর মাঝের ৭৭ বছরের বর্ণময় জীবনের বড় অংশজুড়েই নিমগ্ন থেকেছেন কবিতা সৃজনের মোহ ও অনুরাগে। পুরনো ঢাকায় বেড়ে ওঠায় নগর জীবনের নানা অনুষঙ্গ ও প্রকরণ উদ্ভাসিত হয়েছে এ নাগরিক কবির কবিতায়। জীবনানন্দ পরবর্তী বাংলা কবিতাকে আধুনিকতার পথে ধাবিত করায় তাঁর ভূমিকা একেবারেই স্বতন্ত্র। বিশ শতকের তিরিশের দশকের পাঁচ মহান কবির পর তিনিই আধুনিক বাংলা কবিতার প্রধান পুরুষ হিসেবে প্রসিদ্ধ। ষাটের দশকে গোড়ার দিকেই কবি প্রতিভার বিচ্ছুরণে আলোকিত করেন সাহিত্যের ভুবন। সূচনাটা অস্তিত্ববাদী ইউরোপীয় আধুনিকতায় ধাবিত হলেও একটা সময়ে দেশজ সুর ও ঐতিহ্যকে কবিতায় ধারণ করেছেন নিবিড় মমতায়। সমকালীন ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে চিরকালীনতার অনুভূতির প্রকাশ ঘটিয়েছেন কবিতার বুননে। সাম্প্রদায়িকতা ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে যেমন কবিতার ভাষায় প্রতিবাদ করেছেন, তেমনি মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীনতার আকাক্সক্ষায় উজ্জীবিত মানুষকে প্রেরণা দিয়েছেন কবিতার সৃষ্টিশীলতায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ওপর লিখিত তাঁর দুটি কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি’ ও ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ একইসঙ্গে পাঠক ও বোদ্ধাদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় ও সমাদৃত।
১৯৪৯ সালে লেখেন প্রথম কবিতা ‘১৯৪৯’। প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকায়। আর এই শুরুটা ছিল শিল্পবোধসম্পন্ন সংবেদী পাঠকের জন্য লেখা কবিতার সৃষ্টিসম্ভার। পত্রপত্রিকায় লেখা তাঁর চিত্রকল্পময় কবিতার সূত্র ধরে প্রথম গ্রন্থ প্রকাশের আগেই এপার-বাংলার কবিতাপ্রেমীদের নজর কাড়েন শামসুর রাহমান। ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে।’ কবির নিমগ্ন অন্তর্গত বোধ ও ভাবনার জগতের অপূর্ব রূপায়ণ ছিল এই কাব্যগ্রন্থ। এছাড়াও ষাটের দশকে প্রকাশিত কবির উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো হলো ‘রৌদ্র করোটিতে’, ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’, ‘নিরালোকে দিব্যরথ’ ও ‘আমি অনাহারী।’
অন্তর্মুখী স্বভাবের হলেও রাজনীতির দহন থেকে গা বাঁচিয়ে চলেননি এই কবি। তৎকালীন পাকিস্তান আমলে আইয়ুববিরোধী গণঅভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব ও পরবর্তী বাস্তবতায় অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন কলমকে। রচনা করেছেন অজস্র অনবদ্য কবিতা। তাঁর রচিত ‘বন্দিশিবির থেকে’, ‘দুঃসময়ে মুখোমুখি’, ‘ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা’, ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’ কাব্যগ্রন্থগুলোয় তীক্ষè ও প্রবলভাবে বিম্বিত হয়েছে গণমানুষের কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি। স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে বিদ্রƒপ করে ১৯৫৮ সালে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকায় লেখেন ‘হাতির শুঁড’ নামক কবিতা। সত্তরের নবেম্বরের ভয়াল জলোচ্ছ্বাসের পর মওলানা ভাসানীর পল্টনের ঐতিহাসিক জনসভার পটভূমিতে রচিত ‘সফেদ পাঞ্জাবি’ অথবা তারও আগে ‘বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, একাত্তরের পটভূমিতে ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’, ‘স্বাধীনতা তুমি’, ‘গেরিলা’, ‘কাঁক’ ইত্যাদি কবিতাগুলোয় উচ্চারিত হয়েছে এ দেশের কোটি মানুষের কণ্ঠধ্বনি। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে জীবন বিসর্জন দেয়া আসাদকে নিয়ে লিখেছেন ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটি। বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান যখন কারাগারে তখন তাঁকে উদ্দেশ করে লেখেন অসাধারণ কবিতা ‘টেলেমেকাস।’ সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লিখেছেন ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলছে স্বদেশ’ ও ‘ইকারুসের আকাশ।’ যুদ্ধাপরাধীদের উত্থানে ক্ষোভের প্রকাশ ঘটিয়ে লিখেছেন ‘একটি মোনাজাতের খসড়া’, ‘ফুঁসে ওঠা ফতোয়া’র মতো আলোড়ন সৃষ্টিকারী কবিতা। গণতন্ত্রের জন্য লড়াকু সৈনিক শহীদ নূর হোসেনকে উৎসর্গ করে রচনা করেছেন ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়।’ এভাবেই নিভৃতচারী ও রোমান্টিক কবি শামসুর রাহমান হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের সমকালের সকল গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কাব্যভাষ্যকার। একইসঙ্গে কবিতার জমিনে তিনি পরিস্ফুটিত করেছেন চিরকালীন বেদনা, প্রেম, মৃত্যু, ভালবাসাসহ নানা বিষয়ের শৈল্পিক ব্যঞ্জনা। নগর জীবনের প্রতি ভালবাসায় মুগ্ধ হয়ে তাঁর কলম থেকে বেরিয়ে এসেছে গদ্যগ্রন্থ ‘স্মৃতির শহর।’
কবিতা ছাড়াও উপন্যাস, ছড়া, প্রবন্ধ লেখার পাশাপাশি অনুবাদেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন শামসুর রাহমান। এর বাইরে গীতিকার হিসেবেও তাঁর আরেকটি পরিচয়। সংখ্যাধিক্যে না হলেও শব্দ চয়ন, উপমা ও শব্দের অন্তমিল ব্যবহারে যা কিনা মানের বিবেচনায় পেয়েছে উৎকর্ষতা। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছেÑ ‘আমি প্রতিদিন তোমাকেই দেখি,’ ‘স্মৃতি ঝলমল সুনীল মাঠের কাছে,’ ফসলের মাঠে/ মেঘনার তীরে, অনেক দিনের মতো এই দিন,’ ‘এই মাটির কণা’, ‘স্বাধীনতা তুমি আছ বলে গোলাপ চামেলি ফোটে,’ ‘এল নববর্ষ/শুভ নববর্ষ,’ ‘বৈশাখী দিনে,’ ‘ধুধু পিপাসার ক্ষণে,’ ‘শূন্যে ডালে হঠাৎ হাওয়ায় লাগল ঝাঁকি,’ ‘বৈশাখেরই অগ্নিঝালর দহন আনে জুড়ে,’ ‘কথার ছলেই কথা দিয়েছিলে,’ ‘মধুময় পৃথিবীকে নীলাকাশ ডাকবে,’ ‘তোমার হৃদয়ে শ্রাবণের বর্ষণ,’ ‘মেঘের কিনারে রঙধনু জাগে’ ইত্যাদি।
শামসুর রাহমান রচিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ছয়টি। উপন্যাস লিখেছেন ৬টি। একটি করে রয়েছে প্রবন্ধ ও ছড়ার বই। অনুবাদ গ্রন্থের সংখ্যা ৬টি।
পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে মর্নিং নিউজে সাংবাদিকতার মাধ্যমে পেশাগত জীবনে প্রবেশ ঘটে তাঁর। এরপর ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত রেডিও পাকিস্তানের অনুষ্ঠান প্রযোজক ছিলেন। এর মাঝে আবার ফিরে আসেন পুরনো কর্মস্থল দৈনিক মর্নিং নিউজ-এ। সেখানে ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত সহযোগী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৪ সালের নবেম্বরে সরকারী দৈনিক পাকিস্তানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত দৈনিক বাংলায় এই দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি দৈনিক বাংলা ও সাপ্তাহিক বিচিত্রার সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৮৭তে সামরিক সরকারের শাসনামলে তাঁকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। এ সময় তিনি মাসিক সাহিত্য পত্রিকা অধুনার সম্পাদকের দায়িত্ব¡ পালন করেন।
স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক, বাংলা একাডেমী পুরস্কার, আদমজী পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার, জীবনানন্দ পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন শামসুর রাহমান। রবীন্দ্রভারতী ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে সম্মানসূচক ডিলিট উপাধি দেয়া হয়।
বাবা মুখলেসুর রহমান চৌধুরী ও মা আমেনা বেগম। ১৩ ভাই-বোনের মধ্যে কবি ছিলেন চতুর্থ। পুরনো ঢাকার পোগোজ ইংলিশ হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন ১৯৪৫ সালে। ১৯৪৭ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী বিষয়ে ভর্তি হন এবং তিন বছর নিয়মিত ক্লাসও করেন সেখানে। শেষ পর্যন্ত আর মূল পরীক্ষা দেননি। পাসকোর্সে বিএ পাস করে তিনি ইংরেজী সাহিত্যে এমএ (প্রিলিমিনারি) পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করলেও শেষ পর্বের পরীক্ষায় অংশ নেননি।

No comments

Powered by Blogger.