ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংলাপ-সংশয় ও আশাবাদের কয়েকটি দিক by মশিউল আলম

ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের দুই শীর্ষ নেতাকে সরাসরি আলোচনার টেবিলে ফিরিয়ে আনতে শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তাঁর পক্ষ থেকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে মুখোমুখি আলোচনায় বসার জন্য ওয়াশিংটন ডিসিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।


আগামী ২ সেপ্টেম্বর সেখানে শান্তি আলোচনা শুরু হবে, প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আলোচনার সূচনা বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে অধিকাংশ পর্যবেক্ষকের মন্তব্য হলো, এ আলোচনা থেকে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের দুই নেতা কোনো শান্তি চুক্তিতে পৌঁছাতে পারবেন, এমন সম্ভাবনা কম।
সংশয়বাদীদের একজন ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল, বর্তমানে জেরুজালেমের হিব্রু ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক শ্লোমো আভিনেরি। তিনি মনে করেন, আসন্ন ইসরায়েল-ফিলিস্তিন শান্তি আলোচনা ফলপ্রসূ হওয়ার ব্যাপারে ৫০ শতাংশও আশাবাদী হওয়া যায় না। তাঁর মূল যুক্তি, ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ যেভাবে দুই রাষ্ট্রের ভিত্তিতে অঞ্চলটি বিভক্ত করেছিল, ফিলিস্তিনিরা তখনো তা মন থেকে মেনে নেয়নি, এখনো মানে না। ইসরায়েল নামের কোনো রাষ্ট্রের অস্তিত্ব তারা এখনো স্বীকার করে নেয়নি।
দ্বিতীয়ত, আভিনেরি মনে করেন, মাহমুদ আব্বাস এখন আর পুরো ফিলিস্তিনি জাতির হয়ে কথা বলতে পারেন না, কারণ ২০০৬ সালে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ গাজার উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে এবং গাজা এখন শাসিত হচ্ছে হামাসের দ্বারা, যে হামাস অবৈধ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গাজা উপত্যকায় ক্ষমতাসীন হয়েছে।
তৃতীয়ত, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে বিরোধ-বৈরিতা বা কখনো কখনো সহিংসতার মূল কারণগুলো হচ্ছে সীমান্ত, বসতি স্থাপন, জেরুজালেমের ওপর পরস্পরের অনড় দাবি এবং ১৯৪৭-৪৮ সালে যেসব ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু হয়েছিল তাদের ও তাদের সন্তান-সন্ততিদের ভাগ্য। এই সমস্যাগুলোর কোনোটার ব্যাপারেই নেতানিয়াহু ও মাহমুদ আব্বাস এমন কোনো সমঝোতা-নিষ্পত্তিতে পৌঁছাতে পারবেন না, যা উভয় পক্ষের সাধারণ মানুষের পক্ষে গ্রহণযোগ্য হবে।
এ ছাড়া অনেক সংবাদসূত্র থেকে জানা গেছে, পূর্ব জেরুজালেমে ইসরায়েলিদের বসতি স্থাপন গত ডিসেম্বর থেকে স্থগিত রয়েছে—এমন ঘোষণা সত্ত্বেও সেখানে ইসরায়েলিদের ঘরবাড়ি বানানো বন্ধ হয়নি। এটা ফিলিস্তিনিদের কাছে ভীষণভাবে আপত্তিজনক একটি বিষয়। আভিনেরির সংশয়, নেতানিয়াহুর সঙ্গে মাহমুদ আব্বাসের সংলাপ মাঝপথেই ভেঙে যেতে পারে। কারণ মাহমুদ আব্বাস আগেই সতর্ক করে দিয়েছেন, দশ মাস মেয়াদি যে বসতি স্থাপন বিরতি চলছে, সংলাপকালে তার মেয়াদ যদি আর বাড়ানো না হয়, তাহলে তিনি আলোচনা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবেন। আর জানা যাচ্ছে, নেতানিয়াহু সম্ভবত বসতি স্থাপন বিরতির মেয়াদ বাড়াতে রাজি হবেন না। আভিনেরি বলছেন, ওয়াশিংটনে নেতানিয়াহু-মাহমুদ আব্বাসের ফটোসেশন হবে, তার বেশি কিছু নয়।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ‘বোল্ডেস্ট অ্যান্ড মোস্ট কনট্রোভার্শিয়াল থিংকার’ হিসেবে খ্যাত শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন মিয়ার্শহাইমার, যিনি ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের বিরোধী ছিলেন; যিনি যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলি লবির তীব্র সমালোচক, তিনি সম্প্রতি সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বক্তৃতা করতে গিয়ে বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার ‘দুই রাষ্ট্রভিত্তিক’ সমাধানের কোনো লক্ষণ নেই। কারণ, ইসরায়েলিরা গড়ে তুলতে চায় এক বৃহত্তর ইসরায়েলি রাষ্ট্র, এর অন্য কোনো বিকল্প রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের টিকে থাকার জন্যই হুমকি সৃষ্টি করবে বলে ইসরায়েলিরা মনে করে। ঘরের কাছেই ‘চিরশত্রু ফিলিস্তিনি’দের একটা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পাবে, আর ইসরায়েলিরা তা চেয়ে চেয়ে দেখবে, বিষয়টি এত সহজ নয়। শান্তি-সমঝোতার লক্ষ্যে অতীতের সমস্ত উদেযাগ শেষ পর্যন্ত নিষ্ফল হয়েছে মূলত এই কারণেই।
তবে নেতানিয়াহু-মাহমুদ আব্বাসের মধ্যে আসন্ন আলোচনার ব্যাপারে আশাবাদী অল্প কিছু মতামতও লক্ষ করা যাচ্ছে। ওয়াশিংটন ডিসির নামকরা স্বাধীন চিন্তাশালা ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশন বলছে, ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে এযাবৎ যত উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার সবগুলো থেকে এবারেরটির পরিবেশ ও পটভূমি ভিন্ন। ব্রুকিংস সুনির্দিষ্ট চারটি ফ্যাক্টর বা দিক চিহ্নিত করেছে, যা এ সংলাপের সাফল্যের ব্যাপারে কিছু আশাবাদ সৃষ্টি করে। সেগুলো এ রকম:
এক. ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশন বলছে, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন অঞ্চলে এ মুহূর্তে সহিংসতা উল্লেখযোগ্যভাবে কম। পুরো ১৯৯০ দশকজুড়ে ইসরায়েল সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছে, সে কারণে ইসরায়েলি নেতাদের পক্ষে তাঁদের জনগণকে এটা বোঝানো সম্ভব হয়নি যে ফিলিস্তিনিদের কিছু ছাড় দেওয়ার যুক্তিসংগত কারণ আছে। ইসরায়েলের জনসাধারণ মনে করত ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত শান্তির ব্যাপারে আন্তরিক নন, বরং তিনি দ্বিমুখী চাল চেলেছেন; একদিকে আলোচনার টেবিলে শান্তির কথা বলেছেন, অন্যদিকে ইসরায়েলের অধিকৃত এলাকার মানুষের ওপর হামলা চালাতে সন্ত্রাসীদের মদদ দিয়েছেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলে গিয়েছে: পশ্চিম তীরে সন্ত্রাসী হামলা প্রতিরোধ করতে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষই এখন টহল দিচ্ছে। হামাসও একইভাবে টহল দিচ্ছে গাজা উপত্যকায়, যাতে সেখানে কোনো সহিংসতা না ঘটে, কারণ হামাসের ভয়, সহিংসতা ঘটলে ইসরায়েল গাজায় হস্তক্ষেপ করতে পারে এবং হামাস ক্ষমতাচ্যুত হতে পারে। এসবের পাশাপাশি ইসরায়েলও তার নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করেছে। সব মিলিয়ে ওই অঞ্চলে বেসামরিক ইসরায়েলিদের ওপর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। ২০০২ সালে যেখানে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয়েছিল ৪৫২ জন বেসামরিক ইসরায়েলি, সেখানে ২০০২ সালে নিহত হয়েছিল মাত্র ছয়জন; আর চলতি বছর এ পর্যন্ত তেমন প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে মাত্র দুটি। ফলে, ইসরায়েলি জনসাধারণের মনে এখন এমন একটা ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে আলোচনায় বসা যায়।
দুই. ফিলিস্তিনিদের একটা বড় আপত্তি বিতর্কিত এলাকাগুলোতে ইসরায়েলিদের বসতি স্থাপন নিয়ে। এ বিষয়ে ইসরায়েল গত বছরের ডিসেম্বর থেকে ১০ মাসের একটা বিরতি পালন করছে। বসতি স্থাপন বিরতি শুরু হওয়ার পর থেকে এ বছরের প্রথম তিন মাসে পশ্চিম তীরে নতুন করে কোনো ইসরায়েলি বসতি স্থাপনের কাজ শুরু হয়নি। ব্রুকিংস এটা বলছে ইসরায়েলের কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর বরাতে। অবশ্য পূর্ব জেরুজালেমে ইসরায়েল ১৬০০ আবাসিক ইউনিট নির্মাণ করবে বলে ঘোষণা দিলে গত মার্চে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েল সফরে গিয়ে এ ঘোষণার তীব্র নিন্দা জানালে পূর্ব জেরুজালেমেও ইসরায়েল আর কোনো নতুন বসতি স্থাপন করেনি। সেখানে ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি ভেঙে দেওয়ার ঘটনাও আগের বছরগুলোর তুলনায় হ্রাস পেয়েছে।
ইসরায়েলের বসতি স্থাপন বিরতির মেয়াদ আগামী ২৬ সেপ্টেম্বর শেষ হয়ে যাবে। ধারণা করা হচ্ছে, নেতানিয়াহু এই বিরতির মেয়াদ আর বাড়াবেন না। আর ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে বসেছেন যে ইসরায়েল যদি বসতি স্থাপন কর্মকাণ্ড আবার শুরু করে, তাহলে তিনি আলোচনা থেকে সরে যাবেন। ব্রুকিংস বলছে, এখানে এ রকম একটা সমঝোতা হতে পারে যে যেসব এলাকায় ইসরায়েলিদের বসতি স্থাপন ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে, সেখানে সীমিতসংখ্যক ঘরবাড়ি নির্মাণ সম্পন্ন হবে, চূড়ান্ত চুক্তির সময় সেগুলো ইসরায়েলের মধ্যে আত্তীকৃত হবে। এর বিনিময়ে নেতানিয়াহু প্রতিশ্রুতি দিতে পারেন যে ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আক্রমণ চালাবে না; তিনি পশ্চিম তীরের অধিকাংশ জনপদে ফিলিস্তিনের পুলিশকে টহলের অনুমতি দিতে পারেন।
তিন. ব্রুকিংস মনে করছে, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন উভয় পক্ষেরই সাধারণ মানুষ দুই-রাষ্ট্রভিত্তিক সমঝোতাকে সমর্থন করে। আরবদের অধিকাংশেরও সমর্থন রয়েছে এতে। উভয় পক্ষের সাধারণ মানুষ ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যের এই সুদীর্ঘ বিরোধে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে; নেতানিয়াহু ও মাহমুদ আব্বাস যদি এবার কোনো যুক্তিসংগত সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেন, তাহলে সব পক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই তার প্রতি সমর্থন জানাবে। তবে এটা সত্য যে নেতানিয়াহুকে তাঁর নিজের দল লিকুদ পার্টির মধ্য থেকেই শক্ত বিরোধিতার মুখে পড়তে হবে, কিন্তু ইসরায়েলের পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত রাখতে তিনি ইসরায়েলি মধ্যপন্থী ও বাম শক্তিগুলোর শরণাপন্ন হতে পারেন। ব্রুকিংস আরও মনে করছে, ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রত্ব নিয়ে গণভোট হলে গাজা ও পশ্চিম তীরে এর পক্ষেই বিপুল ভোট পড়বে।
চার. ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের মধ্যে আলোচনা বা দর-কষাকষি করার বেশি কিছু আসলে নেই। অসলো চুক্তির পর থেকে গত ১৭ বছরে বিশদ চূড়ান্ত স্ট্যাটাসসহ সব জটিল বিরোধপূর্ণ ইস্যু বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে। একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে কী কী করতে হবে, তার জন্য উভয় পক্ষকে কী কী বিষয়ে ছাড় দিতে হবে তার সবকিছুই ইতিমধ্যে উভয় পক্ষের জানা।
ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তি স্থাপনের উপযোগী পরিবেশ সব বিবেচনায় এ মুহূর্তে আগের দশকের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। শান্তি স্থাপিত হবে কি না, এখন তা নির্ভর করছে দুই দেশের দুই নেতার ইচ্ছাশক্তি ও আন্তরিকতার ওপর। স্থায়ী শান্তি স্থাপনে দুই পক্ষকে রাজি করাতে এখানে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার রাষ্ট্রনায়কোচিত ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশন মনে করছে।
ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মানুষের মনে পরস্পরের বিরুদ্ধে যত ঘৃণা-বিদ্বেষই থাকুক না কেন; বাস্তবতা তো এই যে, কোনো পক্ষই অন্য পক্ষের অস্তিত্ব অস্বীকার করতে পারবে না। ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্বই মেনে নেয়নি, তারা এখনও ইসরায়েলের ধ্বংস চায়—শ্লোমো আভিনেরির এই দাবি সম্ভবত পুরোটা বাস্তবভিত্তিক নয়। ইসরায়েলিরাও ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে কখনোই দেবে না—এমন ধারণাও হয়তো সম্পূর্ণ ঠিক নয়। জীবনযাপনের বাস্তবতা উভয় পক্ষকে তাদের এই পুরোনো অনড় অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য করবে।
নইলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা প্রেসিডেন্ট ওবামা কেন একটি পূর্বানুমিত ‘নিষ্ফল’ একটি বৈঠকের আয়োজন করতে গেলেন?
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.