ছাত্ররাজনীতি-ছাত্রলীগ কর্মী নাসিমের মৃত্যু: দায় কার? by কুদরাত-ই-খুদা
স্কুলশিক্ষক বাবা মোসলেম উদ্দীনের বড় আশা ছিল, একমাত্র ছেলে নাসরুল্লাহ নাসিমের লেখাপড়া শেষ হলে তাঁকে সংসারের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে তিনি ধর্মকর্মে মনোনিবেশ করবেন। কিন্তু ছাত্ররাজনীতির বিষাক্ত কালো থাবার কারণে বাবা মোসলেম উদ্দীনের সেই আশা আর শেষ পর্যন্ত পূরণ হলো না, আর কখনো হবেও না।
যে ছেলেকে নিয়ে তিনি দীর্ঘদিন ধরে স্বপ্ন দেখে আসছিলেন, প্রতিহিংসাপরায়ণ ছাত্ররাজনীতির কাছে সেই লালিত স্বপ্নগুলো কত সহজেই ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। স্বপ্নপূরণের পরিবর্তে শেষ পর্যন্ত ছেলের লাশ কাঁধে নিয়ে বুক ফাটিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাবা মোসলেম উদ্দীনকে বাড়ি ফিরতে হলো। একজন বাবার কাছে এর চেয়ে বড় কষ্টের, এর চেয়ে বেদনার এবং এর চেয়ে বড় দুঃখের বিষয় জগতে আর কিছু হতে পারে না।
বাস্তব ও নিষ্ঠুর এ ঘটনাটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের। বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ্ মখদুম (এসএম) হলে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বিশেষ খাবারের আয়োজন করা হয়। জানা গেছে, খাবারের অতিরিক্ত টোকেন নেওয়ার বিরোধিতা করায় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতির অনুসারীরা নাসিমের ওপর ক্ষিপ্ত হয়। এরপর শুরু হয় বাগিবতণ্ডা। একপর্যায়ে নাসিমকে হলের দোতলায় ডেকে নিয়ে সভাপতিপক্ষের অনুসারীরা বেধড়ক মারধর করে। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের অনুসারী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের স্নাতক শেষ বর্ষের ছাত্র নাসিমকে তারা হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে আহত করে। শুধু তা-ই নয়, একপর্যায়ে তারা নাসিমের কোমরে ছুরিকাঘাত করে এবং হলের দোতলা থেকে নিচে ফেলে দেয়। এতে নাসিমের মাথা ফেটে যায়। বুকে, পেটে ও মেরুদণ্ডে প্রচণ্ড আঘাত লাগে। অবশেষে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে নয় দিন ধরে লড়াই করার পর গত ২৩ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নাসিমের মৃত্যু হয়।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি গঠিত হওয়ার পর থেকেই অভ্যন্তরীণ কোন্দল এত প্রকট আকার ধারণ করে যে, ছাত্রলীগের একপক্ষের কর্মীদের কাছে অপরপক্ষের কর্মীরা নিজেদের মোটেও নিরাপদ ভাবতে পারে না। গত সাত মাসে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে ছোট-বড় সব মিলিয়ে সংঘর্ষ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ২০-২৫টি। নিজেদের মধ্যে সৃষ্ট সংঘর্ষে নাসিম নামের ওই ছাত্রের অকালমৃত্যু ছাড়াও আহত হয়েছে উভয়পক্ষের শতাধিক নেতা-কর্মী। আধিপত্য বিস্তার, স্বার্থগত দ্বন্দ্ব, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দখলদারি ও চাঁদাবাজির মতো ঘটনায় জড়িয়ে পড়ার কারণেই যে এসব সংঘর্ষ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটে চলছে তা সহজেই অনুমেয়। তা ছাড়া ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও সংঘর্ষের অন্যতম বড় একটি কারণ হচ্ছে ছাত্রলীগের মধ্যে কৌশলে ও ছদ্মবেশে ছাত্রশিবির ও ছাত্রদলের চরদের অনুপ্রবেশ। এসব চর তাদের ‘নীলনকশা’ অনুযায়ী ছাত্রলীগের মধ্যে অন্তঃকোন্দল সৃষ্টিতে সর্বদা তৎপর থাকে।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, সংঘর্ষ, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের ফলে শিক্ষাঙ্গনে লেখাপড়ার সুষ্ঠু পরিবেশ গুরুতরভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সেশনজটের কবলে পড়াসহ থাকতে হচ্ছে কখন সংঘর্ষ বাধে এই ভয়ে, এই শঙ্কায়। সাধারণ এসব শিক্ষার্থীর পাশাপাশি তাদের অভিভাবকদেরও যে এ জন্য কম আতঙ্কে থাকতে হচ্ছে তা নয়। আবার এসব কারণে সৃষ্ট সেশনজটের কারণে ব্যয় করতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে কেউ রেহাই পাবে না’ বা ‘ছাত্ররাজনীতির নামে গুন্ডামি বন্ধ করতে হবে। এসব বন্ধ না করলে তিনি যে-ই হোন না কেন, তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে’ ইত্যাদি। শুধু কথাতেই নয়, দেশের সচেতন জনগণ আজ শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররাজনীতির নামে এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধে সরকারের বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন দেখতে চায়।
দেশ-জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে যেকোনো ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করাসহ এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা অত্যাবশ্যক। পাশাপাশি নিজেদের স্বার্থেই সরকারি রাজনৈতিক দলসহ দেশের সব রাজনৈতিক সংগঠনের উচিত হবে ছাত্ররাজনীতির ব্যাপারে সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া। বর্তমান সরকারসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সম্মিলিতভাবে ছাত্ররাজনীতির নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেবে—এমনটাই সবার প্রত্যাশা।
কুদরাত-ই-খুদা: সাংবাদিক ও গবেষক (আইবিএস), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
kekbabu@yahoo.com
বাস্তব ও নিষ্ঠুর এ ঘটনাটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের। বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ্ মখদুম (এসএম) হলে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বিশেষ খাবারের আয়োজন করা হয়। জানা গেছে, খাবারের অতিরিক্ত টোকেন নেওয়ার বিরোধিতা করায় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতির অনুসারীরা নাসিমের ওপর ক্ষিপ্ত হয়। এরপর শুরু হয় বাগিবতণ্ডা। একপর্যায়ে নাসিমকে হলের দোতলায় ডেকে নিয়ে সভাপতিপক্ষের অনুসারীরা বেধড়ক মারধর করে। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের অনুসারী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের স্নাতক শেষ বর্ষের ছাত্র নাসিমকে তারা হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে আহত করে। শুধু তা-ই নয়, একপর্যায়ে তারা নাসিমের কোমরে ছুরিকাঘাত করে এবং হলের দোতলা থেকে নিচে ফেলে দেয়। এতে নাসিমের মাথা ফেটে যায়। বুকে, পেটে ও মেরুদণ্ডে প্রচণ্ড আঘাত লাগে। অবশেষে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে নয় দিন ধরে লড়াই করার পর গত ২৩ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নাসিমের মৃত্যু হয়।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি গঠিত হওয়ার পর থেকেই অভ্যন্তরীণ কোন্দল এত প্রকট আকার ধারণ করে যে, ছাত্রলীগের একপক্ষের কর্মীদের কাছে অপরপক্ষের কর্মীরা নিজেদের মোটেও নিরাপদ ভাবতে পারে না। গত সাত মাসে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে ছোট-বড় সব মিলিয়ে সংঘর্ষ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ২০-২৫টি। নিজেদের মধ্যে সৃষ্ট সংঘর্ষে নাসিম নামের ওই ছাত্রের অকালমৃত্যু ছাড়াও আহত হয়েছে উভয়পক্ষের শতাধিক নেতা-কর্মী। আধিপত্য বিস্তার, স্বার্থগত দ্বন্দ্ব, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দখলদারি ও চাঁদাবাজির মতো ঘটনায় জড়িয়ে পড়ার কারণেই যে এসব সংঘর্ষ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটে চলছে তা সহজেই অনুমেয়। তা ছাড়া ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও সংঘর্ষের অন্যতম বড় একটি কারণ হচ্ছে ছাত্রলীগের মধ্যে কৌশলে ও ছদ্মবেশে ছাত্রশিবির ও ছাত্রদলের চরদের অনুপ্রবেশ। এসব চর তাদের ‘নীলনকশা’ অনুযায়ী ছাত্রলীগের মধ্যে অন্তঃকোন্দল সৃষ্টিতে সর্বদা তৎপর থাকে।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, সংঘর্ষ, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের ফলে শিক্ষাঙ্গনে লেখাপড়ার সুষ্ঠু পরিবেশ গুরুতরভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সেশনজটের কবলে পড়াসহ থাকতে হচ্ছে কখন সংঘর্ষ বাধে এই ভয়ে, এই শঙ্কায়। সাধারণ এসব শিক্ষার্থীর পাশাপাশি তাদের অভিভাবকদেরও যে এ জন্য কম আতঙ্কে থাকতে হচ্ছে তা নয়। আবার এসব কারণে সৃষ্ট সেশনজটের কারণে ব্যয় করতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে কেউ রেহাই পাবে না’ বা ‘ছাত্ররাজনীতির নামে গুন্ডামি বন্ধ করতে হবে। এসব বন্ধ না করলে তিনি যে-ই হোন না কেন, তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে’ ইত্যাদি। শুধু কথাতেই নয়, দেশের সচেতন জনগণ আজ শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররাজনীতির নামে এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধে সরকারের বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন দেখতে চায়।
দেশ-জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে যেকোনো ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করাসহ এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা অত্যাবশ্যক। পাশাপাশি নিজেদের স্বার্থেই সরকারি রাজনৈতিক দলসহ দেশের সব রাজনৈতিক সংগঠনের উচিত হবে ছাত্ররাজনীতির ব্যাপারে সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া। বর্তমান সরকারসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সম্মিলিতভাবে ছাত্ররাজনীতির নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেবে—এমনটাই সবার প্রত্যাশা।
কুদরাত-ই-খুদা: সাংবাদিক ও গবেষক (আইবিএস), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
kekbabu@yahoo.com
No comments