গোধূলির ছায়াপথে-নামের পেছনে নয়, নাম ছুটবে পেছনে by মুস্তাফা জামান আব্বাসী
প্রতিদিন সম্পাদকীয় ছাপা হচ্ছে নানা পত্রিকায়। রেডিও ও টিভির টক শোতে জরুরি ও উপযোগী মন্তব্য। নীতিনির্ধারক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-সেক্রেটারি-জয়েন্ট সেক্রেটারিদের কাছে সম্পাদকীয় ও কলামিস্টদের প্রয়োজনীয় বক্তব্যের অংশ পৌঁছে যাচ্ছে কি? খবর অনুযায়ী যায়। ওই ব্যক্তির ছবি, প্রশংসা পিআরও সাহেব কাটিং করে প্রস্তুত রাখেন বসের জন্য।
শিল্পকলা একাডেমীর ডিজি ছিলাম যখন, খবরের কাগজে একাডেমীসংক্রান্ত বিরুদ্ধ মন্তব্য বেরোলে ঘরের পিআরও অর্থাৎ বেগম সাহেবা টেলিফোন করে পত্রিকার নাম ও পৃষ্ঠাসংখ্যা জানালেন, দু-একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুও টেলিফোনে টিপ্পনী কাটতে ছাড়লেন না। সাত দিন অপেক্ষা করেও ডেস্কে সেটি এল না, তলব করলাম পিআরওকে। তিনি জানালেন তথ্যটি। বিরুদ্ধ কথা পোস্টিং করলে চাকরি থাকবে না। মন্ত্রীরা অনেকেই বন্ধু। জানিয়েছেন, সম্পাদকীয় ও কলামিস্টদের মন্তব্য পড়ে মন্ত্রিত্ব চালাতে হলেই হয়েছে। ওগুলো বাত কি বাত, বরং উল্টোটাই খুঁজে ফিরি। প্রশংসা হলে অন্য কথা।
আমেরিকার কথা বলি। টেলিভিশনের চ্যানেলগুলোর প্রতিবেদন ও সংবাদপত্রগুলোর জন্য রয়েছে আলাদা মন্ত্রক। প্রধান বিষয়, এমনকি চিঠিপত্রের সার প্রেসিডেন্টের কাছে পৌঁছানো হয়। অবসর সময়ে [প্লেনে চড়েছেন ঘণ্টা অথবা তার চেয়ে বেশি] প্রতিবেদনগুলো প্রতিদিন পাঠ করেন তিনি। প্রতিদিন। তা নাহলে পিছিয়ে থাকবেন। গত হয়েছে সেদিন, যখন খলিফা হারুন-উর-রশীদ ছদ্মবেশে বের হতেন বাগদাদের পথে পথে। কোথায় অভাব-অনটন স্বচক্ষে দেখতে। এখন আর প্রয়োজন নেই তার। প্রয়োজন হারুন-উর-রশীদের মতো অন্তরের, যে অন্তর মানুষের দুঃখে দ্রবীভূত। অভাব-অনটন খোঁজার জন্য সম্পাদকীয়র ও কলামিস্টদের সুভাষিত ও কণ্টকিত মন্তব্যের প্রয়োজন সামান্যই। রাস্তায় বেরোলেই হবে।
নিজের নামটি দেখার জন্য মানুষের ব্যাকুলতা। সহজাত ব্যাকুলতা। ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়। ঈদের দিনে মাঠে খবরের কাগজ বিক্রি হচ্ছে নামাজের মাসাল্লা হিসেবে। দেখে নিলাম কাগজে আমার নামটি। আজাদ-এর মুকুলের মহফিলে: ‘ঈদের দিনে’। বারবার যেন দেখতে ইচ্ছে করে। কী যে সুন্দর নাম! মুস্তাফা জামান, তখনো আব্বাসী লিখিনি।
নামের পেছনে ছুটছে কে না! কবি গোলাম মুস্তাফা বললেন পিতা আব্বাসউদ্দীনকে: আমি বিএবিটি, স্কুলের প্রধান শিক্ষক, আর ওই কবি [অর্থাৎ নজরুল] ক্লাস এইট। তাঁর পেছনে ছুটছে সারা বাংলার মানুষ, তাঁকে নিয়েই যত হইচই। পিতা হেসে বললেন, ‘আপনাকেও লোকে কম ভালোবাসে না। আপনার ‘বিশ্বনবী’ বিশ্বজয় করেছেন। নামের পেছনে ছোটার বিরতি হলে, নাম ছুটবে পেছনে।’ কথাটি ভুলিনি। স্ক্র্যাপ বুক প্রথম দিকে ছিল একটি, এখন নেই। ভাসিয়ে দিয়েছি কালের স্রোতে, কারণ কিছুই থাকবে না, নামটুকু ছাড়া।
এখন নাম করা হয়েছে যত সহজ তত কঠিন। ভালো কিছু লিখলে রাতারাতি সে বিখ্যাত। ভালো কণ্ঠ, ভালো সুর ইথারের তরঙ্গ ভেদ করে ছুটে আসবে ইউটিউবে, ফেসবুকে, আইপডে, ইন্টারনেটে রাতারাতি। ভালো লিখলে এক মাসেই পৃথিবীর সব বইয়ের স্টলে মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়ে যাবে। সেদিক থেকে অবশ্যই দূরে আমরা। অধ্যাপক-উপস্থাপক-লেখক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে শুধালাম একদিন, সুন্দর বইগুলো, পাঠকসংখ্যা মিলিয়ন ছাড়াচ্ছে না, এর প্রতিকার কী? হেসে বললেন, বুঝতে পেরেছি, কী মিন করছেন? গ্রন্থকারের বই ছাপা হচ্ছে সর্বোচ্চ ১০ হাজার। বাণী পৌঁছায় সর্বমোট এক লাখ পাঠকের কাছে। বড় পত্রিকায় কলামিস্টের ভাবনা পৌঁছে যায় ৫০ লাখ পাঠকের কাছে। ইন্টারনেটও সহযোগী। জয়ী সংবাদপত্র। অর্থপূর্ণ দৃষ্টি এবার অধমের কলামের প্রতি।
নিজেকে কে না প্রকাশ করতে চায়? ঢাকা থেকে বেরিয়ে সাভারের দিকে গেলেই নতুন সাইনবোর্ড চোখে পড়বে, নতুন নেতারা গলায় মাল্য পরে বিরাট ক্যানভাসে সারা বছর তাঁদের পরিচয়পত্র জাগিয়ে রেখেছেন। আগে দেখিনি। কোটি লোকের বাস যেখানে, নিত্যনতুন আভরণে নিজেকে সাজিয়ে প্রকাশ করবে মানুষ। আপত্তি, যেখানে প্রচারটাই মুখ্য। নামের পেছনে নয়, নাম ছুটবে পেছনে।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: লেখক-গবেষক, সংগীতব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net
আমেরিকার কথা বলি। টেলিভিশনের চ্যানেলগুলোর প্রতিবেদন ও সংবাদপত্রগুলোর জন্য রয়েছে আলাদা মন্ত্রক। প্রধান বিষয়, এমনকি চিঠিপত্রের সার প্রেসিডেন্টের কাছে পৌঁছানো হয়। অবসর সময়ে [প্লেনে চড়েছেন ঘণ্টা অথবা তার চেয়ে বেশি] প্রতিবেদনগুলো প্রতিদিন পাঠ করেন তিনি। প্রতিদিন। তা নাহলে পিছিয়ে থাকবেন। গত হয়েছে সেদিন, যখন খলিফা হারুন-উর-রশীদ ছদ্মবেশে বের হতেন বাগদাদের পথে পথে। কোথায় অভাব-অনটন স্বচক্ষে দেখতে। এখন আর প্রয়োজন নেই তার। প্রয়োজন হারুন-উর-রশীদের মতো অন্তরের, যে অন্তর মানুষের দুঃখে দ্রবীভূত। অভাব-অনটন খোঁজার জন্য সম্পাদকীয়র ও কলামিস্টদের সুভাষিত ও কণ্টকিত মন্তব্যের প্রয়োজন সামান্যই। রাস্তায় বেরোলেই হবে।
নিজের নামটি দেখার জন্য মানুষের ব্যাকুলতা। সহজাত ব্যাকুলতা। ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়। ঈদের দিনে মাঠে খবরের কাগজ বিক্রি হচ্ছে নামাজের মাসাল্লা হিসেবে। দেখে নিলাম কাগজে আমার নামটি। আজাদ-এর মুকুলের মহফিলে: ‘ঈদের দিনে’। বারবার যেন দেখতে ইচ্ছে করে। কী যে সুন্দর নাম! মুস্তাফা জামান, তখনো আব্বাসী লিখিনি।
নামের পেছনে ছুটছে কে না! কবি গোলাম মুস্তাফা বললেন পিতা আব্বাসউদ্দীনকে: আমি বিএবিটি, স্কুলের প্রধান শিক্ষক, আর ওই কবি [অর্থাৎ নজরুল] ক্লাস এইট। তাঁর পেছনে ছুটছে সারা বাংলার মানুষ, তাঁকে নিয়েই যত হইচই। পিতা হেসে বললেন, ‘আপনাকেও লোকে কম ভালোবাসে না। আপনার ‘বিশ্বনবী’ বিশ্বজয় করেছেন। নামের পেছনে ছোটার বিরতি হলে, নাম ছুটবে পেছনে।’ কথাটি ভুলিনি। স্ক্র্যাপ বুক প্রথম দিকে ছিল একটি, এখন নেই। ভাসিয়ে দিয়েছি কালের স্রোতে, কারণ কিছুই থাকবে না, নামটুকু ছাড়া।
এখন নাম করা হয়েছে যত সহজ তত কঠিন। ভালো কিছু লিখলে রাতারাতি সে বিখ্যাত। ভালো কণ্ঠ, ভালো সুর ইথারের তরঙ্গ ভেদ করে ছুটে আসবে ইউটিউবে, ফেসবুকে, আইপডে, ইন্টারনেটে রাতারাতি। ভালো লিখলে এক মাসেই পৃথিবীর সব বইয়ের স্টলে মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়ে যাবে। সেদিক থেকে অবশ্যই দূরে আমরা। অধ্যাপক-উপস্থাপক-লেখক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে শুধালাম একদিন, সুন্দর বইগুলো, পাঠকসংখ্যা মিলিয়ন ছাড়াচ্ছে না, এর প্রতিকার কী? হেসে বললেন, বুঝতে পেরেছি, কী মিন করছেন? গ্রন্থকারের বই ছাপা হচ্ছে সর্বোচ্চ ১০ হাজার। বাণী পৌঁছায় সর্বমোট এক লাখ পাঠকের কাছে। বড় পত্রিকায় কলামিস্টের ভাবনা পৌঁছে যায় ৫০ লাখ পাঠকের কাছে। ইন্টারনেটও সহযোগী। জয়ী সংবাদপত্র। অর্থপূর্ণ দৃষ্টি এবার অধমের কলামের প্রতি।
নিজেকে কে না প্রকাশ করতে চায়? ঢাকা থেকে বেরিয়ে সাভারের দিকে গেলেই নতুন সাইনবোর্ড চোখে পড়বে, নতুন নেতারা গলায় মাল্য পরে বিরাট ক্যানভাসে সারা বছর তাঁদের পরিচয়পত্র জাগিয়ে রেখেছেন। আগে দেখিনি। কোটি লোকের বাস যেখানে, নিত্যনতুন আভরণে নিজেকে সাজিয়ে প্রকাশ করবে মানুষ। আপত্তি, যেখানে প্রচারটাই মুখ্য। নামের পেছনে নয়, নাম ছুটবে পেছনে।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: লেখক-গবেষক, সংগীতব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net
No comments