আলোকের এই ঝরণাধারায় (পর্ব-১৮)-স্মৃতিপটে পুরান ঢাকা by আলী যাকের
তরুণ বয়সে রবীন্দ্রনাথের 'পুনশ্চঃ'তে লেখা 'বাঁশি' কিংবা 'ক্যামেলিয়া', 'পত্রলেখা' অথবা 'সাধারণ মেয়ে' আমার তারুণ্যের প্রেমানুভূতিকে গাঢ় হতে আরো সাহায্য করেছে। তবে সে কথা থাক। এখন ভাবি, 'তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে/সব গাছ ছাড়িয়ে'_এ কথাটি কত হালকাভাবেই না বলি আমরা।
অথচ এখনো যখন গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাই, তখন ওই তালগাছই হয়ে দাঁড়ায় আমার গ্রামের নিশানা। এখনো কাউকে গ্রামের দিকনির্দেশ দিতে গেলে আমার গ্রামের এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছই দিকচিহ্ন হিসেবে দেখা দেয় সর্বাগ্রে। আকাশে উঁকি মারা কি এতই সহজ? আমাদের সন্তানদের আমরা আশীর্বাদ করে তো নিত্যই বলি, আকাশের মতো উঁচু হও। কিন্তু সেই উচ্চতা পায় কয়জন মানুষ? আমাদের বড় হওয়ার পেছনে ওই এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছ যদি আদর্শ হতো, তাহলে খর্বকায় আমরা হয়তো আরেকটু উঁচু হওয়ার চেষ্টা করতে পারতাম।
কতবার বৈশাখ মাসে হাঁটুজল পেরিয়ে ক্ষীণ স্রোতধারা পেরোনোর জন্য 'আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে'র খোঁজে হয়রান হয়ে ফিরেছি। ওই ছড়াটি হৃদয়ে গেঁথে নিয়ে সাভারের বংশী নদীর ধারে একাধিক অলস দুপুরে বসে বসে দাঁতে ঘাস কেটেছি। অবশেষে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য সাদা-কালো বাংলা ছবিতে অভিনয় করেছি ওই নদীটির পাশে। মোরশেদুল ইসলামের 'আগামী' ছবিতে আমি ছিলাম রাজাকার। বংশী নদীর পাশে একটি শেওড়াগাছের সঙ্গে আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে বেধড়ক পিটিয়েছিল আমার অনুজপ্রতিম বন্ধু পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মজিবুর রহমান দিলু। তবুও এঁকেবেঁকে চলা ছোট নদী বংশী এখনো আমার হৃদয় কেড়ে নেয়। ওখান দিয়ে যাওয়ার সময় দুই মিনিটের জন্য হলেও আমি গাড়ি দাঁড় করিয়ে সেই ক্ষীণকায় নদীর দিকে অনিঃশেষ তাকিয়ে থাকি। হঠাৎ মনে পড়ল, আমার সদ্য প্রয়াত অগ্রজপ্রতিম বন্ধু নওয়াজেশ আহমেদ আর আমি ওই ক্ষুদ্র নদীর অববাহিকায় ঘুরে ঘুরে দিনাতিপাত করেছি বুনো ফুলের সন্ধানে। কত যে ছবি তুলেছি, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। ওইসব ছবির অনেকগুলোই ঠাঁই পেয়েছে আমাদের বই 'Wild Flowers of Bangladesh-এ।
ঝুনু আর বাবার কল্যাণে সেই যে রবীন্দ্রনাথ ঢুকে গেল মাথায়, তা এখনো মাথার ভেতর ঘোরে। অনেকটা জীবনানন্দ দাশের 'বোধ'-এর মতো অথবা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের 'বিমানের মাথায় ঢুকে পড়া আকাশ'-এর মতো, যাকে ঝেড়ে ফেলা যায় না। আমার কৈশোরের আবিষ্কৃত রবীন্দ্রনাথ আরো বেশি পাকাপোক্ত হয়েছিল দিদির গুনগুনিয়ে গাওয়া 'যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে' গানটি শুনে। তিনি যখন গাইতেন, একটা বিষণ্ন আবহ যেন আমাকে ঘিরে ফেলত। আমার একেক সময় মনে হয়, আচ্ছা, দিদি কি বুঝতে পেরেছিলেন, কেবল ৩৮ বছর বয়সে তিনি চলে যাবেন? আমাদের সেই সময়ে যখন বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সংস্কৃতিকে দাঁড় করানো হচ্ছে নানাবিধ ছলাকলায়, তখন রবীন্দ্রনাথের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামকেও দাঁড় করানোর একটা অপচেষ্টা চলেছিল। একবার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'আচ্ছা বাবা, কে বড়? রবীন্দ্রনাথ, না নজরুল?' জবাবে বাবা বলেছিলেন, "'রবি'র অর্থ জানিস? 'রবি'র অর্থ হচ্ছে_সূর্য। বিশ্বে এমন কিছুই নেই, যা রবির আলোয় আলোকিত নয়।" এর পরও কি আর কিছু বলার থাকে? আমার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ পাকাপাকিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল।
প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিককালের আরেকটি গল্প বলার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। আমাদের দেশের স্বনামধন্য শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার এই গল্পটি আমাকে বলেছিলেন। বিগত রাজনৈতিক সরকারের সময় কোনো এক ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কোনো অঙ্গসংগঠন রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী একসঙ্গে পালনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। তারা এই দুই কবির দুটি চিত্রপট আঁকার দায়িত্ব মুস্তাফা মনোয়ারকে দিয়েছিল। মুস্তাফা মনোয়ার রবীন্দ্রনাথের পোট্র্রেইটটি একটু বড় মাপের করে সেটাকে একটু সামনের দিকে স্থাপন করেছিলেন। এর সামান্য পেছনে ছিলেন নজরুল। অনুষ্ঠানের দিন চিত্র দুটি যখন স্থাপন করা হলো, তখন আয়োজকদের একজন মুস্তাফা মনোয়ারকে অভিযোগের সুরে বলেছিলেন, 'এটা কী করেছেন? নজরুলকে কি আরো বড় করে রবীন্দ্রনাথের সামনে স্থাপন করা যেত না?' জবাবে মুস্তাফা মনোয়ার নাকি বলেছিলেন, "আমি তো তা-ই করেছিলাম।
শেষরাতের দিকে যখন ছবি দুটি তৈরি হলো, হঠাৎ নজরুল জীবন্ত হয়ে ছবি থেকে বেরিয়ে এসে আমার গালে শক্ত একটা চড় কষিয়ে বললেন, 'গুরুদেবের সামনে আমায় রেখেছিস কেন গাধা?' তারপর পেছনের ছোট পটে গিয়ে আশ্রয় নিলেন।"
গেণ্ডারিয়া পাড়াটিকে আমরা ঠিক পুরান ঢাকা বলে মেনে নিতাম না। আজকের মান অনুযায়ী ক্ষীণকায় গলির প্রাচুর্য থাকলেও গেণ্ডারিয়াকে অনেকটা ছকে আঁকা শহরতলি বলা যেত। গেণ্ডারিয়া থেকে মূল ঢাকা শহরে আসতে হলে লোহার পুল কিংবা কাঠের পুল পেরোতে হতো। এই দুটি পুল পেরোলে পরেই যে শহরের শুরু, আমাদের ধারণায় সেটাই ছিল গলি এবং নালাময় পুরান ঢাকা। সেই কলুটোলা কিংবা শ্যামবাজার, হেমেন্দ্র দাস রোড থেকে বেরিয়ে আসা গলি, অক্ষয়দাস লেন, পাতলাখান লেন, মালখানগর, শাঁখারীবাজার, কলতাবাজার, তাঁতীবাজারের গলি-ঘুঁজি_এ সবই ছিল পুরনো ঢাকার শিরা-উপশিরা। আমার ধারণা এবং বাস্তবতার মধ্যে কোনো ফারাক আছে কি না, তা যাচাই করার জন্য আমি বছরখানেক আগে দুর্গাপূজার নবমীতে এসব গলির মধ্য দিয়ে ঘোরাঘুরি করেছি বিস্তর এবং বুঝতে পেরেছি, আমার সেই অতীতের ধারণা আর বর্তমান সত্যের মধ্যে কোনো ফারাক নেই। পুরান ঢাকাকে জালের মতো আবিষ্ট করে রেখেছে গলি-ঘুঁজি। তবে এ কারণেই পুরান ঢাকার একটি বিশেষ চরিত্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, যা কোনো নব্য শহরের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব নয়। এ সবই একটি ঐতিহ্যবাহী শহরের নিজস্ব সম্পদ।
(চলবে...)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
কতবার বৈশাখ মাসে হাঁটুজল পেরিয়ে ক্ষীণ স্রোতধারা পেরোনোর জন্য 'আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে'র খোঁজে হয়রান হয়ে ফিরেছি। ওই ছড়াটি হৃদয়ে গেঁথে নিয়ে সাভারের বংশী নদীর ধারে একাধিক অলস দুপুরে বসে বসে দাঁতে ঘাস কেটেছি। অবশেষে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য সাদা-কালো বাংলা ছবিতে অভিনয় করেছি ওই নদীটির পাশে। মোরশেদুল ইসলামের 'আগামী' ছবিতে আমি ছিলাম রাজাকার। বংশী নদীর পাশে একটি শেওড়াগাছের সঙ্গে আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে বেধড়ক পিটিয়েছিল আমার অনুজপ্রতিম বন্ধু পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মজিবুর রহমান দিলু। তবুও এঁকেবেঁকে চলা ছোট নদী বংশী এখনো আমার হৃদয় কেড়ে নেয়। ওখান দিয়ে যাওয়ার সময় দুই মিনিটের জন্য হলেও আমি গাড়ি দাঁড় করিয়ে সেই ক্ষীণকায় নদীর দিকে অনিঃশেষ তাকিয়ে থাকি। হঠাৎ মনে পড়ল, আমার সদ্য প্রয়াত অগ্রজপ্রতিম বন্ধু নওয়াজেশ আহমেদ আর আমি ওই ক্ষুদ্র নদীর অববাহিকায় ঘুরে ঘুরে দিনাতিপাত করেছি বুনো ফুলের সন্ধানে। কত যে ছবি তুলেছি, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। ওইসব ছবির অনেকগুলোই ঠাঁই পেয়েছে আমাদের বই 'Wild Flowers of Bangladesh-এ।
ঝুনু আর বাবার কল্যাণে সেই যে রবীন্দ্রনাথ ঢুকে গেল মাথায়, তা এখনো মাথার ভেতর ঘোরে। অনেকটা জীবনানন্দ দাশের 'বোধ'-এর মতো অথবা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের 'বিমানের মাথায় ঢুকে পড়া আকাশ'-এর মতো, যাকে ঝেড়ে ফেলা যায় না। আমার কৈশোরের আবিষ্কৃত রবীন্দ্রনাথ আরো বেশি পাকাপোক্ত হয়েছিল দিদির গুনগুনিয়ে গাওয়া 'যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে' গানটি শুনে। তিনি যখন গাইতেন, একটা বিষণ্ন আবহ যেন আমাকে ঘিরে ফেলত। আমার একেক সময় মনে হয়, আচ্ছা, দিদি কি বুঝতে পেরেছিলেন, কেবল ৩৮ বছর বয়সে তিনি চলে যাবেন? আমাদের সেই সময়ে যখন বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সংস্কৃতিকে দাঁড় করানো হচ্ছে নানাবিধ ছলাকলায়, তখন রবীন্দ্রনাথের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামকেও দাঁড় করানোর একটা অপচেষ্টা চলেছিল। একবার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'আচ্ছা বাবা, কে বড়? রবীন্দ্রনাথ, না নজরুল?' জবাবে বাবা বলেছিলেন, "'রবি'র অর্থ জানিস? 'রবি'র অর্থ হচ্ছে_সূর্য। বিশ্বে এমন কিছুই নেই, যা রবির আলোয় আলোকিত নয়।" এর পরও কি আর কিছু বলার থাকে? আমার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ পাকাপাকিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল।
প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিককালের আরেকটি গল্প বলার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। আমাদের দেশের স্বনামধন্য শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার এই গল্পটি আমাকে বলেছিলেন। বিগত রাজনৈতিক সরকারের সময় কোনো এক ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কোনো অঙ্গসংগঠন রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী একসঙ্গে পালনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। তারা এই দুই কবির দুটি চিত্রপট আঁকার দায়িত্ব মুস্তাফা মনোয়ারকে দিয়েছিল। মুস্তাফা মনোয়ার রবীন্দ্রনাথের পোট্র্রেইটটি একটু বড় মাপের করে সেটাকে একটু সামনের দিকে স্থাপন করেছিলেন। এর সামান্য পেছনে ছিলেন নজরুল। অনুষ্ঠানের দিন চিত্র দুটি যখন স্থাপন করা হলো, তখন আয়োজকদের একজন মুস্তাফা মনোয়ারকে অভিযোগের সুরে বলেছিলেন, 'এটা কী করেছেন? নজরুলকে কি আরো বড় করে রবীন্দ্রনাথের সামনে স্থাপন করা যেত না?' জবাবে মুস্তাফা মনোয়ার নাকি বলেছিলেন, "আমি তো তা-ই করেছিলাম।
শেষরাতের দিকে যখন ছবি দুটি তৈরি হলো, হঠাৎ নজরুল জীবন্ত হয়ে ছবি থেকে বেরিয়ে এসে আমার গালে শক্ত একটা চড় কষিয়ে বললেন, 'গুরুদেবের সামনে আমায় রেখেছিস কেন গাধা?' তারপর পেছনের ছোট পটে গিয়ে আশ্রয় নিলেন।"
গেণ্ডারিয়া পাড়াটিকে আমরা ঠিক পুরান ঢাকা বলে মেনে নিতাম না। আজকের মান অনুযায়ী ক্ষীণকায় গলির প্রাচুর্য থাকলেও গেণ্ডারিয়াকে অনেকটা ছকে আঁকা শহরতলি বলা যেত। গেণ্ডারিয়া থেকে মূল ঢাকা শহরে আসতে হলে লোহার পুল কিংবা কাঠের পুল পেরোতে হতো। এই দুটি পুল পেরোলে পরেই যে শহরের শুরু, আমাদের ধারণায় সেটাই ছিল গলি এবং নালাময় পুরান ঢাকা। সেই কলুটোলা কিংবা শ্যামবাজার, হেমেন্দ্র দাস রোড থেকে বেরিয়ে আসা গলি, অক্ষয়দাস লেন, পাতলাখান লেন, মালখানগর, শাঁখারীবাজার, কলতাবাজার, তাঁতীবাজারের গলি-ঘুঁজি_এ সবই ছিল পুরনো ঢাকার শিরা-উপশিরা। আমার ধারণা এবং বাস্তবতার মধ্যে কোনো ফারাক আছে কি না, তা যাচাই করার জন্য আমি বছরখানেক আগে দুর্গাপূজার নবমীতে এসব গলির মধ্য দিয়ে ঘোরাঘুরি করেছি বিস্তর এবং বুঝতে পেরেছি, আমার সেই অতীতের ধারণা আর বর্তমান সত্যের মধ্যে কোনো ফারাক নেই। পুরান ঢাকাকে জালের মতো আবিষ্ট করে রেখেছে গলি-ঘুঁজি। তবে এ কারণেই পুরান ঢাকার একটি বিশেষ চরিত্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, যা কোনো নব্য শহরের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব নয়। এ সবই একটি ঐতিহ্যবাহী শহরের নিজস্ব সম্পদ।
(চলবে...)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments