কালের পুরাণ-খোন্দকার দেলোয়ার, এত দিন কোথায় ছিলেন? by সোহরাব হাসান
বেগম খালেদা জিয়ার কনিষ্ঠ ছেলে আরাফাত রহমান কোকো রাজনীতি না করেও রাজনীতির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
কোকো আদালতের জামিন নিয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাননি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তিনি গেছেন প্যারোলে (সাময়িক মুক্তি)।
কোকো আদালতের জামিন নিয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাননি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তিনি গেছেন প্যারোলে (সাময়িক মুক্তি)।
অভিধান অনুযায়ী প্যারোল হলো পালিয়ে যাবেন না, এই শর্তে বন্দী কর্তৃক প্রতিশ্রুতি এবং শর্তাধীন মুক্তি। অর্থাৎ আদালত নয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মর্জির ওপরই তাঁর জেলখানার বাইরে থাকা না-থাকা নির্ভর করছে। অনেকের কাছেই বিষয়টি পরিষ্কার ছিল না। তাঁরা ভেবেছিলেন, অন্যদের মতো তারেক ও আরাফাতও আদালতের জামিন নিয়ে বিদেশে আছেন।
যেমন ‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই’, তেমনি আরাফাত রহমান কোকোর প্যারোল বাতিল করে সরকার দেশবাসীকে জানিয়ে দিয়েছে, তিনি মুক্ত মানুষ নন। একজন বিচারাধীন কারাবন্দী। বিএনপির ভাষায়, ‘মহাষড়যন্ত্রকারী’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিশেষ অনুকম্পায় বিদেশে গিয়েছিলেন চিকিৎসার জন্য। সেই অনুকম্পার মেয়াদ মহাজোট সরকারও ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছে। বিএনপির নেতারা যে দাবি করেছেন, বর্তমান সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলেছে; অন্যান্য ক্ষেত্রে না হলেও এই একটি ক্ষেত্রে তাঁদের দাবি শতভাগ সত্য। না হলে গত ২০ মাস আরাফাত প্যারোলে আছেন কীভাবে?
খালেদা জিয়ার কনিষ্ঠ ছেলে রাজনীতি না করলেও জ্যেষ্ঠ ছেলে তারেক রহমান রাজনীতি করেন। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে তিনি ছিলেন দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তখন খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হলেও দেশ চলত তাঁর কথায়। দলীয় নেতা-মন্ত্রীরা দলবেঁধে তাঁর কাছে ধরনা দিতেন। এখন দেশ না চললেও বিএনপি তাঁর আদেশেই চলে। তিনি যেখানে যাকে চাইছেন থাকছেন, যাকে চাইছেন না বাদ পড়ছেন।
কয়েক দিন আগে বরিশালের দুই জাঁদরেল নেতা মজিবর রহমান সরোয়ার ও আহসান হাবীব কামাল ‘বড় ভাইয়ের’ আশীর্বাদ নিতে লন্ডন পর্যন্ত দৌড়াদৌড়ি করেছেন। তিনি তাঁদের কী আশীর্বাদ করেছেন জানা যায়নি, কিন্তু দেশবাসী অবাক বিস্ময়ে দেখল, দুই প্রতিদ্বন্দ্বী নেতার সমর্থকদের মধ্যে নয়াপল্টনের অফিসে রক্তারক্তি কাণ্ড। পণ্ড হলো কমিটি গঠনের উদ্দেশ্যে আয়োজিত নির্বাচনও। তারেক রহমান দেশে না থাকলেও বিএনপির নেতা-কর্মীরা তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছেন। তাঁরা জানেন, তাঁর ওপরই বিএনপির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে, এমনকি সর্বনাশও। অথচ দেশত্যাগের সময় তারেক রহমান বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিবের পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন। কে এবং কীভাবে সেই পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করলেন, সে সম্পর্কে বিএনপির নেতা-কর্মীরাও কিছু জানতেন না। শুধু বিএনপির কাউন্সিল অধিবেশনে দেখা গেল, তারেক রহমান জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব থেকে জ্যেষ্ঠ যুগ্ম চেয়ারম্যানে পদোন্নতি পেয়েছেন।
বিএনপির নেতা-কর্মীরা বড় ভাইয়ের কৃপালাভে লন্ডন পর্যন্ত দৌড়ঝাঁপ করলেও ছোট ভাইয়ের খুব একটা খোঁজখবর নিয়েছেন বলে জানা নেই। কেননা লন্ডন টিকিটের যে রিটার্ন মূল্য আছে, ব্যাংকক টিকিটের তা নেই। আরাফাত রহমান কোকো ব্যাংককে চিকিৎসাধীন। তাঁর চিকিৎসায় যত দিন প্রয়োজন, সরকারের উচিত হবে তত দিন তাঁকে প্যারোলে থাকার অনুমতি দেওয়া। না হলে বিএনপি এটিকে রাজনৈতিক ইস্যু করবে। এই মুহূর্তে সেটি করতে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বিএনপির হাতে এ মুহূর্তে তেমন ইস্যু নেই—মামলা, বাড়ি ও প্যারোল ছাড়া। তারা জনগণের সমস্যা নিয়ে ভাবিত নয়, নিজেদের সমস্যা নিয়েই ব্যস্ত।
কোকোর প্যারোল বাতিল হওয়ায় ইতিমধ্যে বিএনপি দুই দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। অন্যদিকে, ঢাকা পুলিশ কমিশনার পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত রাস্তায় মিছিল-সমাবেশ করা যাবে না বলে হুকুম জারি করেছেন। বিএনপি কি সেই হুকুম মেনে ঘরে চুপচাপ বসে থাকবে? সম্ভাবনা কম। তারা যদি সরকারি হুকুম অমান্য করে রাস্তায় নামার চেষ্টা করে, পুলিশ তার জবাবে যদি লাঠিপেটা করে, আর এর প্রতিক্রিয়ায় যদি গোলযোগ বা ভাঙচুরের মতো ঘটনা ঘটে, তখন পুরো নগরই অচল হয়ে পড়তে পারে। এতে মানুষের দুর্ভোগও বাড়বে। তারা সরকারের ওপর আরও বেশি ক্ষুব্ধ হবে। বিএনপির এই ফাঁদে সরকার পা দেবে না বলেই আমাদের বিশ্বাস।
একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তিকে নিয়ে রাজনৈতিক পরিবেশ গরম হবে, সেটি কারও কাম্য নয়। তবে সেই সঙ্গে এটিও জানাতে হবে, আরাফাত রহমানের চিকিৎসা শেষ হতে কত দিন লাগবে? তাঁর অসুখটা আসলে কী? বিএনপির নেতারা তারেক রহমানের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। কিন্তু আরাফাতের ব্যাপারে একেবারে নীরব। সাবেক প্রধানমন্ত্রী জোর গলায় প্রচার করেন, ‘বাংলাদেশ ছাড়া আমার কোনো দেশ নেই। এখানে জন্মেছি, এখানেই মরব।’ কিন্তু তাঁর ছেলেদের চিকিৎসার জন্য অনির্দিষ্টকাল বিদেশে থাকতে হবে কেন? বাংলাদেশে কি চিকিৎসা নেই?
২.
বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, তাঁরাও ২১ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচার চান। একই সঙ্গে তিনি মামলাটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, ২১ আগস্টের ঘটনায় বিএনপির নেতাদের জড়ালে তাঁরা মুখ বুজে মেনে নেবেন না। দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে রাজপথে আন্দোলন করবেন।
বিএনপির মহাসচিবের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে আমরা দুটি তথ্য পাই। এক. তাঁরা ২১ আগস্টের ঘৃণ্য গ্রেনেড হামলা ও হত্যাযজ্ঞের বিচার চান। দুই. মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না।
খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন কেবল বিএনপির মহাসচিব নন, একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিক ও আইনজীবীও বটে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে খালেদা জিয়ার মামলা করতে তিনিও আইনজীবীর পোশাক পরে আদালতে দাঁড়িয়েছিলেন। আইনকানুন তিনি ভালোই জানেন। তবে মানতে চান না।
বিএনপির মহাসচিব নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনাটি যখন ঘটে, তখন আওয়ামী লীগ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় ছিল না, ক্ষমতায় ছিল বিএনপি-জামায়াত জোট। ২০০৪-এর ২১ আগস্ট হামলার ঘটনা ঘটে, তারা ক্ষমতা ছাড়ে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর। দুই বছরেরও বেশি সময় পেয়েছে বিএনপি সরকার। এই সময়ে তদন্তকাজটিও শেষ হলো না কেন? একজন আসামিকেও ধরতে পারল না কেন?
খোন্দকার দেলোয়ারের কথাটি খুবই নিরীহ ও নির্ভেজাল। যে ঘৃণ্য গ্রেনেড হামলার ঘটনায় আওয়ামী লীগের নেত্রী আইভি রহমানসহ ২২ জন জীবন দিয়েছেন, শতাধিক লোক আহত হয়েছেন, তার বিচার চেয়ে বিএনপি এখন দায়িত্বশীল বিরোধী দল হিসেবেই প্রমাণ করতে চাইছে। মামলাটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের বিরুদ্ধে দেলোয়ারের হুঁশিয়ারির সঙ্গেও কেউ দ্বিমত করবেন না।
এখন কথা হলো, মামলাটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের কাজটি কে শুরু করেছিল? আওয়ামী লীগ, না বিএনপি? কারা সেদিন আক্রমণকারীকে না ধরে আক্রান্তের ওপরই দায় চাপানোর চেষ্টা করেছিল? কারা দ্রুত ঘটনার আলামত নষ্ট করে দিয়েছিল? প্রকৃত অপরাধীদের বাঁচাতে কারা জজ মিয়া কাহিনি ফেঁদেছিল? কাদের অসহযোগিতার কারণে বিদেশি তদন্ত কর্মকর্তারা তদন্তকাজ শেষ না করেই চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন? কারা সেদিন সংসদের বাইরে ও ভেতরে গরম বক্তৃতা দিয়ে আওয়ামী লীগের কাঁধে দায় চাপাতে চেয়েছিল? কারা পাকিস্তানি জঙ্গিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আর্জেস গ্রেনেড নিয়ে এসেছিল? কোন দলের মন্ত্রীর বাসায় গ্রেনেডবাজদের বৈঠক হয়েছিল? কারা বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের নামে আজগুবি তথ্য হাজির করেছিল? কারা প্রচার চালিয়েছিল, বাংলাদেশে যত বোমা হামলা হয়েছে, সবগুলোর পেছনে শেখ হাসিনা ও ভারত আছে? সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তে নিশ্চয়ই সবকিছু বেরিয়ে আসবে। তবে মনে রাখা প্রয়োজন, ২১ আগস্টের ঘটনা নিয়ে এখনো নানা মহল অপপ্রচার চালাচ্ছে। ন্যায় বিচারের স্বার্থে এদের স্বরূপ উন্মোচন করতে হবে।
বিএনপির মহাসচিব দাবি করেছেন, এ ঘটনায় তাঁদের দলের কোনো নেতা-কর্মী জড়িত নন। তাহলে কেন তাঁরা অপরাধীদের রক্ষা করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন? কেন তদন্ত কর্মকর্তাদের মুখ বন্ধ করা হয়েছিল নানা চাপ ও প্রলোভন দিয়ে? যাঁরা এসব করেছেন, তাঁরা খোন্দকার দেলোয়ারের খুব কাছের লোক। কেউ নেতা, কেউ মন্ত্রী ছিলেন। ২১ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবির আগে দলের সেই নেতা ও সাবেক মন্ত্রীদের নাম প্রকাশ করতে হবে। তাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। দল থেকে বহিষ্কার করতে হবে।
আমরা জানি, সেই কাজ করার ক্ষমতা বা সাহস বিএনপির মহাসচিবের নেই। কেননা, বিএনপিকে তখন তো বটেই, এখনো নেপথ্যে যাঁরা চালনা করছেন, তাঁরা সেই জঙ্গি চক্রের মদদদাতা। বাইরে গণতন্ত্রের কথা বললেও ভেতরে ভেতরে প্রতিহিংসা ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতিরই পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছেন। বিদেশে তাঁদের যাঁরা বন্ধু, তাঁরা গণতন্ত্র বোঝেন না। ষড়যন্ত্র বোঝেন, গ্রেনেড, বোমা মেরে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে পারেন। তার প্রমাণ দেশবাসী ২০০১-০৬-এ পেয়েছে। তাঁদের হাত অনেক লম্বা। এমনকি তাঁরা সীমান্তও মানেন না।
এখন খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার বিচার চান, অপরাধীদের শাস্তি চান, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মামলাকে ব্যবহার না করার সদুপদেশ দেন। কিন্তু ক্ষমতায় থাকতে যদি এই কথাগুলো উপলব্ধি করতেন, বলতেন, তাহলে দেশে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারত না। আমরা এও মনে করি, বিএনপির সবাই গ্রেনেড হামলাকারীদের প্রশ্রয় দেননি, যাঁরা দিয়েছেন, তাঁদের নাম কিন্তু বেরিয়ে আসছে। তদন্ত শেষ হলে বাকিদের নামও জানা যাবে। খোন্দকার দেলোয়ারকে অবশ্যই বলতে হবে, সেদিনের ঘৃণ্য সেই মানব হত্যায় তাঁর দলের কারা যুক্ত ছিলেন, কারা অপরাধীদের আড়াল করতে চেয়েছিলেন। তাতে ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ উন্মুক্ত হবে। দেশি-বিদেশি কোন চক্র বিচারের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল, সেই তথ্যও দেশবাসীকে জানাতে হবে। বিএনপির মহাসচিবের সদুপদেশ শুনে মনে হয়, আমাদের রাজনীতিকেরা বিরোধী দলে গেলে সাধু পুরুষ হয়ে যান। ভালো ভালো কথা বলেন। ক্ষমতায় থাকতে যদি তাঁরা এর সিকি ভাগও পালন করতেন, তাহলে দেশের এত দুর্গতি হয় না।
ছয় বছর পর এসে বিএনপির মহাসচিবের মুখে ২১ আগস্টের হত্যার বিচারে কথা শুনে তাঁকে একটি প্রশ্নই করতে ইচ্ছে হয়, বিচারটি অপনারা করলেন না কেন?। জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কবিতার ভাষায় বলতে হয়, ‘এত দিন কোথায় ছিলেন?’
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
যেমন ‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই’, তেমনি আরাফাত রহমান কোকোর প্যারোল বাতিল করে সরকার দেশবাসীকে জানিয়ে দিয়েছে, তিনি মুক্ত মানুষ নন। একজন বিচারাধীন কারাবন্দী। বিএনপির ভাষায়, ‘মহাষড়যন্ত্রকারী’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিশেষ অনুকম্পায় বিদেশে গিয়েছিলেন চিকিৎসার জন্য। সেই অনুকম্পার মেয়াদ মহাজোট সরকারও ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছে। বিএনপির নেতারা যে দাবি করেছেন, বর্তমান সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলেছে; অন্যান্য ক্ষেত্রে না হলেও এই একটি ক্ষেত্রে তাঁদের দাবি শতভাগ সত্য। না হলে গত ২০ মাস আরাফাত প্যারোলে আছেন কীভাবে?
খালেদা জিয়ার কনিষ্ঠ ছেলে রাজনীতি না করলেও জ্যেষ্ঠ ছেলে তারেক রহমান রাজনীতি করেন। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে তিনি ছিলেন দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তখন খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হলেও দেশ চলত তাঁর কথায়। দলীয় নেতা-মন্ত্রীরা দলবেঁধে তাঁর কাছে ধরনা দিতেন। এখন দেশ না চললেও বিএনপি তাঁর আদেশেই চলে। তিনি যেখানে যাকে চাইছেন থাকছেন, যাকে চাইছেন না বাদ পড়ছেন।
কয়েক দিন আগে বরিশালের দুই জাঁদরেল নেতা মজিবর রহমান সরোয়ার ও আহসান হাবীব কামাল ‘বড় ভাইয়ের’ আশীর্বাদ নিতে লন্ডন পর্যন্ত দৌড়াদৌড়ি করেছেন। তিনি তাঁদের কী আশীর্বাদ করেছেন জানা যায়নি, কিন্তু দেশবাসী অবাক বিস্ময়ে দেখল, দুই প্রতিদ্বন্দ্বী নেতার সমর্থকদের মধ্যে নয়াপল্টনের অফিসে রক্তারক্তি কাণ্ড। পণ্ড হলো কমিটি গঠনের উদ্দেশ্যে আয়োজিত নির্বাচনও। তারেক রহমান দেশে না থাকলেও বিএনপির নেতা-কর্মীরা তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছেন। তাঁরা জানেন, তাঁর ওপরই বিএনপির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে, এমনকি সর্বনাশও। অথচ দেশত্যাগের সময় তারেক রহমান বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিবের পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন। কে এবং কীভাবে সেই পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করলেন, সে সম্পর্কে বিএনপির নেতা-কর্মীরাও কিছু জানতেন না। শুধু বিএনপির কাউন্সিল অধিবেশনে দেখা গেল, তারেক রহমান জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব থেকে জ্যেষ্ঠ যুগ্ম চেয়ারম্যানে পদোন্নতি পেয়েছেন।
বিএনপির নেতা-কর্মীরা বড় ভাইয়ের কৃপালাভে লন্ডন পর্যন্ত দৌড়ঝাঁপ করলেও ছোট ভাইয়ের খুব একটা খোঁজখবর নিয়েছেন বলে জানা নেই। কেননা লন্ডন টিকিটের যে রিটার্ন মূল্য আছে, ব্যাংকক টিকিটের তা নেই। আরাফাত রহমান কোকো ব্যাংককে চিকিৎসাধীন। তাঁর চিকিৎসায় যত দিন প্রয়োজন, সরকারের উচিত হবে তত দিন তাঁকে প্যারোলে থাকার অনুমতি দেওয়া। না হলে বিএনপি এটিকে রাজনৈতিক ইস্যু করবে। এই মুহূর্তে সেটি করতে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বিএনপির হাতে এ মুহূর্তে তেমন ইস্যু নেই—মামলা, বাড়ি ও প্যারোল ছাড়া। তারা জনগণের সমস্যা নিয়ে ভাবিত নয়, নিজেদের সমস্যা নিয়েই ব্যস্ত।
কোকোর প্যারোল বাতিল হওয়ায় ইতিমধ্যে বিএনপি দুই দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। অন্যদিকে, ঢাকা পুলিশ কমিশনার পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত রাস্তায় মিছিল-সমাবেশ করা যাবে না বলে হুকুম জারি করেছেন। বিএনপি কি সেই হুকুম মেনে ঘরে চুপচাপ বসে থাকবে? সম্ভাবনা কম। তারা যদি সরকারি হুকুম অমান্য করে রাস্তায় নামার চেষ্টা করে, পুলিশ তার জবাবে যদি লাঠিপেটা করে, আর এর প্রতিক্রিয়ায় যদি গোলযোগ বা ভাঙচুরের মতো ঘটনা ঘটে, তখন পুরো নগরই অচল হয়ে পড়তে পারে। এতে মানুষের দুর্ভোগও বাড়বে। তারা সরকারের ওপর আরও বেশি ক্ষুব্ধ হবে। বিএনপির এই ফাঁদে সরকার পা দেবে না বলেই আমাদের বিশ্বাস।
একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তিকে নিয়ে রাজনৈতিক পরিবেশ গরম হবে, সেটি কারও কাম্য নয়। তবে সেই সঙ্গে এটিও জানাতে হবে, আরাফাত রহমানের চিকিৎসা শেষ হতে কত দিন লাগবে? তাঁর অসুখটা আসলে কী? বিএনপির নেতারা তারেক রহমানের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। কিন্তু আরাফাতের ব্যাপারে একেবারে নীরব। সাবেক প্রধানমন্ত্রী জোর গলায় প্রচার করেন, ‘বাংলাদেশ ছাড়া আমার কোনো দেশ নেই। এখানে জন্মেছি, এখানেই মরব।’ কিন্তু তাঁর ছেলেদের চিকিৎসার জন্য অনির্দিষ্টকাল বিদেশে থাকতে হবে কেন? বাংলাদেশে কি চিকিৎসা নেই?
২.
বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, তাঁরাও ২১ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচার চান। একই সঙ্গে তিনি মামলাটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, ২১ আগস্টের ঘটনায় বিএনপির নেতাদের জড়ালে তাঁরা মুখ বুজে মেনে নেবেন না। দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে রাজপথে আন্দোলন করবেন।
বিএনপির মহাসচিবের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে আমরা দুটি তথ্য পাই। এক. তাঁরা ২১ আগস্টের ঘৃণ্য গ্রেনেড হামলা ও হত্যাযজ্ঞের বিচার চান। দুই. মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না।
খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন কেবল বিএনপির মহাসচিব নন, একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিক ও আইনজীবীও বটে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে খালেদা জিয়ার মামলা করতে তিনিও আইনজীবীর পোশাক পরে আদালতে দাঁড়িয়েছিলেন। আইনকানুন তিনি ভালোই জানেন। তবে মানতে চান না।
বিএনপির মহাসচিব নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনাটি যখন ঘটে, তখন আওয়ামী লীগ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় ছিল না, ক্ষমতায় ছিল বিএনপি-জামায়াত জোট। ২০০৪-এর ২১ আগস্ট হামলার ঘটনা ঘটে, তারা ক্ষমতা ছাড়ে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর। দুই বছরেরও বেশি সময় পেয়েছে বিএনপি সরকার। এই সময়ে তদন্তকাজটিও শেষ হলো না কেন? একজন আসামিকেও ধরতে পারল না কেন?
খোন্দকার দেলোয়ারের কথাটি খুবই নিরীহ ও নির্ভেজাল। যে ঘৃণ্য গ্রেনেড হামলার ঘটনায় আওয়ামী লীগের নেত্রী আইভি রহমানসহ ২২ জন জীবন দিয়েছেন, শতাধিক লোক আহত হয়েছেন, তার বিচার চেয়ে বিএনপি এখন দায়িত্বশীল বিরোধী দল হিসেবেই প্রমাণ করতে চাইছে। মামলাটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের বিরুদ্ধে দেলোয়ারের হুঁশিয়ারির সঙ্গেও কেউ দ্বিমত করবেন না।
এখন কথা হলো, মামলাটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের কাজটি কে শুরু করেছিল? আওয়ামী লীগ, না বিএনপি? কারা সেদিন আক্রমণকারীকে না ধরে আক্রান্তের ওপরই দায় চাপানোর চেষ্টা করেছিল? কারা দ্রুত ঘটনার আলামত নষ্ট করে দিয়েছিল? প্রকৃত অপরাধীদের বাঁচাতে কারা জজ মিয়া কাহিনি ফেঁদেছিল? কাদের অসহযোগিতার কারণে বিদেশি তদন্ত কর্মকর্তারা তদন্তকাজ শেষ না করেই চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন? কারা সেদিন সংসদের বাইরে ও ভেতরে গরম বক্তৃতা দিয়ে আওয়ামী লীগের কাঁধে দায় চাপাতে চেয়েছিল? কারা পাকিস্তানি জঙ্গিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আর্জেস গ্রেনেড নিয়ে এসেছিল? কোন দলের মন্ত্রীর বাসায় গ্রেনেডবাজদের বৈঠক হয়েছিল? কারা বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের নামে আজগুবি তথ্য হাজির করেছিল? কারা প্রচার চালিয়েছিল, বাংলাদেশে যত বোমা হামলা হয়েছে, সবগুলোর পেছনে শেখ হাসিনা ও ভারত আছে? সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তে নিশ্চয়ই সবকিছু বেরিয়ে আসবে। তবে মনে রাখা প্রয়োজন, ২১ আগস্টের ঘটনা নিয়ে এখনো নানা মহল অপপ্রচার চালাচ্ছে। ন্যায় বিচারের স্বার্থে এদের স্বরূপ উন্মোচন করতে হবে।
বিএনপির মহাসচিব দাবি করেছেন, এ ঘটনায় তাঁদের দলের কোনো নেতা-কর্মী জড়িত নন। তাহলে কেন তাঁরা অপরাধীদের রক্ষা করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন? কেন তদন্ত কর্মকর্তাদের মুখ বন্ধ করা হয়েছিল নানা চাপ ও প্রলোভন দিয়ে? যাঁরা এসব করেছেন, তাঁরা খোন্দকার দেলোয়ারের খুব কাছের লোক। কেউ নেতা, কেউ মন্ত্রী ছিলেন। ২১ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবির আগে দলের সেই নেতা ও সাবেক মন্ত্রীদের নাম প্রকাশ করতে হবে। তাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। দল থেকে বহিষ্কার করতে হবে।
আমরা জানি, সেই কাজ করার ক্ষমতা বা সাহস বিএনপির মহাসচিবের নেই। কেননা, বিএনপিকে তখন তো বটেই, এখনো নেপথ্যে যাঁরা চালনা করছেন, তাঁরা সেই জঙ্গি চক্রের মদদদাতা। বাইরে গণতন্ত্রের কথা বললেও ভেতরে ভেতরে প্রতিহিংসা ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতিরই পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছেন। বিদেশে তাঁদের যাঁরা বন্ধু, তাঁরা গণতন্ত্র বোঝেন না। ষড়যন্ত্র বোঝেন, গ্রেনেড, বোমা মেরে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে পারেন। তার প্রমাণ দেশবাসী ২০০১-০৬-এ পেয়েছে। তাঁদের হাত অনেক লম্বা। এমনকি তাঁরা সীমান্তও মানেন না।
এখন খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার বিচার চান, অপরাধীদের শাস্তি চান, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মামলাকে ব্যবহার না করার সদুপদেশ দেন। কিন্তু ক্ষমতায় থাকতে যদি এই কথাগুলো উপলব্ধি করতেন, বলতেন, তাহলে দেশে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারত না। আমরা এও মনে করি, বিএনপির সবাই গ্রেনেড হামলাকারীদের প্রশ্রয় দেননি, যাঁরা দিয়েছেন, তাঁদের নাম কিন্তু বেরিয়ে আসছে। তদন্ত শেষ হলে বাকিদের নামও জানা যাবে। খোন্দকার দেলোয়ারকে অবশ্যই বলতে হবে, সেদিনের ঘৃণ্য সেই মানব হত্যায় তাঁর দলের কারা যুক্ত ছিলেন, কারা অপরাধীদের আড়াল করতে চেয়েছিলেন। তাতে ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ উন্মুক্ত হবে। দেশি-বিদেশি কোন চক্র বিচারের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল, সেই তথ্যও দেশবাসীকে জানাতে হবে। বিএনপির মহাসচিবের সদুপদেশ শুনে মনে হয়, আমাদের রাজনীতিকেরা বিরোধী দলে গেলে সাধু পুরুষ হয়ে যান। ভালো ভালো কথা বলেন। ক্ষমতায় থাকতে যদি তাঁরা এর সিকি ভাগও পালন করতেন, তাহলে দেশের এত দুর্গতি হয় না।
ছয় বছর পর এসে বিএনপির মহাসচিবের মুখে ২১ আগস্টের হত্যার বিচারে কথা শুনে তাঁকে একটি প্রশ্নই করতে ইচ্ছে হয়, বিচারটি অপনারা করলেন না কেন?। জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কবিতার ভাষায় বলতে হয়, ‘এত দিন কোথায় ছিলেন?’
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments