কতটা দূরে হলে নিরাপদ দূরত্ব হয়? by হায়দার আকবর খান রনো

গত ২৯ মে একই সঙ্গে পর পর তিনটি ঘটনা। সব কয়টিই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের গুরুতর উদ্বেগ ও আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথম ঘটনাটি হলো আদালত এলাকায় পুলিশ কর্তৃক এক তরুণীর শ্লীলতাহানির ঘটনা। দ্বিতীয় ঘটনাটি হলো সেই তরুণীর কাছ থেকে সাংবাদিক ও আইনজীবীরা যখন অভিযোগের বিবরণ শুনছিলেন, তখন অতর্কিতে সাংবাদিক ও আইনজীবীদের ওপর পুলিশি হামলা।


সাংবাদিকরা যখন পুলিশি বর্বরতার শিকার হন, তখন দেশে বাকস্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ কতটুকু আছে, সেই প্রশ্নও উঠে আসে। অতএব গুরুতর বিষয় বৈকি। তৃতীয় ঘটনাটি হলো, এসব বিষয় যখন তীব্র সমালোচনায় উঠে এসেছে, তখন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু সাংবাদিকদের পুলিশ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। মন্ত্রীর পরামর্শ এবং একেবারে নতুন ধরনের পরামর্শ, তাকে তো গুরুত্ব না দিয়ে পারা যায় না। ঘটনা তিনটি কাছাকাছি এবং একই সূত্রে বাধা হলেও তিনটি স্বতন্ত্র ঘটনা। কোনটাকে নিয়ে আলোচনা শুরু করা যেতে পারে?
আমার মনে হয়, যেহেতু নির্যাতিত নারী অথবা আহত সাংবাদিকের চেয়ে মন্ত্রী মহোদয় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, সেহেতু মন্ত্রীর কথা দিয়েই আলোচনা শুরু করা যাক। মন্ত্রী মহোদয় পরামর্শটি একেবারে খারাপ দেননি। কারণ নিয়ন্ত্রণহীন ও বেপরোয়া পুলিশ এখন কী করে বসে তার ঠিক নেই। অতএব পুলিশ থেকে দূরে থাকলে অন্তত লাঠির বাড়ি, মিথ্যা মামলা, হাজতবাস, হাজতে নির্যাতন- এসব থেকে তো রেহাই পাওয়া যাবে! মন্ত্রী মহোদয় সরল বিশ্বাসে কথাগুলো বলেছেন বলে আমরা ধরে নিতে পারি। কারণ তিনি নিঃসন্দেহে দেশের একজন অতীব সম্মানিত ব্যক্তি।
আমরা এতকাল শুনে এসেছি যে জনগণের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব পুলিশের। কিন্তু সেটা যে কথার কথা মাত্র, বাস্তবে পুলিশ যে কী ভয়ংকর জিনিস তা ভুক্তভোগীরাই শুধু নয়, সাধারণ মানুষও বোঝে। এই যে পুলিশ ক্লাবে নিয়ে গিয়ে শ্লীলতাহানির অভিযোগ উঠেছে, এটা কি নতুন কিছু? পুলিশ হেফাজতে নিয়ে মারধর করা, তারও বহু অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। আবার প্রহারেরও নানা ধরনের ডিগ্রি আছে। কেউ গ্রেপ্তার হলে প্রথমে তদবির করতে হয় আসামিকে যেন শারীরিক নির্যাতন না করা হয়। এর জন্য বিভিন্ন থানায় নির্দিষ্ট অঙ্কের 'ফি' নির্ধারণ করা আছে। কালের কণ্ঠে পর পর কয়েকটি সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে ঢাকার বিভিন্ন থানার রাতের কারবারের রিপোর্ট ছাপা হয়েছে। সেখানেও যে চিত্র আমরা পেয়েছি, তাতে মনে হয় যত দূর সম্ভব পুলিশ থেকে দূরে থাকাই উচিত। কথায় বলে বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, আর পুলিশ ছুঁলে নাকি ছত্রিশ ঘা। তাহলে পুলিশ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকাটাই কি বুদ্ধিমানের কাজ নয়? পুলিশের মন্ত্রী হয়ে জনাব টুকু এটা ভালো করেই জানেন। তাই সাংবাদিকদের তিনি সৎ উপদেশ দিয়েছেন। দূরে থাকো, পুলিশ থেকে দূরে থাকো।
সাংবাদিকদের কাজ রিপোর্ট সংগ্রহ করা, বিশেষ ঘটনার ছবি তোলা ইত্যাদি। এই কাজ ঝুঁকিপূর্ণ। এ কাজ করতে গিয়ে এ পর্যন্ত বহু সাংবাদিককে পুলিশের নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। বিশেষ রিপোর্ট সংগ্রহ এবং প্রতিবেদন প্রকাশ করার জন্য পুলিশ ও সরকারের হুমকি-হামলা ছাড়াও স্বার্থান্বেষী সন্ত্রাসীদেরও আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছে। এই তো কয় দিন আগে, আদালতপাড়ার ঘটনার মাত্র তিন দিন আগে পুলিশের হামলায় তিন ফটোসাংবাদিক আহত হয়েছিলেন ঢাকার আগারগাঁওয়ে। কালের কণ্ঠের প্রতিবেদন অনুযায়ী বর্তমান সরকারের সাড়ে তিন বছরের রাজত্বকালে ১৩ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন এবং হামলার শিকার হয়েছেন পাঁচ শতাধিক। সংখ্যাটি নেহাত কম নয়। তাই আতঙ্কের কারণ আছে বৈকি। সম্ভবত এটা জেনেই মন্ত্রী মহোদয় সহানুভূতির সঙ্গে বলেছেন, 'আমি আমার সাংবাদিক বন্ধুদের বলব, তাঁরা যদি পুলিশের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করে সংবাদ সংগ্রহ বা ফটো নেন, তবে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে পারেন। আমি আপনাদের কাছ থেকে আশা করব, আপনারা এটা বিবেচনা করবেন।'
আমরা এটাকে বাস্তবসম্মত সৎ উপদেশ বলে মেনে নিতে পারতাম। কিন্তু মুশকিল বাধিয়েছেন জনাব টুকুর ওপরের মন্ত্রী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর এই বক্তব্য দেওয়ার পরদিনই সাহারা খাতুন বললেন ঠিক বিপরীত কথা। তিনি বললেন, 'পুলিশ এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়ে গেছে।' তাহলে এখন আর ভয় নেই, নিরাপদ দূরত্বে নয়, কাছে থেকেই সাংবাদিকরা তাঁদের কর্তব্য করতে পারবেন। সাহারা খাতুনের বক্তব্যে জনাব টুকুর বক্তব্যটি বাতিল হয়ে গেল।
সরল বিশ্বাসে প্রতিমন্ত্রী যে বাস্তবসম্মত উপদেশ দিতে পারেন, এটা বড় মন্ত্রীর কথায় যেমন অস্বীকৃত হয়ে যাচ্ছে; তেমনি বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থাও তা মানতে পারছে না। তাই দেখি, সমালোচনার ঝড় উঠেছে। হংকংভিত্তিক এশিয়ান মানবাধিকার কমিশন বরং জনাব টুকুর এ বক্তব্যকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করে বলছে যে ওই বক্তব্যের মাধ্যমে মন্ত্রী নিজেই নির্যাতন অনুমোদন করেছেন। ওই মানবাধিকার কমিশন অবশ্য 'নিরাপদ দূরত্ব' কত দীর্ঘ, সেই প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। তাদের মতে, নির্যাতনের মাত্রা ও প্রবণতা এত বেড়ে গেছে যে কেউ কোথাও নির্যাতন থেকে নিরাপদ নয়। তারা বলেছে, সত্যিকারার্থে বাংলাদেশের জাতীয় ভূখণ্ড থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত কোনো দূরত্বই 'নিরাপদ দূরত্ব' নয়। এশিয়ান মানবাধিকার কমিশনের পর্যবেক্ষণ এই যে পুলিশ, র‌্যাব, নিরাপত্তা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাজ হচ্ছে নির্যাতন চালানো এবং এটাই তাদের 'সরকারি' কাজ।
আরো একটি কারণেও জনাব টুকুর উপদেশ মানা সম্ভব হচ্ছে না। নিরাপদ দূরত্বে থাকলেও পুলিশ নিজেই এসে উপস্থিত হয়। যেমন- সেদিনের আদালতপাড়ার ঘটনার কথাই ধরা যাক। ধারে-কাছে পুলিশ ছিল না। যার শ্লীলতাহানির চেষ্টা হয়েছিল, সেই লাঞ্ছিত নারী সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ জানাচ্ছিলেন। ধারে-কাছে কিন্তু পুলিশ ছিল না। সাংবাদিক ও আইনজীবীরা 'নিরাপদ দূরত্বে'ই অবস্থান করছিলেন। এমন সময় অকস্মাৎ পুলিশ এসে হাজির। এরপর বেধড়ক পিটুনি। আহত হয়েছেন কালের কণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন ও প্রথম আলোর তিন সাংবাদিক এবং আরো দুজন আইনজীবী। কালের কণ্ঠের রিপোর্ট অনুসারে (৩০ মে) লাঠিপেটা চলাকালে ওসি সালাউদ্দিন সাংবাদিকদের উদ্দেশে উচ্চ স্বরে বলছিলেন, 'আমাকে এসি শহীদ পাওনি। আমার বাড়ি গোপালগঞ্জে। আন্দোলন কাকে বলে আজ শিখিয়ে দিচ্ছি।'
তাহলে বিশেষ বিশেষ পুলিশের উদ্ধত মেজাজ ও বেপরোয়া আচরণের একটা কারণ খুঁজে পাওয়া গেল। যে এসি শহীদ আগারগাঁওয়ে সাংবাদিক পিটিয়ে পরে সাময়িক বরখাস্ত হয়েছিলেন, তাঁর বাড়ি গোপালগঞ্জে নয়, অন্যত্র। কালের কণ্ঠে প্রতিবেদনে তাই আরো বলা হয়েছে, 'বিশেষ এলাকার লোক হওয়ার কারণে তাঁরা (বিশেষ পুলিশ সদস্য) ঊধ্বর্তন কর্মকর্তাদেরও তোয়াক্কা করেন না। এ কারণেই ধানমণ্ডি থানার ওসি প্রকাশ্যে সাংবাদিককে প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছেন।'
পুলিশ থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করা সম্ভব হলে ভালো। কিন্তু বাস্তবে প্রায়ই তা হয়ে ওঠে না। যেমন ধরা যাক, সেদিনের আদালতপাড়ার ঘটনাটি। শ্লীলতাহানির পর সেই তরুণী কী করতে পারতেন। মুখ বুজে অপমান মেনে নিতে পারতেন। কিন্তু লাঞ্ছিত তরুণী প্রতিবাদ করতে চেয়েছেন, অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ? এটা কি পুলিশ মেনে নেবে। তাই শুধু বেপরোয়া লাঠিপেটাই নয়, সেই তরুণী, তাঁর বাবা ও দুজন আইনজীবীকে পুলিশের গাড়িতে তুলে কোতোয়ালি থানায় নিয়ে আরো নির্যাতন করা হয়েছে। উল্টো অভিযোগকারীকে আটক রাখা হয়েছিল। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সুলতানা কামাল স্বীয় প্রভাব খাটিয়ে তরুণী ও তাঁর বাবাকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
র‌্যাব, পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার বেপরোয়া কারবার, গুম-খুন, পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এখন যে মাত্রায় বেড়েছে, তাতে জনমনে বিরাজ করছে দুর্বিষহ আতঙ্ক। পুলিশের কাছ থেকে ইচ্ছা করলেও সব সময় দূরে থাকা যায় না। আবার কাছে গেলেও বিপদ। পুলিশ ছুঁলে যে ছত্রিশ ঘা।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুর উপদেশটুকু আমরা মেনে নিতে রাজি আছি, যদি তিনি আরো একটু ব্যাখ্যা করে বলেন যে কত দূরে থাকলে সেটাকে নিরাপদ দূরত্ব বলে গণনা করা যায়। কাজে-অকাজে পুলিশের কাছে যেতে হয়। সাংবাদিকরাও পুলিশকে এড়িয়ে চলতে পারেন না। তাই 'নিরাপদ দূরত্ব' পরিমাপ করা বেশ কঠিন ব্যাপার বৈকি।
অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন আমাদের আশ্বস্ত করেছেন এই বলে যে পুলিশ এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়ে গেছে। কত ভালো হয়েছে, এটা আরো ব্যাখ্যা করলে আমাদের জন্য ভালো হতো। আমরা বুঝতে পারতাম, পুলিশ থেকে কতটা দূরত্ব রক্ষা করা দরকার। পুলিশ কর্তৃক কোনো নারীর শ্লীলতাহানির মতো ঘটনা ঘটবে না, বেপরোয়া হয়ে পুলিশ মানুষ পেটাবে না, বন্দিশিবিরে নির্যাতন চালাবে না অথবা ক্রসফায়ার, গুম ইত্যাদির সঙ্গে আর জড়িত থাকবে না? এমন নিশ্চয়তা কি পেতে পারি? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া খুব জরুরি। কারণ ব্যাপারটা শুধুই পুলিশি ব্যাপার নয়, শুধুই ল অ্যান্ড অর্ডারের বিষয় নয়, এর সঙ্গে রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ও বিশ্বাসের বিষয়টিও জড়িত। অর্থাৎ পুলিশি নির্যাতন তথা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এখন যে পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, তা রাজনৈতিক এজেন্ডায় চলে এসেছে। এর ওপর গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎও বহুলাংশে নির্ভর করছে।
লেখক : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.