জন্মদিন-‘আমি সাক্ষী মাত্র’ by ইসরাত জাহান
খালেদ চৌধুরীকে কি মনে আছে কারও? এখন যারা বড় হচ্ছে কিংবা কিছুটা বড় হয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে, তাদের পক্ষে খালেদ চৌধুরীকে চেনা কঠিন। আবার পশ্চিমের দিকে হেলে পড়েছে যাঁদের জীবন, তাঁদেরও অনেকে নামটির সঙ্গে পরিচিত নন। প্রচারবিমুখ মানুষ তিনি।
কে তাঁকে চিনল, কে চিনল না, তা নিয়ে কখনই মাথা ঘামাননি, ফলে লেখার শুরুতে করা প্রশ্নটিতে গলদ আছে।
আমরা বরং বলতে পারি, খালেদ চৌধুরীর কথা শুনতে চান? এ রকম মানুষ খুব একটা খুঁজে পাবেন না। চলুন না, তাঁর সঙ্গে পরিচিত হই। আমাদের সৌভাগ্য, তিনি আছেন এবং কাজ করে চলেছেন। আজ তাঁর জন্মদিন। ৭৯তে পা দিলেন খালেদ চৌধুরী।
সাংবাদিক ফয়েজ আহমদের মধ্যরাতের অশ্বারোহী বইটিতে খালেদ চৌধুরীর যে ছবি আঁকা আছে, আসুন, সে ছবির সঙ্গেও পরিচিত হয়ে নিই। তিনি লিখছেন, ‘...অর্থ-সম্পদ ও গতানুগতিক জীবনধারার প্রতি তাঁর ছিল গভীর অবিশ্বাস। জীবনের প্রতি বৈরাগ্য, গ্রন্থাগারে সকাল-সন্ধ্যা, রুজিতে অরুচি—তিনি যেন ঊনবিংশ শতাব্দীর ফরাসি চিত্রকর কুর্বের আধুনিক শিষ্য। আশা করি, এখন বুঝতে পারছেন, আমরা কার কথা বলছি। ফয়েজ আহমদের আঁকা ছবিটিতে আপাদমস্তক একজন বোহেমিয়ান মানুষকেই কি আমরা দেখছি না?
সম্প্রতি খালেদ চৌধুরী গিয়েছিলেন বিউটি বোর্ডিংয়ে। তরুণ বেলায় এখানে ঢের আড্ডা দিয়েছেন। এখন, এই বার্ধক্যে একই জায়গায় এসে আড্ডা দিতে কেমন লাগল, সে কথা জানতে গিয়েই ছড়িয়ে যেতে থাকে গল্পের ডালপালা। গল্পের শিকড় বিস্তৃত হয় আরও গভীরে।
‘বলুন না আপনার কথা।’—এভাবেই শুরু হয় আমাদের কথোপকথন।
‘আমি আর কী বলব। আমি সাধারণ একজন মানুষ। সময় পরিবর্তনে কিংবা ইতিহাস তৈরিতে আমার কোনো ভূমিকা নেই। কিন্তু এ দেশ ভাগ, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের মতো প্রতিটি ঘটনা কিংবা এ দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ব্যক্তির জীবনের সাক্ষী আমি। আর কিছু নই। আমি সাক্ষী মাত্র। আমার জীবনের গৌরবই হচ্ছে আমার বন্ধুরা। আমার বন্ধুবান্ধব খুব ভালো।’
দীর্ঘদিনের যাতায়াতে দেখেছি, তাঁর ঘরভরা বই, ছোট্ট উঠান, অতি সাধারণ জীবনে বোধের প্রচণ্ড ঐশ্বর্য।
আড্ডার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বললেন, ‘শুধু বিউটি বোর্ডিং নয়। ঢাকা শহরে তখন অনেক আড্ডা ছিল। কোনো কোনো আড্ডা তো বিউটি বোর্ডিংয়ের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আড্ডাগুলো তো সাধারণত উদ্দেশ্যহীন ভ্রমণের মতো হয়। তবে আমি যেসব আড্ডায় যেতাম, সেগুলো ঠিক সে রকম ছিল না। ওই সময় ওয়াহিদুল হকের বাড়িতে, সওগাত অফিসে, ক্যাপিটাল রেস্টুরেন্টে বড় বড় আড্ডা হতো। ওয়াহিদুলদের বাড়ির আড্ডায় প্রচুর খাওয়া-দাওয়া হতো। সওগাত অফিসের আড্ডায় আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দিন, ফয়েজ আহমদসহ প্রায় ৩০-৩৫ জন যেতেন প্রতিদিন। অথচ তাঁদের মধ্যে একমাত্র হাসান হাফিজুর রহমান ছাড়া আর কেউ পত্রিকা অফিসটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। ক্যাপিটাল রেস্টুরেন্টের আড্ডাটা তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নবাবপুরের শেষ প্রান্তে ছিল এটা। তখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন চলছিল। যাঁরা জেল থেকে বের হতেন, মুক্তি পেয়েই ওখানে ঢুঁ মারতেন। এতেই শহরে চাউর হয়ে যেত তাঁর মুক্তির খবর। আবার কেউ ধরা পড়লেও ওখানেই তাঁর সঙ্গী-সাথীরা খবরটা দিয়ে যেতেন। তারপর জুড়িনগরে জোহা সাহেবের বাসায় অগত্যা পত্রিকাকে কেন্দ্র করেও আড্ডা হতো। ১৯৪৮-৪৯ সালের কথা এগুলো।’
আবার বলতে থাকেন খালেদ চৌধুরী, ‘ফজলে লোহানী আর মুস্তাফা নুর-উল ইসলাম বাংলাবাজারে ‘বুকস অ্যান্ড বুকস’ নামে একটি বইয়ের দোকান করেন। ওটার আলমারির পেছনে বসে আমি পড়তাম। ওই দোকানকে কেন্দ্র করেও ঢাকার পড়ুয়াদের একটা আড্ডা হতো। ছিল গোবিন্দ ধাম। একটা চায়ের দোকান। সেখানে আসতেন বিপ্লবী দিনেশ সেন। এভাবেই আড্ডায় আড্ডায় আমার দিন কাটত। আমার ক্ষেত্রে কেউ কেউ ‘বোহেমিয়ান’ শব্দটা ব্যবহার করে। কিন্তু এটা সত্যি, আমি কোনো দিন খারাপ খাইনি, খারাপ বিছানায় ঘুমাইনি। ঢাকা শহরের নামকরা লন্ড্রি ঠিক করা ছিল আমার জন্য। পানের দোকান ঠিক করা ছিল। কে টাকা দিত জানতাম না। কিন্তু দোকানগুলোতে বাকি কোনো দিন হয়নি, তা জানতাম।’
লেখাপড়ার বিষয়ে জানতে চাই।
‘আমার প্রাতিষ্ঠানিক কোনো লেখাপড়া নেই। দুইবার স্কুলে ভর্তি হই। কিন্তু দাঙ্গার কারণে কোনোবারই ক্লাস করা হয়নি। এরপর একেবারে আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠা হলে সেখানে ভর্তি হই। আমি ছিলাম আর্ট কলেজের প্রথম ব্যাচের প্রথম ছাত্র। কিন্তু ওখানে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার পর আমার মনোযোগ আঁকাআঁকি থেকে লাইব্রেরিটার দিকেই বেশি ঝুঁকে যায়। আমার আর আর্ট কলেজেও পড়া হয়নি।’
আমাদের প্রচলিত সমাজে আটপৌরে জীবনের ছক ভেঙে কর্মজীবনেও নিজেকে স্রোতের বাইরে প্রতিষ্ঠিত করেন খালেদ চৌধুরী। ১৯৫৯ সালের দিকে সৈয়দ শামসুল হক ও আলমগীর কবিরের সূত্রে সোভিয়েত কনসুলেটের প্রেস ইনফরমেশন বিভাগে দ্বিতীয় প্রধান অনুবাদক হিসেবে কাজ পান। সে সময় কনসুলেটের তথ্য বিভাগটির প্রধান ছিলেন আলেকসান্দর কোলেবিস্ক। তিনি আগে থেকেই খালেদ চৌধুরীর পাণ্ডিত্য সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তাঁকে দেখেই কোলেবিস্ক সেদিন বলে উঠেছিলেন, ‘আরে আমি তো তোমার জন্য দেড় ঘণ্টা ধরে বসে আছি। তুমি আমাদের সঙ্গে কাজ করছ জেনে খুব খুশি হলাম।’ তাঁর এ বয়ান শুনলাম খোদ খালেদ চৌধুরীর কাছ থেকেই। তথ্য বিভাগের প্রধানের এই আন্তরিক সম্ভাষণের পর কিছু আর বলার ছিল না এত দিন বাউণ্ডুলে জীবন কাটানো মানুষটির। এখানে কাজ করার সময়ই তিনি ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেন আউট লাইন হিস্ট্রি অফ কমিট্রান, জামিলা ইত্যাদি। খালেদ চৌধুরী জানান, তাঁর করা অনুবাদের মধ্যে গোপনীয় নথিপত্র একটা বিরাট অংশ জুড়ে ছিল। তবে তিনি বলেন, ‘যত যাই করি, সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেয়েছি ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়া খানকে যুদ্ধ বন্ধ করতে হুমকি দিয়ে তত্কালীন সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট পদগোর্নির লেখা চিঠিটি অনুবাদ করে। সেটা এপ্রিল মাসের কথা। অফিসে গিয়েছিলাম চাকরি ছাড়তে। সে সময়কার কনসুলেট প্রধান ডেকে নিয়ে বললেন, ‘চাকরি ছাড়বে ভালো কথা, আগে এটা অনুবাদ করো।’ দেখি টেলিপ্রিন্টারে একটি লেখা এসেছে। ‘সেটাই ছিল ওই ঐতিহাসিক চিঠি।’
১৯৭৪ সালে সোভিয়েত দূতাবাস থেকে আবার তাঁর ডাক আসে দাস ক্যাপিটাল অনুবাদের জন্য। এবার মস্কো যান তিনি। সেই দলে ছিলেন দ্বিজেন শর্মা, হায়াৎ মামুদ প্রমুখ। কিন্তু বছর খানেকের মধ্যেই দেশের জন্য অস্থির হয়ে সব ছেড়ে আবার নিজ মাটিতে ফেরেন তিনি। এরপর ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত তিনি সোভিয়েত দূতাবাসের তথ্য ও প্রচার বিভাগের প্রধান অনুবাদক হিসেবে কাজ করেন। এরপর ১৯৯৫ সাল থেকে প্রশিকায় টানা ১১ বছর ভাষাবিষয়ক সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন।
জীবনের চড়াই-উত্রাই পেরিয়ে আসা সৌম্য মানুষটির দিকে তাকিয়ে খুব জানতে ইচ্ছা করে, এখনকার অস্থিরতা তাঁকে অশান্ত করে কি না।
বললেন, ‘না। নিজের দুঃখ-কষ্টকে সবার সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে অস্থিরতা আসে না। আর মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই আশাবাদী হতে বাধ্য। তাই আমিও আশাবাদী।’
আমরা বরং বলতে পারি, খালেদ চৌধুরীর কথা শুনতে চান? এ রকম মানুষ খুব একটা খুঁজে পাবেন না। চলুন না, তাঁর সঙ্গে পরিচিত হই। আমাদের সৌভাগ্য, তিনি আছেন এবং কাজ করে চলেছেন। আজ তাঁর জন্মদিন। ৭৯তে পা দিলেন খালেদ চৌধুরী।
সাংবাদিক ফয়েজ আহমদের মধ্যরাতের অশ্বারোহী বইটিতে খালেদ চৌধুরীর যে ছবি আঁকা আছে, আসুন, সে ছবির সঙ্গেও পরিচিত হয়ে নিই। তিনি লিখছেন, ‘...অর্থ-সম্পদ ও গতানুগতিক জীবনধারার প্রতি তাঁর ছিল গভীর অবিশ্বাস। জীবনের প্রতি বৈরাগ্য, গ্রন্থাগারে সকাল-সন্ধ্যা, রুজিতে অরুচি—তিনি যেন ঊনবিংশ শতাব্দীর ফরাসি চিত্রকর কুর্বের আধুনিক শিষ্য। আশা করি, এখন বুঝতে পারছেন, আমরা কার কথা বলছি। ফয়েজ আহমদের আঁকা ছবিটিতে আপাদমস্তক একজন বোহেমিয়ান মানুষকেই কি আমরা দেখছি না?
সম্প্রতি খালেদ চৌধুরী গিয়েছিলেন বিউটি বোর্ডিংয়ে। তরুণ বেলায় এখানে ঢের আড্ডা দিয়েছেন। এখন, এই বার্ধক্যে একই জায়গায় এসে আড্ডা দিতে কেমন লাগল, সে কথা জানতে গিয়েই ছড়িয়ে যেতে থাকে গল্পের ডালপালা। গল্পের শিকড় বিস্তৃত হয় আরও গভীরে।
‘বলুন না আপনার কথা।’—এভাবেই শুরু হয় আমাদের কথোপকথন।
‘আমি আর কী বলব। আমি সাধারণ একজন মানুষ। সময় পরিবর্তনে কিংবা ইতিহাস তৈরিতে আমার কোনো ভূমিকা নেই। কিন্তু এ দেশ ভাগ, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের মতো প্রতিটি ঘটনা কিংবা এ দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ব্যক্তির জীবনের সাক্ষী আমি। আর কিছু নই। আমি সাক্ষী মাত্র। আমার জীবনের গৌরবই হচ্ছে আমার বন্ধুরা। আমার বন্ধুবান্ধব খুব ভালো।’
দীর্ঘদিনের যাতায়াতে দেখেছি, তাঁর ঘরভরা বই, ছোট্ট উঠান, অতি সাধারণ জীবনে বোধের প্রচণ্ড ঐশ্বর্য।
আড্ডার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বললেন, ‘শুধু বিউটি বোর্ডিং নয়। ঢাকা শহরে তখন অনেক আড্ডা ছিল। কোনো কোনো আড্ডা তো বিউটি বোর্ডিংয়ের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আড্ডাগুলো তো সাধারণত উদ্দেশ্যহীন ভ্রমণের মতো হয়। তবে আমি যেসব আড্ডায় যেতাম, সেগুলো ঠিক সে রকম ছিল না। ওই সময় ওয়াহিদুল হকের বাড়িতে, সওগাত অফিসে, ক্যাপিটাল রেস্টুরেন্টে বড় বড় আড্ডা হতো। ওয়াহিদুলদের বাড়ির আড্ডায় প্রচুর খাওয়া-দাওয়া হতো। সওগাত অফিসের আড্ডায় আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দিন, ফয়েজ আহমদসহ প্রায় ৩০-৩৫ জন যেতেন প্রতিদিন। অথচ তাঁদের মধ্যে একমাত্র হাসান হাফিজুর রহমান ছাড়া আর কেউ পত্রিকা অফিসটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। ক্যাপিটাল রেস্টুরেন্টের আড্ডাটা তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নবাবপুরের শেষ প্রান্তে ছিল এটা। তখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন চলছিল। যাঁরা জেল থেকে বের হতেন, মুক্তি পেয়েই ওখানে ঢুঁ মারতেন। এতেই শহরে চাউর হয়ে যেত তাঁর মুক্তির খবর। আবার কেউ ধরা পড়লেও ওখানেই তাঁর সঙ্গী-সাথীরা খবরটা দিয়ে যেতেন। তারপর জুড়িনগরে জোহা সাহেবের বাসায় অগত্যা পত্রিকাকে কেন্দ্র করেও আড্ডা হতো। ১৯৪৮-৪৯ সালের কথা এগুলো।’
আবার বলতে থাকেন খালেদ চৌধুরী, ‘ফজলে লোহানী আর মুস্তাফা নুর-উল ইসলাম বাংলাবাজারে ‘বুকস অ্যান্ড বুকস’ নামে একটি বইয়ের দোকান করেন। ওটার আলমারির পেছনে বসে আমি পড়তাম। ওই দোকানকে কেন্দ্র করেও ঢাকার পড়ুয়াদের একটা আড্ডা হতো। ছিল গোবিন্দ ধাম। একটা চায়ের দোকান। সেখানে আসতেন বিপ্লবী দিনেশ সেন। এভাবেই আড্ডায় আড্ডায় আমার দিন কাটত। আমার ক্ষেত্রে কেউ কেউ ‘বোহেমিয়ান’ শব্দটা ব্যবহার করে। কিন্তু এটা সত্যি, আমি কোনো দিন খারাপ খাইনি, খারাপ বিছানায় ঘুমাইনি। ঢাকা শহরের নামকরা লন্ড্রি ঠিক করা ছিল আমার জন্য। পানের দোকান ঠিক করা ছিল। কে টাকা দিত জানতাম না। কিন্তু দোকানগুলোতে বাকি কোনো দিন হয়নি, তা জানতাম।’
লেখাপড়ার বিষয়ে জানতে চাই।
‘আমার প্রাতিষ্ঠানিক কোনো লেখাপড়া নেই। দুইবার স্কুলে ভর্তি হই। কিন্তু দাঙ্গার কারণে কোনোবারই ক্লাস করা হয়নি। এরপর একেবারে আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠা হলে সেখানে ভর্তি হই। আমি ছিলাম আর্ট কলেজের প্রথম ব্যাচের প্রথম ছাত্র। কিন্তু ওখানে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার পর আমার মনোযোগ আঁকাআঁকি থেকে লাইব্রেরিটার দিকেই বেশি ঝুঁকে যায়। আমার আর আর্ট কলেজেও পড়া হয়নি।’
আমাদের প্রচলিত সমাজে আটপৌরে জীবনের ছক ভেঙে কর্মজীবনেও নিজেকে স্রোতের বাইরে প্রতিষ্ঠিত করেন খালেদ চৌধুরী। ১৯৫৯ সালের দিকে সৈয়দ শামসুল হক ও আলমগীর কবিরের সূত্রে সোভিয়েত কনসুলেটের প্রেস ইনফরমেশন বিভাগে দ্বিতীয় প্রধান অনুবাদক হিসেবে কাজ পান। সে সময় কনসুলেটের তথ্য বিভাগটির প্রধান ছিলেন আলেকসান্দর কোলেবিস্ক। তিনি আগে থেকেই খালেদ চৌধুরীর পাণ্ডিত্য সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তাঁকে দেখেই কোলেবিস্ক সেদিন বলে উঠেছিলেন, ‘আরে আমি তো তোমার জন্য দেড় ঘণ্টা ধরে বসে আছি। তুমি আমাদের সঙ্গে কাজ করছ জেনে খুব খুশি হলাম।’ তাঁর এ বয়ান শুনলাম খোদ খালেদ চৌধুরীর কাছ থেকেই। তথ্য বিভাগের প্রধানের এই আন্তরিক সম্ভাষণের পর কিছু আর বলার ছিল না এত দিন বাউণ্ডুলে জীবন কাটানো মানুষটির। এখানে কাজ করার সময়ই তিনি ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেন আউট লাইন হিস্ট্রি অফ কমিট্রান, জামিলা ইত্যাদি। খালেদ চৌধুরী জানান, তাঁর করা অনুবাদের মধ্যে গোপনীয় নথিপত্র একটা বিরাট অংশ জুড়ে ছিল। তবে তিনি বলেন, ‘যত যাই করি, সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেয়েছি ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়া খানকে যুদ্ধ বন্ধ করতে হুমকি দিয়ে তত্কালীন সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট পদগোর্নির লেখা চিঠিটি অনুবাদ করে। সেটা এপ্রিল মাসের কথা। অফিসে গিয়েছিলাম চাকরি ছাড়তে। সে সময়কার কনসুলেট প্রধান ডেকে নিয়ে বললেন, ‘চাকরি ছাড়বে ভালো কথা, আগে এটা অনুবাদ করো।’ দেখি টেলিপ্রিন্টারে একটি লেখা এসেছে। ‘সেটাই ছিল ওই ঐতিহাসিক চিঠি।’
১৯৭৪ সালে সোভিয়েত দূতাবাস থেকে আবার তাঁর ডাক আসে দাস ক্যাপিটাল অনুবাদের জন্য। এবার মস্কো যান তিনি। সেই দলে ছিলেন দ্বিজেন শর্মা, হায়াৎ মামুদ প্রমুখ। কিন্তু বছর খানেকের মধ্যেই দেশের জন্য অস্থির হয়ে সব ছেড়ে আবার নিজ মাটিতে ফেরেন তিনি। এরপর ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত তিনি সোভিয়েত দূতাবাসের তথ্য ও প্রচার বিভাগের প্রধান অনুবাদক হিসেবে কাজ করেন। এরপর ১৯৯৫ সাল থেকে প্রশিকায় টানা ১১ বছর ভাষাবিষয়ক সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন।
জীবনের চড়াই-উত্রাই পেরিয়ে আসা সৌম্য মানুষটির দিকে তাকিয়ে খুব জানতে ইচ্ছা করে, এখনকার অস্থিরতা তাঁকে অশান্ত করে কি না।
বললেন, ‘না। নিজের দুঃখ-কষ্টকে সবার সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে অস্থিরতা আসে না। আর মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই আশাবাদী হতে বাধ্য। তাই আমিও আশাবাদী।’
No comments