আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৭৯)-দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য লড়াই by আলী যাকের

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কাজে আমাকে ব্যস্ত থাকতে হয় প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা, এমনকি কোনো কোনো দিন গভীর রাত পর্যন্ত। মাঝেমধ্যেই যুদ্ধ-প্রতিবেদন লেখার জন্য আগে যেমন উল্লেখ করেছি, যেতে হয় আমাদের যুদ্ধের বিভিন্ন সেক্টরে। এরই মধ্যে কোনো সন্ধ্যায় ফাঁক পেলেই আমি চলে আসি হুগলী নদীর পাড়ে।
এখানে একটি অশ্বত্থ গাছের তলায় বেদির ওপরে কিছুক্ষণ একা বসে থাকি। হুগলী অথবা গঙ্গার অবিরাম স্রোতের দিকে তাকিয়ে ভাবি, কোন পথে চলেছে জীবন আমার। যুদ্ধে জয় হবে কি আমাদের? ফিরতে পারব কি নিজ বাসভূমে? দেখা হবে কি আমার সেই প্রিয়জনদের সঙ্গে, যাদের ছেড়ে এসেছি অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীতে? ভাবতে ভাবতে কখন আঁধার গাঢ় হয়ে আসে খেয়ালই থাকে না। হঠাৎ চমকে উঠে ফিরে আসি বর্তমানে আবার। হাঁটতে থাকি গঙ্গার ধার দিয়ে শহরের দিকে। বিশাল এক মাঠ পেরিয়ে পৌঁছতে হয় চৌরঙ্গীতে। এমন সুন্দর, প্রায় সীমাহীন এক ময়দান সচরাচর দেখা যায় না কোনো শহরে। মাঠের মাঝখান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পায়ের স্যান্ডেল দুটো খুলে হাতে নিই। শিশির ভেজা ঘাসের ওপর দিয়ে হাঁটতে থাকি আমার আশ্রয়দাতা শহর কলকাতার দিকে। নিয়ন আলোর ঝলকানি, নানা ধরনের পসরা সাজানো দোকানপাট। তার ওপর দিয়ে চলে গেছে চৌরঙ্গী রোড। এখন যার নাম জওহরলাল নেহরু সরণি। হেঁটেই চলাফেরা আমার। ট্রাম বা বাসের পয়সা যেমন বাঁচে, তেমনি নগর কলকাতাকে চেনা হয় আরো ঘনিষ্ঠভাবে।
এরই মাঝে এক দিন আমাদের যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে গেছি বেতারের একটি কাজে। দেখি সেখানে আমাদের সব সেক্টরের তখনকার কমান্ডাররা হাজির হয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জরুরি কোনো বৈঠকের জন্য। সেখানে ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে শুরু করে পূর্ব এবং উত্তর বাংলাদেশ ঘুরে পশ্চিম হয়ে দক্ষিণ বাংলাদেশ পর্যন্ত সব সেক্টরের কমান্ডাররাই। তাঁরা হলেন মেজর রফিক, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর শফিউল্লাহ, মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত, মেজর মীর শওকত আলী, স্কোয়াড্রন লিডার খাদেমুল বাশার, লে. কর্নেল (অব.) নূরউজ্জামান, মেজর মঞ্জুর, মেজর জলিল, মেজর জিয়াউর রহমান এবং মেজর তাহের। এ ছাড়া ছিলেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী এবং ডেপুটি চিফ অব স্টাফ এয়ার কমোডর এ কে খন্দকার। এ সময় আমাদের প্রধানমন্ত্রী যেমন বিভিন্ন সেক্টরে স্বয়ং ঘুরে বেড়াতেন, তেমনি তাঁর সদর দপ্তরেও ডাক পড়ত সেক্টর কমান্ডারদের। সেখানে যুদ্ধের নানা দিক নিয়ে বিশদ আলোচনা হতো। প্রধানমন্ত্রী এবং ওসমানী ও খন্দকার সাহেব যুদ্ধের কৌশল নিয়ে মতবিনিময় করতেন। কোনো ছোটখাটো বিষয়ও প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি এড়াতো না। ওই দিন আমাদের সেক্টরপ্রধানদের দিকে তাকিয়ে গর্বে আমার বুক ভরে গিয়েছিল। তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন একেকজন অকুতোভয় সৈনিক, দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য লড়ে যাচ্ছেন অবিরাম।
তখন কেবল সামরিক বাহিনীর সদস্যরাই নন, সমগ্র বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অতি সাধারণ মানুষও স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে এগিয়ে আসতেন। আমি স্বচক্ষে দেখেছি বিভিন্ন সেক্টরে সমাগত হাজার হাজার কিশোর-তরুণ-প্রৌঢ়ের ভিড়। লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ছটফট করছেন কবে হাতে একটি হাতিয়ার পাবেন, যা নিয়ে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া যায়। আমাদের রণনীতি অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে তৈরি করা হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এবং তাতে বেশ কিছু বিষয় সংযোজিত ছিল। যেমন মুক্তিযোদ্ধা নিয়োগ (ইনডাকশন), মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও মূল্যবোধ সম্পর্কে আলোচনার মাধ্যমে প্রশিক্ষণ, শৃঙ্খলা ও অস্ত্রশিক্ষা এবং তারপর তাঁদের উপযুক্ত অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধে পাঠানো। আমরা জানি, মুজিবনগর সরকারের অধীনে দুটি বাহিনী তখন কাজ করত, নিয়মিত বাহিনী এবং গণবাহিনী। এই গণবাহিনীর ছোট ছোট দল ওই সময় ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় তটস্থ করে রেখেছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে। কেবল ঢাকাতেই নয়, আমাদের নৌবাহিনীর গেরিলারা নদীমাতৃক বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানি যুদ্ধজাহাজ এবং অন্যান্য জলযানকে বিধ্বস্ত করেছিল অত্যন্ত সফলভাবে। এ সময় মুজিববাহিনী নামে একটি গেরিলা বাহিনীও গঠন করা হয়, যারা মুজিবনগর সরকারের অধীনে যে বাহিনী, তার বাইরে থেকে বিভিন্নভাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। এ সময় পাকিস্তানের কিছু বন্ধুরাষ্ট্র নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কাজ করেছে। তাদের সবার ওপরে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং আদর্শিকভাবে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর হলেও তৎকালীন চীন সরকার পাকিস্তানকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ব্যাপারে অকুণ্ঠ সমর্থন এবং সহযোগিতা প্রদান করে। এর কারণ ছিল চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি সেতুবন্ধের কাজ তখন শুরু করেছিল পাকিস্তান।
যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিজ স্বার্থেই এ উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু বাংলাদেশের গণমানুষ পাকিস্তানের আক্রমণের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে যখন যুদ্ধ শুরু করে, তখন পাকিস্তান সরকার বড় বেকায়দায় পড়ে যায়। পড়ে যায় বিপদে। সেই কারণেই যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে চাইছিল বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করে পাকিস্তানের অখণ্ডতা অটুট রাখতে। তবে স্মর্তব্য, একটি দেশের আপামর জনসাধারণ যখন নিরুপায় হয়ে নিজেদের জীবনবাজি রেখে একটি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, তখন কারো পক্ষেই সম্ভব নয় সেই উদ্দাম জলোচ্ছ্বাস সদৃশ কর্মকাণ্ড প্রতিহত করা।
(চলবে)

লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.