কর রাজস্বেই বেশি নজর

২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেটে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে রাজস্ব আদায়ে। বাড়ছে আয়করের আওতা। স্থানীয় শিল্প খাতকে উৎসাহিত করতে দেওয়া হচ্ছে শুল্ক সুবিধা। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ফর্মুলায় আগামী বাজেটেও ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা থাকছে সবচেয়ে বেশি।


এ ছাড়া অর্থ পাচার রোধে রয়েছে নতুন আইন।
নতুন প্রস্তাবিত বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে এক লাখ ১২ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে আয়কর খাতে ৩৫ হাজার ৩০০ কোটি এবং ভ্যাট ধরা হয়েছে ৪০ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা। আমদানি ও রপ্তানি পর্যায়ে শুল্ক ১৪ হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা। আবগারি শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক, অন্যান্য কর ও শুল্ক ধরা হয়েছে ২১ হাজার ৯২৫ কোটি টাকা।
গতকাল বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, রাজস্ব প্রশাসনের ব্যাপক সংস্কার, জনবল নিয়োগ ও অটোমেশনের মাধ্যমে নতুন অর্থবছরে কর-রাজস্ব আহরণে অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় সবচেয়ে বেশি সাফল্য আসবে। সংস্কারের অংশ হিসেবে আগামী বাজেটে রয়েছে- রাজস্ব-সংক্রান্ত মামলাজট নিরসনে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতি, আয়করের ক্ষেত্রে সীমিত পরিসরে ই-ফাইলিং ও অনলাইনে কর পরিশোধ পদ্ধতি চালু।
পুঁজিবাজারে আগের সব সুবিধা থাকছে বলে অর্থমন্ত্রী উল্লেখ করে বলেন, নতুন অর্থবছরে আরো কিছু প্রণোদনা থাকছে। এর মধ্যে রয়েছে- মার্চেন্ট ব্যাংকের আয়করের হার কমিয়ে ৩৭.৫ শতাংশ করা। একই সঙ্গে কোনো কম্পানি পরিশোধিত মূলধনের ন্যূনতম ২০ শতাংশ শেয়ার পুঁজিবাজারে হস্তান্তর করলে আয়করের ওপর ১০ শতাংশ হারে কর রেয়াত পাবে। এ ছাড়া লভ্যাংশ আয় পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত করমুক্ত থাকবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
আগামী বাজেটে অর্থ পাচার রোধে নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, 'বাণিজ্য উদারীকরণ ও প্রযুক্তির উৎকর্ষের সুযোগে নতুন আইন ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের মাধ্যমে কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ বন্ধ করতে আয়কর আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনের প্রস্তাব আনা হয়েছে।
শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত উচ্চ ফলনশীল কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে আগামী বাজেটে। এর মধ্যে ভুট্টা ও বিট উৎপাদন থেকে উদ্ভূত আয়কে ৫০ শতাংশ কর অব্যাহতির সুবিধা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ধান-চালের কুঁড়া থেকে কোলেস্টেরলমুক্ত ভোজ্য তেল উৎপাদনকে প্রণোদনা প্রদানের জন্য এ-সংক্রান্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানকে এলাকাভেদে পাঁচ ও সাত বছরের জন্য কর অবকাশ সুবিধা প্রদানের প্রস্তাব আছে।
সিনেমা হল এবং সিনেপ্লেক্স নির্মাণের ক্ষেত্রে এলাকাভেদে পাঁচ এবং সাত বছরের জন্য কর অবকাশ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া এ শিল্পের বর্তমান ৩৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের প্রস্তাব করা হয়েছে।
রপ্তানি বাণিজ্যে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা এখন সময়ের দাবি জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, সব ধরনের রপ্তানির ক্ষেত্রে সমহারে অর্থাৎ ১.২ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তনের প্রস্তাব আছে। সব ধরনের রপ্তানির ক্ষেত্রে উৎসে কর্তিত এ করের হার ০.৬০ এবং ০.৭০ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ১.২০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। বাজেট বক্তৃতায় মন্ত্রী আরো বলেন, ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রাইভেট কার, জিপ, মাইক্রোবাসের রেজিস্ট্রেশন/ফিটনেস নবায়নকালে প্রদেয় উৎসে করের হার বৃদ্ধি করা হলো।
ল্যান্ড ডেভেলপার কম্পানি কর্তৃক জমি বিক্রয়ে উৎসে কর কর্তনের হার এলাকাভেদে ৫ ও ৩ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। আগামী বাজেটে করদাতা অতিরিক্ত কর প্রদান করলে ঘরে বসে যেন সেটা ফেরত পান সে লক্ষ্যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। করদাতারা অচিরেই এর সুফল পাবেন বলে অর্থমন্ত্রী জানান। তবে আয়কর সীমা আগের নিয়মে বহাল রয়েছে।
ক্ষুদ্র উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের টার্নওভার পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। বার্ষিক ৬০ লাখ টাকা পর্যন্ত টার্নওভারের ওপর কর ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। নতুন পদক্ষেপের মধ্যে আছে- বার্ষিক সাত লাখ টাকা পর্যন্ত টার্নওভারের ক্ষেত্রে কর সম্পূর্ণ মওকুফ; বার্ষিক সাত লাখ টাকার ঊর্ধ্বে ২৪ লাখ টাকা পর্যন্ত টার্নওভারের ক্ষেত্রে ২ শতাংশ হারে কর ধার্য করা আর বার্ষিক ২৪ লাখ টাকা থেকে ৬০ লাখ টাকা পর্যন্ত টার্নওভারের ক্ষেত্রে বর্তমানের ৩ শতাংশ কর বহাল থাকবে।
লজেন্স, বিস্কুট, চানাচুর, জুতা ও সেন্ডেল, নারিকেল তেল, লন্ড্রি সাবান, ফলের জ্যাম ও জেলি, পিভিসি পাইপ ও বিউটি পার্লারের উৎপাদককে বা সেবা প্রদানকারীকে টার্নওভার নির্বিশেষে মূল্য সংযোজন কর দিতে হয়। এখন থেকে তাঁরা ১৫ শতাংশ হারে টার্নওভার কর পরিশোধের সুবিধা পাবেন।
রেফ্রিজারেটর এবং মোটরসাইকেলের আমদানি ও স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে বিদ্যমান শুল্ক ও করের ব্যাপক বৈষম্য দূর করতে এসব পণ্য আমদানি পর্যায়ে প্রদত্ত সুবিধা বহাল থাকবে। একই সঙ্গে সদ্য আরোপিত অতিরিক্ত ২০ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটি প্রত্যাহার করা হচ্ছে।
দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়ার স্বার্থে সিরামিক শিল্প খাতের স্থানীয় উৎপাদিত বাথটাব, বেসিন, কমোড প্রভৃতি পণ্যের ওপর বিদ্যমান ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের প্রস্তাব করা হয়েছে বলে জানান অর্থমন্ত্রী।
ভ্যাট খাতে নেওয়া নতুন উদ্যোগের বর্ণনায় অর্থমন্ত্রী বলেন, ইট, বিস্কুট, কেক, ফলের জুস প্রভৃতি পণ্যের বিদ্যমান ট্যারিফ মূল্য বাজারদরের সঙ্গে সংগতি রেখে কিছুটা বৃদ্ধি করা হয়েছে। টিস্যু পেপার, দেশীয় উৎপাদিত চশমার ফ্রেম, নিউজপ্রিন্টের বাণিজ্যিক সরবরাহ প্রভৃতি ক্ষেত্রে নতুন করে ট্যারিফ মূল্য ধার্য হয়েছে, সিআর কয়েল, জিপি শিট, সিআই শিট প্রভৃতি পণ্যের বিদ্যমান ট্যারিফ মূল্য হ্রাস করার এবং কনসালট্যান্সি ফার্ম, সুপারভাইজরি ফার্ম, অডিট অ্যাকাউন্টিং ফার্ম, সিকিউরিটি সার্ভিস, কোচিং সেন্টার, আইন পরামর্শক, যানবাহন ভাড়া প্রদানকারী, অনুষ্ঠান আয়োজক, মানবসম্পদ সরবরাহকারী প্রভৃতি সেবা খাতে বিদ্যমান সংকুচিত ভিত্তি মূল্য ও তার ভিত্তিতে কর প্রদানের পদ্ধতি প্রত্যাহারের প্রস্তাব করা হয়েছে।
হাইব্রিড গাড়ি শুল্ক সুবিধা ২০০০ সিসি ক্যাপাসিটি থেকে ২৫০০ সিসিতে উন্নীত করা হয়েছে। তবে সম্পূরক শুল্ক ছাড়াও ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক, ৫ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটি, ১৫ শতাংশ মূসক, ৫ শতাংশ এআইটি ও ৩ শতাংশ এটিভি প্রযোজ্য থাকবে। এ ছাড়া নতুন ও পুরনো গাড়ির নতুন মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ১০ শতাংশ ডিলার্স কমিশনসহ ওই অবচয় সুবিধা আগামী অর্থবছরেও অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে বিদ্যমান আমদানিনীতি আদেশ অনুযায়ী পাঁচ বছর পর্যন্ত পুরনো গাড়ি আমদানি করা যায়। সে বিবেচনায় এ অবচয় সুবিধা তিন বছরের পরিবর্তে পাঁচ বছর পর্যন্ত পুরনো গাড়ির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।
এনবিআর আমদানি-রপ্তানি সম্পর্কিত কার্যক্রম পরিচালনায় এইচএস কোডজনিত সমস্যা দূর করতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আগামী বাজেটে প্রথমবারের মতো ইলিশ মাছ রপ্তানির ক্ষেত্রে পৃথক এইচএস কোড সৃষ্টি করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.