অমৃতবৃক্ষের বিষফল by মাহবুব মোর্শেদ
সাহিত্যের পাঠকরা 'বিষবৃক্ষ' কথাটির সঙ্গে কমবেশি পরিচিত। শুধু বাংলা সাহিত্যের পাঠকই নয়, ইংরেজি সাহিত্যের পাঠকও বিষবৃক্ষ চেনে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৭৩ সালে বিষবৃক্ষ উপন্যাস লিখেছিলেন। আর উইলিয়াম ব্লেক ১৭৯৪ সালে 'এ পয়জন ট্রি' নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন।
সাহিত্যে চিনি বটে কিন্তু বাস্তবের বিষবৃক্ষ কেমন? যদি প্রশ্ন করা হয়, হাজারো বৃক্ষের মধ্যে বিষবৃক্ষ কোনটি_ তবে উত্তর মিলবে? বৃক্ষে যদি বিষাক্ত ফল হয় তবে সে বৃক্ষকে বিষবৃক্ষ বলা যায়। কিন্তু কোনো বৃক্ষ বিষ উৎপাদন করে? আপেলের বীজে বিষ থাকে, কিন্তু আপেল তো অমৃতসম। চকোলেট বৃক্ষেও বিষ থাকে, কিন্তু চকোলেট উপাদেয় খাবার। এমনকি রসুন-পেঁয়াজের মধ্যেও বিষ থাকে। এ বিষ কুকুর-বিড়ালের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু মানুষের রসনা পেঁয়াজ-রসুন ছাড়া তৃপ্ত হয় না। বৃক্ষে বা বৃক্ষফলে বিষ থাকলেও বিষটুকু বাদ দিয়ে অমৃতটুকু মানুষ ঠিকই বেছে নিতে পারে। কখনও কখনও মানুষ স্বেচ্ছায় বিষাক্ত নেশাদ্রব্য পানও করে। কিন্তু বঙ্কিম ও উইলিয়াম ব্লেক কি এমন কোনো প্রাকৃতিক বৃক্ষকে বিষবৃক্ষ বলেছেন? না। বঙ্কিম বা ব্লেকের কাছে মানুষই বিষবৃক্ষ। মানববৃক্ষে উৎপাদিত বিষফলের কারণেই তারা একে বিষবৃক্ষ বলেছেন। ধর্মগ্রন্থে, পুরাণে এমনকি বিজ্ঞানেও মানুষকে বিকশিত, শ্রেষ্ঠ, শ্রেয়তর জীব হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে_ এ হয়তো সত্য। কিন্তু প্রাণিকুলে মানুষের চেয়ে কে বেশি বিষোদ্গার করতে পারে? ব্যক্তিমানুষের বিষোদ্গারের ক্ষমতা নিয়ে তেমন কথা না হলেও আমাদের রাজনীতিতে বিষোদ্গার কথাটি বেশ পরিচিত। রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে। কিন্তু ব্যক্তিমানুষের বিষোদ্গারের ক্ষমতা রাজনীতির চেয়ে কম নয়? কথায়-চিন্তায়-ভাবনায় যে বিষ ভয়ঙ্কর। এ বিষ হয়তো মোকাবেলা করা সম্ভব কিন্তু মানুষ যখন মুনাফার লোভে খাদ্যদ্রব্যে, ফলমূলে বিষ ছড়ায় তা থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ কী? অন্তরের বিষ যুদ্ধ, হিংসা, বিদ্বেষ তৈরি করে প্রাণ-সম্পদ ও প্রকৃতি ক্ষয়ের কারণ হতে পারে। সরাসরি বিষ প্রয়োগ করে এক ব্যক্তির প্রাণ হরণ করা যেতে পারে। কিন্তু খাদ্যদ্রব্যে বিষ এর চেয়ে ভয়ঙ্কর। প্রজন্মের পর প্রজন্মকে বিপর্যস্ত, বিকলাঙ্গ করে দিতে পারে এটি। যুদ্ধের হিংসার চেয়ে এটি কম কিসে? দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত খাদ্যদ্রব্যে বিষ প্রয়োগ করা হচ্ছে। শাকসবজি, ফলমূল, মাছ-মাংস সংরক্ষণের জন্য বিষাক্ত রাসায়নিক প্রয়োগের রীতি এখানে এমনই শিকড় গেড়েছে যে, এ থেকে নিস্তার মেলার পথ কী কেউ জানে না। সংবাদপত্রে প্রতিনিয়ত সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। ফলের মৌসুমে সংবাদ আরও বেশি করে প্রকাশিত হচ্ছে। পরিস্থিতি ভয়াবহ। না, বৃক্ষ এই বিষফল তৈরি করেনি। বৃক্ষ দিয়েছিল অমৃতফল। কিন্তু মানুষ সে ফল থেকে মুনাফা বাড়াতে একে বিষময় করে তুলেছে। সে বিষ স্লোপয়জনিং করছে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে। আমাদের সামনে বিকলাঙ্গ এক প্রজন্মের উত্থানকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলছে। প্রশ্ন হলো, জনস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে এই ভয়ঙ্কর বিষ প্রয়োগ বন্ধ করা হচ্ছে না কেন? কেন কঠোর ব্যবস্থা আসছে না? এর উত্তর নেই। হয় কোনো কর্তৃপক্ষ বা প্রশাসন নেই, অথবা থাকলেও জনস্বাস্থ্য বিষয়ে তারা থোড়াই কেয়ার করে। যদি তেমন ব্যবস্থা থাকত তবে ফরমালিনসহ ক্ষতিকর ও বিষাক্ত দ্রব্যগুলো বাজার থেকে উঠিয়ে নেওয়া হতো এতদিনে। কঠোর ব্যবস্থা নেই, তাই বিষ আছে। মুনাফালোভীদের অন্তরের বিষ আর বাহিরের বিষ মিলেমিশে বিষাক্ত করে তুলতে পারছে আমাদের ভবিষ্যৎও।
No comments