দিল্লির চিঠি-শেখ মুজিব ও উপমহাদেশের রাজনীতি by কুলদীপ নায়ার
ভারতে জরুরি অবস্থা জারির পরে আমি আটক হয়েছিলাম। জেলে বসেই আমি শেখ মুজিবুর রহমানের জঘন্য হত্যাকাণ্ডের কথা জানতে পারি। পাকিস্তানি থাবা থেকে তিনিই বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিলেন। জনপ্রিয় হয়েছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু’ নামে। ঢাকার ধানমন্ডিতে নিজের বাড়িতে পুরো পরিবারসহ তাঁকে হত্যা করা হয়।
অবশ্য জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরই জানতে পারলাম, শেখ হাসিনা ও তাঁর বোন সামরিক অভ্যুত্থানের সময় বিদেশে থাকায় বেঁচে যান।
ঘটনাটি যে ভারতের স্বাধীনতা দিবসে ঘটেছিল, ভারতের মানুষের জন্য তা ভোলা কঠিন। ভারতীয় গোয়েন্দাদের সন্দেহ ছিল, শেখ মুজিবকে লক্ষ্য করে এ রকম ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর জীবনের ওপর আঘাত আসতে পারার বিষয়ে ঢাকাকে সতর্ক করা ছাড়া এ বিষয়ে আমরা আর কিছুই করিনি। কার্যত সর্বদাই এটা নিয়ে আমাদের অনুশোচনা হবে।
শেখের বাড়ির সৈন্যদের মামুলি প্রতিরোধ চূর্ণ করতে ট্যাংক ব্যবহার করা হয়েছিল। আমার মনে আছে, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বিষয়ে সে সময় দায়িত্বরত কর্মকর্তা প্রয়াত ডি পি ধর নয়াদিল্লিকে হুঁশিয়ার করে বলেছিলেন, ভারতীয় সৈন্যরা চলে আসার পর যেন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর কাছে কোনো ট্যাংক না থাকে। তাঁর পরামর্শ পালিত হয়েছিল। কিন্তু দিল্লির হিসাবে ছিল না যে বাংলাদেশ অন্য কোনো দেশের তরফ থেকে ট্যাংক পেতে পারে। মিসর উপহার হিসেবে তিনটি ট্যাংক দিতে চাইলে ঢাকা তা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে গ্রহণ করে। শেখ মুজিব ডি পি ধরের হুঁশিয়ারি সম্পর্কে জানতেন। তিনি জানতেন না, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী সেনাকর্মকর্তারা পাকিস্তানের সঙ্গে যোগসাজশ করে তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত চালাচ্ছিল।
এটাও আর গোপন নেই যে, খালেদা জিয়ার স্বামী, তখনকার সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান এই চক্রান্ত সম্পর্কে জানতেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এবং চক্রান্তকারীদের দলে যোগ দিতে চাননি। কিন্তু বলা হয়, তিনি ঘাতকদের বলেছিলেন তারা সফল হলে তিনি তাদের রক্ষা করবেন। তিনি তা-ই করেছিলেন। জিয়াউর রহমান চেষ্টা করেছিলেন যাতে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের শাস্তি না হয়। এদের কয়েকজন বিদেশে পালিয়েও যায়। আর বাকিদের বিচারের সম্মুখীন হতে হয় ১৯৯৬ সালে, শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর। এমনকি বিচারে খুনীদের মৃত্যুদণ্ড হলেও ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা আরেকবার ক্ষমতারোহণ না করা পর্যন্ত সেই শাস্তি কার্যকর হয়নি।
পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বনকারী ব্যক্তিরা, যারা ঠান্ডা মাথায় লাখ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছিল, তাদের বিচার শুরু করাটাও সংগত হয়েছে, কেননা অপরাধটি ছিল মানবতার বিরুদ্ধে। বেগম খালেদা জিয়ার বিএনপি এবং এর মিত্র জামায়াতে ইসলামী এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করে, কারণ উভয় দলই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের মদদপুষ্ট হয়েছে। দেশটির মৌলনীতি হিসেবে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে মুছে ফেলার বিষয়েও তাদের অবস্থান ছিল পেছনমুখী।
১৯৭২ সালে ঘোষিত বাংলাদেশের আদি সংবিধানের মৌল চার নীতি ছিল: গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। মুজিবের হত্যাকাণ্ডের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রীয় নীতি থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বাতিল করেন। সংবিধানের যে ১২ নং অনুচ্ছেদের মাধ্যমে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, সেই অনুচ্ছেদটিও তিনি সরিয়ে ফেলেন। এ থেকেই পুনরুজ্জীবিত হয় জামায়াতে ইসলামী।
২০০৫ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত রায় দেন, ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিল করার সংশোধনীটি অসাংবিধানিক। তার পরও সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে উচ্চ আদালতের সেই রায়টি বহাল হতে ২০১০ সালের ২৮ জুলাই পর্যন্ত লেগে গেল। সুপ্রিম কোর্ট সুস্পষ্টভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা মুছে ফেলার সমালোচনা করে বলেন, ‘এটা আমাদের মুক্তিসংগ্রামের মূল ভিত্তিকেই ধ্বংস করেছিল এবং রাষ্ট্রের মূল চরিত্র বদলে ফেলেছিল।’ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিব যে ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা সেই অপসৃত ধারাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলেন। অবাক করা ব্যাপার, বিএনপি ও জামায়াত সুপ্রিম কোর্টের এই আদেশ না মেনে তাদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছে।
শেখ মুজিবের মর্মান্তিক পরিণতি ইতিহাসের দুঃখজনক অংশ। এখন অনেক মানুষই জানে, ২৫ মার্চ রাতে আত্মসমর্পণের পর এক পাকিস্তানি হাবিলদার তাঁকে চড় মেরেছিল। পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার জেড এ খান তাঁর বই দ্য ওয়ে ইট ওয়াজ-এ লিখেছেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী তাঁর বাসভবনে একটি গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায়। তারপর মেশিনগানের গুলি চালায়। গ্রেনেড ও গুলিবর্ষণের ফলে শেখ মুজিব পেছনের একটি বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে বলতে বাধ্য হন, তাঁকে হত্যা করা না হলে তিনি স্বেচ্ছায় বেরিয়ে আসবেন। তাঁকে সেই আশ্বাস দেওয়া হলো এবং তিনি বের হয়ে এলেন।’
জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দাবিদার হলেও শেখ মুজিবের সঙ্গে অশালীন আচরণ করা হয়েছিল। তিনি কেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলেন না, সেটা এক দীর্ঘ কাহিনি। তিনি এর জন্য দায়ী করেছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টোকে। ভুট্টো পাকিস্তানের দুই অংশের আলাদা হয়ে যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। এখানে বিস্তারিত লেখার পরিসর না থাকায় পরে কখনো আমি এ বিষয়ে বাকি আলোচনা করব।
যা-ই হোক, আমি একবার শেখ মুজিবকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে বিবাদ মিটবে কি না। তিনি বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান সব সময় চারটি প্রচারণা চালিয়েছে: এক. ইসলাম বিপন্ন, দুই. হিন্দুরা কাফের, তিন. ভারত শত্রু, এবং চার. কাশ্মীর জয় করতেই হবে। বহু বছর ধরে পাকিস্তানিদের এমন প্রচারণা গেলানো হয়েছে। সে দেশের এই ঘৃণা বিস্তারের প্রচারণা এমনকি ইসলামের বিশ্বাসেরও বিরোধী। যত দিন না পাকিস্তানিরা তাদের এই মনোভঙ্গি না পাল্টাবে, তত দিন তাদের এই কল্পজগৎ থেকেও তারা বেরিয়ে আসতে পারবে না।
কিন্তু বেশ কয়েকবার পাকিস্তানে ভ্রমণ করে আমার মনে হয়েছে, শেখ মুজিব যা বলেছেন তা পাকিস্তানি জনসাধারণের বিভিন্ন অংশের জন্য আজও সত্য। তা হলেও বেশির ভাগ মানুষ ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক চায় এবং চায় বন্ধুভাবাপন্ন প্রতিবেশী হিসেবে তাদের সঙ্গে বোঝাপড়া করে ফেলতে।
পাকিস্তান ও ভারতের জন্মদিবস ১৪-১৫ আগস্টে প্রতিবছর ওয়াগাহ সীমান্তে মোমবাতি জ্বালানো কর্মসূচি ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে। সেখানে হয়তো এ বছর দুই লাখ মানুষ ‘ভারত-পাক দোস্তি জিন্দাবাদ ধ্বনি’ করছে না, যেমনটা হয়েছে ভারতের দিকের ওয়াগাহ সীমান্তে। কিন্তু গত বছর অনেক মানুষ সীমান্তে জড়ো হয়ে আমাদের সঙ্গে মোমবাতি বিনিময় করেছিল। এ বছর বন্যার কারণে তারা আসতে পারেনি। আমার প্রত্যয় হয়, পরেরবার, মৈত্রীর জন্য রাত্রি জাগরণের ১৬তম বর্ষপূর্তিতে, শত শত পাকিস্তানি ওয়াগাহ সীমান্তে সমবেত হবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।
ঘটনাটি যে ভারতের স্বাধীনতা দিবসে ঘটেছিল, ভারতের মানুষের জন্য তা ভোলা কঠিন। ভারতীয় গোয়েন্দাদের সন্দেহ ছিল, শেখ মুজিবকে লক্ষ্য করে এ রকম ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর জীবনের ওপর আঘাত আসতে পারার বিষয়ে ঢাকাকে সতর্ক করা ছাড়া এ বিষয়ে আমরা আর কিছুই করিনি। কার্যত সর্বদাই এটা নিয়ে আমাদের অনুশোচনা হবে।
শেখের বাড়ির সৈন্যদের মামুলি প্রতিরোধ চূর্ণ করতে ট্যাংক ব্যবহার করা হয়েছিল। আমার মনে আছে, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বিষয়ে সে সময় দায়িত্বরত কর্মকর্তা প্রয়াত ডি পি ধর নয়াদিল্লিকে হুঁশিয়ার করে বলেছিলেন, ভারতীয় সৈন্যরা চলে আসার পর যেন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর কাছে কোনো ট্যাংক না থাকে। তাঁর পরামর্শ পালিত হয়েছিল। কিন্তু দিল্লির হিসাবে ছিল না যে বাংলাদেশ অন্য কোনো দেশের তরফ থেকে ট্যাংক পেতে পারে। মিসর উপহার হিসেবে তিনটি ট্যাংক দিতে চাইলে ঢাকা তা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে গ্রহণ করে। শেখ মুজিব ডি পি ধরের হুঁশিয়ারি সম্পর্কে জানতেন। তিনি জানতেন না, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী সেনাকর্মকর্তারা পাকিস্তানের সঙ্গে যোগসাজশ করে তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত চালাচ্ছিল।
এটাও আর গোপন নেই যে, খালেদা জিয়ার স্বামী, তখনকার সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান এই চক্রান্ত সম্পর্কে জানতেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এবং চক্রান্তকারীদের দলে যোগ দিতে চাননি। কিন্তু বলা হয়, তিনি ঘাতকদের বলেছিলেন তারা সফল হলে তিনি তাদের রক্ষা করবেন। তিনি তা-ই করেছিলেন। জিয়াউর রহমান চেষ্টা করেছিলেন যাতে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের শাস্তি না হয়। এদের কয়েকজন বিদেশে পালিয়েও যায়। আর বাকিদের বিচারের সম্মুখীন হতে হয় ১৯৯৬ সালে, শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর। এমনকি বিচারে খুনীদের মৃত্যুদণ্ড হলেও ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা আরেকবার ক্ষমতারোহণ না করা পর্যন্ত সেই শাস্তি কার্যকর হয়নি।
পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বনকারী ব্যক্তিরা, যারা ঠান্ডা মাথায় লাখ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছিল, তাদের বিচার শুরু করাটাও সংগত হয়েছে, কেননা অপরাধটি ছিল মানবতার বিরুদ্ধে। বেগম খালেদা জিয়ার বিএনপি এবং এর মিত্র জামায়াতে ইসলামী এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করে, কারণ উভয় দলই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের মদদপুষ্ট হয়েছে। দেশটির মৌলনীতি হিসেবে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে মুছে ফেলার বিষয়েও তাদের অবস্থান ছিল পেছনমুখী।
১৯৭২ সালে ঘোষিত বাংলাদেশের আদি সংবিধানের মৌল চার নীতি ছিল: গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। মুজিবের হত্যাকাণ্ডের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রীয় নীতি থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বাতিল করেন। সংবিধানের যে ১২ নং অনুচ্ছেদের মাধ্যমে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, সেই অনুচ্ছেদটিও তিনি সরিয়ে ফেলেন। এ থেকেই পুনরুজ্জীবিত হয় জামায়াতে ইসলামী।
২০০৫ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত রায় দেন, ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিল করার সংশোধনীটি অসাংবিধানিক। তার পরও সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে উচ্চ আদালতের সেই রায়টি বহাল হতে ২০১০ সালের ২৮ জুলাই পর্যন্ত লেগে গেল। সুপ্রিম কোর্ট সুস্পষ্টভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা মুছে ফেলার সমালোচনা করে বলেন, ‘এটা আমাদের মুক্তিসংগ্রামের মূল ভিত্তিকেই ধ্বংস করেছিল এবং রাষ্ট্রের মূল চরিত্র বদলে ফেলেছিল।’ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিব যে ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা সেই অপসৃত ধারাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলেন। অবাক করা ব্যাপার, বিএনপি ও জামায়াত সুপ্রিম কোর্টের এই আদেশ না মেনে তাদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছে।
শেখ মুজিবের মর্মান্তিক পরিণতি ইতিহাসের দুঃখজনক অংশ। এখন অনেক মানুষই জানে, ২৫ মার্চ রাতে আত্মসমর্পণের পর এক পাকিস্তানি হাবিলদার তাঁকে চড় মেরেছিল। পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার জেড এ খান তাঁর বই দ্য ওয়ে ইট ওয়াজ-এ লিখেছেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী তাঁর বাসভবনে একটি গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায়। তারপর মেশিনগানের গুলি চালায়। গ্রেনেড ও গুলিবর্ষণের ফলে শেখ মুজিব পেছনের একটি বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে বলতে বাধ্য হন, তাঁকে হত্যা করা না হলে তিনি স্বেচ্ছায় বেরিয়ে আসবেন। তাঁকে সেই আশ্বাস দেওয়া হলো এবং তিনি বের হয়ে এলেন।’
জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দাবিদার হলেও শেখ মুজিবের সঙ্গে অশালীন আচরণ করা হয়েছিল। তিনি কেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলেন না, সেটা এক দীর্ঘ কাহিনি। তিনি এর জন্য দায়ী করেছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টোকে। ভুট্টো পাকিস্তানের দুই অংশের আলাদা হয়ে যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। এখানে বিস্তারিত লেখার পরিসর না থাকায় পরে কখনো আমি এ বিষয়ে বাকি আলোচনা করব।
যা-ই হোক, আমি একবার শেখ মুজিবকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে বিবাদ মিটবে কি না। তিনি বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান সব সময় চারটি প্রচারণা চালিয়েছে: এক. ইসলাম বিপন্ন, দুই. হিন্দুরা কাফের, তিন. ভারত শত্রু, এবং চার. কাশ্মীর জয় করতেই হবে। বহু বছর ধরে পাকিস্তানিদের এমন প্রচারণা গেলানো হয়েছে। সে দেশের এই ঘৃণা বিস্তারের প্রচারণা এমনকি ইসলামের বিশ্বাসেরও বিরোধী। যত দিন না পাকিস্তানিরা তাদের এই মনোভঙ্গি না পাল্টাবে, তত দিন তাদের এই কল্পজগৎ থেকেও তারা বেরিয়ে আসতে পারবে না।
কিন্তু বেশ কয়েকবার পাকিস্তানে ভ্রমণ করে আমার মনে হয়েছে, শেখ মুজিব যা বলেছেন তা পাকিস্তানি জনসাধারণের বিভিন্ন অংশের জন্য আজও সত্য। তা হলেও বেশির ভাগ মানুষ ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক চায় এবং চায় বন্ধুভাবাপন্ন প্রতিবেশী হিসেবে তাদের সঙ্গে বোঝাপড়া করে ফেলতে।
পাকিস্তান ও ভারতের জন্মদিবস ১৪-১৫ আগস্টে প্রতিবছর ওয়াগাহ সীমান্তে মোমবাতি জ্বালানো কর্মসূচি ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে। সেখানে হয়তো এ বছর দুই লাখ মানুষ ‘ভারত-পাক দোস্তি জিন্দাবাদ ধ্বনি’ করছে না, যেমনটা হয়েছে ভারতের দিকের ওয়াগাহ সীমান্তে। কিন্তু গত বছর অনেক মানুষ সীমান্তে জড়ো হয়ে আমাদের সঙ্গে মোমবাতি বিনিময় করেছিল। এ বছর বন্যার কারণে তারা আসতে পারেনি। আমার প্রত্যয় হয়, পরেরবার, মৈত্রীর জন্য রাত্রি জাগরণের ১৬তম বর্ষপূর্তিতে, শত শত পাকিস্তানি ওয়াগাহ সীমান্তে সমবেত হবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।
No comments