সরল গরল-সংসদ ও সুপ্রিম কোর্টের জবাবদিহি by মিজানুর রহমান খান
দেশের শীর্ষস্থানীয় আইনজীবীরা পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বজায় রেখে স্পিকার-বিচারপতির মধ্যকার চলতি টানাপোড়েনের সুরাহা চেয়েছেন। বোধসম্পন্ন যে কেউ সেটাই আশা করবেন। কিন্তু যে বিষয়টি দ্রুত চাপা পড়ে যাবে, সেটি হলো সংসদ ও বিচার বিভাগের জবাবদিহির প্রশ্ন। সংসদ আইন পাস করে।
সংবিধানের সঙ্গে তা ঠোক্কর খেলে আদালত তা বাতিল করেন। তাই সংসদের জবাবদিহি আদালত নিশ্চিত করেন। ভারতের সংসদ দুই শতাধিক আইন পাস করে বলেছে, এর বৈধতা আদালত পরীক্ষাই করতে পারবেন না। সুতরাং সেখানে সংসদ বনাম বিচারালয়—একটা বিতর্ক চলে। কিন্তু আমাদের বিতর্ক সেই ঘরানার নয়।
ভারত নির্জীব সংসদীয় অভিশংসনব্যবস্থাকে সক্রিয় করতে ‘দ্য জুডিশিয়াল স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড অ্যাকাউন্টিবিলিটি বিল, ২০১০ এনেছে। এতে আচরণবিধির লঙ্ঘনকে দ্রুত আমলে নিতে অবিচারক সদস্যদের দিয়ে একটি ওভারসাইট (সতত পর্যবেক্ষণ) কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। আমাদের সুপ্রিম কোর্টে আচরণবিধির কোনো উচ্চারণও দৈবাৎ শ্রুত হয়। আপিল বিভাগের এক সাবেক অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার আমাকে বলেছিলেন, ‘আচরণবিধির অস্তিত্ব সুপ্রিম কোর্ট স্বীকার করে না। সে কারণে এর কোনো প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়নি।’ তাঁর কথা উড়িয়ে দিতে পারি না। কোনো প্রধান বিচারপতি আজ পর্যন্ত একটা অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করতেও রাজি হননি। সদাচরণের পরিপন্থী কোনো কাজ সেখানে দেখার মতো কেউ আছেন বলে জনগণের কাছে কখনোই প্রতীয়মান হয় না।
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে অবশ্যই আলোচ্য বিচারপতির আচরণ তদন্ত করে দেখতে হবে। তদন্তে তিনি দায়মুক্ত হলেই কেবল বিচারিক কাজ চালাতে সমর্থন পেতে পারেন। একই সঙ্গে অভিযোগকারীদের সঙ্গে তাঁর বেঞ্চকেন্দ্রিক কোনো স্বার্থের সংঘাত আছে কি না, তা-ও তদন্তে বেরিয়ে আসবে। প্রধান বিচারপতি এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি লিখলে তা সঠিক পদক্ষেপ হবে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আলটিমেটামের তিন দিনকে ৩০ দিন পড়তে বলেছেন। এখন রাষ্ট্রপতিরও ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হতে পারে, তিনি যদি এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ চান। স্পিকার আবদুল হামিদের রুলিং পর্যন্ত অপেক্ষার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান বিচারপতির তরফে বিবেচ্য হওয়া অগ্রহণযোগ্য মনে হয়।
সংসদের ফ্লোরে যে অভিযোগ উঠেছে, তার তদন্ত করা না হলে দেশের সাংবিধানিক ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা আরও নাজুক হতে থাকবে। স্পিকারের প্রতি অশালীন মন্তব্যের কারণেই আলোচ্য বিচারকের আচরণ আজ উত্তপ্ত বিতর্ক ও মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু অনেক আগে থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ ছিল। স্পিকার কি নাগরিক গোত্রের লোক নন বলেই আজ আলটিমেটামের বোল ফুটল? নাগরিক এমনকি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অসংগত আচরণ করা নিয়ে সংসদ সামান্য উদ্বেগ দেখায়নি। স্পিকার নিজে আক্রান্ত না হলে কি রুলিং মিলত? এই পর্ব চুকে গেলে সুপ্রিম কোর্ট নিয়ে সংসদ কি আর মাথা ঘামাবে না? কয়েক শ বিচারিক আদালতের বিচারক বদলির ক্ষেত্রে যে ভয়ানক অনিয়ম চলছে, তার দায় মুখ্যত প্রধান বিচারপতির। বিদায়ী প্রধান বিচারপতি সংসদে সৌজন্য পরিদর্শনে এসেছিলেন বটে। কিন্তু ইস্যুটি আজও জ্বলন্ত।
ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ সংসদে বিচারকবিরুদ্ধ বক্তব্য সমর্থন করেছেন। এমনকি তিনি বাহাত্তরের সংবিধানের অভিশংসনের বিধান ফিরিয়ে আনতে অভিমত দিয়েছেন। কিন্তু শেষোক্ত অবস্থানের জন্য তিনি তাঁর দল থেকেও কোনো বাহবা পাবেন না। আইনজীবীর চেয়ে তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় যে বড়, এটা তারই প্রমাণ। প্র্যাকটিস-নির্ভর রাজনীতিকেরা মওদুদ বা সেনগুপ্তকে সমর্থন করেননি, করবেন না।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কথায়, সংবিধানের দুই প্রণেতা ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম কাউন্সিল পরিহার করে বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যেতে চান না। গতকাল এ নিয়ে আমি টেলিফোনে কথা বলি আমীর-উল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনার সুযোগ যদিও থাকে, তাহলেও একটা প্রশ্ন জনমনে আন্দোলিত হতে পারে। কারণ, সংসদে যেভাবে পাঁচ মিনিটে অভিশংসনব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার হুমকি এসেছে, তাতে সংশয় দেখা দিতে পারে যে তাহলে পরে পাঁচ মিনিটেই বিচারপতির বিচার হবে কি না।’ কিন্তু কথা হলো, ঘুমন্ত জুডিশিয়াল কাউন্সিল সীমাহীন দায়মুক্তির যে স্বাধীনতা ভোগ করছে, সেই স্বাধীনতা আর কত দিন টিকবে? ৩৫ বছরে এক বিচারককে অপসারণে একটি অস্পষ্ট সুপারিশ করা ছাড়া কাউন্সিলের অন্য সাফল্য নেই।
বিদ্যমান কাউন্সিল আইনগতভাবে দুদকের চেয়েও দুর্দশাগ্রস্ত। কারণ, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার বিষয়েও তদন্ত শুরু করতে দুদক প্রধানমন্ত্রীর মুখাপেক্ষী নয়। দুদকের কাছে বিচারপতিদের কথিত দুর্নীতির বিষয়ে একটি ফাইল আছে। একজন কর্মরত বিচারকের বিরুদ্ধে তদন্তের মনস্থির করেছিল কমিশন। পরে তারা ভয়ে নড়েনি। সংসদের উচিত তাদের ভয় তাড়ানো। কাউন্সিল প্রতিনিয়ত প্রমাণ দিচ্ছে, অন্যান্য সাংবিধানিক পদধারীসহ সুপ্রিম কোর্টের শতাধিক বিচারকের আচরণ দেখভালের দায়িত্ব পালনে তারা অক্ষম। বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী বিবেকের কাছে বিচারকের দায়বদ্ধতার যে পূত যুক্তি দিয়েছেন, তা সর্বজনীন। এর সীমা নিঃসীম। কিন্তু আমরা তো তার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারি না। সংসদ যতই পচে যাক, হোক না পুলিশের মতো, তাই বলে ‘সংসদ হইতে বিচারকদের দূরে থাকার’ পরামর্শ কাম্য হতে পারে না। যে প্রধানমন্ত্রীর জীয়নকাঠিতে সুপ্রিম কোর্টতুল্য কাউন্সিল প্রাণ পায়, সেই প্রধানমন্ত্রী তো সংসদের সৃষ্টি। জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের অনেকের আশঙ্কা, সংসদকে অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হলে তদবির সর্পফণা তুলতে পারে। কারণ ‘তিন শ সাংসদের কাছে তিন শ ফোন’ আছে। তাহলে বার-বেঞ্চ ব্যবস্থা নিক। বারের সভাপতি হিসেবে বিচারক নিয়োগ দিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছিলেন শফিক আহমেদ। আইনমন্ত্রী হয়েই তিনি সেই জুডিশিয়াল কমিশন বিলোপ করেন। তাহলে সান্ত্বনা কোথায়?
বার-বেঞ্চ সম্পর্ক বহু ক্ষেত্রে ভেঙে টুকরো হয়ে আছে। স্পিকারকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলার পর সরকারি দলের সাংসদেরা ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। কারণ, তাঁরা স্পিকারকে নিজেদের একান্ত দলের লোক ভাবেন। তিনি সংসদের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা এমন কোনো জীবিত সংসদ কল্পনা করতে পারি না, যেখানে স্পিকার থাকবেন, বিরোধী দলের নেতা থাকবেন না। কিন্তু আমাদের সরকারি দলের কাছে বিরোধী দলটাই যত নষ্টের গোড়া। ফজলুল হক আমিনীর মামলায় এখতিয়ার-বহির্ভূতভাবে বিরোধীদলীয় নেতাকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত করেছিলেন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী। তখন আমরা এই মুখগুলোকেই তাঁদের ‘মহান সংসদের’ মর্যাদা রক্ষায় ঘর্মাক্ত হতে দেখিনি। অবশ্য, তখন বেঞ্চ থেকে একটা ভালো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।
আমীর-উল ইসলাম, রোকনউদ্দিন মাহমুদ, নুরুল ইসলাম এবং সুপ্রিম কোর্ট বারের তৎকালীন সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন ও সম্পাদক ব্যারিস্টার এম বদরুদ্দোজা চেম্বারে গিয়ে ওই বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। খালেদা জিয়া সম্পর্কে নিবৃত্ত হতে তাঁরা অনুরোধ করেছিলেন। স্পিকারের বিরুদ্ধে বিতর্কিত মন্তব্যকালে একইভাবে সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু ও আইনজীবী আনিসুল হক চেষ্টা করেছিলেন। বহু আইনজীবী ওই বেঞ্চে নানাভাবে নিজেদের আহত বোধ করেন।
সুপ্রিম কোর্ট বার তখন সাত বনাম সাত অনুপাতে বিভক্ত ছিল। যদিও সভাপতি ও সম্পাদক ছিলেন বিএনপির। বারের সভায় সতর্ক এজেন্ডা আনা হয়েছিল ‘হাইকোর্টের জনৈক বিচারকের বিচারকসুলভ আচরণ প্রসঙ্গে’। কিন্তু আওয়ামী আইনজীবীরা তা চাপা দেন। সেদিন উপযুক্ত ব্যবস্থা নিলে আজকের পরিস্থিতি হয়তো দেখতে হতো না। সুতরাং, চাপাচাপির পুনরাবৃত্তি কাম্য নয়। সেই এজেন্ডা এখনো মুলতবি রয়েছে। যাঁরা সংসদকে ভয় পান, তাঁরা পারলে বারে সিদ্ধান্ত নিয়ে দেখান। প্রধান বিচারপতি বিচারকদের কার্য বণ্টন করেন। কে কার সঙ্গে বসবেন এবং কোন এখতিয়ারে দায়িত্ব পালন করবেন, সেটা নিরঙ্কুশভাবে প্রধান বিচারপতি নির্ধারণ করেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কথা উঠেছে। কিন্তু আমাদের ‘মহান সংসদে’ কেউ এ নিয়ে কোনো গোপন বৈঠক ডাকারও তাগিদ অনুভব করেননি।
হাইকোর্টে ফৌজদারি ও রিট মোশনের এখতিয়ারকেই সবচেয়ে আকর্ষণীয় মনে করা হয়। কারণ, রুলের ফোয়ারা ছোটানো এবং অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ প্রদান করার চমক অন্য এখতিয়ারে সেভাবে নেই। আমরা দেখেছি, রাজনৈতিকভাবে আশীর্বাদবঞ্চিত বলে প্রতীয়মান হওয়া বিচারকেরা অনেক সময় এরূপ মোশন ক্ষমতা পান না। আবার কোনো বিচারক বিতর্কিত কিংবা অক্ষম হয়ে পড়লে প্রধান বিচারপতিরা এ ধরনের ক্ষমতা তাঁদের দেন না। উপরন্তু, এই এখতিয়ার সাধারণত কোনো বেঞ্চকে একনাগাড়ে দীর্ঘ সময় দেওয়া হয় না। কিন্তু আলোচ্য বিচারক এই ক্ষমতা দীর্ঘ সময় ধরে অনুশীলন করছেন। মিডিয়ায় তাঁর আচরণ নিয়ে সুনামি চলতে থাকলেও প্রধান বিচারপতিকে আমরা উদাসীন থাকতে দেখেছি।
বিচারকদের জবাবদিহি বিমূর্ত নয়, ছুঁয়ে দেখার বিষয়, সেটা প্রতিষ্ঠিত হোক। এই সরকারের আমলেই এক দিনে একটি বেঞ্চ কয়েক শ জামিন দিয়েছেন। জামিন পাওয়া লোকদের মধ্যে খুন ও ধর্ষণের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরাও ছিল। কিন্তু একটি বাস পোড়ানোর অভিযোগে অভিযুক্ত ৩৩ নেতার জামিন দিতে এ পর্যন্ত প্রায় এক ডজন বিচারককে সম্পৃক্ত হতে হলো। গতকাল তাঁরা কেন জামিন পেলেন, আগে কেন পেলেন না, এর কোনো জবাব মিলবে কি? এসব তো মানুষ বোঝে। টিআইবি যখন আদালতের দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করল, তখন সুপ্রিম কোর্ট প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উদার হতে পারেননি।
আচরণবিধিতে লেখা আছে, প্রধান বিচারপতি চাইলে হাইকোর্টের বিচারকেরা সম্পদের বিবরণী দেবেন। কিন্তু প্রধান বিচারপতি চাইছেন বলে আমরা জানতে পারি না। জবাবদিহির কোনো ব্যবস্থা নেই। কর্মরত, অবসরপ্রাপ্ত, একাডেমিক ও সংসদ সদস্যের সমন্বয়ে কাউন্সিলকে ঢেলে সাজানো যেতে পারে। বিচারপতিদের বিচারের ক্ষমতা সংসদকেই দিতে হবে। তবে সে ধরনের প্রস্তাবের প্রাথমিক নোটিশ মাত্রই ওই কাউন্সিলের কাছে পাঠাতে হবে। এভাবে একটা ভারসাম্যমূলক ব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা ভাবা যায়। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, সংসদ, বার ও বেঞ্চের যে বৈশিষ্ট্য গড়ে উঠেছে, তাতে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনার সত্যিই কোনো পরিবেশ নেই! (শেষ)
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
ভারত নির্জীব সংসদীয় অভিশংসনব্যবস্থাকে সক্রিয় করতে ‘দ্য জুডিশিয়াল স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড অ্যাকাউন্টিবিলিটি বিল, ২০১০ এনেছে। এতে আচরণবিধির লঙ্ঘনকে দ্রুত আমলে নিতে অবিচারক সদস্যদের দিয়ে একটি ওভারসাইট (সতত পর্যবেক্ষণ) কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। আমাদের সুপ্রিম কোর্টে আচরণবিধির কোনো উচ্চারণও দৈবাৎ শ্রুত হয়। আপিল বিভাগের এক সাবেক অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার আমাকে বলেছিলেন, ‘আচরণবিধির অস্তিত্ব সুপ্রিম কোর্ট স্বীকার করে না। সে কারণে এর কোনো প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়নি।’ তাঁর কথা উড়িয়ে দিতে পারি না। কোনো প্রধান বিচারপতি আজ পর্যন্ত একটা অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করতেও রাজি হননি। সদাচরণের পরিপন্থী কোনো কাজ সেখানে দেখার মতো কেউ আছেন বলে জনগণের কাছে কখনোই প্রতীয়মান হয় না।
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে অবশ্যই আলোচ্য বিচারপতির আচরণ তদন্ত করে দেখতে হবে। তদন্তে তিনি দায়মুক্ত হলেই কেবল বিচারিক কাজ চালাতে সমর্থন পেতে পারেন। একই সঙ্গে অভিযোগকারীদের সঙ্গে তাঁর বেঞ্চকেন্দ্রিক কোনো স্বার্থের সংঘাত আছে কি না, তা-ও তদন্তে বেরিয়ে আসবে। প্রধান বিচারপতি এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি লিখলে তা সঠিক পদক্ষেপ হবে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আলটিমেটামের তিন দিনকে ৩০ দিন পড়তে বলেছেন। এখন রাষ্ট্রপতিরও ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হতে পারে, তিনি যদি এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ চান। স্পিকার আবদুল হামিদের রুলিং পর্যন্ত অপেক্ষার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান বিচারপতির তরফে বিবেচ্য হওয়া অগ্রহণযোগ্য মনে হয়।
সংসদের ফ্লোরে যে অভিযোগ উঠেছে, তার তদন্ত করা না হলে দেশের সাংবিধানিক ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা আরও নাজুক হতে থাকবে। স্পিকারের প্রতি অশালীন মন্তব্যের কারণেই আলোচ্য বিচারকের আচরণ আজ উত্তপ্ত বিতর্ক ও মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু অনেক আগে থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ ছিল। স্পিকার কি নাগরিক গোত্রের লোক নন বলেই আজ আলটিমেটামের বোল ফুটল? নাগরিক এমনকি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অসংগত আচরণ করা নিয়ে সংসদ সামান্য উদ্বেগ দেখায়নি। স্পিকার নিজে আক্রান্ত না হলে কি রুলিং মিলত? এই পর্ব চুকে গেলে সুপ্রিম কোর্ট নিয়ে সংসদ কি আর মাথা ঘামাবে না? কয়েক শ বিচারিক আদালতের বিচারক বদলির ক্ষেত্রে যে ভয়ানক অনিয়ম চলছে, তার দায় মুখ্যত প্রধান বিচারপতির। বিদায়ী প্রধান বিচারপতি সংসদে সৌজন্য পরিদর্শনে এসেছিলেন বটে। কিন্তু ইস্যুটি আজও জ্বলন্ত।
ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ সংসদে বিচারকবিরুদ্ধ বক্তব্য সমর্থন করেছেন। এমনকি তিনি বাহাত্তরের সংবিধানের অভিশংসনের বিধান ফিরিয়ে আনতে অভিমত দিয়েছেন। কিন্তু শেষোক্ত অবস্থানের জন্য তিনি তাঁর দল থেকেও কোনো বাহবা পাবেন না। আইনজীবীর চেয়ে তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় যে বড়, এটা তারই প্রমাণ। প্র্যাকটিস-নির্ভর রাজনীতিকেরা মওদুদ বা সেনগুপ্তকে সমর্থন করেননি, করবেন না।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কথায়, সংবিধানের দুই প্রণেতা ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম কাউন্সিল পরিহার করে বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যেতে চান না। গতকাল এ নিয়ে আমি টেলিফোনে কথা বলি আমীর-উল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনার সুযোগ যদিও থাকে, তাহলেও একটা প্রশ্ন জনমনে আন্দোলিত হতে পারে। কারণ, সংসদে যেভাবে পাঁচ মিনিটে অভিশংসনব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার হুমকি এসেছে, তাতে সংশয় দেখা দিতে পারে যে তাহলে পরে পাঁচ মিনিটেই বিচারপতির বিচার হবে কি না।’ কিন্তু কথা হলো, ঘুমন্ত জুডিশিয়াল কাউন্সিল সীমাহীন দায়মুক্তির যে স্বাধীনতা ভোগ করছে, সেই স্বাধীনতা আর কত দিন টিকবে? ৩৫ বছরে এক বিচারককে অপসারণে একটি অস্পষ্ট সুপারিশ করা ছাড়া কাউন্সিলের অন্য সাফল্য নেই।
বিদ্যমান কাউন্সিল আইনগতভাবে দুদকের চেয়েও দুর্দশাগ্রস্ত। কারণ, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার বিষয়েও তদন্ত শুরু করতে দুদক প্রধানমন্ত্রীর মুখাপেক্ষী নয়। দুদকের কাছে বিচারপতিদের কথিত দুর্নীতির বিষয়ে একটি ফাইল আছে। একজন কর্মরত বিচারকের বিরুদ্ধে তদন্তের মনস্থির করেছিল কমিশন। পরে তারা ভয়ে নড়েনি। সংসদের উচিত তাদের ভয় তাড়ানো। কাউন্সিল প্রতিনিয়ত প্রমাণ দিচ্ছে, অন্যান্য সাংবিধানিক পদধারীসহ সুপ্রিম কোর্টের শতাধিক বিচারকের আচরণ দেখভালের দায়িত্ব পালনে তারা অক্ষম। বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী বিবেকের কাছে বিচারকের দায়বদ্ধতার যে পূত যুক্তি দিয়েছেন, তা সর্বজনীন। এর সীমা নিঃসীম। কিন্তু আমরা তো তার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারি না। সংসদ যতই পচে যাক, হোক না পুলিশের মতো, তাই বলে ‘সংসদ হইতে বিচারকদের দূরে থাকার’ পরামর্শ কাম্য হতে পারে না। যে প্রধানমন্ত্রীর জীয়নকাঠিতে সুপ্রিম কোর্টতুল্য কাউন্সিল প্রাণ পায়, সেই প্রধানমন্ত্রী তো সংসদের সৃষ্টি। জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের অনেকের আশঙ্কা, সংসদকে অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হলে তদবির সর্পফণা তুলতে পারে। কারণ ‘তিন শ সাংসদের কাছে তিন শ ফোন’ আছে। তাহলে বার-বেঞ্চ ব্যবস্থা নিক। বারের সভাপতি হিসেবে বিচারক নিয়োগ দিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছিলেন শফিক আহমেদ। আইনমন্ত্রী হয়েই তিনি সেই জুডিশিয়াল কমিশন বিলোপ করেন। তাহলে সান্ত্বনা কোথায়?
বার-বেঞ্চ সম্পর্ক বহু ক্ষেত্রে ভেঙে টুকরো হয়ে আছে। স্পিকারকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলার পর সরকারি দলের সাংসদেরা ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। কারণ, তাঁরা স্পিকারকে নিজেদের একান্ত দলের লোক ভাবেন। তিনি সংসদের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা এমন কোনো জীবিত সংসদ কল্পনা করতে পারি না, যেখানে স্পিকার থাকবেন, বিরোধী দলের নেতা থাকবেন না। কিন্তু আমাদের সরকারি দলের কাছে বিরোধী দলটাই যত নষ্টের গোড়া। ফজলুল হক আমিনীর মামলায় এখতিয়ার-বহির্ভূতভাবে বিরোধীদলীয় নেতাকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত করেছিলেন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী। তখন আমরা এই মুখগুলোকেই তাঁদের ‘মহান সংসদের’ মর্যাদা রক্ষায় ঘর্মাক্ত হতে দেখিনি। অবশ্য, তখন বেঞ্চ থেকে একটা ভালো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।
আমীর-উল ইসলাম, রোকনউদ্দিন মাহমুদ, নুরুল ইসলাম এবং সুপ্রিম কোর্ট বারের তৎকালীন সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন ও সম্পাদক ব্যারিস্টার এম বদরুদ্দোজা চেম্বারে গিয়ে ওই বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। খালেদা জিয়া সম্পর্কে নিবৃত্ত হতে তাঁরা অনুরোধ করেছিলেন। স্পিকারের বিরুদ্ধে বিতর্কিত মন্তব্যকালে একইভাবে সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু ও আইনজীবী আনিসুল হক চেষ্টা করেছিলেন। বহু আইনজীবী ওই বেঞ্চে নানাভাবে নিজেদের আহত বোধ করেন।
সুপ্রিম কোর্ট বার তখন সাত বনাম সাত অনুপাতে বিভক্ত ছিল। যদিও সভাপতি ও সম্পাদক ছিলেন বিএনপির। বারের সভায় সতর্ক এজেন্ডা আনা হয়েছিল ‘হাইকোর্টের জনৈক বিচারকের বিচারকসুলভ আচরণ প্রসঙ্গে’। কিন্তু আওয়ামী আইনজীবীরা তা চাপা দেন। সেদিন উপযুক্ত ব্যবস্থা নিলে আজকের পরিস্থিতি হয়তো দেখতে হতো না। সুতরাং, চাপাচাপির পুনরাবৃত্তি কাম্য নয়। সেই এজেন্ডা এখনো মুলতবি রয়েছে। যাঁরা সংসদকে ভয় পান, তাঁরা পারলে বারে সিদ্ধান্ত নিয়ে দেখান। প্রধান বিচারপতি বিচারকদের কার্য বণ্টন করেন। কে কার সঙ্গে বসবেন এবং কোন এখতিয়ারে দায়িত্ব পালন করবেন, সেটা নিরঙ্কুশভাবে প্রধান বিচারপতি নির্ধারণ করেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কথা উঠেছে। কিন্তু আমাদের ‘মহান সংসদে’ কেউ এ নিয়ে কোনো গোপন বৈঠক ডাকারও তাগিদ অনুভব করেননি।
হাইকোর্টে ফৌজদারি ও রিট মোশনের এখতিয়ারকেই সবচেয়ে আকর্ষণীয় মনে করা হয়। কারণ, রুলের ফোয়ারা ছোটানো এবং অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ প্রদান করার চমক অন্য এখতিয়ারে সেভাবে নেই। আমরা দেখেছি, রাজনৈতিকভাবে আশীর্বাদবঞ্চিত বলে প্রতীয়মান হওয়া বিচারকেরা অনেক সময় এরূপ মোশন ক্ষমতা পান না। আবার কোনো বিচারক বিতর্কিত কিংবা অক্ষম হয়ে পড়লে প্রধান বিচারপতিরা এ ধরনের ক্ষমতা তাঁদের দেন না। উপরন্তু, এই এখতিয়ার সাধারণত কোনো বেঞ্চকে একনাগাড়ে দীর্ঘ সময় দেওয়া হয় না। কিন্তু আলোচ্য বিচারক এই ক্ষমতা দীর্ঘ সময় ধরে অনুশীলন করছেন। মিডিয়ায় তাঁর আচরণ নিয়ে সুনামি চলতে থাকলেও প্রধান বিচারপতিকে আমরা উদাসীন থাকতে দেখেছি।
বিচারকদের জবাবদিহি বিমূর্ত নয়, ছুঁয়ে দেখার বিষয়, সেটা প্রতিষ্ঠিত হোক। এই সরকারের আমলেই এক দিনে একটি বেঞ্চ কয়েক শ জামিন দিয়েছেন। জামিন পাওয়া লোকদের মধ্যে খুন ও ধর্ষণের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরাও ছিল। কিন্তু একটি বাস পোড়ানোর অভিযোগে অভিযুক্ত ৩৩ নেতার জামিন দিতে এ পর্যন্ত প্রায় এক ডজন বিচারককে সম্পৃক্ত হতে হলো। গতকাল তাঁরা কেন জামিন পেলেন, আগে কেন পেলেন না, এর কোনো জবাব মিলবে কি? এসব তো মানুষ বোঝে। টিআইবি যখন আদালতের দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করল, তখন সুপ্রিম কোর্ট প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উদার হতে পারেননি।
আচরণবিধিতে লেখা আছে, প্রধান বিচারপতি চাইলে হাইকোর্টের বিচারকেরা সম্পদের বিবরণী দেবেন। কিন্তু প্রধান বিচারপতি চাইছেন বলে আমরা জানতে পারি না। জবাবদিহির কোনো ব্যবস্থা নেই। কর্মরত, অবসরপ্রাপ্ত, একাডেমিক ও সংসদ সদস্যের সমন্বয়ে কাউন্সিলকে ঢেলে সাজানো যেতে পারে। বিচারপতিদের বিচারের ক্ষমতা সংসদকেই দিতে হবে। তবে সে ধরনের প্রস্তাবের প্রাথমিক নোটিশ মাত্রই ওই কাউন্সিলের কাছে পাঠাতে হবে। এভাবে একটা ভারসাম্যমূলক ব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা ভাবা যায়। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, সংসদ, বার ও বেঞ্চের যে বৈশিষ্ট্য গড়ে উঠেছে, তাতে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনার সত্যিই কোনো পরিবেশ নেই! (শেষ)
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments