চিরকুট-মুদ্রারাক্ষস by শাহাদুজ্জামান
কাপড়ে ঢাকা একটি ছবি। মঞ্চের অভিনেতা বলছেন, ‘এ কাপড়ের নিচে কিছু অশ্লীল ছবি আছে।’ একপর্যায়ে কাপড় সরালে দেখা গেল, সেখানে সাঁটা আছে টাকার কিছু নোট। যত দূর মনে পড়ে, বাদল সরকারের এবং ইন্দ্রজিৎ নাটকের দৃশ্য এটি।
টাকা ব্যাপারটি যে আমাদের অশ্লীল করে তুলতে পারে বা তুলে থাকে, সেটি লক্ষ করার সময় আমাদের কোথায়? সেই কবে মীর মশাররফ হোসেন লিখেছিলেন, ‘হে পাতকী অর্থ তুই সকল অনর্থের মূল।’ কিন্তু ঘটনা হলো, যতই অনর্থের মূল হোক, যতই অশ্লীল হোক, আজকের মানুষ যেন ‘আলো-অন্ধকারে যায়’ আর তার মাথায় স্বপ্ন নয়, ‘অন্য এক বোধ কাজ করে’, সে বোধ টাকার। স্কুলে থাকতে এক বন্ধু মজার সব ধাঁধা জিজ্ঞাসা করত। একদিন বলল, বল তো, ‘পৃথিবীটা কার বশ?’ তারপর জানাল, প্রশ্নের মধ্যেই লুকানো আছে উত্তর। ‘পৃথিবী টাকার বশ।’ অবস্থাদৃষ্টে সেটা অস্বীকার করার উপায় কোথায়?
পরাক্রমশালী এই টাকার জাদুঘরে ঢুকি কৌতূহলী হয়ে। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে একটি বিভাগ রয়েছে এই টাকা নিয়ে। সেটি ঘুরে দেখছিলাম সম্প্রতি। টাকার শক্তিশালী হয়ে ওঠার পেছনে সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস রয়েছে। তবে ব্রিটিশ মিউজিয়াম তুলে ধরেছে টাকার বস্তগত রূপের বিবর্তনকে। হাজার বছর আগের সেই কড়ি থেকে শুরু করে আজকের ক্রেডিট কার্ড পর্যন্ত মুদ্রার বাহ্যিক ও প্রতীকী রূপের যে পরিবর্তন হয়েছে, এর ইতিহাস উপস্থাপন করেছে তারা। প্রায় দুই হাজার বছর আগে ভারত ও চীনে মুদ্রা হিসেবে কড়ির ব্যবহার থাকলেও যখন থেকে ধাতব মুদ্রার প্রচলন শুরু হয়, দেখা যাচ্ছে, তখন থেকে এর প্রতীকী মূল্য বেড়ে গেছে অনেক। মুদ্রার গায়ে সম্রাটের বাণী বা ছবি খোদাই হয়ে পৌঁছে গেছে জনে জনে। মুদ্রা তখন শুধু আর পণ্য বিনিময়ের মাধ্যম মাত্র নয়, মুদ্রা সম্রাটের ক্ষমতা ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার একটি উপায়ও বটে। শুধু প্রাচীনকালে নয়, টাকার গায়ে কোন নেতার ছবি থাকবে—এ নিয়ে এই সেদিনও আমরা আমাদের দেশে বিতর্ক দেখেছি। প্রাচীনকালে মুদ্রার গায়ে আইন খোদাই করে অনেক সম্রাট জনগণকে আইনের বিষয়েও সচেতন করতেন। একটি মুদ্রাকে বিশেষ এলাকার একমাত্র বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ঘোষণা করে সম্রাট তাঁর রাজ্যের সীমানাকেও নিশ্চিত করতেন একসময়, যা অব্যাহত রয়েছে আধুনিক যুগেও। মুদ্রার এই প্রতীকী মূল্যের কারণে দেখা গেছে প্রাচীনকালে অনেক সম্রাট নানা রকম মুদ্রাকে অলংকার হিসেবে পরতেন শরীরে। মুদ্রা সঙ্গে থাকলে পরকালেও বিশেষ ক্ষমতা পাওয়া যাবে—এই বিশ্বাসে বহু সম্রাটের সমাধিতেও দেওয়া হতো অসংখ্য মুদ্রা। নানা দেশের বিচিত্র সোনা, রুপা ও তামার অগণিত মুদ্রার নমুনা দেখি ঘুরে ঘুরে। দেখলাম, নানা দেশের প্রাচীন বিবিধ টাকা বানানোর যন্ত্র। দেখা গেল, আজকের মতো টাকা জাল হতো সে সময়ও। চতুর্দশ শতকের জার্মান চিত্রকলায় এক মুদ্রাবিশেষজ্ঞকে জাল মুদ্রা শনাক্ত করতে দেখতে পাই। মিউজিয়াম টাকা সঞ্চয়ের ইতিহাসকেও তুলে ধরেছে। দেখা যাচ্ছে, প্রাথমিকভাবে সঞ্চয় ব্যাপারটির দায়িত্ব ছিল চার্চসহ অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের। বিশাল বিশাল মাটির কলসিতে মুদ্রা ভরে মাটির নিচে পুঁতে রাখত তারা। ক্রমশ শুরু হয় ব্যক্তিগত সঞ্চয়ের চর্চা। মাটির ব্যাংক থেকে শুরু করে ব্যক্তিগতভাবে মুদ্রা সঞ্চয়ের বিচিত্র নমুনা রয়েছে মিউজিয়ামে। সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউরোপে টাকা জমানোর এক ধরনের বাক্স প্রচলিত ছিল, যা দেখতে ঠিক একটি বাইবেলের মতো। নৈতিক কারণে চোর এ ধরনের বাক্স থেকে টাকা চুরি করতে বিরত থাকত বলে এটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল সে সময়। পৃথিবীব্যাপী রোমান, পারস্য, আরব শাসনের সুবাদে মুদ্রার একটি আন্তর্জাতিক রূপ তৈরি হলেও ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক আমলে তা পাকাপোক্ত রূপ নেয়। ডাচরা ষোড়শ শতাব্দীতেই প্রথম আন্তর্জাতিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে। ঔপনিবেশিক দেশগুলো আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা থেকে সোনা আর রুপা পাচার করে বাড়াতে থাকে তাদের মুদ্রার ভান্ডার। একপর্যায়ে সোনা-রুপা সংগ্রহের জটিলতাসহ আরও নানা ব্যবহারিক জটিলতার পরিপ্রেক্ষিতে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকেই ধাতব মুদ্রার বদলে চালু হয় কাগজের মুদ্রা। মিউজিয়ামে রয়েছে বিশ্বব্যাপী নানা রূপ আর বর্ণের কাগুজে টাকার বিশাল সংগ্রহ। ইতালির লিরা বা হল্যান্ডের গিল্ডারের মতো এমনই অনেক কাগুজে মুদ্রা এখন ইতিহাসে বিলীন। ইউরোপ তার জন্য তৈরি করেছে ইউরো নামের একক মুদ্রা। আর আজকের ক্রেডিট আর ডেবিট কার্ডের যুগে আর্থিক লেনদেনে মুদ্রার ব্যবহার তো প্রায় লুপ্তই হতে বসেছে।
টাকার এই দীর্ঘ পথপরিক্রমা দেখতে দেখতে ভাবি, এই মুদ্রা ব্যবহারিক ও প্রতীকী উভয় অর্থে কী দানবীয় শক্তিমানই না হয়ে উঠেছে আজকের পৃথিবীতে। মনে পড়ে, ওপার বাংলায় দেখা মুদ্রারাক্ষস নাটকটির কথা। রূপকথার রাক্ষস আমরা দেখিনি, কিন্তু মুদ্রা নামের ভয়ংকর রাক্ষসের তাণ্ডব আমরা দেখছি অবিরাম। এই রাক্ষসই যেন এখন শাসন করছে রাজনীতি, প্রেম, সৃজনশীলতাসহ জগতের নানা দিগন্তকে। কোন কালকে কে শাসন করেছে, তা সেকালের স্থাপত্য থেকে আমাদের জেনে নিতে বলেছিলেন একজন চিন্তাবিদ। প্রাচীনকালে পৃথিবীর নানা শহরের প্রধান স্থাপত্য ছিল গির্জা বা মন্দির—বোঝা যায়, ধর্মই সে কালের শাসনকর্তা। মধ্যুযুগের পর পৃথিবীর বহু শহরের প্রধান স্থাপত্য ছিল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো—বোঝা যায়, জ্ঞানই শাসন করেছে সে কালকে। আর আজকের পৃথিবীর যেকোনো শহরের সবচেয়ে বৃহত্তম দালানগুলো হয় কোনো ব্যাংক বা কোনো করপোরেট অফিসের। বলা বাহুল্য, সেসব দালানে বসে মুদ্রারাক্ষসেরাই এখন শাসন করেন আমাদের।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.com
পরাক্রমশালী এই টাকার জাদুঘরে ঢুকি কৌতূহলী হয়ে। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে একটি বিভাগ রয়েছে এই টাকা নিয়ে। সেটি ঘুরে দেখছিলাম সম্প্রতি। টাকার শক্তিশালী হয়ে ওঠার পেছনে সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস রয়েছে। তবে ব্রিটিশ মিউজিয়াম তুলে ধরেছে টাকার বস্তগত রূপের বিবর্তনকে। হাজার বছর আগের সেই কড়ি থেকে শুরু করে আজকের ক্রেডিট কার্ড পর্যন্ত মুদ্রার বাহ্যিক ও প্রতীকী রূপের যে পরিবর্তন হয়েছে, এর ইতিহাস উপস্থাপন করেছে তারা। প্রায় দুই হাজার বছর আগে ভারত ও চীনে মুদ্রা হিসেবে কড়ির ব্যবহার থাকলেও যখন থেকে ধাতব মুদ্রার প্রচলন শুরু হয়, দেখা যাচ্ছে, তখন থেকে এর প্রতীকী মূল্য বেড়ে গেছে অনেক। মুদ্রার গায়ে সম্রাটের বাণী বা ছবি খোদাই হয়ে পৌঁছে গেছে জনে জনে। মুদ্রা তখন শুধু আর পণ্য বিনিময়ের মাধ্যম মাত্র নয়, মুদ্রা সম্রাটের ক্ষমতা ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার একটি উপায়ও বটে। শুধু প্রাচীনকালে নয়, টাকার গায়ে কোন নেতার ছবি থাকবে—এ নিয়ে এই সেদিনও আমরা আমাদের দেশে বিতর্ক দেখেছি। প্রাচীনকালে মুদ্রার গায়ে আইন খোদাই করে অনেক সম্রাট জনগণকে আইনের বিষয়েও সচেতন করতেন। একটি মুদ্রাকে বিশেষ এলাকার একমাত্র বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ঘোষণা করে সম্রাট তাঁর রাজ্যের সীমানাকেও নিশ্চিত করতেন একসময়, যা অব্যাহত রয়েছে আধুনিক যুগেও। মুদ্রার এই প্রতীকী মূল্যের কারণে দেখা গেছে প্রাচীনকালে অনেক সম্রাট নানা রকম মুদ্রাকে অলংকার হিসেবে পরতেন শরীরে। মুদ্রা সঙ্গে থাকলে পরকালেও বিশেষ ক্ষমতা পাওয়া যাবে—এই বিশ্বাসে বহু সম্রাটের সমাধিতেও দেওয়া হতো অসংখ্য মুদ্রা। নানা দেশের বিচিত্র সোনা, রুপা ও তামার অগণিত মুদ্রার নমুনা দেখি ঘুরে ঘুরে। দেখলাম, নানা দেশের প্রাচীন বিবিধ টাকা বানানোর যন্ত্র। দেখা গেল, আজকের মতো টাকা জাল হতো সে সময়ও। চতুর্দশ শতকের জার্মান চিত্রকলায় এক মুদ্রাবিশেষজ্ঞকে জাল মুদ্রা শনাক্ত করতে দেখতে পাই। মিউজিয়াম টাকা সঞ্চয়ের ইতিহাসকেও তুলে ধরেছে। দেখা যাচ্ছে, প্রাথমিকভাবে সঞ্চয় ব্যাপারটির দায়িত্ব ছিল চার্চসহ অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের। বিশাল বিশাল মাটির কলসিতে মুদ্রা ভরে মাটির নিচে পুঁতে রাখত তারা। ক্রমশ শুরু হয় ব্যক্তিগত সঞ্চয়ের চর্চা। মাটির ব্যাংক থেকে শুরু করে ব্যক্তিগতভাবে মুদ্রা সঞ্চয়ের বিচিত্র নমুনা রয়েছে মিউজিয়ামে। সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউরোপে টাকা জমানোর এক ধরনের বাক্স প্রচলিত ছিল, যা দেখতে ঠিক একটি বাইবেলের মতো। নৈতিক কারণে চোর এ ধরনের বাক্স থেকে টাকা চুরি করতে বিরত থাকত বলে এটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল সে সময়। পৃথিবীব্যাপী রোমান, পারস্য, আরব শাসনের সুবাদে মুদ্রার একটি আন্তর্জাতিক রূপ তৈরি হলেও ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক আমলে তা পাকাপোক্ত রূপ নেয়। ডাচরা ষোড়শ শতাব্দীতেই প্রথম আন্তর্জাতিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে। ঔপনিবেশিক দেশগুলো আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা থেকে সোনা আর রুপা পাচার করে বাড়াতে থাকে তাদের মুদ্রার ভান্ডার। একপর্যায়ে সোনা-রুপা সংগ্রহের জটিলতাসহ আরও নানা ব্যবহারিক জটিলতার পরিপ্রেক্ষিতে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকেই ধাতব মুদ্রার বদলে চালু হয় কাগজের মুদ্রা। মিউজিয়ামে রয়েছে বিশ্বব্যাপী নানা রূপ আর বর্ণের কাগুজে টাকার বিশাল সংগ্রহ। ইতালির লিরা বা হল্যান্ডের গিল্ডারের মতো এমনই অনেক কাগুজে মুদ্রা এখন ইতিহাসে বিলীন। ইউরোপ তার জন্য তৈরি করেছে ইউরো নামের একক মুদ্রা। আর আজকের ক্রেডিট আর ডেবিট কার্ডের যুগে আর্থিক লেনদেনে মুদ্রার ব্যবহার তো প্রায় লুপ্তই হতে বসেছে।
টাকার এই দীর্ঘ পথপরিক্রমা দেখতে দেখতে ভাবি, এই মুদ্রা ব্যবহারিক ও প্রতীকী উভয় অর্থে কী দানবীয় শক্তিমানই না হয়ে উঠেছে আজকের পৃথিবীতে। মনে পড়ে, ওপার বাংলায় দেখা মুদ্রারাক্ষস নাটকটির কথা। রূপকথার রাক্ষস আমরা দেখিনি, কিন্তু মুদ্রা নামের ভয়ংকর রাক্ষসের তাণ্ডব আমরা দেখছি অবিরাম। এই রাক্ষসই যেন এখন শাসন করছে রাজনীতি, প্রেম, সৃজনশীলতাসহ জগতের নানা দিগন্তকে। কোন কালকে কে শাসন করেছে, তা সেকালের স্থাপত্য থেকে আমাদের জেনে নিতে বলেছিলেন একজন চিন্তাবিদ। প্রাচীনকালে পৃথিবীর নানা শহরের প্রধান স্থাপত্য ছিল গির্জা বা মন্দির—বোঝা যায়, ধর্মই সে কালের শাসনকর্তা। মধ্যুযুগের পর পৃথিবীর বহু শহরের প্রধান স্থাপত্য ছিল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো—বোঝা যায়, জ্ঞানই শাসন করেছে সে কালকে। আর আজকের পৃথিবীর যেকোনো শহরের সবচেয়ে বৃহত্তম দালানগুলো হয় কোনো ব্যাংক বা কোনো করপোরেট অফিসের। বলা বাহুল্য, সেসব দালানে বসে মুদ্রারাক্ষসেরাই এখন শাসন করেন আমাদের।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.com
No comments