শেকড়ের ডাক-ঋণের টাকায় ঘি কারা খাবে? by ফরহাদ মাহমুদ
এক লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকার বিশাল বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি দেখানো হয়েছে ৪৬ হাজার ২৪ কোটি টাকা। এ ঘাটতির পুরোটাই মেটানো হবে ঋণ নিয়ে। ঋণের ৭৩ শতাংশ বা ৩৩ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা নেওয়া হবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে এবং বাকি ২৭ শতাংশ বা ১২ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা নেওয়া হবে বৈদেশিক উৎস থেকে।
ভ্যাট ও করের মাধ্যমে এই ঋণের বোঝা চূড়ান্তভাবে জনগণকেই পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু কথা হলো, এই ঋণের টাকায় কারা ঘি খাবে?
দেশ পরিচালনা ও উন্নয়নের স্বার্থে বাজেট প্রণয়ন করতেই হবে। কিন্তু সেই বাজেট বাস্তবায়নের পদ্ধতিগুলোও যথার্থ ও স্বচ্ছ করতে হবে। তা না হলে ফুটো পাত্রে পানি ঢালার মতো অবস্থারই সৃষ্টি হবে। এ বছরই পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবর ছিল নিম্নরূপ : 'জলাবদ্ধতা দূর করার লক্ষ্যে রাজধানীর খালগুলোতে থাকা অবৈধ স্থাপনা অপসারণ, খাল খনন ও পাড় বাঁধাইয়ের জন্য সরকার সাড়ে আট কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। এর মধ্যে ওয়াসার ড্রেনেজ সার্কেল সাড়ে পাঁচ কোটি টাকার কাজ শতাধিক ঠিকাদারকে ক্ষুদ্র প্যাকেজের মাধ্যমে প্রদানের প্রক্রিয়া শুরু করে। এ জন্য পত্রিকায় কোনো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়নি। ওয়াসার দুজন কর্মকর্তা প্রতিটি প্যাকেজের জন্য দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা আদায় করেন। তাদের বোঝানো হয়েছিল, আড়াই লাখ টাকা ঘুষের পর মাত্র এক লাখ টাকার কাজ করলেই চলবে। এর পরও ঠিকাদারদের এক থেকে সোয়া লাখ টাকা লাভ থাকবে।' কেউ কি বলতে পারেন, এরপর যে কাজ হবে, তাতে খালগুলোর বাস্তব অবস্থার কোনো পরিবর্তন হওয়া কি সম্ভব? আর পরিবর্তন হয় না বলেই ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা দিন দিন বাড়ছে। পানির লাইনে স্যুয়ারেজের ময়লা ঢুকছে। একই অবস্থা কম-বেশি অন্যত্রও দেখা যায়। সারা দেশেই রাস্তাঘাটের বেহাল দশা জনপরিবহনের দুর্ভোগ চরমে তুলেছে। গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির সংকটে মানুষ ধুঁকে ধুঁকে মরছে। বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) রেলওয়ের জেনারেল ম্যানেজার, সাবেক রেলমন্ত্রীর এপিএস এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সম্পদের হিসাব নিতে শুরু করেছে। তাতে দেখা যায়, তাঁরা সবাই ইতিমধ্যে কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন। কিন্তু সরকারের কোন সংস্থাটি আছে, যেখানে এই লুটপাট চলছে না। ফেঁসে গেছেন বলে রেলওয়ের কয়েকজনের নাম আমরা জানতে পেরেছি। বিদ্যুৎ, গ্যাস, টেলিফোনসহ নাগরিক সেবা প্রদানকারী প্রতিটি সংস্থায়ই চলছে এই লুটপাট। আর সে কারণে লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি পাওয়া 'বিশাল' বাজেটও নাগরিক জীবনের ভোগান্তি কমাতে পারছে না। বরং দিন দিন লুটপাটের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে তা জনভোগান্তিকেই কেবল বাড়িয়ে চলেছে। পাশাপাশি লুটপাটকারীর সংখ্যাও ক্রমে এবং দ্রুত গতিতে বেড়ে চলেছে। তাদের এ লুটের অর্থ কোথা থেকে আসে? হয় জনগণের করের পয়সা থেকে, না হয় দেশি-বিদেশি ঋণ থেকে অথবা রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট করে। প্রতিবছরই বাজেটে যে পরিমাণ অনুমোদিত ও বরাদ্দযুক্ত প্রকল্প থাকে, প্রায় সমপরিমাণ থাকে অননুমোদিত ও বরাদ্দহীন প্রকল্প। বাজেট পরবর্তীকালে সেগুলোকে ইচ্ছামতো অনুমোদন দেওয়া হয়। অভিযোগ আছে, এসব প্রকল্পের অধিকাংশই থাকে রাজনৈতিক বা দলীয় বিবেচনায়। এ বছরের বাজেটও তার ব্যতিক্রম নয়। আর অনুমোদিত প্রকল্পগুলোতেও লুটপাটের আধিক্য ক্রমেই বেশি করে পরিলক্ষিত হচ্ছে।
কোনো দেশ বা সমাজে যখন 'চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স' বা নিয়ন্ত্রণ না থাকে, তখন অবস্থার দিন দিন অবনতিই হয়। বাংলাদেশেও তাই ঘটেছে। সংস্থাগুলোর প্রশাসনে কোনো চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স নেই। প্রশাসনের দলীয়করণ চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেছে। আর দলীয় পাণ্ডাদের তো কাউকে তোয়াক্কা করার প্রয়োজন হয় না। দুর্নীতি ও লুটপাট তখন হয়ে পড়ে অবশ্যম্ভাবী এবং ফ্রি-স্টাইল। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয়ভাবে যেসব নিয়ন্ত্রণ থাকা প্রয়োজন ছিল সেসব নিয়ন্ত্রণও নেই। নিধিরাম সর্দার হিসেবে যে দুদক আছে সেটি রাজনৈতিক প্রয়োজনে ব্যবহৃত হওয়া ছাড়া এ পর্যন্ত তেমন কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেনি। বিগত নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ দুদককে শক্তিশালী করার যে প্রতিশ্রুতি মানুষকে দিয়েছিল, সে প্রতিশ্রুতিও তারা রাখেনি। দুর্নীতিগ্রস্ত যে কর্মকর্তা ১০ তলা ভবন নির্মাণ করছে, সেই কর্মকর্তার আয়-ব্যয়ের হিসাবটা মিলিয়ে দেখার ক্ষমতা আমাদের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআরের নেই, দুদকের তো নেই-ই। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলছি; কিন্তু ফ্ল্যাট, প্লট বা জমি কেনাবেচার তথ্যগুলোকে এখনো আমরা ডিজিটালাইজ করতে পারিনি। এটি করা গেলে দুদক বা এনবিআরের পক্ষে সঠিক তথ্য পাওয়া অনেক সহজ হতো। এ অবস্থায় দুর্নীতিবাজরা ফ্রি-স্টাইল হবে না কেন?
বাজেটের আরেকটি দিক অত্যন্ত বেদনাদায়ক। সেটি হলো দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার। রাজধানী ও বড় শহরগুলোতে বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাট বা বাড়ি আছে এমন অনেক মালিক আছেন যাঁরা আয়কর দেন না। এমন অনেক দোকান মালিক বা ব্যবসায়ী আছেন, যাঁদের মাসিক আয় ৫০ হাজার টাকার বেশি, যাঁরা কর দেন না। তাঁদের করের আওতায় আনার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপও নেওয়া হয় না। অথচ বছরে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা আয় করেন যে চাকরিজীবী, তাঁকে আয়কর দিতে হবে। তাঁর মাসিক আয় কত? ১৫ হাজার টাকা। ঢাকায় যেনতেন একটি টিনশেড ভাড়া করতেও যেখানে সাত-আট হাজার টাকার বেশি লাগে, সেখানে এই চাকরিজীবীর তো পরিবার-পরিজন নিয়ে খেয়েপরে বেঁচে থাকাটাই কষ্টকর। সন্তানের লেখাপড়া, বিনোদনের কথা তাঁর পক্ষে ভাবাই সম্ভব নয়। তাঁকেও আয়কর দিতে হবে এবং ন্যূনতম আয়কর তিন হাজার টাকাই দিতে হবে। যে সরকার নিজেকে 'গরিব বান্ধব' বলে দাবি করে, সেই সরকারের অর্থনীতিবিশারদরা এর পক্ষে কী যুক্তি দেবেন?
'ডিজিটাল বাংলাদেশ', 'রূপকল্প ২০২১', 'লক্ষ্য ২০৩০', 'জনবান্ধব স্বাস্থ্যনীতি', 'স্বাধীন ও শক্তিশালী দুর্নীতি দমন কমিশন'- এমনি কথার কথা আমাদের নেতারা প্রায়ই বলেন। আর আমরা, মানে আমজনতা উপায়ান্তরহীন। তাই বারবারই আমরা নানা রকম ধোঁকার শিকার হই- কখনো এর দ্বারা, কখনো ওর দ্বারা। কিন্তু আমরা কি চিরকালই এমন ধোঁকার শিকার হয়ে যেতেই থাকব? আর যাঁরা ধোঁকা দেন, তাঁরা হয়তো জেনে-বুঝেই এসব ধোঁকার আশ্রয় নেন। কারণ তা না হলে, জনগণের মাথায় ঋণের বোঝা চাপিয়ে তারা ঘি খেতে পারবেন না কিংবা আঙুল ফুলে কলাগাছ হতে পারবেন না যে!
লেখক : সাংবাদিক
No comments