মাটির রঙের ফেরিওয়ালা by আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ

গর্তের ভেতর খানিকটা পানি। তাতে একটি টুল নিয়ে বসেছে মেয়েটি। পানির ভেতরে অনবরত হাত নেড়ে যাচ্ছে। বাইরে থেকে দেখে তার কাজটি বোঝার উপায় নেই। সে আসলে পানিতে ধুয়ে মাটির রং বের করছে। মেয়েটির নাম জেসমিন। নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার চান্দইল গ্রামের মাটির স্তরে স্তরে লাল রং পাওয়া যায়।


এ রং দিয়ে নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার বিভিন্ন উজেলার মানুষ আশপাশের গ্রামের মানুষের জন্য রং তৈরি করে। তৈরি করা এ রং ফেরি করে বিক্রি করে কিছু লোক। বেশির ভাগ সময় এই রং বাড়ির গৃহবধূ ফেরিওয়ালার কাছ থেকে ধান-চাল দিয়ে কিনে থাকে। একটি লাল রঙের পাটালি তিন-চার টাকা করে বিক্রি হয়। অথবা এক কেজি চাল দিয়ে আট-দশটা পাটালি রং পাওয়া যায়।
এই রং কিছুটা কাঁকর আকারে মাটির সঙ্গে মিশে থাকে। মাটি খুঁড়ে লাল কাঁকরওয়ালা মাটি তুলে মূলত এই রং তৈরি করা হয়। এ এলাকায় অনেক খাসজমি পড়ে আছে। এগুলোয় কোনো ফসল হয় না। কিছু জায়গায় সরকারিভাবে বনায়ন করা হয়েছে। বন এলাকা বাদ দিয়ে ফেরিওয়ালারা সাধারণত এসব খাসজমি থেকে মাটি খুঁড়ে কাঁকরওয়ালা লাল মাটি তুলে আনে। এ মাটি পানিতে ভেজালে মাটির সাধারণ অংশ গলে যায়। কিন্তু কাঁকর অংশটি থেকে যায়। এগুলো আলাদা করে এক জায়গায় রেখে পানি দিয়ে ছেনে কাদা করা হয়। এরপর পাটালির আকার করে রোদে শুকানো হয়। তখন দূর থেকে দেখতে অবিকল খেজুরের গুড়ের পাটালিই মনে হয়। ফেরিওয়ালারা এরপর এগুলো গ্রামে গ্রামে রং হিসেবে বিক্রি করে। গ্রামের মধ্যে ঢুকেই তাঁরা ‘লাল মাটির আখির লেন...’ বলে হাঁক দেন। হাঁক শুনে গৃহবধূরা এসে চাল অথবা টাকা দিয়ে নেন ওই রং।
নওগাঁর নিয়ামতপুর, পোরশা, সাপাহার ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল এলাকায় এই মাটির কারিগরদের দেখা যায়। নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলা সদর থেকে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দক্ষিণে চান্দইল গ্রাম। গত ৬ এপ্রিল এ গ্রামে ঢুকতেই দেখা যায়, একটি ইউক্যালিপটাস বাগানের ভেতরে রঙের জন্য মাটি খুঁড়ছেন কয়েকজন শ্রমিক। রাস্তার ওপর দাঁড়ানো দুখানা ভ্যানে তাঁরা মাটি বোঝাই করছেন। কাছে গিয়ে দেখা যায়, মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে তাঁরা ভেতরে ঢুকে গেলেন। মাটির ওপর দিব্যি গাছ দাঁড়িয়ে আছে। আর এর নিচে গর্ত হয়ে গেছে। এমনও হয়েছে—গর্তের ভেতরে ঢুকে খুঁড়তে গিয়ে ওপরের মাটির চাপায় মানুষ মারা গেছে। এর পরও থেমে থাকেনি মাটির রঙের সন্ধান। মাটি বিক্রি করেই সেখানে জীবন চালাচ্ছে একদল মানুষ।

No comments

Powered by Blogger.