চারদিক-আমার একটা নদী ছিল by দীপংকর চন্দ
একেবারেই ছোট যখন, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় যখন যুক্ত হয়নি কোনো নদী, মোটামুটি তখনকার কথা। বয়োজ্যেষ্ঠদের গল্পের নানা সূত্রে এবং বহু ধরনের শিশুতোষ বইয়ের অক্ষর ছুঁয়ে একটা নদী জন্ম নিল আমার বুকের ভেতর। কাকচক্ষু জলের নিস্তরঙ্গ সেই নদীর বাঁকে বাঁকে সরলতা।
দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে-রূপে-সৌন্দর্যে অনন্য সেই নদীর দুকূলজুড়ে প্রণিধানযোগ্য পরিচ্ছন্নতা। নদীটির একটা নাম দেওয়া দরকার। নামহীন কোনো কিছুর সঙ্গে আত্মীয়তা যেন ঠিক জমে না! কী নাম দেওয়া যায় নদীটির? সমবয়সীদের কাছে জিজ্ঞেস করলাম প্রথমে। তারা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। অনন্যোপায় হয়ে বড়দের দ্বারস্থ হলাম। আমার কথা তাঁরা ভালো করে শুনলেনই না; বরং স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্যে এসব উদ্ভট চিন্তা মন থেকে ঝেড়ে ফেলার আদেশ দিলেন আমাকে। কিন্তু আমার তখন শয়নে-স্বপনে নদী। নদীর নাম আমার অবশ্যই চাই। আমি নিজেই তখন নদীর নাম খোঁজার চেষ্টা করলাম। একটা খুব সুন্দর নদীকে নামহীন রাখার অপরাধ কাঁধে নেওয়া যায় না কিছুতেই।
কয়েক দিন কয়েক রাত চেষ্টার পর একটা নাম শিশিরস্নাত শিউলির মতো ঝরে পড়ল ভাবনার সবুজ আঁচলে। ‘মালঞ্চ’। চেতন কিংবা অবচেতনের কোনো স্তর থেকে, কোনো আধিভৌতিক অভিজ্ঞতার আদ্যকেন্দ্র থেকে এই নামের জন্ম—কে জানে, তবে মালঞ্চ নামটা বেশ মানিয়ে গেল আমার বুকের গহিনে বাসা বাঁধা নদীটির সঙ্গে।
নদীর নাম দেওয়ার ব্যাপারে কারও কোনো আগ্রহ কিংবা উৎসাহ না থাকলেও নদীর নাম শুনে এবার কিন্তু নড়েচড়ে উঠল সবাই। শুরু হলো নানাজনের নানামুখী আলোচনা, সমালোচনা, মন্তব্য। দূর! নদীর নাম আবার মালঞ্চ হয় নাকি! এমন কথা শুনে আমার শিশুমুখটা ম্লান হলো স্বাভাবিকভাবেই। পাশাপাশি আবাধ্য একটা জেদও তৈরি হলো ভেতরে। যে যা-ই বলুক, আমার নদীর নাম মালঞ্চ-ই। মালঞ্চ নামের নদী অবশ্যই হয়। বড় হয়ে মালঞ্চ নামের নদী খুঁজে বের করে আমি দেখিয়ে দেব সবাইকে।
এই জেদ আমার অটুট রইল পরবর্তী জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে। বিভিন্নমুখী কাজ কিংবা অকাজের পাশাপাশি শুরু হলো একটা নদী খোঁজার খেলা। শৈশবের শেষ পর্যায়ে বাস্তবিক অর্থে প্রথম নদী দেখলাম আমি। আমাদের নিম্নমধ্যবিত্ত মহল্লার পাশেই ছিল ধোপাপাড়া। ধোপাপাড়ার মানুষগুলো ছিল জলের আত্মীয়। বিভিন্ন জলাশয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল তাদের। শুধু বড়রাই নয়, ধোপাপাড়ার অসীম সাহসী শিশুরাও নিকটবর্তী জলাশয়গুলোর খোঁজখবর রাখত বেশ ভালোভাবেই। অভিভাবকদের নিষেধ মানার দেয়াল টপকে একদিন ধোপাপাড়ার শিশুদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম আমি। চেনা পৃথিবী পেছনে ফেলে মালঞ্চ নদী খুঁজতে গিয়ে পরিচয় হলো বাস্তব জীবনের প্রথম নদী শীতলক্ষ্যার সঙ্গে।
তারপর অতিবাহিত হয়েছে অনেক সময়। বুকের ভেতরে থাকা নদীর বাস্তব অস্তিত্ব অনুসন্ধান করতে করতে কত নদ-নদীর বাঁকে ঘুরেছি আমি! পদ্মা-মেঘনা-যমুনা। গঙ্গা-বুড়িগঙ্গা-নবগঙ্গা। ব্রহ্মপুত্র-আঁড়িয়াল খাঁ-কপোতাক্ষ। মাতামুহুরি-হালদা-কর্ণফুলী। কুমার-নারদ-ভৈরব। পুনর্ভবা-করতোয়া-মহানন্দা। সোমেশ্বরী-ধলেশ্বরী-ফুলেশ্বরী। সন্ধ্যা-সুগন্ধা-কীর্তনখোলা। ইছামতি-শঙ্খ-বিষখালী।
নানা নদীর বাঁকে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ খুঁজে পেলাম ময়ূর নামের একটি নদকে। খুলনা মহানগরের প্রান্ত ছুঁয়ে প্রবাহিত হয়ে রূপসা নদীর সঙ্গে মিলিত হওয়া এই নদটি আশা বাড়িয়ে দিল আমার। কেন জানি মনে হলো মালঞ্চ নদী খুঁজে পাওয়া মূলত সময়ের ব্যাপার!
ঘুরে বেড়ানোর আগ্রহ থেকে সাতক্ষীরা জেলার কালীগঞ্জ উপজেলায় গেলাম। কাকশিয়ালি নামের একটা খরস্রোতা নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে লোকালয়। বাসস্ট্যান্ডের পাশেই মাছের আড়ত। প্রখর বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন আড়তদার মো. আফসারের সঙ্গে পরিচয় হলো। তিনি বললেন সুন্দরবনের কথা। কালীগঞ্জ থেকে খুব বেশি দূরে নয় সুন্দরবন। একবার ঘুরে গেলে মন্দ হয় না। ভাবনার সূত্র ধরেই চেপে বসলাম বাসে। কালীগঞ্জ পেছনে ফেলে শ্যামনগর। শ্যামনগর পেছনে ফেলে মুন্সিগঞ্জ।
মুন্সিগঞ্জ পৌঁছে থেমে গেল বাস। আমাদের নামতে হবে এখানেই। এরপর হাঁটতে হবে আবার। কিন্তু সুন্দরবন কোথায়? সামনে দাঁড়ানো একজন ডাববিক্রেতার কাছে জানতে চাইলাম। তিনি আঙুল তুলে নিস্পৃহ স্বরে বললেন, ‘এই তো’। কৌতূহলী দৃষ্টিতে আমি তাকালাম তাঁর আঙুল-নির্দেশিত দিকপ্রান্তে। একি! এ যে সত্যি! সত্যিই তো সুন্দরবন আমার দৃষ্টি প্রত্যক্ষে! কী ভীষণ অপার্থিব ঔদাসীন্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনিন্দ্যসুন্দর বনটি! বর্ণনাতীত সৌন্দর্যের একটা স্বর্গীয় নদীও আছে সামনে! সুন্দরবনের সঙ্গে লোকালয়ের বিভাজন রেখা টেনে কী মৌনমুখরভাবে নদীটি বয়ে চলেছে অমরাবতীর দিকে! আবেগের আতিশয্যে প্রায় বাকরুদ্ধ আমি অস্ফুটস্বরে জানতে চাইলাম, ‘কী নাম এই নদীর?’ কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরের কোনো এক অচেনা গ্রহ থেকে যেন উত্তর ভেসে এল, ‘মালঞ্চ’।
অভূতপূর্ব আনন্দে অবগাহন করতে করতে আমি আবিষ্কার করলাম, আমার বুকের ভেতর বসবাস করা মালঞ্চ নদীর চেয়ে বাস্তবের মালঞ্চ নদী অনেক বেশি রূপবতী, অনেক বেশি ঐশ্বর্যশালী, অনেক বেশি নান্দনিক।
দীপংকর চন্দ
কয়েক দিন কয়েক রাত চেষ্টার পর একটা নাম শিশিরস্নাত শিউলির মতো ঝরে পড়ল ভাবনার সবুজ আঁচলে। ‘মালঞ্চ’। চেতন কিংবা অবচেতনের কোনো স্তর থেকে, কোনো আধিভৌতিক অভিজ্ঞতার আদ্যকেন্দ্র থেকে এই নামের জন্ম—কে জানে, তবে মালঞ্চ নামটা বেশ মানিয়ে গেল আমার বুকের গহিনে বাসা বাঁধা নদীটির সঙ্গে।
নদীর নাম দেওয়ার ব্যাপারে কারও কোনো আগ্রহ কিংবা উৎসাহ না থাকলেও নদীর নাম শুনে এবার কিন্তু নড়েচড়ে উঠল সবাই। শুরু হলো নানাজনের নানামুখী আলোচনা, সমালোচনা, মন্তব্য। দূর! নদীর নাম আবার মালঞ্চ হয় নাকি! এমন কথা শুনে আমার শিশুমুখটা ম্লান হলো স্বাভাবিকভাবেই। পাশাপাশি আবাধ্য একটা জেদও তৈরি হলো ভেতরে। যে যা-ই বলুক, আমার নদীর নাম মালঞ্চ-ই। মালঞ্চ নামের নদী অবশ্যই হয়। বড় হয়ে মালঞ্চ নামের নদী খুঁজে বের করে আমি দেখিয়ে দেব সবাইকে।
এই জেদ আমার অটুট রইল পরবর্তী জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে। বিভিন্নমুখী কাজ কিংবা অকাজের পাশাপাশি শুরু হলো একটা নদী খোঁজার খেলা। শৈশবের শেষ পর্যায়ে বাস্তবিক অর্থে প্রথম নদী দেখলাম আমি। আমাদের নিম্নমধ্যবিত্ত মহল্লার পাশেই ছিল ধোপাপাড়া। ধোপাপাড়ার মানুষগুলো ছিল জলের আত্মীয়। বিভিন্ন জলাশয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল তাদের। শুধু বড়রাই নয়, ধোপাপাড়ার অসীম সাহসী শিশুরাও নিকটবর্তী জলাশয়গুলোর খোঁজখবর রাখত বেশ ভালোভাবেই। অভিভাবকদের নিষেধ মানার দেয়াল টপকে একদিন ধোপাপাড়ার শিশুদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম আমি। চেনা পৃথিবী পেছনে ফেলে মালঞ্চ নদী খুঁজতে গিয়ে পরিচয় হলো বাস্তব জীবনের প্রথম নদী শীতলক্ষ্যার সঙ্গে।
তারপর অতিবাহিত হয়েছে অনেক সময়। বুকের ভেতরে থাকা নদীর বাস্তব অস্তিত্ব অনুসন্ধান করতে করতে কত নদ-নদীর বাঁকে ঘুরেছি আমি! পদ্মা-মেঘনা-যমুনা। গঙ্গা-বুড়িগঙ্গা-নবগঙ্গা। ব্রহ্মপুত্র-আঁড়িয়াল খাঁ-কপোতাক্ষ। মাতামুহুরি-হালদা-কর্ণফুলী। কুমার-নারদ-ভৈরব। পুনর্ভবা-করতোয়া-মহানন্দা। সোমেশ্বরী-ধলেশ্বরী-ফুলেশ্বরী। সন্ধ্যা-সুগন্ধা-কীর্তনখোলা। ইছামতি-শঙ্খ-বিষখালী।
নানা নদীর বাঁকে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ খুঁজে পেলাম ময়ূর নামের একটি নদকে। খুলনা মহানগরের প্রান্ত ছুঁয়ে প্রবাহিত হয়ে রূপসা নদীর সঙ্গে মিলিত হওয়া এই নদটি আশা বাড়িয়ে দিল আমার। কেন জানি মনে হলো মালঞ্চ নদী খুঁজে পাওয়া মূলত সময়ের ব্যাপার!
ঘুরে বেড়ানোর আগ্রহ থেকে সাতক্ষীরা জেলার কালীগঞ্জ উপজেলায় গেলাম। কাকশিয়ালি নামের একটা খরস্রোতা নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে লোকালয়। বাসস্ট্যান্ডের পাশেই মাছের আড়ত। প্রখর বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন আড়তদার মো. আফসারের সঙ্গে পরিচয় হলো। তিনি বললেন সুন্দরবনের কথা। কালীগঞ্জ থেকে খুব বেশি দূরে নয় সুন্দরবন। একবার ঘুরে গেলে মন্দ হয় না। ভাবনার সূত্র ধরেই চেপে বসলাম বাসে। কালীগঞ্জ পেছনে ফেলে শ্যামনগর। শ্যামনগর পেছনে ফেলে মুন্সিগঞ্জ।
মুন্সিগঞ্জ পৌঁছে থেমে গেল বাস। আমাদের নামতে হবে এখানেই। এরপর হাঁটতে হবে আবার। কিন্তু সুন্দরবন কোথায়? সামনে দাঁড়ানো একজন ডাববিক্রেতার কাছে জানতে চাইলাম। তিনি আঙুল তুলে নিস্পৃহ স্বরে বললেন, ‘এই তো’। কৌতূহলী দৃষ্টিতে আমি তাকালাম তাঁর আঙুল-নির্দেশিত দিকপ্রান্তে। একি! এ যে সত্যি! সত্যিই তো সুন্দরবন আমার দৃষ্টি প্রত্যক্ষে! কী ভীষণ অপার্থিব ঔদাসীন্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনিন্দ্যসুন্দর বনটি! বর্ণনাতীত সৌন্দর্যের একটা স্বর্গীয় নদীও আছে সামনে! সুন্দরবনের সঙ্গে লোকালয়ের বিভাজন রেখা টেনে কী মৌনমুখরভাবে নদীটি বয়ে চলেছে অমরাবতীর দিকে! আবেগের আতিশয্যে প্রায় বাকরুদ্ধ আমি অস্ফুটস্বরে জানতে চাইলাম, ‘কী নাম এই নদীর?’ কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরের কোনো এক অচেনা গ্রহ থেকে যেন উত্তর ভেসে এল, ‘মালঞ্চ’।
অভূতপূর্ব আনন্দে অবগাহন করতে করতে আমি আবিষ্কার করলাম, আমার বুকের ভেতর বসবাস করা মালঞ্চ নদীর চেয়ে বাস্তবের মালঞ্চ নদী অনেক বেশি রূপবতী, অনেক বেশি ঐশ্বর্যশালী, অনেক বেশি নান্দনিক।
দীপংকর চন্দ
No comments