স্বপ্ন আছে, পূরণে জোর নেই
চলতি বছরের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ শতাংশ, সর্বশেষ হিসাবে অর্জিত হয়েছে ৬.৩ শতাংশ। তবু গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে এক লাখ ৯১ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকার বাজেট পেশ করার সময় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, আগামী অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করা হয়েছে ৭.২ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতি এখনো ৯ শতাংশের ওপরে, খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি এখনো ১২ শতাংশের বেশি। তবু আগামী অর্থবছরে (২০১২-১৩) তা সাড়ে ৭ শতাংশে নামিয়ে আনার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে উচ্চাশাসহ নানা প্রতিশ্রুতি থাকলেও তা বাস্তবায়নের তাগিদ নেই অর্থমন্ত্রীর বিশালাকার বাজেট বক্তৃতার বইয়ে। বরং এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে আগের তিন অর্থবছরের নানা প্রতিশ্রুতির বহর। বর্তমান সরকারের আগামী দেড় বছরে নতুন-পুরনো প্রতিশ্রুতি কিভাবে তিনি পূরণ করবেন, তা পাশ কাটিয়ে গেছেন সুকৌশলে। বরং তাঁর অসমাপ্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ভার দিয়ে দিয়েছেন দেড় বছর পরে জাতীয় নির্বাচনে যে সরকার গঠিত হবে, তার ওপর। তিনি স্পষ্টই আশা প্রকাশ করে বলেছেন, 'এ সরকারের নেওয়া বিভিন্ন নীতি ও কর্মসূচি যা বাস্তবায়ন করতে পারছি না, তা যেন পরের সরকার বাস্তবায়ন করে।'
বৈদেশিক উৎস থেকে প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা বাড়ায় স্বভাবতই দেশীয় উৎসের দিকে নজর দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তবে তাঁর এ উদ্যোগে হতদরিদ্র মানুষও রেহাই পাবে না। প্রগতিশীল রাজস্ব আদায় ব্যবস্থাপনায় মূলত ধনীদের কাছ থেকে কর নিয়ে দরিদ্রদের জন্য সেবা বাড়ানোর কথা। তবে এবারের বাজেটে কর আদায়ের লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী ও টিআইএন নেই এমন ব্যাংক হিসাবধারীরা।
কর ভিত্তি সম্প্রসারণ ও কর পরিমণ্ডল বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশজ সম্পদ বাড়ানোর পরিকল্পনার শিকার হচ্ছেন দেশের প্রায় ৯ কোটি মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন দরিদ্র কৃষক, শ্রমিক। বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে যে প্রায় ৯০ লাখ কৃষকের ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে, তাঁদের টিআইএন নেই। এবারের বাজেটে সুদের ওপর ১০০ টাকায় তাঁদের কাছ থেকে ১৫ টাকা উৎসে কর আদায় করা হবে। আয় বৃদ্ধির কথা বলে ন্যূনতম কর দুই হাজার থেকে বাড়িয়ে তিন হাজার টাকা করা হয়েছে। কিন্তু জীবনযাত্রার অনিয়ন্ত্রিত ব্যয় বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে সব মহল থেকে দাবি জানানো হলেও ব্যক্তির করমুক্ত আয়সীমা এক লাখ ৮০ হাজার টাকাই রাখা হয়েছে।
বৈদেশিক সহায়তা না পাওয়ায় বিদায়ী অর্থবছরের এডিপি পাঁচ হাজার কোটি টাকা কমাতে হয়েছিল। বৈদেশিক উৎস থেকে আশা করা হয়েছিল ১৩ হাজার ৫৮ কোটি টাকা, সংশোধন করে কমানো হয়েছে প্রায় অর্ধেক। তবু আগামী অর্থবছরে বৈদেশিক সহায়তা ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ৫৮৪ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত এক লাখ ৯১ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকার বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৫ হাজার কোটি টাকা। বরাবরের মতো বাজেট ঘাটতিও এর কাছাকাছি- ৫২ হাজার ৬৮ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী সংসদে বলেছেন, তাঁর ইচ্ছা ছিল দুই লাখ কোটি টাকার বাজেট পেশ করার। সম্পদের সীমাবদ্ধতায় তা সম্ভব হয়নি।
বিদ্যুৎ-গ্যাস সংকটসহ অবকাঠামো খাতের দুর্বলতা, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের কারণে এমনিতেই বিনিয়োগে স্থবিরতা বিরাজ করছে। সরকারি-বেসরকারি অংশগ্রহণ বা পিপিপির মাধ্যমে অবকাঠামো খাতে উন্নয়নের কথা তিন বছর ধরেই অর্থমন্ত্রী বলে আসছেন, এবারও বলেছেন। তিনি জানিয়েছেন, আশানুরূপ না হলেও উল্লেখযোগ্য কিছু প্রকল্প পিপিপির অধীনে নেওয়া হয়েছে। আটটি প্রকল্প চিহ্নিত করা হয়েছে। এতে ব্যয় হবে তিন হাজার কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী নিজেও স্বীকার করেছেন করপোরেট করের হার বাংলাদেশে বেশি। তবে বাজেটে তা কমানো হয়নি, বরং রপ্তানি খাতে প্রবৃদ্ধি কমে গেলেও সেখানে উৎসে করহার প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে। এতে রপ্তানি খাতে চাপ বাড়বে।
বাজেট বক্তৃতাকালে অর্থমন্ত্রী এই বাড়তি অর্থ নেওয়া প্রসঙ্গে বলেছেন, কৃষি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি বাড়ার কারণে তাঁকে ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিতে হয়েছে। এর ফলে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমেছে। ব্যাংক ঋণের সুদ কমেছে। তত্ত্বগতভাবে বিনিয়োগও কমেছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার এতসব নেতিবাচক দিক অর্থমন্ত্রীর চোখে স্পষ্ট হওয়ার পরও নতুন অর্থবছরে ২৩ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকেই নেওয়ার পরিকল্পনা তুলে ধরেছেন তিনি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, ব্যাংকগুলো এমনিতেই তারল্য সংকটে রয়েছে। আমানত সংগ্রহে মরিয়া ব্যাংকগুলো ১৪ শতাংশ পর্যন্ত সুদ গুনছে তারল্য সংকট কাটাতে। এ অবস্থার মধ্যে নতুন অর্থবছরে এই বিপুল পরিমাণ অর্থের জোগান দিতে ব্যাংকগুলোকে আরো নাজুক অবস্থার মধ্যেই পড়তে হবে। নতুন অর্থবছরে অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকের ওপর এত বেশি নির্ভর করলে তাতে ঋণের সুদহার যেমন কমবে না, তেমনি বেসরকারি খাতের বিকাশও বাধাগ্রস্ত হবে।
এবার করসহ সামগ্রিক বাজেট কাঠামো গোছানো বলে মত দিয়েছেন এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ। তিনি বলেছেন, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হলেও এটি করা হয়েছে আইনের আওতায়ই। এতে খুব বেশি ছাড় দেওয়া হয়েছে বলে মনে করার কিছু নেই। বিদ্যমান আইনের ১২৮(১) ধারায় বলা আছে, সময়মতো কর না দিলে প্রাপ্ত করের সঙ্গে প্রতিবছর অতিরিক্ত ১০ শতাংশ করে জরিমানা দিতে হবে। এবার সেটি ফ্ল্যাট হারে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। তবু একজন করদাতাকে ৩৫ শতাংশ কর দিতে হবে কালো টাকা সাদা করার ক্ষেত্রে। আরো তিনটি ইতিবাচক দিক দেখেছেন তিনি। শুল্ক ও ভ্যাট-সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো বাজেট পাস হওয়ার দিন থেকে কার্যকর করার ঘোষণাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন তিনি। এর ফলে সাময়িক সময়ের মধ্যে জিনিসপত্রের দাম বাড়ানোর সুযোগ কমবে বলে তিনি মনে করেন। পুঁজিবাজারের ক্ষেত্রে মার্চেন্ট ব্যাংকের করপোরেট কর ৫ শতাংশ কমানো একটা ভালো সিদ্ধান্ত বলে উল্লেখ করেন তিনি। তিন বছরের অবচয় সুবিধা বাড়িয়ে পাঁচ বছর করার পাশাপাশি অর্থমন্ত্রী এই বার্তাও গাড়ি ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন যে, কোনোমতেই একই উৎস থেকে আনা নতুন গাড়ির দাম পুরনো গাড়ির চেয়ে কম দেখানো যাবে না।
উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেছেন, প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে বিনিয়োগ বাড়ার পরিবেশ থাকতে হবে। জীবনযাত্রার ব্যয় অব্যাহতভাবে বাড়ার কারণে মানুষের ভোগ ব্যয়ের সামর্থ্য কমে গেছে। মানুষ যদি পণ্য ও সেবা কম কেনে, তাহলে উৎপাদন ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি কমবে, বিনিয়োগ কমবে। সে ক্ষেত্রে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে প্রাক্কলন তা অর্জন দুরূহ হবে।
ড. তিতুমীরের মতে, সামষ্টিক ব্যবস্থাপনা আইএমএফের নজরদারিতে থাকায় সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিই বহাল রাখবে বাংলাদেশ ব্যাংক। সে কারণে ব্যাংক ঋণের সুদ কমার সম্ভাবনা থাকবে না, ফলে বিনিয়োগেও গতি আসবে না। বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়ানো ও দারিদ্র্য কমানোর যেসব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, সেগুলোও অর্জিত হবে না। বাংলাদেশ অর্থনীতি স্বাভাবিক গতিতে এগোতে দিলেও সাড়ে ৭ থেকে ৮ শতাংশ হারে বাড়ত। কিন্তু সংকোচনমূলক নীতি সে পথ রুদ্ধ করছে। বাজেটের লক্ষ্য অর্জন করতে হলে সম্প্রসারণমুখী, প্রবৃদ্ধিমুখী রাজস্ব ও মুদ্রানীতি নিয়ে এগোতে হবে, তাতে বাজেট ঘাটতি বাড়লেও ক্ষতি নেই।
আঞ্চলিক বৈষম্য কমানোর কোনো কর্মসূচি এবারের বাজেটেও নেই। তবে তিনি জেলা বাজেটের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, আগামী অর্থবছরে খসড়া শ্রেণীবিন্যাস কাঠামো চূড়ান্ত করা হবে। তারপর এ অঙ্গীকার বাস্তবায়নের কাজ শুরু হবে।
আগের বাজেটের মতোই দীর্ঘমেয়াদি বড় বড় পরিকল্পনা, মহাপরিকল্পনার ফিরিস্তি আছে বাজেট বক্তৃতাজুড়ে। এর মধ্যে রয়েছে তিন বছর থেকে ২০ বছর পর্যন্ত নানা মেয়াদের পরিকল্পনা। বিদ্যুৎ, সড়ক, রেলপথের উন্নয়নের জন্য ২০ বছর মেয়াদি মাস্টারপ্ল্যানের কথা বলা হয়েছে, যার প্রক্কলিত বিনিয়োগ চলতি বছরের অনুন্নয়ন বাজেটের সমান। ১ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকার ২৩১টি প্রকল্পের এ মাস্টারপ্ল্যান কিভাবে বাস্তবায়ন হবে তার বিস্তারিত কিছু নেই বাজেটে।
প্রথম পদ্মা সেতুর অর্থায়নে এখনো কোনো সুরাহা হয়নি, তবু দ্বিতীয় পদ্মা সেতুর পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী। গত বছরের বাজেট বক্তৃতা থেকে ধার করা সমন্বিত পরিবহন নীতি, ঢাকা যানবাহন কর্তৃপক্ষ, ম্যাস রেপিড ট্রানজিট, এলিভেটেড এঙ্প্রেসওয়ের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, ঢাকা শহরের বৃত্তাকার সড়ক ও রেলপথ নির্মাণের কাজ আশাব্যঞ্জকভাবে এগোয়নি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বাস্তবায়িত বিভিন্ন প্রকল্পের বিশদ বিবরণ দিয়ে তিনি বলেছেন, এসবের ফলাফল ২০১৩ সালের মধ্যে স্পষ্ট হবে।
২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উপনীত করার লক্ষ্য নিয়ে আগের তিনটি বাজেটের ধারাবাহিকতায় এবারও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, শতভাগ সফলতা অর্জিত না হলেও সাফল্যের পথে আমাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। ঘোষিত অঙ্গীকারের কতখানি বাস্তবায়ন হয়েছে, কতখানি হয়নি তার একটা খতিয়ানও দিয়েছেন তিনি এবারের বাজেট বক্তৃতায়। তিনি বলেছেন স্বপ্ন পূরণের পথ মসৃণ নয়।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী সফলভাবে সম্পন্ন, বাস্তবায়নাধীন এবং বাস্তবায়ন শুরু করা যায়নি- এমন ২৫১টি নীতি ও কর্মসূচির তালিকা সংযোজন করেছেন। এর মধ্যে ১৭টি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয় গত তিন বছরেও শুরু করা যায়নি। মেয়াদ শেষ হওয়ার দেড় বছর আগেই অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার ভার পরবর্তী সরকারের ওপরই ছেড়ে দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, 'যে বিষয়গুলোতে পরিপূর্ণ সফলতা এখনো অর্জন হয়নি, যেগুলো আমরা শেষ করে যেতে পারিনি ও যেগুলো এখনো শুরু করতে পারিনি, সেগুলো পরবর্তী সরকারের দায়িত্বের অংশ হয়েই থাকল। আমাদের বিশ্বাস, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যারাই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তারা আমাদের অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পন্ন করে জাতির সামনে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন।'
দাম বাড়তে পারে
দাম কমার কথা
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে উচ্চাশাসহ নানা প্রতিশ্রুতি থাকলেও তা বাস্তবায়নের তাগিদ নেই অর্থমন্ত্রীর বিশালাকার বাজেট বক্তৃতার বইয়ে। বরং এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে আগের তিন অর্থবছরের নানা প্রতিশ্রুতির বহর। বর্তমান সরকারের আগামী দেড় বছরে নতুন-পুরনো প্রতিশ্রুতি কিভাবে তিনি পূরণ করবেন, তা পাশ কাটিয়ে গেছেন সুকৌশলে। বরং তাঁর অসমাপ্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ভার দিয়ে দিয়েছেন দেড় বছর পরে জাতীয় নির্বাচনে যে সরকার গঠিত হবে, তার ওপর। তিনি স্পষ্টই আশা প্রকাশ করে বলেছেন, 'এ সরকারের নেওয়া বিভিন্ন নীতি ও কর্মসূচি যা বাস্তবায়ন করতে পারছি না, তা যেন পরের সরকার বাস্তবায়ন করে।'
বৈদেশিক উৎস থেকে প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা বাড়ায় স্বভাবতই দেশীয় উৎসের দিকে নজর দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তবে তাঁর এ উদ্যোগে হতদরিদ্র মানুষও রেহাই পাবে না। প্রগতিশীল রাজস্ব আদায় ব্যবস্থাপনায় মূলত ধনীদের কাছ থেকে কর নিয়ে দরিদ্রদের জন্য সেবা বাড়ানোর কথা। তবে এবারের বাজেটে কর আদায়ের লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী ও টিআইএন নেই এমন ব্যাংক হিসাবধারীরা।
কর ভিত্তি সম্প্রসারণ ও কর পরিমণ্ডল বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশজ সম্পদ বাড়ানোর পরিকল্পনার শিকার হচ্ছেন দেশের প্রায় ৯ কোটি মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন দরিদ্র কৃষক, শ্রমিক। বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে যে প্রায় ৯০ লাখ কৃষকের ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে, তাঁদের টিআইএন নেই। এবারের বাজেটে সুদের ওপর ১০০ টাকায় তাঁদের কাছ থেকে ১৫ টাকা উৎসে কর আদায় করা হবে। আয় বৃদ্ধির কথা বলে ন্যূনতম কর দুই হাজার থেকে বাড়িয়ে তিন হাজার টাকা করা হয়েছে। কিন্তু জীবনযাত্রার অনিয়ন্ত্রিত ব্যয় বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে সব মহল থেকে দাবি জানানো হলেও ব্যক্তির করমুক্ত আয়সীমা এক লাখ ৮০ হাজার টাকাই রাখা হয়েছে।
বৈদেশিক সহায়তা না পাওয়ায় বিদায়ী অর্থবছরের এডিপি পাঁচ হাজার কোটি টাকা কমাতে হয়েছিল। বৈদেশিক উৎস থেকে আশা করা হয়েছিল ১৩ হাজার ৫৮ কোটি টাকা, সংশোধন করে কমানো হয়েছে প্রায় অর্ধেক। তবু আগামী অর্থবছরে বৈদেশিক সহায়তা ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ৫৮৪ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত এক লাখ ৯১ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকার বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৫ হাজার কোটি টাকা। বরাবরের মতো বাজেট ঘাটতিও এর কাছাকাছি- ৫২ হাজার ৬৮ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী সংসদে বলেছেন, তাঁর ইচ্ছা ছিল দুই লাখ কোটি টাকার বাজেট পেশ করার। সম্পদের সীমাবদ্ধতায় তা সম্ভব হয়নি।
বিদ্যুৎ-গ্যাস সংকটসহ অবকাঠামো খাতের দুর্বলতা, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের কারণে এমনিতেই বিনিয়োগে স্থবিরতা বিরাজ করছে। সরকারি-বেসরকারি অংশগ্রহণ বা পিপিপির মাধ্যমে অবকাঠামো খাতে উন্নয়নের কথা তিন বছর ধরেই অর্থমন্ত্রী বলে আসছেন, এবারও বলেছেন। তিনি জানিয়েছেন, আশানুরূপ না হলেও উল্লেখযোগ্য কিছু প্রকল্প পিপিপির অধীনে নেওয়া হয়েছে। আটটি প্রকল্প চিহ্নিত করা হয়েছে। এতে ব্যয় হবে তিন হাজার কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী নিজেও স্বীকার করেছেন করপোরেট করের হার বাংলাদেশে বেশি। তবে বাজেটে তা কমানো হয়নি, বরং রপ্তানি খাতে প্রবৃদ্ধি কমে গেলেও সেখানে উৎসে করহার প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে। এতে রপ্তানি খাতে চাপ বাড়বে।
বাজেট বক্তৃতাকালে অর্থমন্ত্রী এই বাড়তি অর্থ নেওয়া প্রসঙ্গে বলেছেন, কৃষি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি বাড়ার কারণে তাঁকে ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিতে হয়েছে। এর ফলে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমেছে। ব্যাংক ঋণের সুদ কমেছে। তত্ত্বগতভাবে বিনিয়োগও কমেছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার এতসব নেতিবাচক দিক অর্থমন্ত্রীর চোখে স্পষ্ট হওয়ার পরও নতুন অর্থবছরে ২৩ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকেই নেওয়ার পরিকল্পনা তুলে ধরেছেন তিনি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, ব্যাংকগুলো এমনিতেই তারল্য সংকটে রয়েছে। আমানত সংগ্রহে মরিয়া ব্যাংকগুলো ১৪ শতাংশ পর্যন্ত সুদ গুনছে তারল্য সংকট কাটাতে। এ অবস্থার মধ্যে নতুন অর্থবছরে এই বিপুল পরিমাণ অর্থের জোগান দিতে ব্যাংকগুলোকে আরো নাজুক অবস্থার মধ্যেই পড়তে হবে। নতুন অর্থবছরে অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকের ওপর এত বেশি নির্ভর করলে তাতে ঋণের সুদহার যেমন কমবে না, তেমনি বেসরকারি খাতের বিকাশও বাধাগ্রস্ত হবে।
এবার করসহ সামগ্রিক বাজেট কাঠামো গোছানো বলে মত দিয়েছেন এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ। তিনি বলেছেন, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হলেও এটি করা হয়েছে আইনের আওতায়ই। এতে খুব বেশি ছাড় দেওয়া হয়েছে বলে মনে করার কিছু নেই। বিদ্যমান আইনের ১২৮(১) ধারায় বলা আছে, সময়মতো কর না দিলে প্রাপ্ত করের সঙ্গে প্রতিবছর অতিরিক্ত ১০ শতাংশ করে জরিমানা দিতে হবে। এবার সেটি ফ্ল্যাট হারে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। তবু একজন করদাতাকে ৩৫ শতাংশ কর দিতে হবে কালো টাকা সাদা করার ক্ষেত্রে। আরো তিনটি ইতিবাচক দিক দেখেছেন তিনি। শুল্ক ও ভ্যাট-সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো বাজেট পাস হওয়ার দিন থেকে কার্যকর করার ঘোষণাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন তিনি। এর ফলে সাময়িক সময়ের মধ্যে জিনিসপত্রের দাম বাড়ানোর সুযোগ কমবে বলে তিনি মনে করেন। পুঁজিবাজারের ক্ষেত্রে মার্চেন্ট ব্যাংকের করপোরেট কর ৫ শতাংশ কমানো একটা ভালো সিদ্ধান্ত বলে উল্লেখ করেন তিনি। তিন বছরের অবচয় সুবিধা বাড়িয়ে পাঁচ বছর করার পাশাপাশি অর্থমন্ত্রী এই বার্তাও গাড়ি ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন যে, কোনোমতেই একই উৎস থেকে আনা নতুন গাড়ির দাম পুরনো গাড়ির চেয়ে কম দেখানো যাবে না।
উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেছেন, প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে বিনিয়োগ বাড়ার পরিবেশ থাকতে হবে। জীবনযাত্রার ব্যয় অব্যাহতভাবে বাড়ার কারণে মানুষের ভোগ ব্যয়ের সামর্থ্য কমে গেছে। মানুষ যদি পণ্য ও সেবা কম কেনে, তাহলে উৎপাদন ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি কমবে, বিনিয়োগ কমবে। সে ক্ষেত্রে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে প্রাক্কলন তা অর্জন দুরূহ হবে।
ড. তিতুমীরের মতে, সামষ্টিক ব্যবস্থাপনা আইএমএফের নজরদারিতে থাকায় সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিই বহাল রাখবে বাংলাদেশ ব্যাংক। সে কারণে ব্যাংক ঋণের সুদ কমার সম্ভাবনা থাকবে না, ফলে বিনিয়োগেও গতি আসবে না। বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়ানো ও দারিদ্র্য কমানোর যেসব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, সেগুলোও অর্জিত হবে না। বাংলাদেশ অর্থনীতি স্বাভাবিক গতিতে এগোতে দিলেও সাড়ে ৭ থেকে ৮ শতাংশ হারে বাড়ত। কিন্তু সংকোচনমূলক নীতি সে পথ রুদ্ধ করছে। বাজেটের লক্ষ্য অর্জন করতে হলে সম্প্রসারণমুখী, প্রবৃদ্ধিমুখী রাজস্ব ও মুদ্রানীতি নিয়ে এগোতে হবে, তাতে বাজেট ঘাটতি বাড়লেও ক্ষতি নেই।
আঞ্চলিক বৈষম্য কমানোর কোনো কর্মসূচি এবারের বাজেটেও নেই। তবে তিনি জেলা বাজেটের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, আগামী অর্থবছরে খসড়া শ্রেণীবিন্যাস কাঠামো চূড়ান্ত করা হবে। তারপর এ অঙ্গীকার বাস্তবায়নের কাজ শুরু হবে।
আগের বাজেটের মতোই দীর্ঘমেয়াদি বড় বড় পরিকল্পনা, মহাপরিকল্পনার ফিরিস্তি আছে বাজেট বক্তৃতাজুড়ে। এর মধ্যে রয়েছে তিন বছর থেকে ২০ বছর পর্যন্ত নানা মেয়াদের পরিকল্পনা। বিদ্যুৎ, সড়ক, রেলপথের উন্নয়নের জন্য ২০ বছর মেয়াদি মাস্টারপ্ল্যানের কথা বলা হয়েছে, যার প্রক্কলিত বিনিয়োগ চলতি বছরের অনুন্নয়ন বাজেটের সমান। ১ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকার ২৩১টি প্রকল্পের এ মাস্টারপ্ল্যান কিভাবে বাস্তবায়ন হবে তার বিস্তারিত কিছু নেই বাজেটে।
প্রথম পদ্মা সেতুর অর্থায়নে এখনো কোনো সুরাহা হয়নি, তবু দ্বিতীয় পদ্মা সেতুর পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী। গত বছরের বাজেট বক্তৃতা থেকে ধার করা সমন্বিত পরিবহন নীতি, ঢাকা যানবাহন কর্তৃপক্ষ, ম্যাস রেপিড ট্রানজিট, এলিভেটেড এঙ্প্রেসওয়ের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, ঢাকা শহরের বৃত্তাকার সড়ক ও রেলপথ নির্মাণের কাজ আশাব্যঞ্জকভাবে এগোয়নি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বাস্তবায়িত বিভিন্ন প্রকল্পের বিশদ বিবরণ দিয়ে তিনি বলেছেন, এসবের ফলাফল ২০১৩ সালের মধ্যে স্পষ্ট হবে।
২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উপনীত করার লক্ষ্য নিয়ে আগের তিনটি বাজেটের ধারাবাহিকতায় এবারও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, শতভাগ সফলতা অর্জিত না হলেও সাফল্যের পথে আমাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। ঘোষিত অঙ্গীকারের কতখানি বাস্তবায়ন হয়েছে, কতখানি হয়নি তার একটা খতিয়ানও দিয়েছেন তিনি এবারের বাজেট বক্তৃতায়। তিনি বলেছেন স্বপ্ন পূরণের পথ মসৃণ নয়।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী সফলভাবে সম্পন্ন, বাস্তবায়নাধীন এবং বাস্তবায়ন শুরু করা যায়নি- এমন ২৫১টি নীতি ও কর্মসূচির তালিকা সংযোজন করেছেন। এর মধ্যে ১৭টি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয় গত তিন বছরেও শুরু করা যায়নি। মেয়াদ শেষ হওয়ার দেড় বছর আগেই অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার ভার পরবর্তী সরকারের ওপরই ছেড়ে দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, 'যে বিষয়গুলোতে পরিপূর্ণ সফলতা এখনো অর্জন হয়নি, যেগুলো আমরা শেষ করে যেতে পারিনি ও যেগুলো এখনো শুরু করতে পারিনি, সেগুলো পরবর্তী সরকারের দায়িত্বের অংশ হয়েই থাকল। আমাদের বিশ্বাস, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যারাই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তারা আমাদের অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পন্ন করে জাতির সামনে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন।'
দাম বাড়তে পারে
দাম কমার কথা
No comments