গণতন্ত্র ও সংবিধান সমুন্নত রাখতে হবে-হাইকোর্টের ঐতিহাসিক রায়

মাননীয় হাইকোর্ট সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করায় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক শাসন অবৈধ হয়ে গেছে। গত বৃহস্পতিবার বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এই রায় দেন।


১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ তত্কালীন সেনাবাহিনীর প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বিচারপতি আবদুস সাত্তারের সাংবিধানিক সরকারকে উত্খাত করে ক্ষমতা দখল এবং ১৯৮৬ সালের ১১ নভেম্বর পর্যন্ত সামরিক বিধি, আদেশ ও ফরমানবলে দেশ শাসন করেন। সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে তাঁর এসব অসাংবিধানিক কার্যক্রমের সাংবিধানিক বৈধতাও দেওয়া হয়েছিল, যা আদালত অবৈধ ঘোষণা করেছেন।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও আইনবিদেরা হাইকোর্টের রায়কে ঐতিহাসিক বলে আখ্যায়িত করেছেন। আমরাও এই রায়কে স্বাগত জানাই। অসাংবিধানিক উপায়ে ক্ষমতা দখল বন্ধে এই রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলেও প্রত্যাশা। সংবিধানের কোথাও সামরিক শাসনের কথা নেই। ফলে কোনো সংশোধনী দিয়ে তাকে জায়েজ করার সুযোগ নেই। ভবিষ্যতে অবৈধ ক্ষমতা দখল রোধে সংসদ সংবিধান বা দণ্ডবিধিতে অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীর শাস্তি নির্ধারণ করতে পারবে বলে আদালত যে মন্তব্য করেছেন, তাও তাত্পর্যপূর্ণ। দেশে বন্দুকের নলের মুখে প্রথম অসাংবিধানিক শাসন চালু হয় ১৯৭৫ সালে, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর। খন্দকার মোশতাক, বিচারপতি সায়েম ও জিয়াউর রহমানের ক্ষমতারোহণও ছিল অসাংবিধানিক। অপর একটি মামলায় সর্বোচ্চ আদালত এই তিন ব্যক্তির শাসনামলকে বৈধতাদানকারী পঞ্চম সংশোধনীকেও অবৈধ ঘোষণা করেছেন। সব সামরিক শাসকই সংবিধান লঙ্ঘনের জন্য দায়ী। কিন্তু মোশতাক ও জিয়া কেবল সংবিধান স্থগিত করে ক্ষান্ত হননি, তাঁরা সংবিধানের মৌলিক নীতিও পরিবর্তন করেছেন। ঘাতকদের দায়মুক্তি দিয়েছেন। আদালত এসব পদক্ষেপকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ পঞ্চম সংশোধনী বাতিল ঘোষণার পর সবারই ধারণা হয়েছিল, সপ্তম সংশোধনীর পরিণামও ভিন্ন কিছু হবে না। কেননা দুটি মামলায়ই দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের ওপর অন্য কোনো আইন বা কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল। অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীদের জন্য এই রায় মহা সতর্কসংকেত এবং বিচারের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে। ভবিষ্যতে কেউ গায়ের জোরে ক্ষমতা দখল করতে সাহস পাবে না।
সভ্য দেশে অসাংবিধানিক শাসন বা সামরিক আইন অচল। আমাদের সংবিধানে বাংলাদেশকে প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। জনগণই এর মালিক। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী খেয়ালখুশিমতো দেশ চালাতে পারে না। পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিল করে উচ্চ আদালত সেই সত্যই দেশবাসীর কাছে তুলে ধরেছেন। জনগণের প্রত্যাশা, সংবিধান ও গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও জনপ্রতিনিধিরা একযোগে কাজ করবেন। ভবিষ্যতে যাতে কেউ গায়ের জোরে ক্ষমতা দখল করতে না পারে, সে ব্যাপারেও তাদের সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.