দূরদেশ-অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচন: দ্বিদলীয় ব্যবস্থার সমস্যা by আলী রীয়াজ

১৯ আগস্ট বৃহস্পতিবার সকালে সিডনি এয়ারপোর্টে নেমে হোটেলের উদ্দেশে যে ট্যাক্সিতে চড়লাম, তার চালক বয়সে তরুণ, স্মার্ট এবং দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত। পরিচয়পর্বে জানলাম, মা-বাবার সঙ্গে মাত্র দুই বছর বয়সে ইউরোপ থেকে সে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমায়। ওয়েস্টার্ন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্কুল থেকে সবে পাস করেছে।


আমার সিডনি আসার কারণ একটি সম্মেলনে অংশ নেওয়া, কিন্তু আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক শোনামাত্রই তার প্রশ্ন, নির্বাচন দেখতে এসেছি কি না। অস্ট্রেলিয়ায় নির্বাচনের তখন বাকি দুই দিন। ২১ আগস্টের নির্বাচন নিয়ে আমার উত্সাহ থাকলেও সেটা এই সফরের উদ্দেশ্য নয়, জানানো সত্ত্বেও পরবর্তী আধা ঘণ্টার অধিকাংশ সময়ই আমরা অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচন নিয়ে কথাবার্তা বললাম। তরুণ চালক সম্ভাব্য ফলাফলের ব্যাপারে তার পূর্বাভাস জানাতে মোটেই কুণ্ঠিত হলো না, ‘ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির বিজয়ী হওয়া উচিত, কিন্তু মনে হয় না তারা বিজয়ী হবে। কারণ তাদের নির্বাচনী প্রচারে সমূহ দুর্বলতা।’ প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ডের জনপ্রিয়তা নিয়ে সংশয় না থাকলেও এই তরুণের বদ্ধমূল ধারণা, প্রধানমন্ত্রী গিলার্ড তাড়াহুড়ো করে নির্বাচন ডেকেছেন; এখন ভালোয় ভালোয় পার হতে পারলেই হয়।
বৃহস্পতিবার বিকেলে পর্যটকের মতো শহর ঘুরতে বেরোনোর কথা আমার এক আত্মীয়ের সঙ্গে। ততক্ষণ পর্যন্ত হোটেলের আশপাশেই ঘুরে বেড়াতে গিয়ে দেখলাম, আমার হোটেলটা কেবল শহরের কেন্দ্রস্থলেই অবস্থিত নয়, কাছেই ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি-সিডনির ক্যাম্পাস। অস্ট্রেলিয়ার গণমাধ্যমে নির্বাচন নিয়ে যতটা উত্সাহ ও উত্তেজনা, আশপাশে তা নিয়ে এর সামান্যও চোখে পড়ে না। ব্রিটেনের নির্বাচনের সময়ও এমনটাই লক্ষ করেছি। তবু কফির দোকানে বসে থাকা তরুণদের সঙ্গে কথাবার্তা হলো, একা সংবাদপত্র নিয়ে বসে থাকা প্রৌঢ় এন্ড্রু স্মিথের সঙ্গে খানিকটা সময় কাটল। সবার কণ্ঠেই ক্ষমতাসীন লেবার দলের ব্যাপারে খানিকটা অনিশ্চয়তা ও হতাশাই শুনতে পেলাম। লিবারেল পার্টি ও ন্যাশনাল পার্টির জোট—যাকে এখানে কোয়ালিশন বলে বর্ণনা করা হয়, তার সমর্থনের পেছনে মনে হলো লেবার দলের প্রতি আস্থাহীনতাই কারণ। লেবার পার্টি যে প্রতিনিধি পরিষদ বা হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভে আসন হারাবে, সেটা জনমত জরিপেও বলা হচ্ছিল—হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের ইঙ্গিত ছিল সর্বত্র। শনিবার সকালের কাগজে সর্বশেষ জনমত জরিপেও তা-ই উঠে এল। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতা যে কতটা তীব্র, সেটা স্পষ্ট হলো শনিবার ২১ আগস্ট সন্ধ্যায়—অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায় লেখা হলো, যখন ফলাফল আসতে শুরু করল।
গত ৭০ বছরের ইতিহাসের ধারা পাল্টে দিয়ে নির্বাচনের ফলাফল হলো অমীমাংসিত। অর্থাৎ ১৫০ আসনের সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজনীয় ৭৬ আসন কোনো দলই পেল না। অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকেরা শনিবার ভোট দিয়ে ঘুমোতে যাওয়ার আগে তাদের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, সেটা জেনেই অভ্যস্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অস্ট্রেলিয়ায় কখনোই এমন পরিস্থিতি হয়নি। শুধু তা-ই নয়, ১৯৩১ সালের পর কখনোই অস্ট্রেলিয়ার ক্ষমতাসীন দল এক মেয়াদের পর ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে, এমন ইতিহাস নেই।
অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতি যাঁরা খুব ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করেন না, তাঁদের জন্যই এ নির্বাচনের পটভূমি সংক্ষেপে বলা দরকার। অস্ট্রেলিয়ায় সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০০৭ সালে। এ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন লিবারেল পার্টি ও ন্যাশনাল পার্টির জোটকে ব্যাপকভাবে পরাজিত করে ক্ষমতায় আসে লিবারেল পার্টি। কেভিন রাডের নেতৃত্বাধীন পার্টি ৮৩টি আসন লাভ করে। পূর্ববর্তী নির্বাচনের চেয়ে ২৩টি আসন বেশি লাভ করে তারা এই নির্বাচনে। নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর লিবারেল পার্টি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী জন হাওয়ার্ড নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ান। ২০০৯ সালে নেতৃত্বে আসেন টনি এবোট। এবোটকে তখন অনেকেই ‘নির্বাচনের অযোগ্য’ নেতা বলেও বর্ণনা করেন। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী কেভিন রাডের সরকার বেশ কিছু জনপ্রিয় পদক্ষেপ নেয়। বিশ্বজুড়ে মন্দার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করে, বিনিয়োগের উদ্যোগ নেয় এবং সব মিলিয়ে প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলারের ‘স্টিমুলাস প্যাকেজ’ ঘোষণা করে। দেশে বেকারদের হার পাঁচ শতাংশের কাছে রাখতে সক্ষম হয়। তদুপরি তারা দেশের খনিশিল্পের মুনাফার ওপর আয়কর আরোপের প্রস্তাব করে, যা থেকে সাধারণ লোকজন সুবিধা পাবে। পরিবেশবান্ধব কিছু পদক্ষেপের ওপরও জোর দেয়। তাদের এসব প্রস্তাবের বিরোধীরা তত্পর হয়ে উঠলে বেশ কিছু পদক্ষেপ থেকে সরে আসার ঘাষণা দেন কেভিন রাড। এতে করে তাঁর জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করে। তাঁর এই দ্বিধান্বিত পদক্ষেপের ফলে দলের ভেতর অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। সেই অসন্তোষের পরিপ্রেক্ষিতেই এ বছরের জুন মাসে দলের নেতৃত্বে আসেন ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ড। অস্ট্রেলিয়ায় রাজনীতির বিশ্লেষকেরা অনেকেই বলেন, কেভিন রাড ও জুলিয়া গিলার্ডের মধ্যে সমঝোতা হয়েছিল—অক্টোবরে অনুষ্ঠেয় নির্বাচন পর্যন্ত রাড নেতৃত্বে থাকবেন; যদি জনমত জরিপে দেখা যায় যে তিনি পিছিয়ে পড়ছেন, কেবল তখনই তিনি সরে দাঁড়াবেন। কিন্তু গিলার্ড এই সমঝোতা ভঙ্গ করে নিজেই দায়িত্ব নেন এবং প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হন বলে অভিযোগ রয়েছে। ক্ষমতায় এসে অক্টোবর পর্যন্ত অপেক্ষা না করে জুলিয়া গিলার্ড নির্বাচনের ঘোষণা দেন এবং সেই নির্বাচনই অনুষ্ঠিত হয় ২১ আগস্ট শনিবার।
নির্বাচনের এই ফলাফলে কোনো দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেনি, এটা বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার গণমাধ্যমে। কিন্তু কমবেশি সবাই যে বিষয়ে একমত, তা হলো অস্ট্রেলীয় ভোটাররা কার্যত দুই দলের প্রতিই অনাস্থা প্রকাশ করেছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে যাঁরা গণতন্ত্রায়ণ, নির্বাচন ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণা করেন, অতীতে তাঁরা এমন মতই দিয়েছেন যে, যেকোনো দেশে দ্বিদলীয় ব্যবস্থা পরিপক্ব (ম্যাচিউর) গণতন্ত্রের লক্ষণ। অনেকে এমনও বলেছেন, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য দল সরকারের স্থায়িত্বের পথে বাধা এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুসংহত করার অনুকূল নয়। ইউরোপের অধিকাংশ দেশে এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে দুই দলের প্রাধান্যের পেছনে এ ধারণাই কাজ করে। এসব দেশে তৃতীয় দল প্রতিষ্ঠা এবং এর জনপ্রিয়তা সৃষ্টির চেষ্টার ক্ষেত্রে বিরাজমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাই সবচেয়ে বড় বাধা।
সম্প্রতি লক্ষ করা যাচ্ছে, ভোটাররা এই দ্বিদলীয় ব্যবস্থার ব্যাপারে ক্রমেই আস্থা হারিয়ে ফেলছেন এবং তাঁরা এই ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য তৃতীয় পক্ষকে সমর্থনের চেষ্টা করছেন। ব্রিটেনের সর্বশেষ নির্বাচনে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রতি সমর্থন এই প্রত্যাশারই ফল। যুক্তরাষ্ট্রে তৃতীয় দল প্রতিষ্ঠার চেষ্টা অতীতে বহুবার ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু তার পরও অনেকেই আশা করেন, বর্তমান ব্যবস্থায় দুই দলের মধ্যে পার্থক্য এত কমে আসছে যে ভবিষ্যতে হয়তো সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। এই প্রত্যাশা যেমন উদারপন্থী গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন প্রগতিশীলদের মধ্যে আছে, ঠিক একইভাবে দক্ষিণপন্থীদের মধ্যেও বিরাজমান। যুক্তরাষ্ট্রে গত দেড় বছর ধরে রিপাবলিকান দলের ভেতর তুলনামূলক দক্ষিণপন্থীরা এ রকম একটি প্লাটফর্ম তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। ‘টি পার্টি’ বলে পরিচিত এ গোষ্ঠীর সদস্যরা দলকে আরও ডানপন্থী ও রক্ষণশীল করে তোলার জন্য চাপ দিচ্ছে। এ বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় কংগ্রেসের নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী হিসেবে দক্ষিণপন্থীদের মনোনীত করার জন্য তাদের চেষ্টা অনেকাংশেই সফল হয়েছে। সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী সারাহ পেলিনের নেতৃত্বে এ গোষ্ঠীটি সিনেটে এ যাবৎ কমপক্ষে আটজনকে রিপাবলিকান দলের মনোনয়ন নিশ্চিত করেছে।
অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচনে লেবার ও লিবারেল দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় গ্রিন পার্টির একজন এবং নির্দলীয় চারজন বিজয়ীর হাতেই এখন ক্ষমতার চাবিকাঠি। তাঁরা যেদিকে ঝুঁকবেন, সে দলই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে। তিনজন নির্দলীয় প্রার্থী এরই মধ্যে দুই পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করছেন এবং বিভিন্ন রকম দাবিদাওয়া পেশ করেছেন। লক্ষণীয় যে তাঁদের বিশেষ করে নির্দলীয় প্রার্থীদের একটি অন্যতম দাবি হলো বর্তমান ব্যবস্থার সংস্কার করা। অনেকেরই স্মরণে থাকবে, কনজারভেটিভ দলের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠনের জন্য ব্রিটেনে লিবারেল ডেমোক্রেটিকদের শর্তগুলোর অন্যতম ছিল নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার। ব্রিটেনে লেবার পার্টি এ বিষয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য ও সময়সীমা বলতে দেরি করলেও অস্ট্রেলিয়ার লেবার পার্টি সেই ভুল করেনি।
২৩ আগস্ট সোমবার দুপুরে সিডনি থেকে বিমানে চড়ার আগে দৈনিক সিডনি হেরাল্ড ট্রিবিউন-এর সেদিনের সংখ্যাটির শিরোনাম পড়ে সিদ্ধান্ত নিলাম, শিরোনামের একটি অংশে ছিল, ‘১১ মিলিয়নের বেশি অস্ট্রেলিয়ান ভোট দিয়েছেন। এখন আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই পাঁচজনের ওপর।’ আর সে কারণেই লেবার পার্টি ও লিবারেল পার্টির নেতারা এই পাঁচজনের সঙ্গে বৈঠক করছেন, তাঁদের দাবিদাওয়া শুনছেন। ব্রিটেনের মতো অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতিতেও একটা পরিবর্তনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, সে সম্ভাবনা কতটা বাস্তবায়িত হবে, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু এর জন্য একটি বিশাল দল বা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন কোনোটারই প্রয়োজন হয়নি। দ্বিদলীয় ব্যবস্থায় অসন্তুষ্ট ভোটারদের জন্য এটা একটা আশার বাণী হতে পারে।
ইলিনয়, ২৬ আগস্ট ২০১০
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.