সময়চিত্র-সামরিক শাসনের আশঙ্কা রুদ্ধ হয়েছে কি? by আসিফ নজরুল

প্রথম আলোর পাঠকদের মতামতের প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ বহুদিনের। তাঁদের মতামত জানানোর সবচেয়ে বড় সুযোগ ঘটে ওয়েবভিত্তিক জরিপে। যাঁরা সেখানে মতামত দেন, তাঁদের ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে এবং দেশ নিয়ে চিন্তাভাবনা প্রকাশের তাড়নাও তাঁরা পোষণ করেন।


এই পাঠকেরা আমাদের মতো আরোপিত বা প্রকৃত বিশেষজ্ঞ নন। বাংলাদেশের বহু বিশেষজ্ঞ হাওয়া বুঝে কথা বলেন। তাঁদের মধ্যে এই প্রবণতা নেই, দলবাজি করার ঝোঁকও নেই। মালিবাগ হত্যা মামলায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নাম প্রত্যাহার সমর্থন করেন কি না এর উত্তরে তাই প্রায় ৯৩ শতাংশ জানান যে তা তাঁরা সমর্থন করেন না।
প্রথম আলোর জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মন্তব্য অত্যন্ত বাস্তবোচিতও বটে। পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী মামলার রায়ের পর অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ ও সরকারপক্ষের রাজনীতিবিদেরা আনন্দে উদ্বেল হয়েছেন। এসব রায় সামরিক শাসনের আশঙ্কা চিরতরে রোধ করেছে এমন অতিশয়োক্তিও শোনা গেছে। এত ডামাডোলের মধ্যেও প্রথম আলোর অধিকাংশ পাঠক প্রভাবিত হননি। ২৮ আগস্টের জরিপে মাত্র ৩৭ শতাংশ পাঠক জানিয়েছেন, তাঁরা মনে করেন এসব রায়ের পর দেশে সামরিক শাসনের আশঙ্কা কমেছে। ৬০ শতাংশের বেশি পাঠক মনে করেন, এই আশঙ্কা কমেনি। প্রথম আলো যদি প্রশ্ন করত, এসব রায়ের পর সামরিক শাসনের আশঙ্কা ‘চিরতরে’ রুদ্ধ হয়েছে কি না, তাহলে ‘না’ উত্তর দেওয়ার সংখ্যা নিশ্চয়ই অনেক বেশি হতো।

২.
আমি ঠিক জানি না, জরিপে অংশ নেওয়া পাঠকদের বয়স কেমন। যাঁরা মাঝবয়সী তাঁদের নিশ্চয়ই স্মরণে থাকার কথা সামরিক বা অসাংবিধানিক শাসনে সব ক্ষেত্রে মিত্রপক্ষ থেকেছে দেশের কোনো না কোনো বড় দল। বিএনপি ও জাতীয় পার্টির সৃষ্টিই সামরিক শাসনের ঔরস থেকে। জামায়াত সামরিক শাসক এমনকি গণহত্যাকারীরদের দোসর সাজতে পারে তার প্রমাণ ১৯৭১ সালে দেখা গেছে। বাকি থাকে আওয়ামী লীগ। ১৯৭৫ সালের তিক্ত স্মৃতি বাদ দিলেও ১৯৮২ সালে এরশাদের ক্ষমতাগ্রহণ এবং এক/এগারোর পর অসাংবিধানিক পদ্ধতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে প্রকাশ্য সমর্থন ছিল আওয়ামী লীগের।
স্বাধীনতার পর অধিকাংশ ক্ষেত্রে সামরিক শাসনের বা এতে সমর্থনের (এমনকি জনগণের একাংশের) অন্যতম কারণ ছিল গণতান্ত্রিক দলগুলোর দেশশাসনে এবং গণতন্ত্রচর্চার ক্ষেত্রে নিদারুণ ব্যর্থতা। কিংবা বিরোধী দল ও মতের প্রতি গণতান্ত্রিক সরকারের নির্মম অসহিষ্ণুতা। এই ধারা অব্যাহত থাকলে আদালতের রায় বা সংবিধানে যা কিছুই থাকুক না কেন সামরিক শাসনের আশঙ্কা দূরীভূত হওয়ার কথা নয়। পৃথিবীর কোথাও তা হয়নি।
সামরিক শাসনের আশঙ্কা রুদ্ধ করতে পারে প্রকৃত গণতন্ত্রের চর্চা, সুশাসন, বিরোধী দলের সঙ্গে সরকারি দলের ন্যূনতম আস্থার সম্পর্ক এবং নির্ভেজাল নির্বাচনের নিশ্চয়তা। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতে এর অনেক উদাহরণ আছে। ভারতে যথেষ্ট মাত্রায় গণতন্ত্রের চর্চা হয় বলে জরুরি অবস্থা জারি, কোয়ালিশন সরকারের পতন কিংবা গুরুতর সামপ্রদায়িক দাঙ্গার পরও সামরিক শাসন আসেনি কখনো, আসবে যে তাও ঘুণাক্ষরে কেউ ভাবেন না। অন্যদিকে পাকিস্তানে রাজনৈতিক দলগুলোর গণতন্ত্রচর্চার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর দুর্বলতা এবং সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কারণে সংবিধান ও আদালতের কিছু রায়ে কঠোরতমভাবে সামরিক শাসনকে নাকচ করা হলেও সেখানে বারবার সামরিক শাসন এসেছে। ভবিষ্যতে যে আবারও আসবে, তাও অনেকে মনে করেন।
আদালতের রায় প্রাসঙ্গিক। এসব অভিজ্ঞতাও প্রাসঙ্গিক।

৩.
অতীতে পাকিস্তানের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে উচ্চ আদালতের বিভিন্ন রায়ে নানাভাবে সামরিক শাসনকে সমর্থন করা হয়েছে। উচ্চ আদালতের বিচারপতি সামরিক শাসকের সঙ্গী হয়েছেন এমন ঘটনাও ঘটেছে। পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী মামলার রায়ে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের উচ্চ আদালত সুস্পষ্টভাবে সামরিক শাসনকে অবৈধ ঘোষণা করার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। এমন রায় সামরিক শাসকের আমলে হলে তার তাৎপর্য ও প্রভাব বেশি হতো। ভবিষ্যতের সামরিক শাসকদের জন্য এটি এখন একটি সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে এই রায়ের প্রায়োগিক মূল্য কতটুকু তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করার কারণ আছে।
উচ্চ আদালতের রায় সব ক্ষেত্রে মহৌষধ নয়, চূড়ান্ত সমাধানও নয়। মানবাধিকার ও আইনের শাসন জোরদার করার লক্ষ্যে উচ্চ আদালত অতীতে রিমান্ডে নির্যাতন ও ৫৪ ধারার অপপ্রয়োগ বন্ধ করার সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছে। এর পরও রিমান্ড ও ৫৪ ধারার অপপ্রয়োগের বহু অভিযোগ পাওয়া গেছে। গণতান্ত্রিক সরকারগুলো উচ্চ আদালতের নির্দেশ আন্তরিকভাবে পালনের চেষ্টা করেনি, উচ্চ আদালতও সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এ জন্য উপযুক্তভাবে আদালত অবমাননার শাস্তি দেয়নি। পরিবেশ সংরক্ষণ, ভোক্তা অধিকার রক্ষা, স্থানীয় শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেও উচ্চ আদালতের বিভিন্ন রায় ও নির্দেশনা বিভিন্নভাবে গণতান্ত্রিক সরকারগুলো লঙ্ঘন করেছে। নানা ঘটনায় প্রমাণ হয়েছে শেষ পর্যন্ত সরকার (নির্বাহী বিভাগ) আন্তরিকভাবে উচ্চ আদালতের নির্দেশ না মানলে জনকল্যাণকর বা জনস্বার্থমূলক রায় কার্যকর কোনো পরিবর্তন আনতে পারে না।
আমাদের উচ্চ আদালত সামরিক শাসনকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। কিন্তু এই শাসনকে রুদ্ধ করার লক্ষ্যে আদালতের নির্দেশনা যথেষ্ট নয়। প্রচলিত আইনে (দণ্ডবিধির ১২৪ ও ১২৪ক ধারা) সামরিক শাসকের বিচার করার বিধান থাকলেও উচ্চ আদালতের রায় নতুন আইন তৈরির কথা বলে সম্ভবত কিছু জটিলতা সৃষ্টি করেছে। নতুন আইন সত্যিই করা হলে তা এরশাদের মতো জীবিত সামরিক শাসকের ক্ষেত্রে ভূতপেক্ষভাবে প্রয়োগ করা যাবে না। তাঁর দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তি না হলে ভবিষ্যৎ আইন ‘পোটেনশিয়াল’ সামরিক শাসককে নিবৃত্তও রাখতে পারবে না।

৪.
সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সংবিধানে নতুন কোনো বিধানও যথেষ্ট হবে না। বাংলাদেশের সংবিধানের কোথাও সামরিক শাসনকে অভ্যর্থনা জানানোর বা মেনে নেওয়ার কোনো বিধান ছিল না। সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদসহ বহু বিধান বরং সব ধরনের অনির্বাচিত শাসনের ঘোর বিরোধী। সংবিধানে এখন কঠোর ও সরাসরিভাবে সামরিক শাসনকে নাকচ করে এবং এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচার করার বিধান সংযোজিত করা যেতে পারে। কিন্তু কোনো সামরিক শাসকের বিচার না করা হলে এবং গণতন্ত্রকে সুদৃঢ়ভাবে চর্চা না করা হলে সামরিক শাসনের আশঙ্কা বাংলাদেশে থেকেই যাবে।
মনে রাখতে হবে, গণতন্ত্রচর্চা মানে শুধু নির্বাচন অনুষ্ঠান নয়; গণতন্ত্র মানে কার্যকর সংসদের মাধ্যমে জনগণের কাছে শাসকদের জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা, স্থানীয় শাসন কাঠামোর মাধ্যমে প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ, বিচার বিভাগের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও সুবিধাভোগে জনগণের সাম্য এবং মুক্ত গণমাধ্যম। গণতন্ত্র মানে সংবিধানেরও গণতন্ত্রায়ণ। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য এনে, গোপন ব্যালটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ব্যবস্থা করে, কালো আইনের বিরুদ্ধে সাংসদদের ভোট দেওয়ার অবাধ অধিকার দিয়ে, সংসদ বর্জনের সুযোগ হ্রাস করে, নির্বাচন কমিশনের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে, বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে যেকোনো চুক্তি সংসদে আলোচনার ব্যবস্থা করে, জনগণের অর্থনৈতিক অধিকার বাস্তবায়নে সরকারের সুস্পষ্ট জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করে সংবিধানের গণতন্ত্রায়ণ সম্ভব।
ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, মেক্সিকো এমনকি অপেক্ষাকৃত নতুন গণতান্ত্রিক দেশ পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া, রুমানিয়ার মতো পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বহু দেশের সংবিধান বাংলাদেশের চেয়ে গণতন্ত্রবান্ধব। বহু দেশের গণতন্ত্রের ভিত ও সংস্কৃতি বাংলাদেশের চেয়ে উন্নতমানের। এসব বিষয়ই সামরিক শাসনের আশঙ্কার বিরুদ্ধে সবচেয়ে মোক্ষম প্রতিরোধ গড়তে পারে।
সামরিক শাসনের আশঙ্কা প্রতিরোধ করতে হলে আন্তরিকভাবে এসব সত্য উপলব্ধি করতে হবে। শুধু আদালতের রায়ে মুগ্ধ হয়ে থাকলে বা সংবিধানে দু-চার কথা লিখে দিলে কাজ শেষ হয়ে যায় না।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.