বাজেট ২০১২-১৩-আশাবাদ বেশি, পদক্ষেপ কম
অর্থনীতি আছে চাপের মধ্যে। বিশ্ব-অর্থনীতিতে শিগগির চাঙা ভাব ফিরে আসবে, তার লক্ষণ কম। নির্বাচন সামনে রেখে আছে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণের চাপ। আবার আমন্ত্রণ করে ডেকে আনা হয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকে (আইএমএফ)। নিতে হবে জ্বালানির দাম বাড়ানোর মতো অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত।
এ যেন অমিয় চক্রবর্তীর সেই কবিতার মতো। তিনি লিখেছিলেন, ‘মেলাবেন তিনি ঝোড়ো হাওয়া আর/ পোড়োবাড়িটার/ ঐ ভাঙা দরজাটা/ মেলাবেন।’ কবিতার নাম ‘সংগতি’। আর অর্থমন্ত্রীর নতুন বাজেটের নামও যেন হওয়া উচিত ছিল সংগতি। কেননা, অর্থমন্ত্রীও আছেন বিশ্ব-অর্থনীতির ঝড়ের মধ্যে। তাঁর হাতে থাকা অর্থনীতিটাও যেন পোড়োবাড়ির মতো নড়বড়ে। আর ভাঙা যে দরজাটা, সেখান থেকে উঁকি মারছে আইএমএফ। অথচ অর্থমন্ত্রীকে মেলাতেই হবে। মেলানোর দায়িত্ব তাঁরই কাঁধে। কারণ এই ঝড়, এই পোড়োবাড়ি আর এই ভাঙা দরজা নিয়েই অর্থমন্ত্রীকে নৌকা নিয়ে আগামী নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, মেলানোর সেই সংগতি তিনি কতখানি দেখাতে পারলেন বাজেটে?
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে আগামী ২০১২-১৩ অর্থবছরের যে বাজেট দিলেন, তাতে সবকিছুর মধ্যে ভারসাম্য আনা হয়েছে, তা বলা যাবে না। এই বাজেটে সাধারণ ভোক্তারা খুশি হবেন না। ব্যবসায়ীরাও স্বস্তি পাচ্ছেন না। অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপের কথা বাজেটে নেই। বাজেটে অতীতের অনেক গুণগান আছে, ভবিষ্যতের জন্য অনেক আশার কথা আছে, কিন্তু আশা পূরণের পরিকল্পনার কথা নেই। এই বাজেট দিয়ে ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন আর মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৭ শতাংশে নিয়ন্ত্রণে রাখাই হবে অর্থমন্ত্রীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
অর্থমন্ত্রী তাঁর দীর্ঘ বাজেট বক্তৃতার নাম দিয়েছেন ‘তিনটি বছরের খতিয়ান: আগামীর পথ ্ররচনা’। ১৫৯ পৃষ্ঠার পুরো বাজেট-বক্তৃতায় গত তিন বছরের উন্নয়নের লম্বা ফিরিস্তি আছে। অর্থমন্ত্রীর আশা, গত তিন বছরের খতিয়ানই আগামীর পথ রচনা করবে। এ জন্য অর্থমন্ত্রীর বড় ভরসা, ‘অনুমান করা হয়েছে, ২০১২ সালে বিশ্ব-অর্থনীতি, বিশেষ করে ইউরোপে মন্দার যে পুনরাবির্ভাব ঘটে, ২০১৩ সালে বিশ্ব-অর্থনীতি তা থেকে বেরিয়ে আসবে।’ অর্থমন্ত্রীর কাছে সম্ভবত আরেক ভরসার নাম রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি।
পুরো অর্থবছরটি সাধারণ মানুষের কেটেছে উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে। মূল্যস্ফীতি বেশি থাকলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) খানিকটা সুবিধা হয় রাজস্ব বাড়াতে। কারণ, কর ধার্য হয় মূল্যের ওপর। মূল্যস্ফীতিকে তাত্ত্বিকভাবেই বলা হয় এমন একটি বৈষম্যমূলক কর, যা কেবল দরিদ্র মানুষেরই দিতে হয়। সংকট আরও তীব্র হয় যখন প্রতিমাসেই মূল্যস্ফীতি ও করের পরিমাণ বাড়তে থাকে। শেষ দুই মাস বাদ দিলে বিদায়ী পুরো অর্থবছরের পরিস্থিতি এখন এ রকমই। মূল্যস্ফীতিই হচ্ছে গরিব মানুষের জীবনযাপনের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক শত্রু। নতুন যে বাজেট গতকাল অর্থমন্ত্রী দিলেন, তাতে মূল্যস্ফীতি কমানোর আশাবাদ আছে, নির্ভর করার মতো পদক্ষেপ নেই, বরং জ্বালানির দাম বাড়ানোর মতো মূল্যস্ফীতির চাপ বৃদ্ধির কথা বলা আছে।
করের বোঝা সাধারণের ওপর: নতুন অর্থবছরে আগের তুলনায় ২২ শতাংশ বেশি কর দিতে হবে দেশের মানুষকে। বিদায়ী ২০১১-১২ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় এক লাখ ১৯ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা হবে বলে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন। আর নতুন অর্থবছরে আদায়ের পরিকল্পনা এক লাখ ৪৫ হাজার ৭১৪ কোটি টাকা। এই অর্থ দেবেন সাধারণ মানুষ আর ব্যবসায়ীরা।
বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন বলেছিলেন, ‘মানুষের জীবনে কেবল দুটি জিনিসই সুনির্দিষ্ট—একটি হচ্ছে মৃত্যু, অন্যটি কর।’ কথাটা সব অর্থমন্ত্রীরই পছন্দ। সম্ভবত মানেন আমাদের অর্থমন্ত্রীও। আর তাই নতুন বাজেটে করের আওতা বাড়ানোর সব ধরনের চেষ্টাই তিনি করেছেন।
অর্থমন্ত্রী এ ক্ষেত্রে চমকও দেখিয়েছেন। কথা বলার ওপর তিনি আরও কর বসিয়েছেন। অবশ্য, তা কেবল মোবাইল বা মুঠোফোনে কথা বলার জন্য। অন্য কোথাও কথা বললে এখনো তা করের আওতায় আসেনি। নতুন অর্থবছর থেকে মুঠোফোনের বিলের ওপর ২ শতাংশ হারে সারচার্জ দিতে হবে।
মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে খানিকটা স্বস্তি দিতে অর্থমন্ত্রীর কাছে থাকা অন্যতম বড় উপকরণ হচ্ছে ব্যক্তিশ্রেণীর করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়িয়ে দেওয়া। বিভিন্ন মহল থেকে এবার এই সীমা এক লাখ ৮০ হাজার থেকে বাড়িয়ে দুই লাখ টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আগের বছরে নেওয়া পরিবর্তনগুলোর প্রভাব পর্যবেক্ষণ করার সময় প্রয়োজন বলে অজুহাত দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তবে তিনি ঠিকই ন্যূনতম করহার দুই হাজার থেকে বাড়িয়ে তিন হাজার টাকা করেছেন। এ জন্য অবশ্য দায়ী করেছেন মাথাপিছু আয় বাড়াকে। আবার কর চিহ্নিতকরণ নম্বর (টিআইএন) নেই, অথচ টাকা ব্যাংকে রেখে সুদ নেবেন, তাদের ওপরও এবার চোখ পড়েছে অর্থমন্ত্রীর। টিআইএন না থাকলেও তাঁদের উৎসে কর দিতে হবে ১৫ শতাংশ।
মার্কিন রাষ্ট্রনায়ক ফ্রাঙ্কলিন ডেলানো রুজভেল্ট বলেছিলেন, ‘যাদের অনেক আছে তাদের প্রাচুর্য বাড়ানো আমাদের প্রগতির মাপকাঠি নয়; এই মাপকাঠি হলো, যাদের অতি অল্প রয়েছে তাদের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা।’ অনেকেরই আশঙ্কা, এবারের বাজেটে এই নীতি চোখ বুজে মানেননি অর্থমন্ত্রী।
অস্বস্তিতে ব্যবসায়ীরা: প্রায় ৪২ শতাংশ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হওয়ার পর বিদায়ী অর্থবছরে এই খাতে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ৮ শতাংশের বেশি। রপ্তানি বাজার ধরে রাখতে রপ্তানিকারকদের দাবি ছিল নানা ধরনের প্রণোদনা। তবে বাজেট রপ্তানিকারকদের অনেকটা হতাশই করছে। কেননা, রপ্তানির ওপর উৎসে কর দ্বিগুণ করে ১ দশমিক ২০ শতাংশ করা হয়েছে। এতে করের বোঝা খানিকটা বাড়বে।
তবে ব্যবসায়ীদের বড় আশঙ্কা বাজেট ঘাটতি নিয়ে। অর্থমন্ত্রী এমনিতেই আইএমএফের ফর্মুলা মেনে মুদ্রা সরবরাহ কমাবেন বলে জানিয়েছেন। বাড়বে জ্বালানির দাম। এর ওপর আবার অর্থমন্ত্রী দিয়েছেন অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থায়ননির্ভর বিশাল ঘাটতি বাজেট। ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকার বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি খাতের ভাগ কমে যাবে। বাড়বে সুদহার। চলতি অর্থবছরে এমনটিই ঘটেছে এবং অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট-বক্তৃতায় তা স্বীকারও করেছেন। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনও পিছিয়ে পড়বে।
আবারও কালোটাকা: অর্থমন্ত্রীর দেওয়া নতুন এই বাজেটই হচ্ছে বর্তমান সরকারের জন্য বাস্তবায়নযোগ্য শেষ বাজেট। এর পরের বাজেটে তিনি সময় পাবেন ছয় মাস। আর অতীত ইতিহাস মেনে মেয়াদের শেষ সময়ে এসে অর্থমন্ত্রীও দিলেন কালোটাকা সাদা করার সুযোগ। তবে নানা মহলের চাপে পড়ে জরিমানাসহ এ সুযোগ রাখা হয়েছে। এর সঙ্গে নতুন ব্যাংক দেওয়ার কোনো সম্পর্ক আছে কি না, তা নানা মহল থেকে বলা হলেও এ নিয়ে অর্থমন্ত্রী বাজেটে একটি শব্দও ব্যয় করেননি।
অর্থমন্ত্রী আগেই বলেছিলেন, স্পর্শকাতর বলে শেয়ারবাজারকে ‘ছোঁয়াছুঁয়ি’ আর করবেন না। কথা রেখেছেন তিনি। শেয়ারবাজারের মাধ্যমে কালোটাকা সাদা করাসহ আগে দেওয়া সব সুযোগই তিনি বহাল রেখেছেন। শেয়ারবাজার ভালো রাখা রাজনৈতিক কারণেও প্রয়োজন অর্থমন্ত্রীর জন্য।
ব্যর্থতার স্বীকারোক্তি: বাজেট-বক্তৃতায় ব্যর্থতার স্বীকারোক্তি খুব একটা পাওয়া যায় না। তবে এবারের বাজেটে অর্থমন্ত্রী সেই ব্যতিক্রমী কাজটি করেছেন। প্রতিশ্রুতি দিয়েও তিনি অনেক কিছু কেন করতে পারেননি, তার ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তবে বিনিয়োগে বাধা হিসেবে অনুন্নত অবকাঠামো এবং সুশাসনের অভাবের কথা বললেও অর্থমন্ত্রী এর ব্যাখ্যা আর দেননি।
অনেকেরই আশঙ্কা ছিল, এবারের বাজেটে জনতুষ্টিমূলক নানা সিদ্ধান্ত থাকবে। নির্বাচনী ভাবনা দেখাবেন তিনি বাজেটে। এ ধরনের দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ অর্থমন্ত্রী নেননি। তবে ৫৫ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেট এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ বাড়িয়ে সম্ভবত রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের হাতে অর্থ পৌঁছানোর চেষ্টা চালাবেন।
সবশেষে অর্থমন্ত্রী সবাইকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, ‘বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ বাস্তবতার নিরিখে যে বাজেট-কাঠামোটি আমরা আগামী অর্থবছরে বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছি, তা প্রবৃদ্ধি-সহায়ক হবে, মূল্যস্ফীতি সংযত রাখবে এবং এতে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে।’
জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী বাজেট-বক্তৃতা শুরু করেন বেলা সাড়ে তিনটার কিছু পরে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনি সংসদ অধিবেশনকক্ষে প্রবেশ করেন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এ সময় সংসদে উপস্থিত ছিল না। সরকারদলীয় সাংসদেরা টেবিল চাপড়ে অর্থমন্ত্রীকে উৎসাহ দেন। রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান সংসদের নির্দিষ্ট আসনে বসে বাজেট উপস্থাপন প্রত্যক্ষ করেন। সরকারের উচ্চপদস্থ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, বিশিষ্ট নাগরিক, ব্যবসায়ী নেতা ও বিদেশি মিশনের কূটনীতিকেরা সংসদের ভিআইপি গ্যালারিতে বসে বাজেট-বক্তৃতা শোনেন। এর আগে মন্ত্রিসভার বৈঠকে সংসদে উপস্থাপনের জন্য নতুন অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব এবং ২০১১-১২ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট অনুমোদিত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পরে রাষ্ট্রপতি বাজেট প্রস্তাবে তাঁর সম্মতি দেন।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে আগামী ২০১২-১৩ অর্থবছরের যে বাজেট দিলেন, তাতে সবকিছুর মধ্যে ভারসাম্য আনা হয়েছে, তা বলা যাবে না। এই বাজেটে সাধারণ ভোক্তারা খুশি হবেন না। ব্যবসায়ীরাও স্বস্তি পাচ্ছেন না। অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপের কথা বাজেটে নেই। বাজেটে অতীতের অনেক গুণগান আছে, ভবিষ্যতের জন্য অনেক আশার কথা আছে, কিন্তু আশা পূরণের পরিকল্পনার কথা নেই। এই বাজেট দিয়ে ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন আর মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৭ শতাংশে নিয়ন্ত্রণে রাখাই হবে অর্থমন্ত্রীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
অর্থমন্ত্রী তাঁর দীর্ঘ বাজেট বক্তৃতার নাম দিয়েছেন ‘তিনটি বছরের খতিয়ান: আগামীর পথ ্ররচনা’। ১৫৯ পৃষ্ঠার পুরো বাজেট-বক্তৃতায় গত তিন বছরের উন্নয়নের লম্বা ফিরিস্তি আছে। অর্থমন্ত্রীর আশা, গত তিন বছরের খতিয়ানই আগামীর পথ রচনা করবে। এ জন্য অর্থমন্ত্রীর বড় ভরসা, ‘অনুমান করা হয়েছে, ২০১২ সালে বিশ্ব-অর্থনীতি, বিশেষ করে ইউরোপে মন্দার যে পুনরাবির্ভাব ঘটে, ২০১৩ সালে বিশ্ব-অর্থনীতি তা থেকে বেরিয়ে আসবে।’ অর্থমন্ত্রীর কাছে সম্ভবত আরেক ভরসার নাম রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি।
পুরো অর্থবছরটি সাধারণ মানুষের কেটেছে উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে। মূল্যস্ফীতি বেশি থাকলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) খানিকটা সুবিধা হয় রাজস্ব বাড়াতে। কারণ, কর ধার্য হয় মূল্যের ওপর। মূল্যস্ফীতিকে তাত্ত্বিকভাবেই বলা হয় এমন একটি বৈষম্যমূলক কর, যা কেবল দরিদ্র মানুষেরই দিতে হয়। সংকট আরও তীব্র হয় যখন প্রতিমাসেই মূল্যস্ফীতি ও করের পরিমাণ বাড়তে থাকে। শেষ দুই মাস বাদ দিলে বিদায়ী পুরো অর্থবছরের পরিস্থিতি এখন এ রকমই। মূল্যস্ফীতিই হচ্ছে গরিব মানুষের জীবনযাপনের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক শত্রু। নতুন যে বাজেট গতকাল অর্থমন্ত্রী দিলেন, তাতে মূল্যস্ফীতি কমানোর আশাবাদ আছে, নির্ভর করার মতো পদক্ষেপ নেই, বরং জ্বালানির দাম বাড়ানোর মতো মূল্যস্ফীতির চাপ বৃদ্ধির কথা বলা আছে।
করের বোঝা সাধারণের ওপর: নতুন অর্থবছরে আগের তুলনায় ২২ শতাংশ বেশি কর দিতে হবে দেশের মানুষকে। বিদায়ী ২০১১-১২ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় এক লাখ ১৯ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা হবে বলে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন। আর নতুন অর্থবছরে আদায়ের পরিকল্পনা এক লাখ ৪৫ হাজার ৭১৪ কোটি টাকা। এই অর্থ দেবেন সাধারণ মানুষ আর ব্যবসায়ীরা।
বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন বলেছিলেন, ‘মানুষের জীবনে কেবল দুটি জিনিসই সুনির্দিষ্ট—একটি হচ্ছে মৃত্যু, অন্যটি কর।’ কথাটা সব অর্থমন্ত্রীরই পছন্দ। সম্ভবত মানেন আমাদের অর্থমন্ত্রীও। আর তাই নতুন বাজেটে করের আওতা বাড়ানোর সব ধরনের চেষ্টাই তিনি করেছেন।
অর্থমন্ত্রী এ ক্ষেত্রে চমকও দেখিয়েছেন। কথা বলার ওপর তিনি আরও কর বসিয়েছেন। অবশ্য, তা কেবল মোবাইল বা মুঠোফোনে কথা বলার জন্য। অন্য কোথাও কথা বললে এখনো তা করের আওতায় আসেনি। নতুন অর্থবছর থেকে মুঠোফোনের বিলের ওপর ২ শতাংশ হারে সারচার্জ দিতে হবে।
মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে খানিকটা স্বস্তি দিতে অর্থমন্ত্রীর কাছে থাকা অন্যতম বড় উপকরণ হচ্ছে ব্যক্তিশ্রেণীর করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়িয়ে দেওয়া। বিভিন্ন মহল থেকে এবার এই সীমা এক লাখ ৮০ হাজার থেকে বাড়িয়ে দুই লাখ টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আগের বছরে নেওয়া পরিবর্তনগুলোর প্রভাব পর্যবেক্ষণ করার সময় প্রয়োজন বলে অজুহাত দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তবে তিনি ঠিকই ন্যূনতম করহার দুই হাজার থেকে বাড়িয়ে তিন হাজার টাকা করেছেন। এ জন্য অবশ্য দায়ী করেছেন মাথাপিছু আয় বাড়াকে। আবার কর চিহ্নিতকরণ নম্বর (টিআইএন) নেই, অথচ টাকা ব্যাংকে রেখে সুদ নেবেন, তাদের ওপরও এবার চোখ পড়েছে অর্থমন্ত্রীর। টিআইএন না থাকলেও তাঁদের উৎসে কর দিতে হবে ১৫ শতাংশ।
মার্কিন রাষ্ট্রনায়ক ফ্রাঙ্কলিন ডেলানো রুজভেল্ট বলেছিলেন, ‘যাদের অনেক আছে তাদের প্রাচুর্য বাড়ানো আমাদের প্রগতির মাপকাঠি নয়; এই মাপকাঠি হলো, যাদের অতি অল্প রয়েছে তাদের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা।’ অনেকেরই আশঙ্কা, এবারের বাজেটে এই নীতি চোখ বুজে মানেননি অর্থমন্ত্রী।
অস্বস্তিতে ব্যবসায়ীরা: প্রায় ৪২ শতাংশ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হওয়ার পর বিদায়ী অর্থবছরে এই খাতে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ৮ শতাংশের বেশি। রপ্তানি বাজার ধরে রাখতে রপ্তানিকারকদের দাবি ছিল নানা ধরনের প্রণোদনা। তবে বাজেট রপ্তানিকারকদের অনেকটা হতাশই করছে। কেননা, রপ্তানির ওপর উৎসে কর দ্বিগুণ করে ১ দশমিক ২০ শতাংশ করা হয়েছে। এতে করের বোঝা খানিকটা বাড়বে।
তবে ব্যবসায়ীদের বড় আশঙ্কা বাজেট ঘাটতি নিয়ে। অর্থমন্ত্রী এমনিতেই আইএমএফের ফর্মুলা মেনে মুদ্রা সরবরাহ কমাবেন বলে জানিয়েছেন। বাড়বে জ্বালানির দাম। এর ওপর আবার অর্থমন্ত্রী দিয়েছেন অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থায়ননির্ভর বিশাল ঘাটতি বাজেট। ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকার বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি খাতের ভাগ কমে যাবে। বাড়বে সুদহার। চলতি অর্থবছরে এমনটিই ঘটেছে এবং অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট-বক্তৃতায় তা স্বীকারও করেছেন। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনও পিছিয়ে পড়বে।
আবারও কালোটাকা: অর্থমন্ত্রীর দেওয়া নতুন এই বাজেটই হচ্ছে বর্তমান সরকারের জন্য বাস্তবায়নযোগ্য শেষ বাজেট। এর পরের বাজেটে তিনি সময় পাবেন ছয় মাস। আর অতীত ইতিহাস মেনে মেয়াদের শেষ সময়ে এসে অর্থমন্ত্রীও দিলেন কালোটাকা সাদা করার সুযোগ। তবে নানা মহলের চাপে পড়ে জরিমানাসহ এ সুযোগ রাখা হয়েছে। এর সঙ্গে নতুন ব্যাংক দেওয়ার কোনো সম্পর্ক আছে কি না, তা নানা মহল থেকে বলা হলেও এ নিয়ে অর্থমন্ত্রী বাজেটে একটি শব্দও ব্যয় করেননি।
অর্থমন্ত্রী আগেই বলেছিলেন, স্পর্শকাতর বলে শেয়ারবাজারকে ‘ছোঁয়াছুঁয়ি’ আর করবেন না। কথা রেখেছেন তিনি। শেয়ারবাজারের মাধ্যমে কালোটাকা সাদা করাসহ আগে দেওয়া সব সুযোগই তিনি বহাল রেখেছেন। শেয়ারবাজার ভালো রাখা রাজনৈতিক কারণেও প্রয়োজন অর্থমন্ত্রীর জন্য।
ব্যর্থতার স্বীকারোক্তি: বাজেট-বক্তৃতায় ব্যর্থতার স্বীকারোক্তি খুব একটা পাওয়া যায় না। তবে এবারের বাজেটে অর্থমন্ত্রী সেই ব্যতিক্রমী কাজটি করেছেন। প্রতিশ্রুতি দিয়েও তিনি অনেক কিছু কেন করতে পারেননি, তার ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তবে বিনিয়োগে বাধা হিসেবে অনুন্নত অবকাঠামো এবং সুশাসনের অভাবের কথা বললেও অর্থমন্ত্রী এর ব্যাখ্যা আর দেননি।
অনেকেরই আশঙ্কা ছিল, এবারের বাজেটে জনতুষ্টিমূলক নানা সিদ্ধান্ত থাকবে। নির্বাচনী ভাবনা দেখাবেন তিনি বাজেটে। এ ধরনের দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ অর্থমন্ত্রী নেননি। তবে ৫৫ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেট এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ বাড়িয়ে সম্ভবত রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের হাতে অর্থ পৌঁছানোর চেষ্টা চালাবেন।
সবশেষে অর্থমন্ত্রী সবাইকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, ‘বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ বাস্তবতার নিরিখে যে বাজেট-কাঠামোটি আমরা আগামী অর্থবছরে বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছি, তা প্রবৃদ্ধি-সহায়ক হবে, মূল্যস্ফীতি সংযত রাখবে এবং এতে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে।’
জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী বাজেট-বক্তৃতা শুরু করেন বেলা সাড়ে তিনটার কিছু পরে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনি সংসদ অধিবেশনকক্ষে প্রবেশ করেন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এ সময় সংসদে উপস্থিত ছিল না। সরকারদলীয় সাংসদেরা টেবিল চাপড়ে অর্থমন্ত্রীকে উৎসাহ দেন। রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান সংসদের নির্দিষ্ট আসনে বসে বাজেট উপস্থাপন প্রত্যক্ষ করেন। সরকারের উচ্চপদস্থ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, বিশিষ্ট নাগরিক, ব্যবসায়ী নেতা ও বিদেশি মিশনের কূটনীতিকেরা সংসদের ভিআইপি গ্যালারিতে বসে বাজেট-বক্তৃতা শোনেন। এর আগে মন্ত্রিসভার বৈঠকে সংসদে উপস্থাপনের জন্য নতুন অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব এবং ২০১১-১২ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট অনুমোদিত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পরে রাষ্ট্রপতি বাজেট প্রস্তাবে তাঁর সম্মতি দেন।
No comments